জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় একমত প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে দলটি নিম্ন ও উচ্চ- উভয়কক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চায়। যদিও কমিশনের প্রস্তাবে সংখ্যানুপাতিকে উচ্চকক্ষের কথা বলা হয়েছে। জামায়াত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে একমত হলেও তাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে রাখার পক্ষে নয়। অন্যদিকে দলটি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুইবার থাকার পক্ষে মত দিয়েছে। যদিও ওপরের তিনটি বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দ্বিমত জানিয়ে রেখেছে বিএনপি।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় সংস্কার প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় সংসদের এলডি হলে জামায়াতের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শুরু হয় বেলা ১১টায়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের বক্তব্যের পর শুরু হয় রুদ্ধদ্বার আলোচনা। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিয়ে আলোচনা চলে বিকাল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত। এদিন শুধু সংবিধান সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে বৈঠক মুলতবি করা হয়। সুবিধাজনক সময়ে মূলতবি বৈঠক শুরু হবে।
ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, আমরা আজকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল এখানে এসেছি। দীর্ঘ সময় আলোচনার পরও আমাদের আলোচনা অসমাপ্ত রয়েছে। বিষয়গুলো খুব পটেনশিয়ালি বের হয়ে আসা উচিত, এজন্য আমরা তাড়াহুড়ো করছি না। আজকের আলোচনায় আমরা (জামায়াতে ইসলামী) কিছু কিছু বিষয়ে একমত হতে পেরেছি। কিছু কিছু বিষয়ে আমরা তাদের (ঐকমত্য কমিশন) প্রস্তাব দিয়েছি। সেটা ওনারা বিবেচনার জন্য রেখেছেন। কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের আরো আলোচনার প্রয়োজন। সেজন্য সেগুলো আমরা পরের আলোচনার জন্য রেখেছি।
কমিশনের যেসব প্রস্তাবে একমত ও দ্বিমত
কমিশনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামী একমত হয়েছে। তবে নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক হারে (পিআর) উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করেছে দলটি। অথাৎ নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, উচ্চকক্ষে তত শতাংশ আসন পাবে। উল্লেখ্য, বিএনপি দ্বিকক্ষের সংসদ গঠনে রাজি হলেও, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে রাজি নয়।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই যে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি, সেখানে আমরা পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের কথা বলেছি। তার মানে সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন হবে মার্কা বা দলের ভিত্তিতে এবং যে দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই পরিমাণে সংসদে আসন নির্ধারিত হবে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের নির্বাচনে যে দুর্নীতি, জবরদখল হচ্ছে এবং ভোটবিহীন নির্বাচনের যে ফলাফল হচ্ছে এটি তখন বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার খেলাও বন্ধ হয়ে যাবে। এটা পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশে চর্চা হচ্ছে। গত তিন মেয়াদের নির্বাচন নিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য উত্তম হবে।’
ঐকমত্য কমিশনের জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৪ বছর করার প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করেছে জামায়াত। দলটি ৫ বছর রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছে । উল্লেখ্য, বিএনপিও চায় সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছরই থাকুক।
একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না অর্থাৎ দশ বছরের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না এই বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে জামায়াত। তবে বিএনপি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। বিএনপি চায়, পরপর দুই বারের পর একবার গ্যাপ দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। তারা একজন ব্যক্তির তিন বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে।
সংবিধানের আর্টিকেল-৭০ এর কিছু অ্যামেন্ডমেন্টসহ ঐকমত্য কমিশনের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে জামায়াত। সংবিধান পরিবর্তন, অর্থবিল বা বাজেট অনুমোদন এবং আস্থা ভোট ছাড়া বাকি যেকোনো বিষয়ে একজন সংসদ সদস্য যেকোনো দলের ও মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবেন এমন প্রস্তাব করেছে দলটি। সংবিধানের আর্টিকেল-৭০ জামায়াতের মতোই আস্থা বিল, অর্থবিল, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধনী বিল- এই চারটি বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন- এমন প্রস্তাব করেছে বিএনপি।
জাতীয় সংবিধান কাউন্সিলের (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে প্রস্তাবিত এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে চায় না দলটি। তবে বিএনপি এনসিসি গঠনের বিপক্ষে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে আগামী বৈঠকে আরও আলোচনা করতে চায় জামায়াত। সেসময় তারা তাদের প্রস্তাব পরিবর্তন করতে পারে।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে করে এনসিসি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেখানে তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির কথা বলেছেন। আমরা তাতে না বলেছি। ওনারা দুইজন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুইটি জায়গায় আছেন। দেশে জরুরি অবস্থায় অনেক সময় রাষ্ট্রপতির কাছে ধরনা দিতে হয়, অনেক সময় জুডিশিয়াল সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। তাই ওনাদের কমিটির ভেতর অন্তর্ভুক্ত না করাই ভালো হবে।এনসিসির কাঠামোগত দিকের সঙ্গে আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। এটা একটা নতুন প্রস্তাব।
সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ যুক্ত করার প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে জামায়াত। দলটির নায়েবে আমির বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়ার কথা আমরা বলেছি এবং আরেকটা প্রস্তাব করেছি, সেটা হলো- আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য।
আলোচনার উদ্দেশ্য জাতীয় সনদ তৈরি: আলী রীয়াজ
আলোচনার সূচনা বক্তব্যে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকারের নয়, এটা বাংলাদেশের গণমানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার ফলাফল। সংস্কারের এই গুরুদায়িত্ব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ প্রতিটি দায়িত্বশীল পক্ষকে অর্পণ করেছে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটা সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছি। তাই আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য থাকবে, একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা। যেখানে কোনো মানুষকে দ্বিতীয়বার বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের শিকার হতে হবে না।
ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত সংস্কারে সহযোগিতা করবে জামায়াত: ডা. তাহের
ইতিবাচক, বাস্তবসম্মত সংস্কারে জামায়াতে ইসলামী পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর সংস্কারে জামায়াত পরিপূর্ণভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। জামায়াত দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চায়।
চব্বিশের আন্দোলনে দেশ কতটা স্বাধীন হয়েছে, সেটা সময় বলে দেবে উল্লেখ করে ডা. তাহের বলেন, ৫৪ বছরে দেশের মানুষের ব্যাপক হতাশা তৈরি হয়েছে। নতুন যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা যেন অতীতের মতো হারিয়ে না যায়। সে জন্য আমাদের অনেক বেশি সাবধান হতে হবে।
আলোচনায় ডা. তাহের ছাড়াও অংশ নেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, নির্বাহী পরিষদের সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির। অপরদিকে, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।