শিগগিরই ঘোষণা করা হতে পারে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির নতুন কমিটি। কমিটিতে কারা আসছেন, তা নিয়ে আলোচনা-গুঞ্জন চলছে। ঢাকা মহানগরের কাণ্ডারি হতে ইচ্ছুক, এমন অনেক নেতা ইতোমধ্যে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন।
তবে মহানগরের নেতা-কর্মীরা জানান, এবার তারা কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য কমিটি চান। আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে দলকে এগিয়ে নিতে পারেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, নিজস্ব সাহসী কর্মী বাহিনী রয়েছে- এমন স্থানীয় নেতাদের ঢাকা মহানগর বিএনপির কাণ্ডারির দায়িত্ব দেওয়া উচিত। না হলে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাতে আবারও ব্যর্থ হতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত দিনে যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, কমিটিতে তারা মূল্যায়িত হবেন। তবে সংগঠনকে এগিয়ে নিতে পদ-পদবি ভুলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খবরের কাগজকে বলেন, ‘মহানগর কমিটি নিয়ে হাইকমান্ড এখনো কিছু জানাননি। হাইকমান্ড যখনই কমিটি অনুমোদন করবেন, তখনই প্রেসে পাঠানো হবে।’
মহানগরের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মহানগরের নেতৃত্বে সিনিয়র-জুনিয়র সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে সাবেক এমপি, এমন কাউকে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলা ও মিটিংয়ের সময়ে পরিবেশ কিছুটা অনুকূলে থাকবে। প্রশাসন সাবেক এমপিদের মূল্যায়ন করলেও বর্তমান নেতাদের সেভাবে মূল্যায়ন করতে চায় না। তবে স্থানীয় সাবেক এমপি যারা আছেন, তারাও দলের বড় দায়িত্ব পালন করছেন।
তারা আরও বলেন, ‘পদ বাণিজ্য’ এবং ‘মাইম্যান’ দিয়ে কমিটি গঠন করলে দলই আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। টাকা দিয়ে কেউ পদে এলে আন্দোলনের সময় রাজপথে থাকেন না। আন্দোলনে যারা দলকে এগিয়ে নিতে পারবেন, এমন ৫০০ নেতা বাছাই করতে হবে। নতুন কমিটিতে পরীক্ষিত সিনিয়র-জুনিয়র নেতাদের সমন্বয় থাকতে হবে। না হলে মহানগরে যারা ৪০-৫০ বছর ধরে রাজনীতি করছেন, তারা বেকায়দায় পড়বেন। জুনিয়র নেতাদের সঙ্গে তাদের সমন্বয়ে সমস্যা হবে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, এমন নেতাও এই তালিকায় রয়েছেন। তারা ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়বেন এবং রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হবে।
প্রায় ৪০ ধরে ঢাকার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক তিনবারের কমিশনার ও গেন্ডারিয়া থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল ইসলাম খান টিপু। তিনি বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থেকেও দলকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন। আমি মনে করি, সাবেক এমপি কাউকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। আরও যাচাই-বাছাই করে সাহসী নেতাদের দায়িত্বে আনতে হবে। স্থানীয় ব্যক্তিত্ববান নেতাদের সমন্বয়ে কার্যকর কমিটি গঠন করতে হবে। না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মির হোসেন মিরু খবরের কাগজকে বলেন, ‘কার্যকরী কমিটি দিতে পারলে রাজপথে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বিএনপি। আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিতে পারেন, তাদেরই কমিটিতে আনতে হবে। দলের একজন কর্মী হিসেবে বিএনপির রাজনীতি করে যাচ্ছি। কমিটি রাখলেও আছি, না রাখলেও থাকব।’
সূত্রমতে, আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগর। কিন্তু ঢাকায় আন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারছে না বিএনপি। বর্তমান প্রতিকূল পরিবেশের পাশাপাশি মহানগর নেতৃত্ব কি পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে? থানা এবং ওয়ার্ড কমিটি গোছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। নতুন কমিটি এসে আবার থানা-ওয়ার্ড কমিটি ভেঙে দিচ্ছে। এতে নেতা-কর্মীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগরের আহ্বায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়ান প্রয়াত সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। ওই বছরের ১৮ জুলাই মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবীব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্যসচিব করে কমিটি গঠিত হয়। তখন কেউ কাউকে সহযোগিতা করেননি বলেও অভিযোগ ওঠে। প্রায় তিন বছর পর মহানগর দক্ষিণে নবী খান সোহেল এবং উত্তরে এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি করে কমিটি দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল। ২০২১ সালের ২ আগস্ট প্রায় সাড়ে চার বছর পর আব্দুস সালামকে দক্ষিণের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু এবং আমানউল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক ও আমিনুল হককে সদস্যসচিব করে কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু আড়াই বছরের মাথায় গত ১৩ জুলাই এই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির নেতা-কর্মীরা বলছেন, সংগঠনে সাহসী নেতা-কর্মীদের সঠিক স্থানে বসাতেও সময় লাগে। এখন আবার নতুন কমিটি এলে তারা থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে তাদের নিজস্ব বলয়ের নেতা-কর্মীদের স্থান দেবে। এতে দলের সাহসী-ডেডিকেটেড নেতা-কর্মী অনেকেই বাদ পড়েন। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে এক গ্রুপ ঝুঁকি নিলেও আরেক অংশ নিষ্ক্রিয় থাকে। তাদের মতে, দলে সাহসী ও নিবেদিত নেতা-কর্মীর অভাব রয়েছে।
তারা বলেন, ‘তিন বছরে আন্দোলন-সংগ্রাম বেগবান করেছি, নির্যাতন-নিপীড়ন ও হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। এখন পুলিশ নেতা-কর্মীদের না পেয়ে বাবা-মা ও সন্তানকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরও রাজপথে থাকার চেষ্টা করেছে সবাই। বর্তমান বাস্তবতার প্রকৃত তথ্য পাচ্ছেন না ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তাকে একটি গ্রুপ প্রতিনিয়ত ভুল তথ্য দিয়ে আসছে। শেষ মুহূর্তে এসে ঢাকার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।
দক্ষিণের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অস্থায়ী লোক দিয়ে কমিটি করলে আন্দোলনের সময় তাদের রাজপথে পাওয়া যায় না। সিনিয়র-জুনিয়র সংমিশ্রণে হলে কমিটি কার্যকরী হবে। আন্দোলন-সংগ্রামে দলকে এগিয়ে নিতে পারেন, এমন নেতাদের নেতৃত্বে প্রয়োজন। অর্থবিত্ত ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, নিজস্ব কর্মী-সমর্থক রয়েছে, ২ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ-সাত হাজার নেতা-কর্মী জড়ো করতে পারেন-তাদের কমিটিতে জায়গা দিতে হবে।’
সাবেক সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগামী দিনে দলের প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তার সঙ্গে আমরা একমত।’
ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সদস্যসচিব আমিনুল হক বলেন, ‘কমিটি ভেঙে দেওয়া সাংগঠনিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়া। প্রায় সব থানা-ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠন করেছি। যারা দলের জন্য সাহসী ভূমিকা পালন করতে পারবেন, যারা দলের জন্য নিবেদিত, তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির কমিটির সুপার ফাইভে যাদের নিয়ে আলোচনা রয়েছে তারা হলেন সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবী, সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন, বিএনপি নেতা আ ন ফ সাইফুল ইসলাম, ইশরাক হোসেন।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সুপার ফাইভে আলোচনায় রয়েছেন যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাবেক সদস্যসচিব আমিনুল হক, বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল, যুবদল নেতা এস এম জাহাঙ্গীর, শফিকুল ইসলাম মিল্টন, দপ্তর সম্পাদক এ বি এম রাজ্জাক।
উত্তরের একাধিক নেতা জানান, বিদায়ী কমিটিতে আমান উল্লাহ আমানকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি স্থানীয় নেতা নন। আমান উত্তরের রাজনীতির সঙ্গেও কখনোই সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাই স্থানীয় নেতাদের দায়িত্বে চান তারা।
মহানগর উত্তরের দুবারের সাবেক দপ্তর সম্পাদক এ বি এম রাজ্জাক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা আশা করি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কমিটিতে যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাদের মূল্যায়ন করবেন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে মহানগর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছি। তদবির-লবিংয়ে নেতা নির্বাচন নয়, রাজপথের পরীক্ষিত নেতাদের মূল্যায়িত করতে হবে। যোগ্য নেতাদের মূল্যায়ন না হলে দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’