
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নানা ধরনের আলাপ হচ্ছে। বিগত সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা (বর্তমানে নিষিদ্ধ) শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধের কারণে প্রথমে দাবি উঠেছিল ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার। একই সঙ্গে কার্যকর ছাত্র সংসদ চালুর। তবে ছাত্রদলের কার্যক্রম ও শিবিরের আত্মপ্রকাশের পর নিষিদ্ধের পরিবর্তে আলাপ শুরু হয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চলবে না।
কিন্তু এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন ছাত্রসংগঠন আনছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে ছাত্ররাজনীতির সমীকরণ পাল্টে যাবে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও নতুন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কোনো ছাড় দেবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে ত্রিমুখী সংঘাত কিংবা বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েটে) ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরপর একে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি, বক্তব্য ও কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ক্যাম্পাসগুলোতে দীর্ঘদিন পর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হন শিক্ষার্থীরা। বাধ্যতামূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ থেকে মুক্তির পাশাপাশি গণরুম, গেস্টরুম সংস্কৃতি থেকেও রেহাই মেলে। অনেক আবাসিক হলে মেধার ভিত্তিতে বণ্টন করা হয় সিট। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রাখা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজে যুক্ত হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ‘সমন্বয়করা’ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দেন। এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি নেওয়া হয় ছাত্রসংগঠনগেুলোর পক্ষ থেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে নিজেদের তুলে ধরার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
ক্যাম্পাসে সংঘাতের শঙ্কা
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জুলাই আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী পরস্পরের বিরুদ্ধে সমালোচনায় লিপ্ত হন। শিবিরের বিরুদ্ধে গোপন রাজনীতি করা নিয়ে ছাত্রদলের শীর্ষ পর্যায় থেকেও মন্তব্য করা হয়। দুই দলের অনুসারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে ব্যাপক বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশাসনের বৈঠকে দুই সংগঠনই ভিন্নমত পোষণ করে। এর মধ্যে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো থেকেও শিবিরের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে ছাত্রদের নতুন দল গঠন নিয়ে বিরোধ।
গত সোমবারই নতুন ছাত্রসংগঠন গঠন করার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়করা। এরপরই ছাত্রদলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী প্রতিক্রিয়া দেখান। ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের স্লোগান দেওয়া ব্যক্তিরাই আবার ছাত্রসংগঠন তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন ছাত্রদলের এক নেতা। পরক্ষণেই সেই মন্তব্যের ‘স্ক্রিনশট’ নিয়ে অন্যরা এটাকে সংঘাতের রাজনীতির সূচনা বলে মন্তব্য করেন। গতকাল কুয়েট ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় রামদা হাতে দেখা যায় বহিরাগতদের। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিবির ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বলা হচ্ছে।
এ নিয়ে ফেবসুকে পাল্টাপাল্টি পোস্ট দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির লেখেন, ‘ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনীতি করার সুযোগ দিলে যেকোনো ধরনের সংঘাত এড়ানো সম্ভব। কথিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে গোপন সংগঠন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের আড়ালে বিরাজনীতিকীকরণের চেষ্টা করা হলে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস হবে এবং শুধু বাংলাদেশবিরোধী গোপন নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাড়বে।’
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন লেখেন, ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের সহযোগী থেকে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পুনরায় আত্মপরিচয় লুকিয়ে ছাত্রলীগের মতো ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে চাইবে, তাদের বিরুদ্ধে অতীতের মতোই নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তার লড়াই-সংগ্রাম জারি রাখবে।’
শিবিরের ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক লেখেন, ‘আমার ভাইবোনদের ওপর নৃশংস সন্ত্রাসী হামলায় রক্ত ঝরাল ছাত্রদল। কুয়েটে ছাত্রদলের সংঘবদ্ধ হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ছাত্র-জনতা আবার রুখে দাঁড়াও। নব্য ফ্যাসিজমের সম্ভাবনাকে গুঁড়িয়ে দাও। জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে দখলদারত্বের রাজনীতির কিছুতেই প্রশ্রয়-আশ্রয় দেওয়া হবে না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুকে পেজে পোস্ট দেওয়া হয়, ‘ছাত্রদলের সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াও ছাত্রসমাজ।’ কুয়েটে ছাত্রদলের হামলার প্রতিবাদে ঘোষণা করা হয় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি। অন্যদিকে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ থেকে উল্টো ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করা হয়েছে দাবি করে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দেওয়া হয়। সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ লেখেন, ‘যে ছাত্রলীগ হয়ে উঠতে চাইবে তার পরিণতি ছাত্রলীগের মতো হবে।’
ছাত্রসংগঠনগুলোর এসব কার্যক্রম নিয়ে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকে একজন লেখেন, ‘এ দেশে ছাত্ররাজনীতি কোনোদি ন ভালো হবে না।’
কেমন হবে নতুন ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম
নতুন ছাত্রসংগঠনের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের কোনো মাদার সংগঠন থাকবে না। আমাদের কমিটি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই সংগঠনের নেতা হবেন। আমরা শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি পালন করব। যখন লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি হয়, তখন কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া উপেক্ষিত থাকে। যখন আপনি মাদার সংগঠনের কাছে ধরা থাকবেন, সেখানে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ উপেক্ষিত থাকবে। আমরা জুলাই স্পিরিটকে ধারণ করে শুধু শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করব।’
তবে তার এই বক্তব্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের ধারণা, জাতীয় নাগরিক কমিটি যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবে সেই দলের ছাত্রসংগঠন হিসেবে কাজ করতে পারে নতুন ছাত্রসংগঠনটি। নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর একটা মন্তব্য ফেসবুকে আলোচনায় এসেছে। সেখানে তিনি নতুন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত হতে আগ্রহীদের আবু বাকের মজুমদারের নম্বর দিয়ে কথা বলতে বলেন। একই সঙ্গে দুই প্ল্যাটফর্ম থেকেও একই ধরনের প্রচারণা দেখা গেছে।
ছাত্ররাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ফেসবুকে সরব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি জুলাই অভ্যুত্থানের দিকে তাকাই তবে দেখব নেতৃত্বের কেউ সাধারণ ছাত্র ছিল না। প্রায় সবাই ছিল কোনো না কোনো পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যার ফলে অভ্যুত্থানের পরে কিছুদিন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের হাইপ থাকলেও এখন সেটা নেই। এখন বরং নতুন নতুন ছাত্রসংগঠন তৈরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, সাবেক গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব; এই ৩টা পক্ষই মূলত জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করেছে। নতুন রাজনৈতিক দলের মূল নেতাও তারা হবেন বলেই মোটামুটি সবাই নিশ্চিত। এখন নতুন ছাত্রসংগঠনের ঘোষণাও তারাই দিচ্ছেন। নতুন ছাত্রসংগঠন হবে নতুন রাজনৈতিক দলের মতোই মধ্যপন্থি। অর্থাৎ আদর্শিক দিক থেকে দুটি দল একই হবে। সবকিছু মিলিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে সবাই এটাই বিশ্বাস করে যে, নতুন দলের ছাত্রসংগঠনের দায়িত্বই পালন করবে নতুন ছাত্রসংগঠনটি।