আওয়ামী লীগের ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত রাখতে চাইলেও দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয় বিএনপি। দলটি মনে করে, রাজনীতিতে বিএনপির আজকের যে স্বস্তিকর পরিস্থিতি সেটি চিরকাল না-ও থাকতে পারে। তাই আওয়ামী লীগকে এখন নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান নিলে বিএনপিরও ভবিষ্যতে এমন ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
‘বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর এদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই’ এমন বক্তব্য গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি আওয়ামী লীগ। যদিও দলটির শীর্ষ দুই নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে একাধিক মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। আর এতে এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হয়েছিল বিএনপিতে। মূলত বিএনপিকে চাপে রাখার জন্যই আওয়ামী লীগ সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, একই কৌশল গ্রহণ করতে চায় বিএনপি। দলটি চায় আওয়ামী লীগ চাপে থাকুক। বিশেষ করে শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ যেন খুব শিগগির বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হতে না পারে- এটিই বিএনপি চায়।
সূত্রমতে, এ জন্য বিএনপির তৎপরতাও অব্যাহত আছে। দলটি গণহত্যাসহ গুম-খুন ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিচারের ব্যাপারে সোচ্চারও রয়েছে। বিএনপি মনে করে, ঘটনার বিচার হলে দলটির গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ নেতার সাজা হবে। ফলে আওয়ামী লীগ এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত ১৫ বছর বিএনপিকে একইভাবে দুর্বল করার কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এখন বিএনপি এই কৌশল গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে দলগতভাবে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। এরপর দলীয় ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনে আসা না আসা এটা তাদের নিজেদের ও জনগণের ওপর নির্ভর করছে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বলেছেন, আমরা চাই না, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। কারণ আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। তবে আওয়ামী লীগের যারা নানা অপরাধ করেছেন, যারা গণহত্যা করেছেন, সেই ব্যক্তিরা রাজনীতি করতে পারবেন না, জনগণ সেটা চায়। তাদের অপরাধের বিচার করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রে কোনো দলের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যায় না।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া বা ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত নয়, কারণ এ দুটি কাজ গণতান্ত্রিক চর্চাকে দুর্বল করবে। জনগণকে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া উচিত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, ‘শহিদ জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমরা বাকশাল নই, বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সেই দল হিসেবে আমরা অন্য কোনো দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক, এটা চাই না।’
যদিও বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে এক ধরনের মতামত রয়েছে। তবে দলের হাইকমান্ড এটিকে বিবেচনায় নিচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু নেতাও সভা-সমাবেশে বহুবার বিএনপিতে নিষিদ্ধের কথা বলেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের কারও কারও মত ছিল, ‘সন্ত্রাসী’ দল আখ্যা দিয়ে বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক।
২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় বিএনপির নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি প্রথমবার আলোচনায় এসেছিল। কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী কোনো দল পর পর দুই বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। অনেকের মতে, সেটি বিবেচনায় নিয়েই বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। এরপর বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার আরও একটি সুযোগ পায়। ফলে ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটে যায় না। অর্থাৎ দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ বা নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি মাথায় রেখেই বিএনপি সবসময় রাজনীতি করেছে।
দলীয় সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে দলের ভেতরে কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি। তবে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে কথা বলেছেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো ফল দেবে না। এমনকি ঘোরতর আওয়ামী লীগবিরোধী দল জামায়াতকেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেনি। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার মাত্র চারদিন আগে তারা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ঘটনা থেকে কোনো ফল পায়নি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে এমন আলোচনা এসেছে যে, রাজনীতি নিষিদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আসলে কোনো লাভ হয় না।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ঘটনাও নির্বাহী আদেশে নয়; আদালতের নির্দেশে ঘটেছে। ২০১৩ সালে ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন গত ১ আগস্ট ‘সন্ত্রাস ও সহিংসতার’ অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই মাসের ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও এর সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩-এর একটি খসড়া সংশোধনীর অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার সম্ভাবনার কথা অনেকে বলছেন। বিএনপির মধ্যম সারির দু-একজন নেতাও এ ব্যাপার কথা বলেছেন। তবে এই পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক দেশে উপযুক্ত নয় বলে মনে করেন বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা।
গত ২৪ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে, এটা খুবই দুঃসাহসিক, আমরা খুশি হয়েছি। কিন্তু যদি বিএনপিকে নিষিদ্ধ করে তখন আমরা কী করব? যারা বিভিন্ন সংগঠনের নামে মানুষকে হত্যা, গুম, নির্যাতন করেছে তাদেরকে ধরে ধরে বিচার করেন।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু খবরের কাগজকে বলেন, ‘জাতি ও জনগণ কী চায় তার ওপর নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ? ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ভুল করেছিল, এবারও তারা ভুল করেছে। আগেও মাশুল দিতে হয়েছে এবারও মাশুল দিল। আমরা কোনো দলকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নই। নির্বাহী আদেশে কোনো দল নিষিদ্ধ হোক এটা চাই না। কারণ কালকে তো আমাদেরকেও নিষিদ্ধ করতে পারে! যে অপরাধ করেছে তার বিচার করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের (আওয়ামী লীগের) বিচার করতে হবে।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল খবরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগ নিজে থেকেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। ছাত্র-জনতার গণহত্যা, লুটপাট চালিয়ে বিদেশে টাকা পাচার, দুর্নীতি, গুম-খুনসহ রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে আওয়ামী লীগকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তাদেরকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। নিজেরাই নিজেদের আড়াল করে রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসবে কি আসবে না তা জনগণ ঠিক করবে। রাষ্ট্র ও দেশবিরোধী কাজ করার পরও জনগণ তাদের ভোট দেয় কি না- এটাও দেখার প্রয়োজন।’