
প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির একটি সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে (আরজি কর হাসপাতাল) এক নারী ডাক্তারকে (পিজিটি) ধর্ষণ করে হত্যা। এরপর একটি অকিঞ্চিৎকর উপনির্বাচনে জয়ের পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতার উন্মত্ত আস্ফালন দেখাতে গিয়ে ৯ বছর বয়সী এক শিশুকে বোমা মেরে খুন। আর মাত্র দিন কয়েক আগে সরকারি আইন কলেজে এক ছাত্রীকে ওই কলেজেরই সিনিয়র এবং ইউনিয়নের তিন সদস্যের নির্মম দলবদ্ধ ধর্ষণ। এ তিনটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল এবং সেই দলের ঘনিষ্ঠ নেতারা। দুটি ঘটনাই ঘটেছে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতর। গত এক বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিশু, মেডিকেল ছাত্রী, আইনের ছাত্রীদের ওপর উপর্যুপরি পাশবিক অত্যাচারের ঘটনা আর কতদিন দেখতে হবে রাজ্যবাসীকে।
এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কারণ ওপরের তিনটি ঘটনায় একটিতেও দোষীদের শাস্তি হয়নি। ফলে জনমানসে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলাহীন, সর্বাত্মক অরাজক এ পরিস্থিতিই এখন এ রাজ্যের স্বাভাবিকতা।
তামাহা ছিল মাত্র ৯ বছরের এক নিষ্পাপ শিশু। রাজনীতি বোঝেনি, সভা-সমিতির কথা জানত না। তবু তাকে প্রাণ দিতে হলো; শুধু এ কারণে যে, তার পরিবার ছিল রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরে। নদিয়া জেলার কালীগঞ্জে এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়েছে কয়েকজন তৃণমূল নেতা।
এটি শুধু একটি খুনের ঘটনা নয়। এটি এক নির্মম বার্তা; এ রাজ্যে জন্মপরিচয়ও কাউকে রাজনৈতিক ‘শাস্তি’ থেকে রক্ষা করতে পারে না। রাজনীতি এমন স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে শিশুরাও ক্ষমতার প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে। শুধু ক্ষমতা না পাওয়ার কারণে প্রতিবাদ করলেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে। তামান্নার মৃত্যু যেন সেই রাজনৈতিক প্রতিপত্তির নিঃশব্দ ঘোষণা। এ ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দেয়, ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর নামে ভোট নেওয়া গেলেও, এক ‘মা’-এর সন্তানের নিরাপত্তা কেউ নিশ্চিত করে না। প্রশ্ন জাগে, এক শিশুর মৃত্যু যদি সরকারকে না নাড়ায়, তবে আর কী হলে তারা সাড়া দেবে?
তামান্নার রক্ত এখনো শুকোয়নি, তার মধ্যেই কলকাতার এক আইন কলেজে এক ছাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। অভিযুক্ত আবারও এক তৃণমূল ছাত্রনেতা। শিক্ষাঙ্গনের মতো জায়গায়ও যদি নারীর নিরাপত্তা না থাকে, তবে রাজ্যের ‘উন্নয়ন’, ‘সুশাসন’ বা ‘অভিযান’- সবকিছুর ওপরই বড় প্রশ্নচিহ্ন ওঠে। তামান্না জন্মসূত্রে ‘অপরাধী’, আর সেই কলেজছাত্রী শুধু নারী বলেই ‘দোষী’? এ রাজনীতির অন্ধকার ছায়ায় নারীর সুরক্ষা আজ সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যদি এ প্রশ্ন তোলেন, আপনাকেই বলা হবে ‘বড় যন্ত্রকারী’।
কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর এক বছরও কাটেনি। এবার দক্ষিণ কলকাতার একটি আইন কলেজে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনজনকে। তাদের মধ্যে একজন কলেজের সাবেক ছাত্র এবং বর্তমান কর্মী। অন্য দুজন এখনো ওই কলেজে পড়ে। এই তিনজনেরই তৃণমূলযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। রাজ্যের শাসক দল মেনে নিয়েছে, মূল অভিযুক্ত তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে এও জানিয়েছে, এখন কোনো পদে নেই তিনি। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় দোষীদের কড়া সাজা দাবি করেছে তৃণমূল। ধর্ষণের এ ঘটনায় বিরোধীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে চলছে বলেও দাবি তাদের।
গত বছর আরজি কর আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল ১৪ আগস্ট রাতে ‘রাত দখল’-এর কর্মসূচি থেকে। লাখ লাখ মানুষের মতো দক্ষিণ কলকাতার এ আইন কলেজ থেকেও বেশকিছু ছাত্রছাত্রী ওই কর্মসূচিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেসবুক লাইভও করেছিলেন। সেই পড়ুয়াদের অনেকেই বলেন, মনোজিৎ মিশ্র এবং তার দলবল তখন ফেসবুক ধরে তালিকা বানিয়েছিলেন কারা সেই রাত দখলের আন্দোলনে গিয়েছিলেন। তারপর তাদের ফোন করে কলেজে ডেকে পাঠান মনোজিৎ।
রাত দখলে অংশ নেওয়ার জন্য হুমকি, এমনকি মারধরও চলে বলে অভিযোগ। এক ছাত্র প্রতিবাদ করায় তাকে লেক মলের সামনে থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মনোজিতের অনুগামীদের বেধড়ক মারের জেরে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এসব ঘটনায় অপহরণ, মারধরসহ আরও নানা ধারায় মামলা হয় মনোজিৎদের দলবলের নামে। কিন্তু তার কেশও ছুঁতে পারেনি পুলিশ।
দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজের ক্যাম্পাসের মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণে অভিযুক্ত মনোজিৎ গ্রেপ্তার হওয়ার পরে পুরোনো এসব অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। অভিযোগ, ওই কলেজ ক্যাম্পাসে মনোজিৎ এতটাই প্রভাবশালী যে, তার মুখের ওপরে কথা বলতে পারতেন না কলেজের সার-ম্যাডামরাও। মনোজিতের হাতে মার থেকে অচৈতন্য হয়ে পড়া ওই ছাত্র এদিন বলেন, ‘আমরা অন্তত ১০-১২ জন ছাত্রছাত্রী এমন আছি, যারা ওর ভয়ে গত এক বছর ধরে ক্যাম্পাসেই ঢুকতে পারি না। আমাদের অপরাধ, কেন আমরা রাত দখলের আন্দোলনে গিয়েছিলাম।’ শুধু রাত দখল কর্মসূচি নয়, কলেজে মনোজিতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই ক্যাম্পাসে, এমনকি ক্যাম্পাসের বাইরে মারধর করে মনোজিৎ ওই ছাত্রছাত্রীদের কলেজ, ছাড়া করতেন বলে অভিযোগ।
পুলিশের খাতায় অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে মনোজিতের নামে।
২০১৭ সালে কলেজে ভাঙচুর চালানো, তার পর ক্যাম্পাসে সিসিটিভি ভাঙচুরের ঘটনাতেও নাম জড়িয়েছে মনোজিতের। প্রয়াত প্রিন্সিপাল দেবাশীস চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৭ সালে মনোজিৎকে ক্যাম্পাসে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগে একবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্তত তিনবার মনোজিৎকে সাসপেন্ড করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাকে বাগে আনা যায়নি কখনোই।
আইন কলেজের ঘটনা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে নির্যাতিতার মেডিকেল পরীক্ষা হয়। সেখানের চিকিৎসকদের বক্তব্য, পুলিশ যখন নির্যাতিতাকে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য নিয়ে এসেছিল, তার গলায় কামড়ের দাগ ছিল। শরীরের একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। যৌনাঙ্গেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। নির্যাতিতার বিবরণ গ্রহণের সময়ও চিকিৎসকদের কাছে তরুণী উল্লেখ করেছেন যে, তাকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল। একজন ধর্ষণ করে, বাকি দুজন দাঁড়িয়ে ছিল। গত ২৫ জুন রাতে কসবার সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় প্রথম বর্ষের ছাত্রী। গতকালই নির্যাতিতা তার বয়ানে জানিয়েছেন, কী ঘটেছিল সেদিন। প্রথমে ইউনিয়ন রুমের ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন অভিযুক্ত। তরুণী প্রাণপণে আটকানোর চেষ্টা করছিলেন। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। তার প্যানিক অ্যাটাক হয়, শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।
অভিযুক্তদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা তরুণীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। পরে একটা ইনহেলার এনে দেয়। সাময়িক সুস্থ বোধ করলে ওই ছাত্রী বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে, তাকে জোরপূর্বক গার্ড রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ধর্ষণ করা হয়। তখন সামনে দাঁড়িয়েছিল বাকি দুই অভিযুক্ত। অভিযুক্তরা ধর্ষণের ভিডিও রেকর্ড করে রাখে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য। নির্যাতিতার বয়ানেই ওঠে এসেছে প্রতি মুহূর্তের বীভৎসতার বর্ণনা।
কালীগঞ্জের ঘটনা- গত ১৯ জুন কালীগঞ্জে বিধানসভার উপনির্বাচন ছিল। ২৩ তারিখ ছিল ভোট গণনা। সেদিন ফল পুরোপুরি ঘোষিত হওয়ার আগেই কালীগঞ্জে শাসক দল তৃণমূলের জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ফলে বিজয় মিছিল বের করা হয়। অভিযোগ, সেখান থেকে সিপিএম সমর্থকদের বাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোড়া হয়েছিল। যে বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়েছে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী তামান্নার। তার পরিবার সিপিএম সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তামান্নার মা গাওয়ালকেই মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। শনিবার গাওয়ালের গ্রেপ্তারের খবর শুনে তিনি বলেন, ‘গাওয়াল এখানকার মূল মাথা। ওর নির্দেশে বোমা হামলা হয়েছে। তবে ওর ওপরও মাথা আছে, পুলিশ সেটাও তদন্ত করে দেখুক। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে পুলিশ সব জানতে পারবে।’
বুখ সভাপতির গ্রেপ্তারি প্রসঙ্গে তৃণমূলের কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান রুকবানুর রহমান বলেন, ‘দুষ্কৃতদের কোনো দল হয় না। কে কোন দলের সমর্থক, দেখার দরকার নেই। যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুক পুলিশ। দলীয়ভাবে আমরা সেই দাবি জানাচ্ছি।’ তবে শাসক দলকে পাল্টা কটাক্ষ করেছে বিজেপি। কৃষ্ণনগর নদিয়া উত্তরের বিজেপির সভাপতি অর্জুন বিশ্বাস বলেন, ‘বড় মাথাদের আড়াল করতে চুনোপুঁটিদের বলি দেওয়া হচ্ছে। যারা এত দিন ধরে গোটা এলাকাকে সন্ত্রস্ত করে রাখল, ভোটে যাদের তৃণমূল ব্যবহার করল, সেই মস্তানবাহিনীর শিকড় পর্যন্ত পৌঁছোনোর ক্ষমতা পুলিশের নেই। তবু এই গ্রেপ্তারি মানুষকে কিছুটা ভয়মুক্ত করবে।’
কসবা দলবদ্ধ ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে সরব হয়েছেন আরজি করের নির্যাতিতা ছাত্রীর বাবা-মা। তাদের অভিযোগ, অপরাধীদের মাথায় সরকারের হাত আছে।
সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে নির্যাতিতা ছাত্রীর মা বলেন, পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কসবা দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা আমাদের কাছে লজ্জার। একসময় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সবাই গর্ব করতেন। বিদেশেও সুনাম ছিল। এখন শিক্ষাব্যবস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে। এমন ঘটনা বারবার ঘটায় রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা কলুষিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের দুর্নাম আরও বাড়ছে।
আরজি করের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে নিহত চিকিৎসক ছাত্রীর মা বলেন, আরজি কর হাসপাতালেও একই ঘটনা ঘটেছিল। আমার মেয়েকে সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল।
সেই ঘটনার প্রতিবাদে লড়াই-আন্দোলন সবকিছুই দেখেছিলেন রাজ্যের সাধারণ মানুষ। এত আন্দোলন হওয়ার পরও লাভ কী হলো? সেই তো অপরাধ ঘটেই চলেছে। অপরাধীদের মাথায় যদি সরকারের হাত থাকে তাহলে তো অপরাধের ঘটনা বাড়তেই থাকবে। এ নিয়ে আরজি করে নির্যাতিতা ছাত্রীর মা বলেন, এটাই তো নিয়ম। কোনো ঘটনা ঘটলেই শাসক দল দায় ঝেড়ে ফেলবে। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কথা বলছি না। এ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। আমার মেয়ের মৃতুর এক বছর হতে চলল। অথচ আসল অপরাধীদের এখনো খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি আরও বলেন, আসল অপরাধীদের সরকারি মদদে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের মাথায় সরকারের হাত রয়েছে।
এ রকম ঘটনায় প্রভাবশালী তকমা বারবার ফিরে আসছে। প্লেট কালচার কিংবা শাসকদলের দাপাদাপি এখনো বন্ধ হয়নি বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অন্যদিকে সুর চড়িয়েছেন আরজি করের নির্যাতিতা ছাত্রীর বাবাও। তিনি বলেন, যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে, তার মধ্যে টিএমসিপির এক নেতাও রয়েছে। ক্ষমতা এবং টাকার অপব্যবহার বেড়ে গেছে। যার ফলে এসব ঘটনা বারবার ঘটছে। সরকারের নজরদারির অভাব রয়েছে।
নজরদারির বদলে সরকার যেন অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমার মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় প্রথম থেকেই পুলিশ প্রশাসন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখনো সেটাই চলছে। আমরাও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার কিছু করবে না। মানুষকেই বুঝে নিতে হবে। এটা আমরা ভালো করেই বুঝতে পেরেছি।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক