
রূপকথার গল্প সূত্রে বাঙালির পরিচয় হয়েছে আলাদিনের চেরাগের সঙ্গে। যার শক্তি কোনো কিছু স্পর্শ করলেই তাতে অভাবনীয় পরিবর্তন এবং ইচ্ছেমতো কার্যসিদ্ধি হয়। প্রযুক্তির দুনিয়ায় তেমনি এক জাদুকরী চেরাগের নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। দুয়ের মধ্যে পার্থক্য এতটুকু- এই শক্তি আলাদিনের চেরাগের মতো প্রত্যক্ষ কোনো কিছু নির্মাণ করতে পারে না, তবে গবেষণালব্ধ প্রত্যাশিত তথ্য হাজির করতে পারে নিমিষেই। সাদা চোখে মানুষ এ যন্ত্রের গুরুত্ব বুঝতে না পারলেও এ এক বিস্মকর সৃষ্টি, তা মানতেই হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে তথ্যই শক্তি। কিন্তু কেবল তথ্য থাকলে হবে না, এ তথ্য স্বল্পশ্রমে অতি সহজে পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য যেকোনো যুগ থেকে আধুনিককালে ‘সময়’ তাই বড় মূল্যবান। প্রবহমান জীবনের ক্লান্তি নাশ করে এই ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ মানুষের সময়কে সাশ্রয়ের সীমানায় নিয়ে আসতে পারে নিমিষেই। এতেই শেষ নয়, মানুষের থেকেও তার কাজের গতি অস্বাভাবিক গতিসস্পন্ন এবং নিখুঁত। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সামনের দিনে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানুষের কর্মকৌশল শক্তিকে ছেড়ে যাবে।
সঙ্গতভাবেই তাই জানতে সাধ হয় ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ আসলে কী জিনিস? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ম্যাকার্থি বলেছেন, ‘কম্পিউটার যখন মানব বুদ্ধিমত্তাকে সিমুলেট বা অনুকরণ করতে সক্ষম হবে, তখন সেই মেশিনকে ইন্টেলিজেন্ট বা বুদ্ধিমান বলা চলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বুদ্ধিমত্তা হলো মানুষের কম্পিউটেশনাল বা গণনামূলক ক্ষমতা, যা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ সম্পাদনে সমর্থ করে তোলে।’ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে মানুষ দৈহিক ও কায়িক শ্রমকে পেছনে রেখে বুদ্ধির বাস্তব প্রয়োগে অতি দ্রুত তার কাজ সম্পন্ন করতে চায়।
এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিজ্ঞানীরা মেধা প্রয়োগ করে সৃষ্টি করেছেন ব্যাপক শক্তিধর নানা কৃত্রিম বুদ্ধিযুক্ত সফটওয়্যার। যার মধ্যে আছে- ওপেন এআইয়ের ‘চ্যাটজিপিটি’ তথা (Chat Generative Pre-training Transformer), গুগলের ‘জেমিনাই’ এবং মাইক্রোসফটের ‘কো-পাইলট’ ইত্যাদি। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর বিশ্বের প্রথম সারির মার্কিন গবেষণা ল্যাবরেটরি ‘ওপেন এআই’ চ্যাটবট বাজারে আনে। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে বাজারে আসে মাইক্রোসফটের ‘কো-পাইলট’ এবং সবশেষ ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গুগলের ‘বার্ড’ প্রসার লাভ করে।
কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা ও বিকাশ পৃথিবীর সব স্তরের গবেষক এবং দার্শনিকের মনে শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মহলের প্রশ্ন মানবমস্তিষ্কের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য ও বিভেদ কতখানি তা নিয়ে। একই সঙ্গে সচেতন মানুষের ভাবনার পালে হাওয়া দিয়েছে অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এর কত ব্যাপক সে বিষয় নিয়ে। সম্প্রতি চ্যাটজিপিটি সম্পর্কে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছেন, ‘বিশ্বকে বদলিয়ে দেবে চ্যাটজিপিটি।’ তিনি মনে করেন ‘আগের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলো সব বিষয়ে লিখতে ও পড়তে পারত; কিন্তু বিষয়বস্তু বুঝত না, কিন্তু চ্যাটজিপিটি বিষয়বস্তুও বুঝে।’ দুশ্চিন্তার বেগ আরও গতিশীল হয়েছে চাকরির বাজার তথা কর্মক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে। কারণ এটি একদিকে যেমন প্রোগ্রাম কোড লিখতে পারে, তেমনি ক্রেতার সব প্রশ্নের উত্তরও সময়মতো দিতে পারে।
অন্যদিকে সংবাদ সমীক্ষা থেকে ব্যাকরণ, আইনি নথি ও দলিলদস্তাবেজ তৈরিতেও এর রয়েছে ভয়ানক কার্যক্ষমতা। ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বগ্রাসী শক্তি হাল আমলের সব মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রচণ্ড অস্থির করে তুলেছে। যৌক্তিক কারণেই তাই এ প্রত্যুৎপন্নমতি তথা সব অঘটন-ঘটনপটিয়সী আবিষ্কারটির সৃষ্টি উৎসের রহস্য জানতে মন বেশ খরতর হয়ে ওঠে।
অগণিত উপাত্ত ধারণক্ষম এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ কৌতূহলপ্রদ। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপে বেসামাল হয়ে ওঠে বিশ্ব। দুই বলয়ের পরাশক্তি মেতে ওঠে একপক্ষ অন্যপক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হিংস্র প্রতিযোগিতায়। শুরু হয় গোপনে তথ্য আদান-প্রদানের কৌশলী খেলা। যুক্তরাষ্ট্র ২৯ জন নাভাহো আদিবাসীকে নিয়োগ দিয়ে, নাভাহো ভাষা ব্যবহার শুরু করে কোড আদান-প্রদানে। ‘যেখানে তিন বাক্যের ইংরেজি কোড ভাঙতে ৩০ মিনিট সময় লাগত, নাভাহো কোড টকাররা সে কোড ভেঙেছেন ২০ সেকেন্ডে।’ আর জার্মানরা তা পড়তে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
কিন্তু জার্মানরা পিছিয়ে না থেকে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য ‘এনিগমা’ নামের কোডিং যন্ত্র চালু করে। দাদার ওপর দাদাগিরি বলে কথা। ‘এনিগমা’ কোডিং বাইরে আসামাত্র পোল্যান্ডের গণিতবিদরা ‘এনিগমার’ কোড ভেঙে ফেলেন। অবশ্য জার্মানরা এ পদ্ধতিকে অধিক শক্তিশালী করলে মিত্রশক্তি হিটলারের কাছে খেই হারিয়ে ফেলে। ঠিক তখনি ‘যুক্তরাজ্যের বাকিংহামশায়ারের ব্রেচলি পার্কের অতি গোপন তথ্য বিশ্লেষণ কেন্দ্রে কাজ নেন সে সময়ের মেধাবী গণিতজ্ঞ আল্যেন টুরিং। তিনি ‘বম্ব’ নামের একটি কোডি-ব্রেকিং যন্ত্র তৈরি করেন, যা মিত্রপক্ষকে ব্যাপক সুবিধা এনে দেয়। যুদ্ধ শেষে আল্যেন টুরিং উপাত্ত বিশ্লেষণের ওপর জোর দেন। ১৯৫০ সালে ‘কম্পিউটিং মেশিনারি আ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রথম আলোকপাত করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে ‘টুরিং টেস্ট’ নামক একটি পরীক্ষা প্রবর্তন করেন।’ সেই থেকে পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করে তোলার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে। আর তাদের এই হার-না মানা চেষ্টার ফল আজকের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্ময়কর ব্যবহার ও বিচরণ। বর্তমান বিশ্বে এ আবিষ্কারের সব থেকে বেশি আলোচনা হচ্ছে যে দিক নিয়ে তা হলো ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপুল তথ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে।’ দার্শনিকদের মধ্যে এখানেই বিতর্ক শুরু।
বিষয়টির ওপর ২০২৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমের এক নিবন্ধে খ্যাতিমান দার্শনিক নম চমস্কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানব বুদ্ধিমত্তার চেয়ে অধিক শক্তিশালী নয় বলে অভিমত রাখেন। তিনি বলেন, ‘মানবমস্তিষ্ক স্বল্প তথ্য ব্যবহার করে বিপুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অযুত তথ্যের প্রয়োজন পড়ে না।’ চমস্কি একজন ভাষাবিদ, তাই বিষয়টি সেই প্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু ম্যাকার্থি বুদ্ধিমত্তাকে একান্তভাবে একটি গাণিতিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। লক্ষ করার বিষয় হলো চমস্কি ও তার সহগবেষকরা ‘রিজন’ বা যুক্তি প্রদানের ক্ষমতা, নীতিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়কে বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্রে খুঁজে পেয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘যন্ত্র পরিসংখ্যান খাটিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়, তবে দায়ভার নেয় না। বলে আমার কাছে থাকা উপাত্তের ভিত্তিতে আমি এ সিদ্ধান্ত দিচ্ছি।’ অতএব, উপাত্তের পরিবর্তন ঘটলে এর সিদ্ধান্ত বদলাবে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষ স্বল্প উপাত্ত থেকে শুধু সিদ্ধান্তই নয়, তার ব্যাখ্যাও তৈরি করে। চিন্তাশীল জীব হিসেবে মানুষ একই সঙ্গে রিজন ও সৃষ্টি দুই-ই সম্পন্ন করতে পারে।
ষোলো শতকে দার্শনিক রেনে দেকার্ত বলেছিলেন, ‘আমি চিন্তা করি বলেই আমার অস্তিত্ব আছে।’ এই ‘রিজন’ নিয়ে দার্শনিক টমাস হবস ‘লেভিয়াথানে’ মানবক্রিয়ার সংযমের কথা তুলে ধরেন। আবার ডেভিড হিউম ও ট্রিটিসে বিষয়টির সঙ্গে মানব অনুভূতির অনেক খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করেছেন। তবে ব্যাপারটি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন দার্শনিক ইমানুয়েল ক্যান্ট; যিনি রিজনিং বিভাজন করেছেন চারটি শ্রেণিতে- তাত্ত্বিক, নৈতিক, প্রায়েগিক ও নান্দনিক। তিনি প্রবর্তন করেছেন রিজনিংয়ের সর্বজনীন বিধিমালা।
দার্শনিক বিচারে যন্ত্র তাই বুদ্ধিমত্তা ধারণ করে এ কথা প্রমাণ দেওয়া খুব সহজ নয়। অবশ্য বিতর্ক যাই থাক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি আগামী দিনে প্রভাব রাখবে। তাই একে ভয় না পেয়ে নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে এগোতে হবে। বিষয়টির ওপর পরিবেশবিজ্ঞানী নাভিদ সালেহর মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই- ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি গাণিতিক প্রক্রিয়া, যা বিপুল পরিমাণ উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম। এ প্রযুক্তিকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব, তার ওপর নির্ভর করছে এর সম্ভাবনা কিংবা ঝুঁকি।’ একটি নিরাবেগ পর্যালোচনা করে তাই বিখ্যাত চিন্তাবিদরা বলেছেন, সর্বজনীন সত্য হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শেকসপিয়র বা রবীন্দ্রনাথকে বড় জোর অনুকরণ করতে পারে কিন্তু তাদের লেখনি সৃষ্টিতে আদৌ সক্ষম নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাই মানুষের হাতে সৃষ্ট দাস। অধিপতি নয় কোনোভাবেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া