বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তিন দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়ে গত মঙ্গলবার তাকে চিঠি দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। একই সঙ্গে গিয়াস কাদের চৌধুরীর ছেলে শামীর কাদের চৌধুরী ও রাউজান উপজেলা বিএনপির দুই যুগ্ম আহ্বায়ককেও শোকজ করা হয়।
তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় দুষ্কর্মে সহযোগিতা, দেশি ও প্রবাসী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, চাঁদা না পেয়ে হুমকি প্রদর্শন, ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়াসহ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
রাউজানের বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ৫ আগস্ট দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হলেও রাউজান এখনো বন্দি। মার খেয়ে এলাকাছাড়া হয়েছেন আক্রান্তরা। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাউজান উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন সোহেল খবরের কাগজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে এক যুগ এলাকাছাড়া ছিলাম। এখন ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে ঠিকই, রাউজানের বিএনপি নেতা-কর্মীরা মুক্তি পায়নি। আওয়ামী লীগের আমলে এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন। এখন তার চাচাতো ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্ত্রাসীরা বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।’ তিনি মরতে মরতে বেঁচে গেছেন এ কথা উল্লেখ করে জানান, তিনি এবং তার দলের আরেকজন নেতাকে মেরে নদীর চরে ফেলে দিয়েছিল গিয়াস কাদেরের লোকজন। তিনি এখনো রাউজান যেতে পারেন না। একবার প্রাণে বেঁচে গেছেন। এখন রাউজান গেলে তাকে সরাসরি গুলি করার হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
রাউজান উপজেলার ১৩ নম্বর নোয়াপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. দৌলত খবরের কাগজকে জানান, তারা এলাকার মাদক ব্যবসা বন্ধে যুবশক্তি নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে প্রচার-প্রচারণা চালান। তাতে সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে পাথর মেরে তার দোকানের ডিজিটাল সাইনবোর্ড ভেঙে দেয়। দোকানের সাইনবোর্ড ভাঙার খবর শুনে তিনি দোকানে গেলে হাবিব, লাড্ডুম্যেসহ সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। এ সময় তাকে কিরিচ দিয়ে কোপ মারা হয়। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনার কিছুদিন পর তার ওপর আবারও হামলা করে। তিনিসহ কয়েকজন এখন চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করছেন। প্রাণের ভয়ে তারা দুই মাস ধরে রাউজানের গ্রামের বাড়ি যান না।
একই এলাকার বাসিন্দা মো. শওকত খবরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে যারা রাউজানে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। তারা এখন বিএনপি হয়ে গেছে। গিয়াস কাদের চৌধুরীর ছত্রচ্ছায়ায় বিএনপি নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের এলাকায় থাকতে দিচ্ছে না।
গিয়াস কাদেরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
ক. এলাকায় দলমত নির্বিশেষে ধনী ব্যবসায়ীর তালিকা করে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়। খ. ওমানে বসবাসরত সিআইপি ব্যবসায়ী ইয়াসিনের কাছে দেড় কোটি টাকা চাঁদা দাবি, চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ইয়াসিনের রাউজানের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া। গ. সিআইপি ব্যবসায়ী মো. ফোরকানের কাছে ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ফোরকানকে নির্মম নির্যাতন, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থানরত রাউজানের ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাও চাঁদাবাজির মাধ্যমে এলাকাকে আতঙ্কের জনপদে পরিণত করা। ঘ. স্বঘোষিত কমিটি ঘোষণা করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে বলা হয় রাউজান কমিটি গঠন করতে কারোর প্রয়োজন নেই, আমার এলাকা আমি করব। এ ধরনের বক্তব্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বের প্রতি চরম অনাস্থা ও ধৃষ্টতা এবং ঙ. দীর্ঘ ছয় বছর বিদেশে থেকে নতুন সরকারের শুরুতে দেশে এসে দেশ-বিদেশের সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে রাউজানে অস্থিরতা ও মারাত্মক আতঙ্ক তৈরি করেছেন গিয়াস কাদের চৌধুরী; যা রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ডসহ উত্তরের অন্যান্য নির্বাচনি এলাকায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে এসব কারণে তার বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার যথাযথ কারণ দর্শিয়ে তিন দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দলের নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলে রিং হয়। তবে তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও উত্তর দেননি।
নোটিশ দেওয়া হয়েছে গিয়াস কাদেরের ছেলে শামীর কাদের চৌধুরীকেও। নোটিশে বলা হয়, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আযম খানের এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে এলাকায় দুষ্কর্মে সহযোগিতা, দেশি ও প্রবাসী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, চাঁদা না পেয়ে কাউকে কাউকে হুমকি প্রদর্শনসহ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অনৈতিক অভিযোগের কথা উঠে এসেছে। রাউজান উপজেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য শামীর কাদের চৌধুরীকেও তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আযম খানের তদন্ত কমিটি একই ধরনের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হুদা চেয়ারম্যান ও ফিরোজ আহমেদ মেম্বারের বিরুদ্ধেও। তাদেরও তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল হুদা চেয়ারম্যান বলেন, তার বিরুদ্ধে কে অভিযোগ করেছেন, কেন করেছেন তা তার জানা নেই।
ফিরোজ মেম্বার বলেন, গিয়াস কাদের চৌধুরীর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের প্রতিপক্ষ কেন্দ্রীয় বিএনপির মাধ্যমে এসব করাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই। তারা তিন দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব দেবেন বলে উল্লেখ করেন। গিয়াস কাদের চৌধুরী বর্তমানে দেশে নেই বলেও জানান তিনি।