ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ শেষ। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন আরও বেশি চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগ ও দলের তৃণমূল নেতাদের জন্য। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই দলটির নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা, তৃণমূলের প্রার্থীদের মধ্যে সহিংসতা বাড়বে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রে বেশিসংখ্যক ভোটার আনা কঠিন হয়ে পড়বে।
কারণ উপজেলার প্রথম ধাপের নির্বাচনে এবার ভোটার উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে কম। এই নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন নির্বাচনি এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে। আর নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। এই ঘটনায় জনগণ কিছুটা নির্বাচনবিমুখ হচ্ছেন বলে খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই মনে করছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনের প্রতি জনগণের অনাগ্রহ সরকারের জন্য ভালো নয়। তাই পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় এবং পরের ধাপগুলোর নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। যদিও বিষয়টি নিয়ে দলের কেন্দ্র উদ্বিগ্ন। তাই ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট তৃণমূল নেতাদের তাগিদ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।
এমন প্রেক্ষাপটে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনাগ্রহের কারণ খুঁজে পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা শনিবার খুলনায় এক মতবিনিময় সভায় উপজেলার প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। সেই সঙ্গে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কাজ করছে কমিশন। রাশেদা সুলতানা বলেন, প্রার্থীদের দায়িত্ব ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা। আর নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান ও নির্বিঘ্নে ভোটদানের পরিবেশ সৃষ্টি করা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার ১৩৯টি উপজেলায় অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির ১৭ জন স্বজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন ১২ জন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে একাধিকবার স্বজনদের বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও পার পেয়ে যাবেন মন্ত্রী-এমপির স্বজনরা। জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ১৬০টি উপজেলায় প্রায় মন্ত্রী-এমপির ১৮ জন স্বজন নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মন্ত্রী-এমপির স্বজন হওয়ার কারণে তারা দলীয়, এমনকি প্রশাসনিকভাবেও বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। যার ফলে প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে তাদের সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে প্রায় ৫০টি উপজেলায় সহিংস ঘটনা ঘটেছে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই।
গত বুধবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাদারীপুর সদর, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, সুনামগঞ্জের শাল্লা, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কিছু কেন্দ্রে সংঘর্ষ এবং ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই সব এলাকায় বোমাবাজি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
এদিকে ভোটে অনিয়মের অভিযোগে বগুড়ায় দুই সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই জেলার আরেক কেন্দ্রে আটক করা হয় প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ দুজনকে।
যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিষয়ে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দলীয় নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি পেতেই হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৩ জন এমপি মনোনয়ন পাননি, ২৫ জন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন। শাস্তিটা অনেকভাবেই আসতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনে কেউ প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে এবং সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ঐকমত্য এবং ভিন্নমতও হয়। তবে কেউ যেন কোন্দলে না জড়ায়। দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যারা ভালো করে দল তাদের পুরস্কৃত করে আবার অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আমরা তৃণমূলে বার্তা দিচ্ছি। কেউ যেন প্রভাব বিস্তার না করে, সেদিকেও লক্ষ রয়েছে। ভোটাররা যেন নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারেন আমরা সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চাই।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পরবর্তী ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিতর্ক এড়াতে অন্তত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো:
প্রথম ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রত্যাশার চেয়ে ভোট কম পড়েছে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ৬৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ৬১ শতাংশ ভোটার উপজেলা নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৪০ শতাংশের বেশি। এবারের প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা নিয়ে আওয়ামী লীগের মাঝে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ভোটারদের ‘ডোর টু ডোর’ গিয়ে ভোট চাইতে বলা হয়েছে।
তৃণমূলে কোন্দল নিয়ন্ত্রণ:
গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী ও দলীয় স্বতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখনো নিরসন হয়নি। এর মধ্যে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিয়েছে। কারণ একাধিক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এর ফলে কর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন, যা নিয়ন্ত্রণ করে দলের ঐক্যের বার্তা দিচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের দলীয় নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য করা:
প্রথম ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্দেশ অমান্য করে মন্ত্রী-এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন। তা সত্ত্বেও তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা রোধে এখনই স্বজনদের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। ফলে বিপাকে পড়েছেন দলের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীরা। কারণ এমপি-মন্ত্রীর ইমেজ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে সুবিধা করে যাচ্ছেন স্বজনরা। তাই পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে স্বজনদের বুঝিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের চেষ্টা করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ:
উপজেলা নির্বাচনে একাধিক স্থানে প্রভাবশালীদের আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ করেছেন তৃণমূল নেতারা। একাধিক উপজেলায় সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। পরবর্তী ধাপের নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে পরিবারতন্ত্র বা আধিপত্য বিস্তার করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা:
বিএনপিবিহীন উপজেলা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে চায় আওয়ামী লীগ। কারণ স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। সেই লক্ষ্যে এবার প্রতীক বরাদ্দ না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার নেতা-কর্মীদের বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করার বার্তা দিয়েছেন। কেউ প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।