মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, সংবিধানে এমন সংস্কার চান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এক সেমিনারে তিনি বলেন, ‘সংস্কারের উদ্দেশ্য বলতে সেটিই বুঝি, যে সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্য নয় বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ একজন মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা হবে, তার ও পরিবারের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা এবং সঞ্চয় নিশ্চিত হবে।’
বৃহষ্পতিবার (১৪ নভেম্বর) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা: ৩১ দফার আলোকে সংস্কার’ প্রস্তাব নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করে বিএনপি। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ের রাষ্ট্রদুত এবং পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ ৩৮ দেশের কূটনীতিক, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।
তারেক রহমান বলেন, বর্তমানে আলোচিত প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবই আমাদের ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই রূপরেখা তৈরি হয়েছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা, খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০, বিএনপির জনসম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে প্রথমে প্রদত্ত ২৭ দফার ওপর ভিত্তি করে।
তিনি বলেন, আমি সংস্কার বলতে বুঝি- যে সংস্কার কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিটি নারী ও পুরুষের বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করবে, নারীদের সম্মান, স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন এবং মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। যে সংস্কার দেশের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, মানুষকে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল এবং কৃষক, শ্রমিক ও সব কর্মজীবী মানুষের ন্যায্য এবং প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত করবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা যেন ফিরে না আসতে পারে সেজন্য কেউ পরপর দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে চাই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজের জ্ঞানী-গুণীদের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য তরুণ ও বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান, আর কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত বেকার ভাতা প্রবর্তন। আমরা নিশ্চিত করতে চাই- সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ, তৃণমূলের ক্ষমতায়ন এবং আবারো ঐতিহাসিক খাল কাটা কর্মসূচির বাস্তবায়ন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, জ্বালানি, জলবায়ু, অর্থনীতি- সব ক্ষেত্রে আনতে চাই যুগোপযোগী আমূল পরিবর্তন। যেন তৈরী হয় দক্ষ মানবসম্পদ; বৃদ্ধি পায় রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, স্থাপিত হয় মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
তারেক রহমান আরো বলেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, কৃষক ও উৎপাদনকারীদের জন্য ন্যায্য মূল্য, চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও বহুভাষার প্রশিক্ষণ, বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা, এবং সবার জন্য পর্যায়ক্রমিক আবাসন সুবিধা ও সামাজিক সুরক্ষা- এই পরিকল্পনাগুলোকে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠী- সমতল-পাহাড়ি নির্বিশেষে সুষম ও সমঅধিকারের আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে একটি ঐকমত্যের ভিশন বলেই আমি মনে করি।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, দেশের প্রয়োজন এবং মানুষের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে ৩১ দফাকে সংযোজন, বিয়োজন, পুনর্বিন্যাস বা পরিবর্তনও করা যেতে পারে। তবে তা হবে জনমতের ঐক্যের মাধ্যমে। এই ৩১ দফাই একদিন আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য তথা সুখী ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ অর্জনের দ্বার উন্মোচন করবে- যা বিশ্ব মানচিত্রে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিল্পায়নে সাফল্যমণ্ডিত, অর্থনীতিতে গতিশীল, মানবসম্পদে সমৃদ্ধ, এবং সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত পাবে।
তারেক রহমান বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা আছে, সেটিই স্বাভাবিক। তবে ভিন্ন-ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার মাঝেও বৃহত্তর পরিসরে আমাদের সবার মাঝে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আদর্শিক ঐকমত্য রয়েছে। আমরা সবাই এমন দেশ গড়তে চাই, যেখানে আর কখনো ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না। আমরা সবাই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ চাই, যেখানে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নেবে না। নির্বাচিত ও জবাবদিহিমূলক সরকার নিশ্চিত করবে জনগণের মালিকানা ও অংশীদারত্ব।
শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা খুন, হামলা, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও তাদের শাস্তি দেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেড় হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে হত্যা করার পরেও আওয়ামী লীগের কোনো নেতার অনুতাপ বা অনুশোচনা নেই। অপরদিকে বিএনপির ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা থাকার পরও কেউ বিচ্ছিন্নভাবে কোনো অপরাধে জড়িত হলে আমরা জানামাত্রই দ্রুত সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছি।
তারেক রহমান বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার রাজনীতির ভিত্তি ছিল দুর্নীতি, দুঃশাসন ও দুর্বৃত্তায়ন। অন্যদিকে জনগণের ভোটে বিএনপি যদি সরকার গঠন করে তাহলে ৩১ দফার আলোকে জনগণের ক্ষমতায়ন ও অংশীদারিত্বের রাজনীতি দেখতে পারবেন। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হবে আইনের অনুশাসন, মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা। আমরা যদি একটি রুলস-বেসড রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে আসতে পারি তাহলে বিশ্ব থেকে বিভিন্ন বিনিয়োগ নিজ গতিতেই বাংলাদেশে আসবে।
গত ১৬ বছরে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে হরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তারেক রহমান বলেন, বিএনপি সরকারের সময় মিডিয়া নির্ভয়ে সরকারের সমালোচনা করতে পারতো, কার্টুন আঁকতে পারতো। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলবো যেখানে প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিষয়ে মন্তব্যের দায়ে কাউকে হেনস্থা করা হবে না। নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী, সংবাদকর্মী ও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে ইনশাআল্লাহ।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন পরিশেষে আমি বলতে চাই, গত ১৬ বছর ধরে এবং জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যারা ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সবার আত্মত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিটি শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণকে সম্মান জানিয়ে লুণ্ঠিত ভোটাধিকার ফিরিয়ে এনে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের সবাইকে এক হয়ে এগিয়ে যেতে হবে বহু দূরে। এই অগ্রযাত্রার গতি হতে হবে দ্রুত তবে স্থির; লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট।
সভাপতির বক্তব্য মির্জা ফখরুল বলেন, চলমান সময়ে চাওয়া সংস্কারগুলোর সঙ্গে আমাদের অধিকাংশ দফার মিল আছে। আমরা বিশ্বাস করি, ঐক্যবদ্ধ থেকে সফলতা অর্জন করতে পারব। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কেন লেখা, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়। ছাত্র জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘাড়ে বসে থাকা ফাসিবাদকে সরাতে পেরেছি।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও মিডিয়া সেলের সদস্য এডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুলের সঞ্চলনায় আরও বক্তব্য রাখেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম), রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এলিনা খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিএম এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এহসানুল হুদা, এনপিপির চেয়ারম্যান এডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাগপার সিনিয়র সহ সভাপতি রাশেদ প্রধান প্রমুখ।
শফিকুল ইসলাম/এমএ/