জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠক কার্যত সর্বদলীয় বৈঠকে পরিণত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, ‘ঐকমত্যের সুযোগ যেন আমরা হাতছাড়া না করে ফেলি।’
তবে বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে যাওয়ার একটি কারণও নেই। অন্যদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জুলাই সনদের আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নয়।’ তবে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। অবশ্য বৈঠকে নেওয়া বেশির ভাগ দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে।
সোমবার (২ জুন) রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিকেল ৪টায় বৈঠক শুরু হয়। সাড়ে ৩ ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে ২৮টি রাজনৈতিক দল ও দুটি জোট অংশ নেয়।
ছয় সংস্কার কমিশনের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার বৈঠক ছিল এটি। আজ মঙ্গলবার সকালে আবারও বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করবে। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই মনে করি, ডিসেম্বরে নির্বাচন সম্ভব। এর আগেই জরুরিভিত্তিতে নির্বাচনমুখী যে সংস্কার, সেগুলো চিহ্নিত করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা যায়। এমন কোনো সংস্কার নেই, যা এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। শুধু সংবিধান ছাড়া অন্যান্য যে সংস্কার আছে, তা নির্বাহী আদেশে বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে এক মাসের ভেতরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, যেটা আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি। সংস্কার বিষয়ে আমরা তিন দিন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সংস্কার কমিশন অন্যান্য দলের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। আমরা আমাদের মতামত লিখিতভাবেও দিয়েছি এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে কাছাকাছি আসতে পেরেছি।’
বৈঠকে অধিকাংশ দলই ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা সেটি বিবেচনা করবেন। প্রধান উপদেষ্টা নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করবেন। কারও প্রতি রাগ-বিরাগ, অভিমান প্রদর্শন করবেন না। তবে জাতি তার কাছে নিরপেক্ষতা আশা করে।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংবিধান সংশোধনের যেসব প্রস্তাব বিভিন্ন দল দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ওনারা যেভাবে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তাতে আগামী এক মাসের মধ্যে একটা ঐকমত্যে আসা সম্ভব বলে মনে করি। কিছু কিছু বিষয়ে অবশ্যই দ্বিমত থাকবে, সব বিষয়ে সবাই একমত হবেন, এমনটা আমরা আশাও করি না। যেসব বিষয়ে আমরা একমতে আসতে পারব, সেটা অবশ্যই পরবর্তী সংসদে পাস হবে। এসব বিষয়ে এখন ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সনদ স্বাক্ষরিত হলেই হবে। আশা করি, আর বেশি সময় নেবেন না। এই মাসের মধ্যে একটা কম্পাইল করা সম্ভব হবে।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিল সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বৈঠকে অংশ নেন।
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মাঝে নির্বাচন চায় জামায়াত
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেছেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। জুলাইয়ের মাঝে সংস্কার শেষ করতে হবে। বেশির ভাগ বিষয়ে একমত হয়েছি। যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছে না তাও আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যাবে বলে মনে করি। একেবারে একমত না হলে কী করা যাবে তা নিয়ে আলোচনা করব।’
তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের মধ্যে রিফর্ম হবে। তারপর একটি জুলাই সনদ হবে, তাতে আমরা সব দল নীতিগত একমত- এই চার্টারে আমরা স্বাক্ষর করব।’
জামায়াতের এই সিনিয়র নেতা বলেন, ‘নির্বাচনের তারিখ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূসের ওপর আস্থা আমরা পুনর্ব্যক্ত করেছি। একটা সফল সুন্দর নির্বাচন হোক, তা-ই চেয়েছি। নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে তিনটি বক্তব্য এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ডিসেম্বর থেকে জুন। কিছু রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে চেয়েছেন। আমরা বলেছি মে ও জুন মাসে নির্বাচন করার জন্য উপযুক্ত সময় নয়। সে অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টার কমিটমেন্ট রাখতে গেলে জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝে নির্বাচন হতে পারে। আমরা বলেছি মাঝেখানে একটা তারিখ ঘোষণা করুন। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মাঝে একটা তারিখ দিলে জনমনে যে শঙ্কা এবং অস্বস্তি আছে তা ঠিক হয়ে যাবে।’
নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ: নাহিদ
এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আগামী ৫ আগস্ট আমাদের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হবে। এটি আমরা উদযাপন করতে চাই। ৫ আগস্টের আগেই জুলাই মাসে যেন জুলাই সনদ রচিত হয়। জুলাই সনদের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা এবং শাসন কাঠামো দেখতে চান। জুলাই সনদ হওয়ার আগে যেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না করা হয়। এতে সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘যেসব রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে আমরা তাদের প্রতি এবং সরকারের প্রতি আহ্বান রেখেছি, ১৬ বছর অপেক্ষা করেছি, ১০ মাস অপেক্ষা করেছি, আরও ২ মাস যেন অপেক্ষা করি। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি এবং সরকারকে সময় দিই। এ দুই মাসের মধ্যে আমরা জুলাই সনদ রচনা করে ফেলি।’
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ‘জুলাই সনদের পরেই সরকার যেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দেয়। জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য ৩০ কার্যদিবস ছিল, সেটা অনেক কার্যদিবস হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। আমরা আহ্বান জানিয়েছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেন জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়িত হয়। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার, নির্বাচন কমিশন আইন সংস্কার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা উচিত।’
অন্য দলের নেতারা যা বললেন
বৈঠক শেষে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। আমরা বলেছি, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। এখন ডিসেম্বর থেকে কোনো কারণে নির্বাচন পেছালে তাহলে বাড়তি সময় কেন লাগবে, তা সরকারকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা জনমনে আশঙ্কা তৈরি করছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করতে সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা তিনটি প্রস্তাব দিয়েছি। প্রথমত, কোনো সংস্কার গুরুত্বসহকারে করবেন, কত সময় লাগবে তার রোডম্যাপ। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে খুনি শেখ হাসিনাসহ তার দোসরদের বিচার দৃশ্যমান করা। তৃতীয়ত, ডিসেম্বর থেকে জুন, কোন মাসে করবে তা নির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়েছি।’
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন কী অর্জন করতে চায় তার লিখিত ফ্রেমওয়ার্ক থাকা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার ১০ মাসে কী কী করেছে, তার আমলনামা বা খতিয়ান জনগণের কাছে প্রকাশ করা দরকার। প্রত্যেক উপদেষ্টার আমলনামা দেওয়া দরকার। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি দিনক্ষণে পৌঁছানো যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আগামী জুনের মধ্যে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদের কাজ শেষ করতে আহ্বান জানিয়েছি। পাশাপাশি বিতর্কিত পদক্ষেপ থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছি।’
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে জামায়াতের হামিদুর রহমান আযাদ, ১২-দলীয় জোটের মোস্তফা জামাল হায়দার ও শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস, খেলাফত মজলিসের ড. আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এনসিপির আখতার হোসেন ও সারোয়ার তুষার, এনডিএমের মোমিনুল আমিন, জেএসডির শহীদ উদ্দীন মাহমুদ স্বপন, সিপিবির সাজেদুল হক রুবেল, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, বাংলাদেশ জাসদের ডা. মুশতাক হোসেন, নাগরিক ঐক্যের সাকিব আনোয়ার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, এলডিপির লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান সোহরাওয়ার্দী ও ড. নেয়ামুল বশির, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল ইসলাম নুর, আমজনতা পার্টির মিয়া মশিউজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।