অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, এ সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সবার ব্যর্থতা, গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ-বিদেশ থেকে নানা রকমের উস্কানিতেও জনগণ ব্যর্থ হতে দেবে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সে ব্যপারে তাদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ভার্চ্যুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। এতে সভাপতিত্ব করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার হাজারো শহিদের রক্তের বিনিময়ে লাখো কোটি জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। এ সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সকলের কাছে হয়তো সাফল্য হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে কিন্ত ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে এবং রাখবে।
তিনি বলেন, কিন্তু কোনো এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহিতাও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়। সুতরাং জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই তাদের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেট হওয়া জরুরি।
বিএনপির এ শীর্ষ নেতা বলেন, এ জন্যই অগ্রাধিকারভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। কারণ জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়া ছাড়া উন্নয়ন-গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই এবং কার্যকর হয় না। সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন জনপ্রশাসনের সংস্কার এবং আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে 'সক্ষম এবং উপযুক্ত' গড়ে তুলতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএনপি মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার এজেন্ডা সেটিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে না পারলে গণ অভুত্থানের সাফল্য ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্রকারী চক্র নানা সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। এর কিছু আলামত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বন্দুকের সামনে জনগণ বুক পাততে রাজি তবুও স্বৈরাশাসন মানবে না
গণতন্ত্রকামী বীর জনগণকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ছাত্র-জনতা নারী শিশু কৃষক শ্রমিক সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে রাজি তবুও স্বৈরশাসন মেনে নিতে রাজি নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা শহিদ এবং আহত হয়েছেন, হাত পা চোখ হারিয়েছেন কিংবা চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ আজীবন তাদের এই আত্মত্যাগ এবং অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। হতাহতদের প্রতিটি পরিবারের প্রতি অবশ্যই রাষ্ট্র যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে।
তিনি বলেন, স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্র-রাজনীতি শাসন প্রশাসন হওয়ার কথা ছিল গভর্নমেন্ট অফ দ্যা পিপল বাই দ্যা পিপল ফর দ্যা পিপল। অথচ গত ১৫ বছর বাংলাদেশে মাফিয়া শাসন চালু করা হয়েছিল। পলাতক স্বৈরাচার বিনাভোটের সরকারের পরিচয় হয়ে উঠেছিল গভর্নমেন্ট অফ দ্যা মাফিয়া বাই দ্যা মাফিয়া ফর দ্যা মাফিয়া।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এ মাফিয়া চক্র দেশকে সর্বক্ষেত্রে ভঙ্গুর করে সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর, ঋণ নির্ভর এবং পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করে দিয়েছে। আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক রীতিনীতি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। বিচার বিভাগের সূতিকাগারে পরিণত করেছিল। দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। গত দেড় দশকে ১৭ লক্ষ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার করেছে। বৈদেশিক ঋণ বর্তমানে ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিটি শিশু জন্ম থেকেই মাথা পিছু ঋণ কমপক্ষে দেড় লক্ষ টাকা।
মাফিয়া সরকারের জঞ্জাল এখনো দূর হয়নি
তারেক রহমান বলেন, গণ বিস্ফোরণে মাফিয়া চক্রের প্রধান দেশ ছেড়ে পালানোর মধ্য দিয়ে একটি-গণতান্ত্রিক-মানবিক বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রধান বাধা দূর হয়েছে। তবে বাধা দূর হলেও মাফিয়া চক্রের রেখে যাওয়া ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর হয়নি। এ জঞ্জাল দূর করে জনগণের ভোটে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারের বেনিফিশিয়ারি অপশক্তি প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে কিংবা রাজনীতির ছদ্মাবরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এবারের গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে জনগণ ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেয়েছে। জনগণ গুম-খুন-অপহরণ আর বিভীষিকাময় ‘আয়নাঘরে’র আতঙ্কমুক্ত স্বাধীন। এবার দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা সুরক্ষায় প্রথম কাজ হতে হবে রাষ্ট্র এবং জগণের গণতান্ত্রিক ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কারণ প্রায় আড়াই কোটি নতুন ভোটার একটি জাতীয় নির্বাচনেও ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি।
সংষ্কার কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করুন
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপি মনে করে দেশের জনশক্তির অর্ধেক নারী এবং তারুণ্যের এ বৃহৎ অংশকে রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের বাইরে রেখে একটি বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। সংবিধান কিংবা প্রবিধানে যাই থাকুক জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না গেলে, সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে শেষ পর্যন্ত কোনো সংস্কার কার্যক্রমেরই কার্যকর ফল পাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি, সকল ক্ষেত্রেই সংস্কার কার্যক্রম একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং, রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির আরও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জনকেও বিএনপি স্বাগত জানায়।
কেউ যদি মনে করেন, উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে। গণঅভ্যুত্থান কিংবা সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানারকম কথা হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, ফৌজদারি অপরাধের বিচার যেমন বিচারিক আদালতে হয় ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজনৈতিক আচরণের বিচার হয় জনগণের আদালতে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কোনো প্রলোভন কিংবা উস্কানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সমাজের নেতৃত্ব দানের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখুন। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াতে হয়তো আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তবে সে পথ সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-প্রতিশোধ নয়। সে পথ হবে ধৈর্য-সহনশীলতা ও সমঝোতার। সংস্কার কার্যক্রমের পথ ধরে নির্বাচনী রোডম্যাপে উঠবে দেশ। আসুন আমরা সবাই কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করি।
বিএনপি প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্যসচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, আব্দুস সালাম আজাদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা) সাইদুল ইসলাম বাবুল, সমাজকল্যাণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন, ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরী, কৃষক দলের সভাপতি হাসান জারিফ তুহিন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক হোসেন খান, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির প্রমুখ।
শফিক/এমএ/