আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনায় আগের মতোই যে যার অবস্থানে অনড়ই থেকেছেন। বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করেছে। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এতে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে আরেক ধাপ অনিশ্চয়তা তৈরি হলো। ফলে এই অনিশ্চয়তা কীভাবে দূর হবে বা রাজনৈতিক এই অচলাবস্থা কীভাবে কাটবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা আলোচনা রয়েছে। বিশ্লেষকরাও এ বিষয়ে নানা মতামত দিচ্ছেন।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখনই করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে নির্বাচন করলে সমস্যাগুলোর অনেকটা সমাধান হবে। এ ছাড়া নির্বাচিত সরকার সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে বড় সংস্কারগুলো নিয়ে কাজ করতে পারবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সংস্কার কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো দু-এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। তাদের আশঙ্কা- নির্বাচন পেছালে আওয়ামী লীগের দোসররা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে, দেশ ক্ষতিগ্রন্ত হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দ্রুত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা বর্তমানে দেশের সব রাজনৈতিক দলের অন্যতম দাবি। জনগণকে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনের দিনক্ষণের জটিলতার সমাধান হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলীয় ফোরামে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- কীভাবে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারি। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল এবং গণতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে যাবে।’
দলীয় সূত্রমতে, আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিএনপি সমমনা দলগুলোর মতামত নেওয়া শুরু করেছে। এরপর দলীয় ফোরামে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আপাতত রাজপথের বড় কোনো আন্দোলনে যাবে না বিএনপি। শিগগিরই মহানগর ও জেলা পর্যায়ের সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
জানা গেছে, গত বছরের ৬ আগস্টের পর থেকেই নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নানা তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা এখনো স্পষ্ট করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। সর্বশেষ বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা তার আগের বক্তব্য ধরেই ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। এর আগে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও তিনি একই কথা বলেন। এ ছাড়া বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমকে প্রধান উপদেষ্টা জানান, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে এই সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। দলটি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পাওয়ায় বিএনপিতে নতুন করে সংশয় তৈরি হয়েছে।
তবে মৌলিক সংস্কার ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার করার পর নির্বাচনের দাবি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ও এনসিপি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনেকটাই একই স্ট্যান্ড নিয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। তবে জামায়াতে ইসলামী বিগত আট মাসের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলছে। দলটি এখন আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচনের দাবি তুলছে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন দেশের সাধারণ জনগণ। কিন্তু ওই বৈঠকে কোনো ঐকমত্য বা সুরাহা না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে এখন নতুন করে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। অনেকের মধ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ‘অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর, তারা নির্বাচিত’- দু-একজন উপদেষ্টার এমন বক্তব্য নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে নির্বাচন নিয়ে সরকারের এই অবস্থান ও বক্তব্য মানতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলো।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন। সবার মত এক হবে না, এটা স্বাভাবিক। সরকারও তার সুবিধামতো সময়ে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করতে চাইছে। মূলত নির্বাচনের টাইমলাইন নিয়ে প্রত্যক দল আলাদা মতামত দিচ্ছে। এর মধ্য থেকে যেকোনো একটা সময় সরকার বেছে নিলে সংকট বা অচলাবস্থা কেটে যাবে। নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে বলে মনে করছি না।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনের টাইমফ্রেম নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। আমরা নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রে মৌলিক সংস্কার ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যাসহ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার চাই। এসব যদি ডিসেম্বরের আগে শেষ করা সম্ভব হয়, তাহলে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে কোনো বাধা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনীতির ধারা ও লক্ষ্য হলো দেশের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত ১৬ বছরে তিনটি নির্বাচনে দেশের জনগণ ভোট দিতে পারেনি। দেশের মানুষও দ্রুত নির্বাচন চায়। তাই দ্রুত নির্বাচন দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমি মনে করি, সরকার এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব বা বিরোধ তৈরি হয়। তারা দলনিরপেক্ষ সরকার, ফলে তাদের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকার কথা নয়। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বর সামনে রেখে তৎপরতা চালাচ্ছে, ঐকমত্য কমিশনও তাদের কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ডিসেম্বর কেন, চাইলে আরও দুই মাস আগেও জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। সুতরাং এটা নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। বাস্তবে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না সরকার। আধা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশে একটা অচলাবস্থা চলছে। নির্বাচিত সরকার না এলে দেশে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবেন না। তার আশা, নির্বাচনের দাবি আদায়ে বড় কোনো আন্দোলন নামা লাগবে না। প্রধান উপদেষ্টার কালকের (বুধবার) বক্তব্য শেষ কথা নয়। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানে আসা যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিশিষ্টিজনের অভিমত পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন-
>সংস্কারের ভিত্তি মজবুত করতে নির্বাচন জরুরি: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
>রোডম্যাপ জানালে বিভ্রান্তি দূর হবে: আনু মুহাম্মদ
>সমস্যার সমাধান হবে রোডম্যাপ দিলে: ড. শাহদীন মালিক