
একাত্তরের শহিদের রক্ত দিয়ে লেখা যে সংবিধান, সে সংবিধানকে যখন কবর দেওয়ার কথা বলা হয় তখন কিন্তু আমাদের কষ্ট লাগে, বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আমার সঙ্গে থাকা অনেক সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব মারা গেছে, প্রায় ৩০ লক্ষ শহিদ হয়েছে। আমরা তোমাদের সিনিয়র, অগ্রজ হিসেবে কষ্ট পাই, এটা কী করছো? এটা করা কি ঠিক হলো? ঐ সংবিধানে যদি খারাপ কিছু থাকে নিশ্চয় সেটা বাতিল যোগ্য। যদি নতুন কোনো সংবিধান লিখতে হয় তাও তো লিখতে হবে, আগের অমুক সালের সংবিধান বাতিল করে এই সংবিধান জারি করা হলো। সুতরাং এই সংবিধানকে সংশোধন করা যাবে।
রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর নয়াপল্টনের একটি রেস্টুরেন্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজুনর সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির বাণিজ্য বিয়ষক সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সহ-সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন, যুগ্ম-আহ্বায়ক সাইদুর রহমান মিন্টু প্রমুখ।
মির্জা আব্বাস বলেন, সংবিধান কোনো রাফ খাতা নয়, যে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। কবর দিয়ে দেব, মেরে ফেলব, কেটে ফেলব-এই কথাগুলো কিন্তু ফ্যাসিবাদের কথা। জাতি তাকিয়ে আছে তোমাদের (বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের) দিকে, আমরাও তাকিয়ে আছি তোমাদের দিকে। তোমাদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা আমরা আশা করি না।
তিনি বলেন, কিছু লোক বাহির থেকে সরকার গঠন করে ফেলেছেন মনে হয় এরকম। তাদের কথাবার্তার ঝাঁঝ, আজকে ছাত্র ভাইদের কথাবার্তার যে ঝাঁঝ একই রকম। আমরা তাহলে ৭১ সালে কী করলাম? আমরা কি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে অন্যায় করেছিলাম? আমি জানি, একটা পক্ষ বলবে, হ্যাঁ, ঐদিন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে অন্যায় করেছেন। এই দেশ স্বাধীনের পর বাকশাল কায়েম করল আওয়ামী লীগ, আর শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরের দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে মির্জা আব্বাস বলেন, শেখ হাসিনা চলে গেলেও তার প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে। সচিবালয়ে এখনো ৮ জন ফ্যাসিবাদের দোসর রয়েছে। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বসে আছেন। এতো বিরোধীতার পরও দুই-তিন দিন আগে সচিবালয়ে বাকশালের প্রাক্তন সচিবকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বাকশালের প্রেতাত্মা কি সংস্কার হবে? আমরা কি আবার আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আসার রাস্তা করে দিচ্ছি? জাতির মনে প্রশ্ন জাগে, আমার মনেও প্রশ্ন জাগে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এককভাবে কৃতিত্ব দাবি করা ঠিক না মন্তব্য করে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, এই আন্দোলন যখন নিভু নিভু করে তখন কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও জনগণ সবাই সামনের দিকে এগিয়ে আসে, আমরা এগিয়ে যাই। এই আন্দোলনে বিএনপির ৪৬২ নেতা-কর্মী মারা গেছে। নিশ্চই নেতৃত্বে একজন থাকবে, পিছনে হাজারো লোক থাকবে কিন্তু এককভাবে কেউ কারো দাবি করা ঠিক না। এতে কিন্তু জনমনে বিভেদ-বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, আগামী দিনে কেউ যদি বলে আমরা তোমাদের সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সেদিন তোমাদের কেমন লাগবে? তোমাদের মতো আগামী দিনে যদি কেউ চলে সেদিন কী হবে? আমাদের প্রতিবেশী দেশ কখনো বাংলাদেশকে স্থির থাকতে দিতে চায় না। আজকে কেউ কেউ তো চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর নিয়ে যায়। বাংলাদেশ নিয়ে বলতেছে হরিলুটের মাল বাংলাদেশ। না, সম্ভব না। এই যে আগুন, আনসার বিদ্রোহ এসমস্ত বিষয়গুলোর পেছনে কেউ না কেউ উস্কানি দিচ্ছে। তারা সচিবালয়েই বসে আছে। তারা আজকে উপদেষ্টাদের সহযোগী হয়ে আছেন। সবাইকে কিন্তু আমরা চিনি।
তিনি বলেন, চব্বিশের আন্দোলনকে কেউ ব্রান্ডিং করার চেষ্টা করবেন না। জাতির মধ্যে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টি করবেন না। সংবিধানের যারা অপব্যবহার করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। এত কষ্টের অর্জন, হাসিনার পতন সেই কষ্টের অর্জনকে দয়া করে কয়েকজন লোকেরায় ইশারায় কথা বলে, বালখিল্যতা করে জাতিকে বিভক্ত করবেন না, এটা আমার অনুরোধ।
মির্জা আব্বাস বলেন, নির্বাচন দিলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এটা আমরা ভাবি না। বিএনপি অত্যন্ত একটা জনপ্রিয় দল। আমরা ভোটের অধিকার চাই, নির্বাচন চাই। এই ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য ১৭ বছর আন্দোলন করেছি, আমিসহ পরিবারের অনেকের সাজা দেওয়া হয়েছে। এই আন্দোলন কি একেবারে কোনো কাজে আসেনি? কেউ যদি ভাবেন আমরা আসমান থেকে নাযিল হয়েছি, সারাদেশ আমাদের নিয়ন্ত্রণে, এটা কিন্তু খুব ভালো লক্ষণ নয়।
শেখ মুজিবের আমলে চারটি সংবাদপত্র বাদে সবগুলো বন্ধ দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের সংবাদপত্র বরাবরই স্বাধীন ছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নেই, মালিকপক্ষ যা বলে তাদেরকে তাই করতে হয়। তাই আমাদের এমন জায়গায় যেতে হবে যাতে সাংবাদিকরা তার আসল কথা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে।
সভাপতির বক্তব্য রফিকুল আলম মজনু বলেন, গত ৫ আগস্টের পর বিএনপি বা অঙ্গ সংগঠনের নামে যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, চাঁদাবাজি করেছেন তাদেরকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছি। আগামী দিনেও দলের কেউ অপর্কম করতে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। ছাত্র-জনতার অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয়কে আমরা নষ্ট হতে দেব না।
মাহফুজ