
মানুষের মনোযোগকে অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে দেখার ধারণাটি নতুন কিছু নয়। ডিজিটাল যুগে এটি এক ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। অ্যাটেনশন ইকোনমি বা ‘মনোযোগ অর্থনীতি’ এমন একটি কাঠামো যেখানে মানুষের মনোযোগকে একটি দুষ্প্রাপ্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং একে ব্যবহার করে মূল্য তৈরির চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশে এ ধারণাটি দিন দিন আরও গভীরভাবে প্রসারিত হচ্ছে, যেখানে অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি এবং গণতন্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক এক জটিল সংকটে পরিণত হয়েছে।
অ্যাটেনশন ইকোনমির গোড়াপত্তনে কয়েকজন চিন্তাবিদের নাম উঠে আসে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও মনোবিজ্ঞানী হেরবার্ট সাইমন, যিনি ১৯৭১ সালে বলেছিলেন, ‘একটি তথ্যসমৃদ্ধ সমাজ মনোযোগের দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, যেখানে মনোযোগই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।’ তার এই দূরদর্শী উক্তিটি আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। সাইমনের মতে, মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সীমিত এবং এ সীমাবদ্ধতার মধ্যে যখন অতিরিক্ত তথ্য প্রবাহিত হয়, তখন মনোযোগ একটি দুর্লভ সম্পদে পরিণত হয়।
এ ধারণার ভিত্তিতেই আজকের ফেসবুক, টিকটক বা ইউটিউবের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো গড়ে উঠেছে। যাদের মূল লক্ষ্যই হলো যত বেশি সম্ভব ব্যবহারকারীর সময় ও মনোযোগ দখল করে রাখা। এ প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীর মনোযোগকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে তাদের পণ্যের প্রচার করে থাকে, যা তাদের আয়ের প্রধান উৎস।
এ ধারণাকে আরও সম্প্রসারিত করেন অর্থনীতিবিদ থিওডোর স্কিৎজিন। যিনি ১৯৭৬ সালে তার ‘Attention and the Structure of Consumption’ গ্রন্থে মনোযোগকে একটি ভোগ্য সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার ভাবনা আজকের বাংলাদেশে স্পষ্টভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেখানে ব্যবহারকারীদের সময় কার্যত বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে এবং এ বিক্রি থেকেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর আর্থিক সাফল্য আসছে।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির আকার ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যেখানে ‘ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং’ একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যের প্রচারের জন্য বিপুল সংখ্যক ফলোয়ার থাকা ব্যক্তিদের ব্যবহার করে, যারা তাদের দর্শকদের মনোযোগকে পণ্যে রূপান্তর করতে সাহায্য করে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মনোযোগ একটি মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়, যা সরাসরি অর্থনৈতিক মূল্যে পরিমাপ করা যায়।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অ্যাটেনশন ইকোনমির ভিত্তি গড়ে উঠেছে বি এফ স্কিনারের অপারেন্ট কন্ডিশনিং থিওরির (১৯৩৭) ওপর। স্কিনার বলেন, যখন কোনো আচরণের পর ফল ইতিবাচক হয়, তখন সে আচরণ পুনরাবৃত্তি হয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এ নীতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবহারকারীদের ‘লাইক’, ‘শেয়ার’, ‘কমেন্ট’, ‘নোটিফিকেশন’-এর মাধ্যমে এক ধরনের ডোপামিন রিওয়ার্ড লুপ তৈরি করে। এ লুপ ব্যবহারকারীদের ক্রমাগত প্ল্যাটফর্মে নিযুক্ত রাখে, কারণ তারা প্রতিটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্য এক ধরনের মানসিক সন্তুষ্টি অনুভব করে।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ এই রিওয়ার্ড সাইকেলে আটকে পড়েছে। ফলে গড়ে প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সময় ৫-৭ ঘণ্টায় পৌঁছেছে। এই অতিরিক্ত সময় ব্যয় কর্মক্ষমতা, ঘুম, মানসিক স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যুবকদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তাদের শেখার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদি মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে তাদের সামগ্রিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনীতির প্রথাগত তত্ত্ব অনুযায়ী, উৎপাদন-ব্যবস্থায় মূল্যবান উৎপাদন উপাদানগুলোর মধ্যে শ্রম, মূলধন ও ভূমি প্রধান। কিন্তু অ্যাটেনশন ইকোনমি এ কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আজকের দিনে মনোযোগ নিজেই একটি উৎপাদন উপাদানে পরিণত হয়েছে, যার মূল্য নির্ধারণ করে ক্লিক রেট, এনগেজমেন্ট টাইম এবং কনভার্সন রেশিও। অর্থাৎ, একজন ব্যবহারকারী কতক্ষণ একটি প্ল্যাটফর্মে সময় কাটাচ্ছেন, কতবার ক্লিক করছেন এবং একটি বিজ্ঞাপনে কতজন ব্যবহারকারী সাড়া দিচ্ছেন, তার ওপর ভিত্তি করে মনোযোগের মূল্য নির্ধারিত হয়।
এ প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করতে অর্থনীতিবিদ শোশননা জুবফ তার ‘The Age of Surveillance Capitalism’ (২০১৯) বইয়ে বলেন, এটি এমন এক ধরনের ব্যবস্থা যেখানে মানুষের অভ্যন্তরীণ জীবন- চিন্তা, অভ্যাস, আচরণ বাণিজ্যের কাঁচামালে পরিণত হয়েছে। মানুষের ডেটা সংগ্রহ করা হয়, বিশ্লেষণ করা হয় এবং তার পর ব্যবহারকারীদের নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন বা কন্টেন্ট দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এ ‘সার্ভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ এক নতুন ধরনের অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করেছে, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য এবং মনোযোগই নতুন পণ্য।
বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে এ পরিবর্তন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ হিউ বোয়েন (১৯৬৩) বলেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে মানব মূলধনে বিনিয়োগ। কিন্তু যদি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বাণিজ্যিক কনটেন্টে চলে যায়, তবে এ বিনিয়োগ অর্থহীন হয়ে পড়ে। বাস্তবে, কোচিং সেন্টার, অনলাইন টিউটরিং অ্যাপ বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম একদিকে শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করছে, অন্যদিকে একই প্ল্যাটফর্মে তরুণরা সময় ব্যয় করছে বিনোদনমূলক ভিডিও, রিলস বা লাইভ স্ট্রিমে।
ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন ও বিশ্লেষণী দক্ষতা অর্জন প্রতিস্থাপিত হচ্ছে সাময়িক আনন্দ ও তথ্যের খণ্ডচিত্রে। শিক্ষার্থীরা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার পরিবর্তে দ্রুতগতির, আকর্ষণীয় এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিওতে আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্স এবং সামগ্রিক শিক্ষার গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসমতা এ মনোযোগ অর্থনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। পিয়েরে বুরদিয়ুর ‘কালচারাল ক্যাপিটাল’ তত্ত্ব (১৯৮৬) অনুযায়ী, যে ব্যক্তি সাংস্কৃতিক পুঁজি বেশি অর্জন করে- ভাষা, অভ্যাস, রুচি- সে সমাজে প্রাধান্য পায়। ডিজিটাল যুগে যাদের তথ্য ব্যবহারের জ্ঞান ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তারা এ অ্যাটেনশন ইকোনমিকে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে। তারা জানে কীভাবে অপ্রয়োজনীয় তথ্য ফিল্টার করতে হয় এবং তাদের মনোযোগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে গ্রামীণ ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের মনোযোগ সবচেয়ে সহজেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতা বা রাজনৈতিক প্লেয়ারদের কাছে। এ ডিজিটাল বিভাজন সমাজের বিদ্যমান অসমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। যাদের কাছে শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাব রয়েছে, তারা সহজেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের মূল্যবান মনোযোগ বিক্রি করে ফেলছে, যা তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘Capability Approach’-এ বলেছেন, উন্নয়ন মানে কেবল আয় বৃদ্ধি নয়, বরং মানুষের স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার সক্ষমতা অর্জন। অ্যাটেনশন ইকোনমি যদি মানুষের মননশক্তিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, তবে তা প্রকৃত উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদি মানুষের মনোযোগ ক্রমাগত বিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং তারা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তবে তাদের স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের সক্ষমতা কমে যায়, যা সামগ্রিক মানব উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে অ্যাটেনশন ইকোনমি এখন আর কেবল অর্থনীতির নতুন অধ্যায় নয়, এটি আমাদের মূল্যবোধ, রাজনীতি, শিক্ষা এবং সমাজব্যবস্থার কেন্দ্রে প্রবেশ করেছে। সময় ও মনোযোগকে পণ্যে রূপান্তরের এ প্রক্রিয়া যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় না আসে, তবে তা একদিকে ভোক্তাচেতনা নষ্ট করবে, অন্যদিকে গণতন্ত্র ও মানবিক বিকাশকে হুমকির মুখে ফেলবে।
তাই এখনই সময়, অর্থনীতি ও মনোবিজ্ঞানের আলোকে, মনোযোগকে পণ্য নয়, একপ্রকার নাগরিক অধিকার হিসেবে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও উৎপাদনশীল ডিজিটাল পরিবেশে বেড়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য এ পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য। মনোযোগের এ নতুন সংজ্ঞা এবং তার সঠিক ব্যবস্থাপনা আমাদের ডিজিটাল ভবিষ্যৎকে আরও স্থিতিশীল ও মানবিক করে তুলতে সাহায্য করবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]