
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন- ‘মার্কিন সেনাবাহিনী ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা: ফরদো, নাতানজ এবং ইসফাহানে ব্যাপকভাবে নির্ভুল হামলা চালিয়েছে। আমি বিশ্বকে বলতে পারি যে, এ হামলাগুলো ছিল দর্শনীয় সামরিক সাফল্য। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।
হামলার পর জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ংকর উত্তেজনা বেড়েছে যা ইতোমধ্যেই একদম প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। এ হামলা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি বলে মনে হচ্ছে। ১৩ জুন, ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে একাধিক বিমান ও সাইবার হামলা চালায়। এ হামলায় বেশ কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং উচ্চপর্যায়ের সামরিক কমান্ডারের প্রাণহানি ঘটে। এর জবাবে ইরান ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনাগুলোয় শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অনেকদিন থেকে দাবি করে আসছেন যে, ইরান এক বা দুই বছরের মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। সত্য ঘটনা- ইরানে আক্রমণ করে নেতানিয়াহুর মূল লক্ষ্য হলো সরকার উৎখাত করা, দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা এবং সিরিয়া, লেবানন ও লিবিয়ার মতো ইরানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। তার পর ইরানকে ভেঙে ফেলা।
এতে সন্দেহ নেই যে, ইসরায়েল আমেরিকা, ইউরোপ এবং ন্যাটোর সঙ্গে ইরানের ওপর আক্রমণের জন্য আলোচনা করেছিল। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় যুদ্ধ চালিয়েছে। নেতানিয়াহু ১৯৯০ সাল থেকে আমেরিকাকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বরাবরই এ ধরনের ফাঁদ এড়িয়ে গেছেন।
নেতানিয়াহুর চাপে ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাবে গৃহীত ইরানের পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করে দেন। তার দ্বিতীয় মেয়াদের মাত্র কয়েক মাস পরই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সামরিক হামলা চালান। নেতানিয়াহু ট্রাম্পের ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অসাধারণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ শক্তি দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সাহসী সিদ্ধান্ত ইতিহাস বদলে দেবে’।
সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো- ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি একমত হওয়ার পর এ আক্রমণটি করা হলো। ওমান এবং ইতালিতে প্রথম তিন দফা পারমাণবিক আলোচনার চুক্তিটি বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি হতে পারত।
ইরানি সূত্র থেকে জানা যায়, ‘মাস্কট এবং রোমে তিন দফা আলোচনার মাধ্যমে উইটকফ এবং আরাঘচির মধ্যে চুক্তির মূল বিষয়গুলো নিয়ে একমত হয়েছিল। চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ: ইরান সর্বাধিক পারমাণবিক পরিদর্শন এবং স্বচ্ছতা গ্রহণ করবে যার মধ্যে অতিরিক্ত প্রোটোকল এবং সহায়ক ব্যবস্থা কোড ৩.১ বাস্তবায়ন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটি হলো একটি দেশের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিদর্শনের জন্য সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া।
সূত্রটি আরও যোগ করেছে- ‘দ্বিতীয়ত, ইরান তার বিদ্যমান ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়ামের মজুদ রূপান্তর বা রপ্তানি করবে যা ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। তৃতীয়ত, ইরান তার বর্তমান উচ্চ-স্তরের সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনবে। বেসামরিক উদ্দেশ্যে যা ৩.৬৭ শতাংশ স্তরে কমিয়ে আনবে। সব প্রযুক্তিগত অস্পষ্টতা সমাধানে ইরান IAEA-এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে’।
বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক-সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে। উভয় পক্ষের প্রযুক্তিগত পক্ষ এ চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া তৈরি করবে বলে একমত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্পের মধ্যে একটি ফোনালাপের পর আমেরিকা পক্ষ মাস্কটে তাদের প্রযুক্তিগত দল পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তাদের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ বন্ধের দাবি জানায়।
এ চুক্তি হওয়ার পর ট্রাম্পের দুই মাসের সময়সীমা শেষ হতে না হতেই এমন ঘটনা ঘটে। এটি ছিল ইসরায়েলের ফাঁদ- যা আমেরিকা এবং ট্রাম্পকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে টেনে আনার অন্যরকম কৌশল।
ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি কাজা কাল্লাস আরাঘচির সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আবার দেখা করতে সম্মত হয়েছেন।
ইরান আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায়, তেহরানের বিরুদ্ধে ১০ দিনের সামরিক অভিযানে ইসরায়েল কেবল ব্যর্থই হয়নি, বরং পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে গেছে। ইসরায়েল যদি সংকটে না থাকত তাহলে আমেরিকা কেন হস্তক্ষেপ করবে?
মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ ইসরায়েল যার কাছে আসলে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ধারণা করা হয়, তাদের কাছে ৪০০টিরও বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। তারা পারমাণবিক বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াই করার দাবি করতে পারে না। তাছাড়া, গত ২০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন নিশ্চিত করেছে যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। মূল বিষয় হলো, তাৎক্ষণিক এবং গুরুতর কোনো হুমকি ছিল না। ইরানে দুই সপ্তাহে ১০টি বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সমৃদ্ধ পরমাণু মজুদ আছে, এ দাবিটিও সত্য নয়।
এমনকি যদি ইরান বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তবে পারমাণবিক যুদ্ধ করার মতো ডেলিভারি সিস্টেম তৈরি করতে তাদের এক থেকে দুই বছর সময় লাগবে। আমেরিকান আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘ইসরায়েলের আক্রমণ শুরু হওয়ার আগে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এমন কোনো হুমকি ছিল না’।
এই প্রথম দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ পারমাণবিকহীন দেশের ওপর সামরিক আক্রমণ শুরু করেছে। কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, ‘ইরান ইসরায়েলকে আক্রমণ করেনি, তারাই যুদ্ধ শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে আক্রমণ করেনি, তারা এই মুহূর্তে এ সংঘাত ছড়িয়ে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য প্রণীত পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) কেবল একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আক্রমণ জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং এনপিটির গুরুতর লঙ্ঘন করেছে’।
ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা দল ইরানের ওপর মার্কিন সামরিক হামলার ভয়াবহ প্রভাব সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ট্রাম্পকে নিরুৎসাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক না কেন, এ ঘটনা হোয়াইট হাউসের ওপর নেতানিয়াহুর প্রভাবের মাত্রা আরও প্রকাশ করেছে। এ যুদ্ধটি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য উসকে দিয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বেচ্ছায় তাকে আমেরিকার সামরিক ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন যাতে এটি দীর্ঘায়িত হয়। কংগ্রেসওম্যান বনি ওয়াটসন কোলম্যান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কারও প্রক্সি সেনাবাহিনী নয় এবং আমাদের সৈন্যরা দর কষাকষির জন্যও নয়’।
তেহরানের ধারণা হলো- এ দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের আক্রমণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এনপিটির তেমন কোনো মূল্য নেই বরং এটি ক্ষতিকারকও বটে। উত্তর কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো যারা চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্রের সামরিক আক্রমণ থেকে মুক্ত রয়েছে। এটা স্বাভাবিক যে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আক্রমণের পর ইরান তার পারমাণবিক কৌশল পুনর্বিবেচনা করবে; যার মধ্যে রয়েছে এনপিটিতে তার সদস্যপদ অব্যাহত রাখা। ইরান অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু এ আক্রমণের নেতিবাচক প্রভাব শুধু ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- এটি যুক্তরাষ্ট্রেরও ক্ষতি করবে। আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে। বর্তমান যুদ্ধে কোনো জয় বা পরাজয় নেই। ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই ধ্বংস, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় আঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সব পক্ষই তাদের অর্জনের চেয়ে অনেক বেশি হারাতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না করলে মধ্যপ্রাচ্য একটি বিপর্যয়কর সংঘাতের দিকে যেতে পারে।
লেখক: ভিজিটিং রিসার্চ সহযোগী, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির সাবেক প্রধান।
মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত
অনুবাদ: সানজিদ সকাল