রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ডাক দিয়েছে তাবলিগ জামাত সংশ্লিষ্ট দুটি পক্ষ। আগামী ৫ নভেম্বর ডাকা এই সমাবেশের মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর পর তাবলিগ জামাতের বিবাদমান দুই পক্ষ আবারও মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াচ্ছে।
নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে বিভক্ত দুটি পক্ষের একটি অংশ দিল্লির মাওলানা মুহাম্মদ সাদ কান্ধলভির অনুসারী। আরেকটি অংশ প্রয়াত মাওলানা জুবায়েরুল হাসানের অনুসারী।
জানা গেছে, আগামী ৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘উলামা মাশায়েখ বাংলাদেশ’ ব্যানারে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে তাবলিগের সাদবিরোধী অংশ।
‘দাওয়াত ও তাবলীগ, মাদারেসে কওমিয়া এবং দ্বীনের হেফজতের লক্ষে’ আয়োজিত এ সমাবেশের আয়োজনে রয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সংশ্লিষ্টরা।
প্রকাশ্যে না থাকলেও জেলাভিত্তিক ও বিভিন্ন পয়েন্টের মার্কাজ মসজিদে সমাবেশ বাস্তবায়নে কাজ করছেন জুবায়েরপন্থী তাবলীগের সদস্যরা।
গত শুক্রবার রাজধানীর মিরপুরের জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদ মাদরাসায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশ সফলে প্রস্তুতি কমিটি করা হয়। এতে আহ্বায়ক করা হয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুককে।
ওই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- বেফাক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা নাজমুল হাসান, মাওলানা আব্দুল আওয়াল, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি প্রমুখ।
এ বিষয়ে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি সরকার পতনের পর দেশের নানা এলাকায় মাদরাসা-মসজিদ নিয়ে নানা ঝামেলা চলছে। এছাড়া, তাবলিগ জামাত নিয়ে সাদপন্থীরা ঝামেলা করার পাঁয়তারা করছে। সেজন্যই দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা মাশায়েখদের আহ্বানে এ মহাসম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া।
এ দিকে একই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাল্টা সমাবেশ ডেকেছে সাধারণ মুসল্লি পরিষদ বাংলাদেশ।
জানা গেছে, তাবলিগ জামাতের সাদপন্থী অংশের বিক্ষুদ্ধ কর্মীরা এ সংগঠনটির মাধ্যমে রাজপথের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে থাকে।
তাবলিগ ইস্যুতে দুপক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘোষণায় আবারও রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
৩১ অক্টোবর ডিএমপি কমিশনার বরবার করা আবেদনে সাধারণ মুসল্লি পরিষদ বাংলাদেশের সদস্যসচিব মীযানুর রহমান জানিয়েছেন, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পায়তারা, আসন্ন বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে ষড়যন্ত্র ও দেশের বিভিন্ন জেলায় ইজতেমা ও মারকাজে হামলা-ভাঙচুরের প্রতিবাদে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় মহাসমাবেশ আয়োজন করা হবে।
মীযানুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে চিহ্নিত কিছু ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার পায়তারা করছে। বিশেষত যারা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দিয়ে নিজেদের কূটচাল বাস্তবায়ন করেছিল তারাই আজ ভুল পাল্টে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টের চেষ্টা করছে। তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ ও বিশ্ব ইজতেমায় স্বৈরাচারী সরকারের মাধ্যমে অবৈধ দখলদারত্ব কায়েম করেছে তারা। এখন আমাদের সমূলে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এ চক্রটি। আমরা আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও সংবিধানের আলোকে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ রোধে এ সমাবেশের আয়োজন করেছি।
২০১৯ সাল থেকে আলাদাভাবে বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলিগের কার্যকম পরিচালনা করে আসছে তাবলিগের সাদ ও জুবায়েরপন্থীরা। এতোদিন বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেলেও বড় আকারে বিবাদের কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাই হঠাৎ অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে এ মহাসমাবেশ নিয়ে ধর্মীয় মহলে কৌতুহল তৈরি হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য থাকারও কথা শোনা যাচ্ছে ইসলামিক রাজনৈতিক মহলে।
তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অংশিদারত্বের বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বিরা। ২০১৫ সালে তাবলিগের দিল্লির নিজামুদ্দিন বিশ্ব মারকাজের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভির বিরোধিতা করেন পাকিস্তান ও ভারতের কয়েকজন মুরুব্বি। তাই তাবলিগের মূল সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিজামুদ্দীন মারকাজের সমান ক্ষমতা দাবি করে আলমি শূরা নামে কমিটি গঠন করেন তারা।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অংশীদারত্বের বিবাদে দিল্লি-লাহোর জড়িয়ে পড়লে বিশ্বজুড়েই এর প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদেও ছড়িয়ে পড়ে এ বিভক্তি।
ওই সময়ের ১১ জন শূরা সদস্যের মধ্যে ছয়জন নিজামুদ্দীন মারকাজ ও মাওলানা সাদের পক্ষে অবস্থান নিলেও বাকি ৫ জন তার বিরোধিতা করেন। হেফাজতপন্থি আলেমরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হলে বাংলাদেশেও বিষয়টি নিয়ে উত্তাপ ছড়ায়। এ অংশের বাধায় মাওলানা সাদ ২০১৮ সালের বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে পারেননি। বাংলাদেশে আসলেও ইজতেমায় অংশ না নিয়েই ফিরে যেতে হয় তাকে।
ওই বছরে ১ ডিসেম্বর টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়। সংঘর্ষে দুইজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এরপর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগ হয়ে পড়ে তাবলিগ জামাত। ২০১৯ সাল থেকে আলাদাভাবে বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলিগের কার্যকম পরিচালনা করেন তারা।
শফিকুল ইসলাম/অমিয়/