পরনে সাদামাটা সেন্ডুগেঞ্জি ও লুঙ্গি। মেঝেতে বসা। উঠতে চাইলে ‘এই বস-বস, মাটিতে বসা থাক’ বলে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছিল না। চারপাশ ঘিরে রেখেছেন কয়েকজন লোক। দুজন পুলিশও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ অবস্থায় ভিডিও ধারণ করে বলা হচ্ছিল, ‘ডেভিল, ডেভিল ধরা পড়ছে...’।
এভাবে পুলিশে সোপর্দ করা হয় দিরাই-শাল্লার (সুনামগঞ্জ-১ আসন) সাবেক সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তের ‘এমপি প্রতিনিধি’ প্রদীপ রায়কে।
তিনি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দিরাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) রাত প্রায় আড়াইটার দিকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকার লন্ডনি রোডের একটি বাসা থেকে তাকে জালালাবাদ থানায় সোপর্দ করা হয়।
বুধবার যোগাযোগ করলে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্থানীয় জনতা প্রদীপ রায়কে আটক করলে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হেফাজতে নিয়েছে।’
ওসি জানান, প্রদীপ রায়ের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের আগে ও পরে সিলেট-সুনামগঞ্জে মোট সাতটি মামলা রয়েছে। জলমহাল দখল নিয়ে হত্যা মামলাও রয়েছে। তাকে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
জানা গেছে, প্রদীপ রায় বিগত ১৫ বছর দিরাই শাল্লায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। নানা ঘটনায় স্থানীয়ভাবে সমালোচিতও ছিলেন তিনি। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার ভাই বিশ্বজিৎ রায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দিরাই পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৫ আগস্টের পর প্রদীপ রায় ও তার ভাই আত্মগোপনে ছিলেন।
পুলিশ জানায়, প্রদীপের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে সিলেট নগরীর পাঠানটুলা এলাকায় বসবাসরত দিরাই বিএনপি কর্মীরা স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রদীপ রায়কে আটকের সময় একটি ভিডিও মধ্যরাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে দেখা যায়, প্রদীপকে বাসার মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বার কয়েক দাঁড়াতে চাইলেও উঠতে বা নড়তে দেওয়া হচ্ছিল না। দিগম্বর ও ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছিল। ভিডিওতে তাকে ‘ডেভিল’ বলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাকালে দিরাই-শাল্লায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে বিক্ষুব্ধদের নানা কথাবার্তা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। শেষে দুজন পুলিশ সেখানে গিয়ে বিক্ষুব্ধদের শান্ত করে প্রদীপকে তাদের হেফাজতে নেন।
প্রদীপের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের আগে মামলার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দিরাই থানা সূত্রে জানা গেছে, দিরাইয়ের কুলঞ্জ ইউনিয়নের জারুলিয়া জলমহালের দখল নিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি দুই পক্ষের সংঘর্ষে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় প্রদীপ রায়কে আসামি করা হয়। তবে পুলিশের চার্জশিটে তাকেসহ আরও কয়েকজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়া ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর দিরাইয়ের ভাটিপাড়া জলমহালের দখল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনার একজন নিহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলায়ও প্রদীপ রায় আসামি। ৫ আগস্টের পর দিরাই ও সিলেটে আরও পাঁচটি মামলার আসামি।
জানা গেছে, দিরাই-শাল্লায় ভোটের রাজনীতিতেও প্রদীপ রায় একজন অবৈধ প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে পরিচিত। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে ডামি প্রার্থী জয়া সেনগুপ্তকে বিজয়ী করেছিলেন। সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনটি প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্বাচনি এলাকা। ভোটের রাজনীতিতে ‘সুরঞ্জিতের আসন’ হিসেবে পরিচিত। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেলে তার স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্ত ওই বছরের ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের দ্বিতীয়বার মতো তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে শাল্লা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ছোট ভাই চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (আল-আমিন চৌধুরী) আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হলে প্রদীপ রায় তার এমপি প্রতিনিধি টিকিয়ে রাখতে দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন বলে তখন খোদ আওয়ামী লীগ থেকে অভিযোগ উঠেছিল।
অমিয়/