
সিলেট নগরীর অন্যতম প্রবেশমুখ মদিনা মার্কেট পয়েন্ট এলাকায় বিলবোর্ডে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিএনপিকে নাজেহাল হতে হয়। একটি বিলবোর্ড দেখাতে সড়ক বিভাজকের বৃক্ষ কর্তনের ঘটনাও ঘটে। এ নিয়ে খবরের কাগজে সংবাদের প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনা চলে। তাৎক্ষণিক বিলবোর্ড অপসারণও করা হলেও ঈদের পরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় ওই নেতার পদ স্থগিত করা হয়। যে সব নেতার নামে বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল, তখন ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে সব বিলবোর্ড অপসারণও করা হয়।
ঈদুল ফিতরের পর এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে সিলেট নগরীর অন্যতম প্রবেশমুখ মদিনা মার্কেট থেকে আম্বরখানা সড়ক বিভাজকের সেই সব বিলবোর্ডে বিএনপির তরফে ঈদ শুভেচ্ছার বিলবোর্ড সাঁটাতে দেখা যায়নি। তবে বিএনপি টপকে ঈদ শুভেচ্ছার বিলবোর্ড সাঁটাতে দেখা গেছে জামায়াতকে।
মদিনা মার্কেট থেকে সুবিদবাজারে দুটো বিলবোর্ডে এখন শোভা পাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-১ (মহানগর-সদর) আসনে জামায়াত ঘোষিত প্রার্থী ও সিলেট জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমানের ঈদ শুভেচ্ছার বিলবোর্ড।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, সিলেট-১ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালে সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী নেতা অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে। এ আসনে প্রার্থী বদল করে জুবায়েরের স্থলে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয় মাওলানা হাবিবুর রহমানকে। তিনি সিলেট জেলা জামায়াতের আমির।
সিলেট-১ আসনে দলীয় প্রার্থী বদলসংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জামায়াত জানায়, ২০ মে জেলা ও মহানগর জামায়াতের যৌথ সভায় সিদ্ধান্তে সিলেট-১ আসনে দলটির কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও সিলেট জেলা আমির মাওলানা হাবিবুর রহমানকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সিলেট-১ আসনে দলের সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই দিন সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয়।
ওই সভার পর ২৩ মে সিলেট মহানগর জামায়াতের উদ্যোগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেট-১ আসন নিয়ে জামায়াতের নির্বাচন কমিটি গঠন করা হয়। জামায়াতের মহানগরীর সাবেক নায়েবে আমির হাফিজ আব্দুল হাই হারুনকে আহ্বায়ক, মহানগরীর নায়েবে আমির ড. নূরুল ইসলাম বাবুলকে যুগ্ম আহ্বায়ক ও সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা ইসলাম উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে সিলেট-১ আসন নির্বাচন কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত নির্বাচন কমিটির কার্যক্রম হিসেবে প্রার্থীর নামে বিলবোর্ডে ঈদ-শুভেচ্ছা জানানো হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত ঈদুল ফিতরে যে বিলবোর্ডটি ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ও বিএনপির চেয়ারপরসনের উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদির ঈদের শুভেচ্ছা ছিল, ঠিক সেখানেই রয়েছে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা হাবিবুরর রহমানের ঈদ শুভেচ্ছার বিলবোর্ড। একই সড়কে সুবিদবাজার মোড়ে আরেকটি বিলবোর্ড রয়েছে। দুটো বিলবোর্ডে অভিন্ন লেখা-
‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম/ ঈদুল আযহা উপলক্ষে সিলেট-১ আসনসহ সর্বস্তরের জনগণকে জানাই ঈদ শুভেচ্ছা- ঈদ মোবারক/ মাওলানা হাবিবুর রহমান/ বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী/ সিলেট-১ (সিটি ও সদর)...।’
জামায়াতের ‘সিলেট-১ আসন নির্বাচন কমিটি’ জানায়, মদিনা মার্কেট থেকে সুবিদবাজার পর্যন্ত সড়ক বিভাজকে বিলবোর্ডের মধ্যে দুটো বিলবোর্ড রয়েছে ইবনে সিনা হাসপাতালের। জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান ইবনে সিনা হাসপাতালের চেয়ারম্যান। এজন্য একটি শুভেচ্ছা বিলবোর্ড ইবনে সিনার বিলবোর্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। অপরটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে ভাড়া নিয়ে ঈদ-শুভেচ্ছার ব্যানার সাঁটানো হয়েছে।
যোগাযোগ করলে ভাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিলবোর্ড তদারক শাখা। সিসিকের ওই দপ্তর জানায়, মদিনা মার্কেট ও সুবিদবাজার এলাকায় যে দুটো বিলবোর্ড রয়েছে, এগুলোর একটি ইবনে সিনা হাসপাতালের। অপরটি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার। সেখান থেকে ভাড়া নিয়ে জামায়াত প্রার্থীর প্রচারণায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিলবোর্ডে ঈদ শুভেচ্ছায় নির্বাচনি প্রচারণার গড্ডলিকায় কখনো জামায়াতকে দেখা যায়নি। এবারই প্রথম দেখছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বিএনপিকে টপকে জামায়াতের প্রচারণায় জনমনে কৌতূহল ও চাঞ্চল্যও দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ এ বিষয়টিকে জাতীয় পর্যায়ে জামায়াতের নির্বাচনমুখী ভূমিকার সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে ভূমিকার বৈপরীত্য বলে মন্তব্য করছেন। এ নিয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশি হচ্ছে।
‘ওরে বিলবোর্ড দেখে করিসনে তোরা ভয়/...আড়ালে বিএনপি অবাক তাকিয়ে রয়’, ‘নির্বাচন শুধু বিএনপি চায়’এ রকম স্যাটায়ার কথা লিখে মদিনা মার্কেটে জামায়াতের নির্বাচনি প্রচারণার বিলবোর্ডের ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখা গেছে। পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চললেও মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের নির্বাচনমুখী তৎপরতার বিষয়টিই ফুটে উঠছে।
তবে এসব ব্যাপারে কোনো মন্তব্য না করে জামায়াতের নির্বাচন কমিটির আহ্বায়ক হাফিজ আব্দুল হাই হারুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচন তো ছয় থেকে আট মাসের ভেতর হয়ে যাবে। তাই নির্বাচনি প্রচার এখন থেকেই শুরু করা উচিত। অনেক দলের প্রার্থীরা আরও আগে থেকে কাজ শুরু করেছেন। আমরা কাজ শুরু করেছি মাত্র ১০ দিন হলো। বিএনপি বা অন্যান্য দলের যারা আছেন তারা অনেক আগে থেকে অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রচারণার কাজ করছেন। কিন্তু আমরা এর আগে কখনো কোনো কাজ করিনি। মাত্র ১৫দিন আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সিলেট-১ আসনে মাওলানা হাবিবুর রহমানকে প্রার্থিতার ব্যাপারে। তাই উনাকে যে জামায়েত মনোনয়ন দিয়েছে এটা জামায়াতের লোকজনসহ সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। তাই সব ধরনের প্রচার আমরা করছি।’
জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-১ নির্বাচনি আসনটি রাজনীতিতে একটি মর্যাদার আসন হিসেবে পরিচিত। ‘মিথ’ রয়েছে এ আসনে যে দলের প্রার্থী জিতেন, সেই দলই সরকার গঠন করে। ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচনি রাজনীতিতে ওই মিথটি প্রচলিত এবং সবকটি নির্বাচনে তার প্রতিফলনও দেখা গেছে।
১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল থেকে জানা গেছে, সিলেট-১ আসনে একক প্রার্থী হিসেবে জামায়াত সর্বশেষ নির্বাচন করেছিল ১৯৯৬ সালে। এর আগে ১৯৯১ সালে প্রথম একক প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াত। বর্তমানে কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান ’৯১ ও ’৯৬ সালে প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মালিক। জামায়াত প্রার্থী তৃতীয় হয়েছিলেন। প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৭ হাজার ৫১৭। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বিজয়ী হয়েছিলেন। আর জামায়াত প্রার্থী ডা. শফিকুর রহমান চতুর্থ হলেও ’৯১ সালের তুলনায় ভোট বেড়েছিল। প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৮ হাজার ২৯। এরপর ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় জোটের হয়ে নির্বাচন করায় একক প্রার্থী নিয়ে জামায়াতকে আর নির্বাচনী মাঠে দেখেননি ভোটাররা।
প্রায় ২৮ বছর পর দলীয় প্রার্থী নিয়ে মাঠে নির্বাচনি প্রচারণায় কি রকম সাড়া মেলছে? জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগরীর আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম গত মঙ্গলবার রাতে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগের মতোন না পরিবর্তন - এ রকম মনোভাব থেকে আমরা ভোটার তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে জামায়াতকে নিয়ে ইতিবাচক আগ্রহ লক্ষ্য করছি। মানুষ আগের মতোন কিছুই চায় না, পরিবর্তন চাইছে। সিলেট-১ আসনে ১৯৯১ ও ১৯৯৬-এর পর জামায়াত একক প্রার্থী না দিলেও জোটগতভাবে নির্বাচনি মাঠেই ছিল। এরপর রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে প্রচারবিহীন থাকলেও জামায়াত কখনো রাজনীতি বা ভোটের মাঠ ছাড়া ছিল না। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে এবার মাঠে জামায়াত বাঁধাহীন বলা যায়। আগের মতোন না পরিবর্তন-এ আগ্রহের কেন্দ্রে এখন জামায়াত।’
অমিয়/