
বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় বহির্বিশ্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির নেই কোনো কমিটি। দীর্ঘ ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র শাখা বিএনপির কমিটি হচ্ছে না। এ নিয়ে সেখানকার বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হামলা-মামলার রোষানলে পড়লেও তাদের নেই কোনো দলীয় পরিচয়। কমিটিবিহীন চলছে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির রাজনীতি। পদ-পদবি না পেয়েও অনেক নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ। দলীয় নানা কর্মসূচিও পৃথকভাবে পালন করছেন কেউ কেউ। এমন অবস্থায় বিগত দেড় দশকের ত্যাগ ও পরিশ্রমের মূল্যায়নের দাবি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা-কর্মীদের।
এদিকে অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ব্যানারে কর্মসূচি পালন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ কর্মসূচি পালন করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত ১৭ জানুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিতে তোলপাড় চলছে। সেখানকার নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন, এই নিষেধাজ্ঞা কাদের বিরুদ্ধে? তারা বলছেন, এখানে দলীয় শৃঙ্খলা কিংবা নিয়ম ভঙ্গ করার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। শুধু চলমান কর্মসূচি দলীয় ব্যানারে পালন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকন ভুল বুঝিয়ে এই চিঠি ইস্যু করিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট ও মহানগরের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে খোকন চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতি করেছেন। নিজ বলয়ের লোকদের নিয়ে ৫ থেকে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন। নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপির কমিটি গঠনের বিষয়ে খোকনের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অনেক বড় দেশ। তাই বিভিন্ন স্টেট কমিটির মাধ্যমে চলছে বিএনপি। তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি দেওয়ার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামীতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার নিজস্ব কোনো বলয় নেই, সবাই বিএনপির লোক। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই আমরা রাজনীতি করি।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অনেক বড় দেশ। এখানে এক স্টেট থেকে আরেক স্টেটে যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। আগে নিউইয়র্ক বেজড রাজনীতি হতো। এখন পর্যন্ত ১৮ স্টেটে কমিটি দিয়েছি। কোথাও অনৈতিক কিছু কেউ দেখাতে পারবে না।’
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিএনপির অন্তত ছয়জন সিনিয়র নেতা জানান, চাকরি ও পেশাগত কাজের পাশাপাশি তারা নিঃস্বার্থভাবে বিএনপির রাজনীতি করছেন। বিগত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বাধার মুখে পড়েও তারা থেমে থাকেননি। বিএনপিকে যুক্তরাষ্ট্রে সুসংগঠিত করেছেন। অথচ দলীয় পদবি না থাকায় এখন পরিবারের কাছেও এসব ত্যাগী নেতার সম্মান নেই। যুক্তরাষ্ট্রে দলীয় রাজনীতি ও কমিটির ব্যাপারে কেন্দ্রের উদাসীনতা, স্টেট কমিটির মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি পরিচালনার সিদ্ধান্তে চরম হতাশা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন প্রবাসের নেতা-কর্মীরা। তাই শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি দিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
দলীয় সূত্রমতে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভূমিকা ছিল নজিরবিহীন। শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফর ঘিরে তারা সংঘবদ্ধভাবে মানববন্ধন ও বিভিন্ন স্লোগান দেওয়ায় অনেকেই বাংলাদেশে মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত ১৫ বছর অনেকে দেশেও আসতে পারেননি।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাত মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠনের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ প্রবাসে ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কমিটি গঠন করেছিলেন সেখানে অবস্থারত বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পরে ১৯৯৬ সালে প্রথম কমিটি অনুমোদন দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সর্বশেষ ২০০৫-এ আব্দুল লতিফ (সম্রাট) ও জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে কমিটি দেওয়া হয়, যা ২০১২ সালে ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কয়েকবার কমিটি গঠনের ব্যাপারে আলোচনা ও লন্ডনে বৈঠক করলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। আর সর্বশেষ বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকনকে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির রাজনীতি আরও স্থবির হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, খোকনকে আমেরিকা-ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়ায় বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল থেকে আরও দুর্বলতর হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থারত বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানান, বিগত ১৫ বছর আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, বিভিন্ন স্টেট ও মহানগর কমিটিতে তাদের অনেকের স্থান হয়নি। অথচ যখন দেশে কেউ কথা বলতে পারত না, তখন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দূতাবাস ও কূটনৈতিক পাড়ায় বহির্বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সিনিয়র নেতা ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফোরাম যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘গত ১৫ বছর নিউইয়র্কে নেতা-কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ব্যানারে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। শেখ হাসিনা পালানোর পরও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। কিন্তু বিশেষ একজন ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়ায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বিএনপির হাইকমান্ড উপলব্ধি করতে পারছে না। সুতরাং দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠন অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।’
জানা গেছে, শুধু কয়েকটি স্টেট কমিটি গঠন করে চলছে যুক্তরাষ্ট্র শাখা কমিটি। এই সময়ের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এহছানুল হক (মিলন) কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেও গঠন করা হয়নি কমিটি। খালেদা জিয়া আমেরিকায় গেলে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে শাখা বিএনপির ব্যানারে স্বাগত ও সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। তারা উভয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির পৃথক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। এসব কর্মসূচিতে তাদের সঙ্গে দেখা করে নেতা-কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্র শাখার কমিটি ঘোষণা করার দাবিও তুলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা ও নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. মিজানুর রহমান মিল্টন ভূঁইয়া বলেন, “বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির যারা বেশি সক্রিয় ছিল, তাদের আজ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ‘বিএনপি করতে পারবে না’- এ কথা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়াও কখনো বলেননি। দেশের সংকট এখনো কেটে যায়নি। তাই যুক্তরাষ্ট্র শাখা বিএনপির শক্তিশালী কমিটি গঠন করা জরুরি। যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি দিতে হবে। পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে দল উপকৃত হবে।”
যুক্তরাষ্ট্র শাখা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ডা. মজিবুর রহমান বলেন, ‘স্টেট ও মহানগর কমিটি দেখে নেতা-কর্মীরা হতাশ। বিগত সময়ে যারা ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। গ্রুপিং-কোন্দলের কারণেও কয়েকবার কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।’
কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরা সাবেক সভাপতি সম্রাট, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, শরাফত হোসেন বাবু পৃথক ব্যানারে বিভক্ত হয়ে কর্মসূচি পালন করছেন। ২০১৯ সালের পর বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকন দায়িত্ব নেওয়ার পর জুমের মাধ্যমে তিনি স্টেট ও মহানগরের নামে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। প্রতিটি স্টেট ও মহানগরের আহ্বায়ক কমিটিতে ২০ থেকে ২৫ জন করে খোকনের অনুসারী। ভোটার ও প্রার্থী সবই তার। ১১ মাস আগে, বিশেষ করে নিউইয়র্ক স্টেটে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল ও চট্টগ্রামের লোকজনদের স্থান দিয়ে চরম আঞ্চলিকতা প্রতিষ্ঠা করেন আনোয়ার হোসেন খোকন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসূচিতে বেশির ভাগ সময়েই এসব নেতা অনুপস্থিত থাকেন। এমনি তাদের পড়াশোনা নেই এবং রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডও নেই। অথচ ১৫-২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির রাজনীতি করছেন।