
২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তাগাদা দিয়েছে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি। তারা বলছে, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও তার প্রেস সচিবের বক্তব্য অস্পষ্ট ও পরস্পরবিরোধী। তারা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসের মধ্যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। নির্বাচনি সংস্কারগুলো শেষ করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভোট দেওয়া সম্ভব। দলগুলোর দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বিএনপি।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রথমে ১২-দলীয় জোট, পরে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির (ইরান) সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। তিন বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে অংশ নেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। বৈঠক বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শুরু হয়ে শেষ হয় রাত সাড়ে ৮টার দিকে। শনিবার দুই জোট ও দল মিলিয়ে অন্তত ২৪ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া আরও অন্তত ২৬টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ দেশের সামগ্রিক ইস্যুতে মতামত দেয় জোট ও দলগুলো। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। বৈঠকে বিএনপির নেতারা বলেছেন, যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হবে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া দল ও জোটের একাধিক নেতা জানান, বৈঠকে মূলত নির্বাচনের রোডম্যাপের ব্যাপারে মতামত চেয়েছে বিএনপি। আমরা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬-এর প্রথমার্ধে নির্বাচন করার কথা বলেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেননি। আবার তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তাদের এই ধরনের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক। যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। ফলে আমরা দ্রুত নির্বাচন চাই। ২০২৫ সালই এই সরকারের নির্বাচন আয়োজন করার জন্য যথেষ্ট সময়।
তারা আরও জানান, ইতোমধ্যে কিংস পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। ‘জনশক্তি’ নামে অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ নতুন কিংস পার্টি গঠন করতে চাইছেন। নির্বাচন করতে কালক্ষেপণের পেছনে এটা অনেকটা দায়ী। সরকারের ‘অনুকম্পা’ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল যেন না হয়। তারা যদি দল করতে চান, তাহলে সরকার থেকে পদত্যাগ করে সরাসরি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলুক।
১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক ও সামগ্রিক ইস্যুতে বিএনপি আমাদের মতামত নিয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন চাই।’
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের কাজের গতি ও দক্ষতা থাকলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। আমরা মনে করি, ২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হওয়া দরকার।’
সূত্র জানায়, নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে আলোচনা চালাবে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কের মুখে ফেলতে চায় না বলেই রাজপথে আন্দোলনে নামার কথা ভাবছে না দলটি। তবে আগামী বছরের শুরুর দিকেই নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা চায় বিএনপি। বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা বলেছেন, নির্বাচন ইস্যুতে সরকারপ্রধানের ঘোষিত সম্ভাব্য সময়ের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে তুলতে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তিতে বহু আয়োজন চলছে। এসব কথা বিবেচনা করেই রাজপথের আপাতত কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি।
সমমনা দলের নেতারা বলেন, ‘গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি দীর্ঘ বছর ধরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি। তাই জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ হলে জনগণও তা ভালোভাবে নেবে না। এখন প্রধান উপদেষ্টা, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করবেন বলে আমরা আশা করি।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ডা. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাই। বিশেষ করে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। জনগণের সরকার দ্রুত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করা যাবে না।’
১২-দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, সমসাময়িক রাজনীতি, আগামী নির্বাচন ও পঞ্চদশ সংশোধনীর রায়ের পর গণভোট-ব্যবস্থা আলোচনায় স্থান পায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়নি। নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে আন্দোলন করেছি, হাসিনার পতনের এক দফা দাবির বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু আমাদের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সেই লক্ষ্যেই এই আলোচনাগুলো হচ্ছে। যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা ও তার প্রেস সচিবের বক্তব্যে মিল নেই, তাই নির্বাচনের সময় নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না।’
বিকেল সাড়ে ৪টায় বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ১২-দলীয় জোটপ্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তাফা জামাল হায়
দারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাগপার সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, জমিয়তে উলামায় ইসলামের মহাসচিব মুফতি গোলাম মুহিউদ্দিন ইকরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ব্যাপারী, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজসহ জোটের শীর্ষ ১২ নেতা।
অন্যদিকে এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে বৈঠকে অংশ নেন জাগপার আরেক অংশের সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, গণদলের চেয়ারম্যান এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চেয়ারম্যান আবু তাহের, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান এম এন শাওন সাদেকীসহ জোটের শীর্ষ নেতারা। লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও মহাসচিব খন্দকার মিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি।