
নবাবি আমলে বাংলা সম্পদশালী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এখানে কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উচ্চমান ও কম মূল্য, যা বাংলার বাইরে এসব জিনিসের প্রচণ্ড চাহিদা তৈরি করে। এ স্বল্পমূল্য কোনো প্রাচুর্যতার লক্ষণ নয়। যে ইবনে বতুতা এ দেশের প্রাচুর্যতার বর্ণনা করেছেন, তিনি তার জবানিতেই বলেছেন- ‘এ অঞ্চলের প্রজারা ফসলের প্রায় ৫০ ভাগ খাজনা দেয়, এর বাইরেও আছে অন্য কর।...
আজ পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সিরাজউদদৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের সূচনাকাল বলা যায় এ তারিখকে। বলা হয়ে থাকে, এক সুখী-সমৃদ্ধশালী অঞ্চল দারিদ্র্য আর পরাধীনতার গহ্বরে প্রবেশ করে এ পরাজয়ের মাধ্যমে, যার স্থায়িত্ব ছিল পরবর্তী ১৯০ বছর।
বাংলাকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করার ইতিহাস অনেক পুরোনো। মৌর্যযুগ থেকে শুরু করে মোগল আমলের প্রায় ১৮০০ বছরের যে বর্ণনা তাতে এ অঞ্চলকে দেখানো হয়েছে অতিশয় প্রাচুর্যপূর্ণ ও সম্পদশালী হিসেবে। এখানে আরব পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনা উল্লেখযোগ্য। ভ্রমণকাহিনিতে ইবনে বতুতা বলেন, ভারতবর্ষ এক বিশাল দেশ। আশ্চর্যের বিষয় হলো এর অধিকাংশই অত্যন্ত উর্বর। তার মধ্যে বাংলা হলো অন্যতম। এত উর্বর দেশ পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। বাংলার সম্পদ ও ঐশর্য অতুলনীয়।
স্বর্গরাজ্য হিসেবে প্রাচীন বাংলার যে ছবি আঁকা হয়েছে। তার শিল্পী বিদেশি বণিক বা বণিকবেশে আসা পর্যটকরা। বিদেশি পর্যটকরা ছবি এঁকেছেন সেই সব মানুষের আর তাদের অর্থনীতির, যাদের সঙ্গে তারা মিশেছেন। এ অঞ্চলে আসা এই বিদেশি বণিক আর পর্যটকরা সাধারণ মানুষের কাছে যাননি। তাদের সঙ্গী ছিলেন এ দেশে তাদের ব্যবসায়ী সহযোগী, জমিদার বা উচ্চশ্রেণির আমলা। তারা ছিলেন দেশের অন্যতম সম্পদশালী। এই বণিক আর পর্যটকদের চোখে বাংলা ছিল তাই স্বর্গের মতোই সীমাহীন সম্পদের খনি।
এই আকর্ষণীয় বর্ণনার বাইরে কেউ কেউ জনজীবনের অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন। দেখিয়েছেন প্রদীপের তলার অন্ধকারকে। তেমনই একজন ফ্রাঁশোয়া বার্নিয়ের। বার্নিয়ের বলেছিলেন- এই দেশ সোনা ও রুপায় ভরপুর। সোনা-রুপা পৃথিবীর অন্য স্থান ঘুরে এসে ভারতবর্ষে পৌঁছায় এবং এর গুপ্ত গহ্বরে হারিয়ে যায়।
অথচ এত সোনা-রুপা থাকার পরও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। এমনকি আমির-ওমরাহদের অনেকেই ভিতরে ভিতরে শোচনীয় অবস্থায় থাকেন। এর একটা কারণ হলো এ সোনা-রুপার বড় অংশ গলিয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়। অর্থাৎ গলিয়ে অলংকার প্রস্তুত করা, যা হাত, পা, মাথা, নাক, কান, গলা সর্বত্র অলংকৃত করার মাধ্যমে সোনার অপচয় হয়।
এক ফরাসির মুখে এ দেশের মানুষের অর্ধাহারে-অনাহারেও থেকেও সোনার অলংকার পরার প্রতি আসক্তি যদি অতিরঞ্জন মনে হয় তবে ফরাসিদের জাতশত্রু এক ইংরেজ রালফ ফিচ তার এ অঞ্চল ভ্রমণের বর্ণনায় উল্লেখ করেছিলেন- ‘এ দেশের মেয়েরা অসংখ্য হাতির দাঁতের তৈরি চুড়ি পরে আর তাতে তারা এত আনন্দ পায় যে, মনে হয় তাদের আর ভালো খাবারের প্রয়োজন নেই’।
রালফ ফিচ ছিলেন ভারতবর্ষ ভ্রমণকারী প্রথম ইংরেজ। তার ভ্রমণ বর্ণনার উদ্দেশ্য ছিল এ দেশে ইংরেজ বণিকদের ব্যবসা করার জন্য পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য প্রদান। বিখ্যাত বা কুখ্যাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের সময় রালফ ফিচের ভ্রমণবৃত্তান্ত বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় এবং তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের একজন উপদেষ্টা। বার্নিয়ের তার ভ্রমণ বিবরণ ফ্রান্সের তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল এ দেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো। তাই তাদের বর্ণনায় নিছক প্রাচুর্য আর সম্পদের বাইরে সাধারণ মানুষের অবস্থাও যেমন উঠে এসেছে, তেমনি সম্পদাশালী এ অঞ্চলের সম্পদ যে ছিল অসাম্যের প্রতীক, সেটারও ধারণা পাওয়া যায়। যা সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত ছিল, এমন ধারণার সমর্থনের বিপরীত প্রমাণ দেয়।
পলাশীর যুদ্ধের ৭০ বছর আগে বার্নিয়ের লিখেছেন, দিল্লির মতো শহরের প্রতি ১০ জনের সাত/আটজন অতি দরিদ্র ও জীর্ণ। প্যারিসের ঠিক বিপরীত যেখানে ৭-৮ জনই অবস্থাসম্পন্ন। পরবর্তীতে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা অঞ্চলে ব্রিটিশরা আসার আগেই পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় গরিব ছিল।
ইউরোপীয় কর্তৃক এ অঞ্চলের লুটপাটের শুরু হয়েছিল রাজা ও ধনী ব্যক্তিদের লুকানো সম্পদ দিয়ে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লুটপাট করার মতো তেমন কিছু ছিল না। এ দেশে সম্পদ ছিল সত্যি, প্রাচুর্যতাও ছিল। কিন্তু স্বর্গরাজ্য ছিল না। কারণ ছিল তীব্র অসাম্য।
নবাবি আমলে বাংলা সম্পদশালী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এখানে কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উচ্চমান ও কমমূল্য, যা বাংলার বাইরে এসব জিনিসের প্রচণ্ড চাহিদা তৈরি করে। এ স্বল্পমূল্য কোনো প্রাচুর্যতার লক্ষণ নয়। যে ইবনে বতুতা এ দেশের প্রাচুর্যতার বর্ণনা করেছেন, তিনি তার জবানিতেই বলেছেন- ‘এ অঞ্চলের প্রজারা ফসলের প্রায় ৫০ ভাগ খাজনা দেয়, এর বাইরেও আছে অন্য কর। এই কর এ অঞ্চলের কল্যাণে সেভাবে ব্যবহার হয় না বরং রাজাদের নজরানা দিতেই চলে যায়। ফলে উচ্চহারের কর এ অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে’।
নবাব শায়েস্তা খানের সময় টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, এ কথার ঐতিহাসিক সত্যতা আছে, তবে চালের এ মূল্যমান নিয়েও অনেক কথা আছে। পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা গেছে, সে সময় মওসুম অনুসারে চালের মূল্য ছিল টাকায় তিন থেকে চার মণ, এ হিসেবে সাপ্তাহিকভাবে যাদের গড় আয় ছিল এক টাকা, তারা মূলত মোটামুটিভাবে শুধু পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে পারত, কিন্তু সেই সময়ে কতজন সপ্তাহে এক টাকা আয় করতে পারত সে হিসাব করলে সংখ্যাটি অনেক কম হয়। তাই বলা যায়, সে সময়ের ভারতবর্ষের সম্পদশালী অঞ্চল বাংলায় সম্পদের মতো বৈষম্যও ছিল বিপুল ও ব্যাপক। বরং এ অঞ্চলে ব্যাপক অসমতা না থাকাটাই হতো ব্যতিক্রম।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পদশালীদের গুরুত্ব দিয়ে তাদের স্বার্থে আইন ও নীতি প্রণয়ন করে তা সমাজের অপর সদস্যদের স্বার্থের মূল্যে পুনরায় সম্পদশালীদের আরও ধনসম্পদ অর্জনে সহয়তা করে। এবং এ সম্পদশালীরা যদি হয় অদক্ষ প্রকৃতির তাহলে সেই সম্পদ আসলে শেষপর্যন্ত কারোরই কাজে লাগে না। তৎকালীন এ অঞ্চল ছিল এরই প্রতিচ্ছবি। তাই ক্লাইভের সামনে সিরাজউদদৌলার সম্পদ লুঠের সামগ্রী হওয়া ছাড়া কোনো কাজে আসেনি।
লেখক: প্রাবন্ধিক