জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভয় ধরাতে সরকারের বিরামহীন তৎপরতা ছিল। এর লক্ষ্য ছিল ছাত্র আন্দোলন কোনোমতেই যেন যৌক্তিকতা না পায়। গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পরই সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছিল যে গ্রীষ্মের এই আন্দোলন সরকারের জন্য গলার কাঁটা হতে চলেছে। তাই আন্দোলন দমানোর অংশ হিসেবে ছাত্রলীগকে মাঠে নামানো হয়। ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের নানা হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। ১৫ জুলাই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ওই হামলার জন্য ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উসকানি দিয়েছিলেন এবং সংগঠিত করেছিলেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ‘জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১১ জুলাই ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আন্দোলনকারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘কেউ কেউ আন্দোলনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তাদের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ছাত্রলীগ।’ তার হুঁশিয়ারির পর ওই দিনই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের মিছিলে লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ছাত্রদের এত গাত্রদাহ কেন? যদি মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা কোটা সুবিধা না পায়, তা হলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা সুবিধা পাবে?’
শিক্ষার্থীরা তার ওই বক্তব্যে ফুঁসে ওঠেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর বলা ‘রাজাকার’ শব্দটিকে ব্যক্তিগতভাবে নেন। ওই দিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমে আসেন। তারা স্লোগান দিতে থাকেন ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রী হলের তালা ভেঙে রাতেই সেই মিছিলে যোগ দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাতে ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উসকানি দেন এবং তাদের সংগঠিত করেন। পরের দুই দিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা চলতে থাকে। বিক্ষোভকারীরাও বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের ওপর পাল্টা হামলা চালান। এভাবে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। হামলায় পুলিশ ছাত্রলীগের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। শটগানের গুলি ছোড়ে। এই অবস্থায় ১৬ জুলাই দেশব্যাপী বিভিন্ন হামলায় ছয়জন নিহত হন। তাদের একজন ছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগের বেশির ভাগ হামলা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও এসব হামলায় অংশ নেন। ধারালো ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হয়। আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব হামলায় উসকানি দেন। ১৪ জুলাই রাত থেকে শুরু করে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ১৪ জুলাই রাত ৩টায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমর্থকদের উদ্দেশে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘সোমবার (১৫ জুলাই) থেকে বাংলাদেশের রাস্তায় কোনো রাজাকার থাকবে না। প্রতিটি জেলা, নগর, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের প্রতি সুষ্পষ্ট নির্দেশনা, যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উপহাস করবে, তাদের রাস্তায় মোকাবিলা করা হবে।’
১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা এখন মারমুখী। আমরাও তাদের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ছাত্রলীগ কোটা আন্দোলনকারী নেতাদের মন্তব্যের জবাব দিতে প্রস্তুত। আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় রাজাকার নিয়ে যে ধরনের স্লোগান দিয়েছে, তাতে আমাদের জাতীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত হেনেছে। আমরা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করব।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্লোগান দিয়েই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা ওএইচসিএইচআরকে এসব বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, মোটরবাইকে হেলমেট পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সংঘবদ্ধ পদ্ধতিতে হামলা চালিয়েছেন।
১৪ জুলাই সন্ধ্যার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা স্লোগান দেন, ‘চাইতে গিয়ে অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’ ছাত্রলীগ কর্মীরা সেখানে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে হামলা চালান। বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আহত হন। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে মিছিল বের হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্দোলনকারীও একই সময়ে মিছিল বের করলে বিজয় একাত্তর হলে প্রথম সংঘর্ষ হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা সহকর্মীদের মুক্ত করতে জিয়াউর রহমান হলে যান। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাদের আটকে রেখেছিলেন। ছাত্রলীগের সমর্থকরা এ সময় হেলমেট মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সশস্ত্র অবস্থান নেন। বেলা ৩টায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ক্যাম্পাসে হামলা চালান। এ সময় ছাত্রীদেরও নির্মমভাবে পেটানো হয়। তাদের লাঞ্ছিত করা হয় এবং ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়।