ঢাকা ১৭ বৈশাখ ১৪৩২, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
English
বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

মানবিক চিকিৎসক ডা. সাহিদা আখতার : শিশুদের বন্ধু, সমাজসেবক এবং গবেষক

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ০৩:০৪ পিএম
আপডেট: ০৩ মে ২০২৪, ০৩:৫৬ পিএম
মানবিক চিকিৎসক ডা. সাহিদা আখতার : শিশুদের বন্ধু, সমাজসেবক এবং গবেষক
ড. মতিউর রহমান

আজ থেকে তিন বছর আগে ২০২১ সালের ১ মে সন্ধ্যায় আমাদের সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন। কয়েক মাস ধরে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার ফুলার রোডের বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে দেশের চিকিৎসাঙ্গনে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন দক্ষ শিক্ষক, গবেষক এবং মানবিক চিকিৎসক। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবার উন্নতিতে উৎসর্গ করেছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তার ছাত্রছাত্রীরাও তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত।

ডা. সাহিদা আখতার বিশেষ করে শিশুদের চিকিৎসায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। নবজাতক শিশুদের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং তাদের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার মানবিক মনোভাব ও সহানুভূতির জন্য তিনি শিশুদের মাঝে ‘শিশুদের বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিত্ব। রোগীদের প্রতি তার আন্তরিকতা ও সহানুভূতি তাকে সবার কাছে সমাদৃত করে তুলেছিল। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের চিকিৎসায় তিনি সর্বদা সাহায্য করতেন এবং তাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাও দিতেন।

ডা. সাহিদা আখতার ১৯৬১ সালে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীতে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পর্যায়েই তিনি তার অসাধারণ মেধা ও কৃতিত্বের মাধ্যমে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন এ কলেজের পঞ্চম ব্যাচের একজন ছাত্রী।

এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস ও সার্জনস থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিশুবিশেষজ্ঞ, যিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় শিশুদের সুস্থতা ও কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক এবং বারডেম জেনারেল হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ শিশুবিশেষজ্ঞ হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন।

ডা. সাহিদা আখতার
ডা. সাহিদা আখতার

শুধু ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতালেই নয়, ডা. সাহিদা আখতার দেশের বিভিন্ন খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল (অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, ইন সার্ভিস ট্রেইনি); ঢাকা শিশু হাসপাতাল; আইপিজিএমআর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়); ডা. কাশেমস ক্লিনিক ও হাসপাতাল, কুষ্টিয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (লেডি ডাক্তার), ইত্যাদি।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন দেশের একজন প্রখ্যাত শিশুবিশেষজ্ঞ, যিনি তার জীবনের প্রায় তিন দশক নবজাতক শিশুদের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন দেশের নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট প্রোগ্রামের একজন পথিকৃৎ, যা শিশুদের জন্মের পরপরই নির্দিষ্ট কিছু বংশগত রোগের জন্য পরীক্ষা করে।

নিউবর্ন স্ক্রিনিং টেস্ট হল জেনোমিক মেডিসিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা শিশুদের জন্মের পরপরই কিছু গুরুতর বংশগত রোগ শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এই রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেনাইলকেটোনিউরিয়া (PKU), হাইপোথাইরয়েডিজম এবং অ্যাড্রেনাল কনার্টিকাল হাইপারপ্লাসিয়া (CAH)। যদি এই রোগগুলো শিশুদের জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা হয় এবং চিকিৎসা করা হয়, তবে তাদের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনযাপন করা সম্ভব।

ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশে নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি এই প্রোগ্রামের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং এর ব্যাপক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কাজ করেছিলেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে, বাংলাদেশে নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট একটি জাতীয় পর্যায়ের প্রোগ্রামে পরিণত হয়েছে যা প্রতি বছর লাখ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করছে।

ডা. সাহিদা আখতার শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ, হাঁপানি, বুকের দুধ খাওয়ানোর অনুশীলন, নবজাতকের প্রয়োজনীয় যত্ন, জন্মের সময় নবজীবন সঞ্চার, উন্নত কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট, এইচবিবি (শিশুদের শ্বাস নিতে সহায়তা করা), ইসিডি (প্রাথমিক শৈশব বিকাশ), পিএনডিএ (পেরিনিটাল ডেথ অডিট) ইত্যাদি বিষয়ে নিবিড় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এই জ্ঞান ও দক্ষতা তার চিকিৎসা অনুশীলনে প্রভাব ফেলেছিল এবং তাকে শিশুদের জন্য একজন নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

শিশুদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য ডা. সাহিদা আখতার শুধু চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোতে তার গবেষণা কাজও উল্লেখযোগ্য ছিল। তার গবেষণা ফলাফল শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা ব্যতীতও তিনি ছিলেন একজন সচেতন সমাজ গবেষক। দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং মৌলিক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। তার রচিত মৌলিক গবেষণা ও সেমিনারে/ওয়ার্কশপে উপস্থাপিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৫০-এর বেশি।

ডা. সাহিদা আখতার নিরলস পরিশ্রম করেছেন নবজাতক শিশুদের রোগাক্লান্ত মুখে হাসি ফোটাতে। তিনি কেবল চিকিৎসায়ই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং নিয়মিত চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডেও সদাসক্রিয় ছিলেন। শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মাতৃদুগ্ধপানে মায়েদের উদ্বুদ্ধকরণ সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে তার বিশেষ অবদান ছিল।

শিশুস্বাস্থ্যের নানা বিষয় ছাড়াও একিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন, এন্ডোক্রাইনোলজি এবং জিনোমিক্সও ছিল ডা. সাহিদা আখতারের আগ্রহের জায়গা। নিওনেটোলজি, প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ, জেনেটিকস, জিনোমিক মেডিসিন, মা ও শিশু মৃত্যু এবং অসুস্থতা, শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যের সামাজিক মাত্রা, পানীয় জলে আর্সেনিক প্রশমন-সনোফিল্টার ইত্যাদি বিষয়েও তিনি কাজ করেছেন।

ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক। তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে এ দেশের গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তিনি বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন (দায়িত্ব গ্রহণের আগেই মৃত্যুবরণ করেন)। এ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সহসভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরামের নির্বাচিত সহসভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটির নির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের জীবন সদস্য, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের জীবন সদস্য, ইয়ং ডায়াবেটিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটির জীবন সদস্য। এসব সংগঠনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এ দেশের শিশু চিকিৎসা শাস্ত্রকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

ডা. সাহিদা আখতারের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ। তিনি বিখ্যাত গবেষক ও অর্থনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক আবুল বারকাতের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি শুধু একজন স্ত্রীই ছিলেন না, বরং একজন সঙ্গী, বন্ধু এবং সহকর্মীও ছিলেন। তাদের তিন কন্যা সন্তান রয়েছে।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন মানবিক এবং বিনয়ী ব্যক্তিত্ব। রোগী, শিক্ষার্থী, সহকর্মী- সবার কাছেই তিনি ছিলেন সম্মানিত ও প্রিয়। তিনি ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষক যিনি তার ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তাদের ভালো চিকিৎসক হতে সাহায্য করেছেন।

তার মৃত্যুর পর অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতারের স্বামী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের সম্পাদনায় ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনী ‘অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার একজন শিশুচিকিৎসকের যাপিত জীবন’। যে কেউ এ জীবনীগ্রন্থ পড়ে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন ও অনুপ্রাণিত হবেন।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার চলে গেলেও তার অবদান ও স্মৃতি আমাদের অন্তরে চির অমলিন হয়ে থাকবে। একজন দক্ষ শিশুবিশেষজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক এবং মানবিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি আমাদের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার আত্মার শান্তির জন্য আমাদের সবার প্রার্থনা।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

অতি লোভ কমান, নয়তো সর্বস্ব হারাতে হবে

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১২ পিএম
অতি লোভ কমান, নয়তো সর্বস্ব হারাতে হবে
রিয়াজুল হক

এক শ টাকা ইনভেস্ট করলে দুই শ টাকা পাবেন। হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা টেলিগ্রামে এরকম টেক্সট পেলেন। ভাবলেন, এক শ টাকা! এ আর এমন কী? পাঠালেন এক শ টাকা। সাথে সাথে দুই শ টাকা পেয়ে গেলেন।

এরপর এক হাজার টাকা পেমেন্ট করলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুই হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। ভাবলেন, ভালোই তো। কোনো কিছু করা লাগে না। যা দেই, দ্বিগুণ ফেরত আসে। এরপর পাঁচ হাজার টাকা দিলেন, ১০ হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। ২৫ হাজার টাকা দিলেন, ৫০ হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। এক অদ্ভুত লোভের মধ্যে আপনি আটকে গেলেন। কাউকে জানাচ্ছেন না। কারণ এত লাভের কথা অন্য কাউকে জানালে সেও অতি লাভবান হওয়া শুরু করবে। সেটা তো করা যায় না! 

এরপর এক লাখ টাকা দিলেন কিছু সময় পর দেখলেন দুই লাখ টাকা পেয়ে গেছেন। বাহ! জীবনে আর কি দরকার। আপনি দুর্দান্ত প্রতাপে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলেন। থামার কোনো নাম-গন্ধ নেই।

এরপর আর ২-৪ লাখ না করে, ধার দেনা করে একবারে ৩০ লাখ টাকা পাঠালেন। অপেক্ষায় আছেন ৬০ লাখ টাকা এখনই চলে আসবে। টাকা আসলে কী করবেন, সেই পরিকল্পনা তো অনেক আগেই করা শেষ।

যাই হোক, টাকা চলে আসলো বলে! সময় চলে যাচ্ছে। আপনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, শীতের মধ্যে শরীর ঘামছে। কিন্তু সেই ৬০ লাখ টাকা আর আসে না।

এরপর যা হবার তাই হলো। আপনি খোলস থেকে বের হলেন। বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জানানো শুরু করলেন। বলা শুরু করলেন যে, আপনার সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। 

এখানে আপনার সরল বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা হয়নি। আপনার লোভ নিয়ে খেলা করা হয়েছে। অতি লোভ কমান। অনেক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারবেন।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

এআই কি মানুষের ভবিষ্যৎ শাসক?

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:০৫ পিএম
আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৩ পিএম
এআই  কি মানুষের ভবিষ্যৎ শাসক?
প্রতীকী ছবি

প্রযুক্তিতে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence)। একদিকে এই প্রযুক্তি যেমন বদলে দিয়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি, শিল্পসহ নানা খাত; অন্যদিকে এটি তৈরি করছে উদ্বেগ। মানুষ কি ধীরে ধীরে এআই-এর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে? আর ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?

বর্তমান বাস্তবতা: নিয়ন্ত্রণ কি শুরু?

বিশ্বজুড়ে এআই এখন শুধু সহায়ক প্রযুক্তি নয়, বরং মানবিক আচরণ, সিদ্ধান্ত এবং বিশ্বাসকে প্রভাবিত করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি Google, Facebook-এর অ্যালগোরিদম আমাদের দেখার জগৎ ও ভাবনার ধারা নির্ধারণ করছে। চীনের 'Social Credit System' নাগরিকদের আচরণের ওপর ভিত্তি করে তাদের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করছে। একটি ভয়ঙ্কর সফট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে এটি।

এ ছাড়া, চ্যাটবট, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, এবং বিভিন্ন Recommendation System ব্যবহারকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলছে, যা এক ধরণের অদৃশ্য ও নরম শাসনের প্রক্রিয়া।

নিয়ন্ত্রণের ধরণ: কেমনভাবে কাজ করছে এআই?

১. মানসিক নিয়ন্ত্রণ (Psychological Manipulation):

এআই আজ এমনভাবে তথ্য সাজায়, যাতে ব্যবহারকারী নিজের অজান্তেই নির্দিষ্ট একটি পথে চিন্তা করে। এর ফলে আমাদের স্বাধীন মত গঠনের ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২. নীতিনির্ধারণে এআই:

আদালতের রায়, পুলিশি নজরদারি, এমনকি চাকরির আবেদন বাছাইয়ের মতো ক্ষেত্রেও এআই ব্যবহার হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের পরিবর্তে মেশিনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

৩. মানবীয় কাজের বিকল্প:

রোবট ও অটোমেশন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মানুষ তার কর্মক্ষমতা ও কাজের জায়গা হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে। এআই-এর অগ্রগতি ভবিষ্যতে মানুষের চেয়েও দক্ষ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হয়ে উঠতে পারে।

ভবিষ্যতের শঙ্কা: নিয়ন্ত্রণের সীমা কোথায়?

বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞদের মনে নানা শঙ্কা দানা বাঁধছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সম্ভাবনাগুলো হলো:

স্বায়ত্তশাসিত এআই (Autonomous AI Systems):

এমন এআই যেটি নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজেকে উন্নত করতে পারে- তখন তা মানব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

Superintelligence এর হুমকি:

বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী Stephen Hawking এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তা Elon Musk-এর মতে, যদি এআই মানুষের তুলনায় বেশি চিন্তাশক্তি অর্জন করে, তবে তা হতে পারে মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

এআই-ভিত্তিক একনায়কতন্ত্র:

নজরদারি, তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও জনমত প্রভাবিত করতে এআই ব্যবহার করলে ভবিষ্যতে কিছু সরকার ‘ডিজিটাল দাসত্ব’ তৈরি করতে পারে।

সমাধানের পথ: এখনই পদক্ষেপ জরুরি

বিশ্ববাসীর এখনই প্রয়োজন সচেতনতা এবং সুপরিকল্পিত কার্যক্রম। সম্ভাব্য করণীয়গুলো হলো:

* এআই নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন।
* Human-in-the-loop: এআই যেন সর্বদা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
* স্বচ্ছতা ও ব্যাখ্যাযোগ্যতা নিশ্চিত করা।
* নৈতিকতা ও মানবাধিকারের প্রাধান্য দেওয়া।

নিয়ন্ত্রণ না সেবা? নির্ধারণ করবে মানুষই

এআই এখনও পুরোপুরি মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেনি, তবে এর সম্ভাবনা ও ঝুঁকি অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন সময় সচেতন হওয়ার, প্রযুক্তিকে শাসকের আসনে না বসিয়ে মানুষের সেবক হিসেবে রাখার।

মেহেদী/

মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৪ এএম
মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুহাম্মদ হারুন আল-রশিদ

মুজিবুল হায়দার চৌধুরী- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জগতের রূপান্তরের রূপকার এই অভিজন ২০২৪ সালের ১০ এপ্রিল বিকেল ৪টা ৫৩ মিনিটে ঢাকা এভার কেয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তার স্বজন ও সুজনদের কাঁদিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলা আজিজ ফাজিলপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
 
চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপনকারী চৌধুরী ১৯৫৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬১ বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড ব্যাংকে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে সরকারি জনতা ব্যাংকে ডিজিএম পদে যোগদান করেন এবং পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৮১ সালে সরকারি খাতের পূবালী ব্যাংকে জিএম পদে বদলি হন।

দেশের অর্থনীতিতে প্রয়াত মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর ভূমিকা বহুমুখী। বেসরকারি খাতের প্রথম ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি ও প্রথম জীবন বিমা কোম্পানি ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স পিএলসির তিনিই প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ। দেশের বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত লিজিং কোম্পানিও তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জন্ম হয়েছে। দেশের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রয়াত মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর নাম। এসব প্রতিষ্ঠান ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ দশকে আক্ষরিক অর্থেই দেশের অর্থনীতিকে একটি মাত্রা দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ১৯৮৫ সালে বেসরকারি খাতে দেশের প্রথম অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ক্রেডিট লি. প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩ সালে সেটি একটি পূর্ণ মাত্রায় বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে এখন স্বমহিমায় বিদ্যমান। দেশের বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠায়ও তার অবদান রয়েছে।

বর্তমান সময়ে পোশাক খাতে যে উচ্চপ্রবৃদ্ধি, এর সূচনা ঘটে ১৯৮৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক লি.-এর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক হায়দার চৌধুরীর মাধ্যমে। ঋণের সব ঝুঁকি উপেক্ষা করে, চাকরিপ্রত্যাশী যুবক ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় শর্তহীন ও জামানতবিহীন ঋণ দিয়েছেন। তার সেই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে ব্যাংকটির পরিচালক এমনকি তার ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। মানস চোখে দুরবীন দূরত্বের ছবি পরিষ্কার দেখার অদ্ভুত দক্ষতাই মানুষটির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল। যে কারণে বুঝেছিলেন সভ্য দুনিয়ার পোশাক খাতে লুকিয়ে থাকা এক অমিত সম্ভাবনার কথা। প্রায় শূন্য পর্যায়ের একটি খাত তার প্রণোদনা থেকেই পেয়েছিল গগনচুম্বী উল্লম্ফনের গতি। যে শিল্প আজ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত, কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সেই শিল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রণোদনার প্রাণপুরুষ এখন বিস্মৃতির অতলান্তে বিলীন। 

মুজিবুল হায়দার চৌধুরী

নিজ গ্রামসহ স্বীয় অর্থায়নে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু স্কুল-মাদরাসা হিফজখানা ও রংপুরের বদরগঞ্জ এবং শরীয়তপুরের গহীন চর-মাঝির কান্দিতে প্রতিষ্ঠিত বিশাল মসজিদগুলো তার সৎকর্মের স্মারক হয়ে মানুষের কল্যাণ করবে অনাদিকাল। দক্ষিণ উপকূলের প্রত্যন্ত খরপানির অঞ্চলসহ বহু গ্রামে শত শত নলকূপে অর্থায়ন করে লক্ষ পিপাসিত মানুষের পানির ব্যবস্থা করেছেন।

১৯৮৪ সালে দ্য ডেইলি নিউজ এবং ১৯৯০ সালে দৈনিক জনপদ পত্রিকা প্রকাশনায় তার অবদান অনস্বীকার্য কীর্তি হয়ে থাকবে।

যে চিত্ত গভীরতা ও দেশপ্রেম নিয়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও সম্পদ সৃষ্টির জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন, তার কর্মের প্রতিদান হিসেবে যেন বেহেশত নসিব হয়।

মুহাম্মদ হারুন আল-রশিদ:
বহু জাতিক পুঁজি বিনিয়োগ কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর গুণমুগ্ধ সহকর্মী।

আমেরিকার ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১৯ পিএম
আমেরিকার ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ
রিয়াজুল হক

বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর আমেরিকা ট্যারিফ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সিস্টেমে ট্যারিফ বাড়িয়েছে সেটাও দুর্দান্ত রকমের অদ্ভুত একটা ব্যাপার। 

যেমন- কম্বোডিয়া ৯৭ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ করতো আমেরিকার নির্ধারিত পণ্যের ওপর, এখন আমেরিকা ৪৯ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ নির্ধারণ করেছে। ভিয়েতনাম ৮৮ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ করতো আমেরিকার নির্ধারিত পণ্যের ওপর, এখন আমেরিকা ভিয়েতনামের ওপর ৪৪ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ নির্ধারণ করেছে। আর নাম দেওয়া হয়েছে ডিসকাউন্ট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ।

তবে এই পদ্ধতিতে আমাদের পোশাক শিল্পের ওপর একটা প্রভাব আসতে পারে। আমাদের পোশাক খাতের ওপর এতদিন ট্যারিফ ছিল ১৫ শতাংশ, কিন্তু নতুন ট্যারিফের হার ৩৭ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। অন্যদিকে পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশ, যেমন চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, তুরস্কের ওপর ১০ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ হবে। আমেরিকার আমদানিকারকরা কম ট্যারিফ দেওয়ার সুযোগে হয়তো আমাদের প্রতিযোগী দেশের দিকেও ঝুঁকতে পারে। আমেরিকা আমাদের জন্য অনেক বড় মার্কেট। অথচ কম ট্যারিফের কারণে পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের থেকে কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ পাবে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ আমেরিকায় ৭.২৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে এবং প্রায় ২.২১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যে আমেরিকা থেকে আমদানি করে। আমেরিকায় আমাদের রপ্তানির পরিমাণ আমদানি থেকে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ সেখানে আমাদের ট্রেড সারপ্লাস।

এখন আমাদের উচিত, কীভাবে আমাদের রপ্তানি পোশাক শিল্পের ওপর ট্যারিফ কমানো যায়, সেই বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করা। প্রয়োজনে আমরা আমেরিকার কিছু আমদানি করা পণ্যের ওপরও ট্যারিফ কমিয়ে দিতে পারি। যেহেতু আমেরিকা ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ ফলো করছে। 

কেউ কেউ বলতে পারেন, আমেরিকা আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চাইছে। তারা নিজেরাই সবকিছু উৎপাদন করবে। এটা কি আদৌ সম্ভব? যেমন ধরুন, আমাদের মোংলা ইপিজেডের মধ্যে যেসব পোশাক কারখানা রয়েছে, সেখানে একজন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেতনে সারা মাস চাকরি করেন‌। আমেরিকায় কাউকে পাবেন, যিনি ৫০ ডলার বেতনে সারা মাস চাকরি করবে? সুতরাং বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়।

এটা ঠিক, ট্যারিফ বাড়িয়ে আমেরিকার সরকারের আয় বাড়বে। বাড়তি ট্যারিফ দিতে যেয়ে সেখানকার আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। আর সেই বাড়তি খরচের জন্য আমদানি করা পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। আলটিমেট প্রভাবটা পড়বে কাদের ওপর? ঠিক ধরেছেন, আমেরিকার জনগণের ওপর। তাদের বেশি মূল্যে আগের পণ্য কিনতে হবে।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইতিহাসের আড়ালে ৫৪ বছর একাত্তর সালের ডহরপাড়া গণহত্যা

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫৭ পিএম
ইতিহাসের আড়ালে ৫৪ বছর একাত্তর সালের ডহরপাড়া গণহত্যা

একাত্তর সালে বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা বীভৎস গণহত্যা চালিয়েছিল। এই বর্বর গণহত্যা থেকে রক্ষা পায়নি এ দেশের শিশু ও নারীরা। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের সবুজে বেষ্টিত মেঠোপথের ডহরপাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষও রক্ষা পায়নি সেই গণহত্যা থেকে। রক্তাক্ত সেই ভয়াল দিনের কথা বলতে গেলে এখনো গ্রামের লোক শিউরে ওঠে, কান্নায় কথা আটকে যায় স্বজনদের। একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, মুক্তিযুদ্ধ কোষ এবং গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ গ্রন্থেও ডহরপাড়া গণহত্যার ওপর অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোকপাত করা আছে।

ডহরপাড়া গ্রামের গণহত্যার দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১ সালের ২০ মে। অনুসন্ধান, গবেষণা ও শহিদ পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয়দের ভাষ্য অনুসারে সেদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বর্তমানে গ্রামটির যোগাযোগব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ডহরপাড়া গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত ও ভরগ্রাম। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এত ভিতরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশ করার সুযোগ ছিল না। গ্রামের শহিদ পরিবার ও এলাকাবাসীর ধারণা, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কিছুদিন আগে মারা গিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী মাধবপাশা এলাকার তৎকালীন স্বাধীনতাবিরোধী নেতা সিরাজ মাওলানা। ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে বরিশাল ত্রিশ গোডাউন ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লঞ্চে করে ভোরে এসে ভেড়ে গুঠিয়ার কালিজিরা নদীর পাড়ে। অপরিচিত এলাকা হওয়ার কারণে পথ ভুলে গুঠিয়ার এপাড়ে উঠে এসে বটতলা থেকে গণহত্যা শুরু করে ডহরপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ সময় গ্রামের লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। গ্রামের মুসলমানদের মধ্যে তাৎক্ষণিক ধারণা হয়েছিল যে, মুসলমান ভাই ভাই। এ কারণে অনেকেই টুপি, পাঞ্জাবি পরে কোরআন শরিফ পড়ছিল ঘরে বসে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকের।

বটতলায় পাকিস্তানিদের হাতে প্রথম শহিদ হন ডহরপাড়ার গ্রামের জুম্মাত আলী ফকিরের ছেলে মালেক ফকির (২৭)। আব্দুল মালেক হাওলাদারের বাড়িতে হত্যা করে দুজনকে। গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার মোল্লার সামনেই হত্যা করে মেহের উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে বয়োজ্যেষ্ঠ আজিমউদ্দিন হাওলাদারকে (৮০)। এই বীভৎস্য গণহত্যা দেখে সাত্তার মোল্লার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয় এবং পরদিনই তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশ ছাড়েন। এভাবেই গণহত্যা চালিয়ে হত্যা করে ডহরপাড়া গ্রামের তালুকদার বাড়ির গোলাম কাদেরের ছেলে কাশেম তালুকদার (৫৫), মেনাজ উদ্দিন হাওলাদারে ছেলে তুজুম্বর (৪৫), হাওলাদারবাড়ির সোবাহান হাওলাদারের ছেলে হাশেম হাওলাদার (৩২), আব্দুল আজিজ হাওলাদারের ছেলে নূর মোহাম্মদ হাওলাদার (৪৫), তোরাব হাওলাদারের ছেলে ওহাব হাওলাদার (৬৫), সাদেত আলী হাওলাদের ছেলে আশরাফ আলী (২৫), আজাহার আলী হাওলাদারের  ছেলে লতিফ আলী হাওলার (২৪), হাতেম আলী হাওলাদারের ছেলে আব্দুল মান্নান হাওলাদার মনা (২০), হাসেম আলী হাওলাদারের ছেলে নুরুল ইসলাম হাওলাদার (২৬), নিজামউদ্দিন হাওলাদারের ছেলে কদম আলী হাওলাদার (৪৬), আফসার উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে মোশারফ হোসেন হাওলাদার (৬০), ঝালকাঠি পরমহল নবগ্রামের ময়িজ উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে মোবারক হোসেন হাওলাদার (৬০), সিকদারবাড়ির কদম আলী সিকদারের ছেলে ইসমাইল সিকদার (৩৬) ও লস্করবাড়ির হামেদ লস্করের ছেলে মুজাহার লস্কর (৪৫) এবং ডহরপাড়া গ্রামের সবার কাছে মেহেন্দী গঞ্জের হুজুর নামে পরিচিত এক ব্যক্তিসহ মোট ১৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। স্থানীয়দের কাছে তিনি মেহেন্দি গঞ্জের হুজুর নামেই পরিচিত ছিলেন যার মূল বাড়ি ছিল হিজলা উপজেলায় এবং তিনিও স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। শহিদ আশরাফ আলী সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এলাকায় এসে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এলাকার মানুষকে সংগঠিত করে গ্রামের সামাদিয়া দারুল উলুম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন। শহিদ কদম আলী হাওলাদারও পেশায় শিক্ষকতা করতেন। 

ওইদিনের গণহত্যায় আহত হন হাওলাদার বাড়ির নিজাম উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে কাশেম আলী হাওলাদার (৩০), ইয়াছিন আলী হাওলাদারের ছেলে আজাহার আলী হাওলাদার (৫০) ও মৃত সাদেক আলী মুন্সির ছেলে আব্দুল ওহাব আলী হাওলাদার (২২), তালুকদার বাড়ির লেহাজ উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে আব্দুল হাই হাওলাদার (৩০)। আহতদের মধ্যে ওহাব আলী হাওলাদার ছিলেন পেশায় শিক্ষক।

 

এই গণহত্যার সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওইদিন পাকিস্তানি বাহিনীদের হাতে শহিদ হয়েছেন স্থানীয় শিক্ষক, চাকরিজীবী, মসজিদের ইমাম, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। ডহরপাড়া গ্রাম ও শহিদদের পরিবারের অনেক সদস্য স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। 

তবে ডহরপাড়ার এই গণহত্যা নিয়ে স্বাধীনতার এত বছরেও উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা কিংবা তথ্যচিত্র নির্মিত হয়নি। এত বছরে শহিদ পরিবারের সদস্যরা শহিদের মর্যাদা পাননি। শহিদদের স্মৃতিরক্ষার্থে কোনো শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। বেশির ভাগ শহিদের স্থানীয়ভাবে কাফনের কাপড় সংগ্রহ করে কিংবা বাড়ির মহিলাদের পরনের সাদা কাপড় দিয়ে দ্রুত দাফন করা হয়েছিল। গণহত্যায় শহিদদের জানাজার নামাজ পড়িয়েছিলেন আবুল বাশার হুজুর ও ইস্কান্দার মৌলভী এবং চেরাগ আলী মুন্সি। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাই নিজেদের মতো করে জানাজা ও দাফন-কাফন করেছিলেন। 

লেখক: রাইসা রহমান উর্মি, এমএড (প্রশিক্ষণার্থী), সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা ও ইমাম মেহেদী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, পিএস টু ভিসি, লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া