বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহতের ঘটনার জবাব চেয়েছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি উল্লেখ করে দেশটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তারও সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রে চলা ইসরায়েলবিরোধী মিছিলে পুলিশের হামলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর মানবাধিকার রিপোর্ট লেখে কিন্তু আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না। এ ছাড়া জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে কাজ করে যাচ্ছে কিংবা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিচ্ছে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে।’
যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রবিক্ষোভে পুলিশের হামলার ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই দেশে মানবাধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বাঙালি মারা গেছে। সেই দিনও দুজন মারা গেল। আমি প্রতিবাদ জানাই। তারা জীবন-জীবিকার জন্য গেছে। কিন্তু তাদের এভাবে হত্যা করবে কেন? তারা তো কোনো অপরাধ করেনি।’ বাচ্চা ছেলেও তাদের হাত (যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ) থেকে রেহাই পায় না উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যারা এখন মানবাধিকারের গীত গায় এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার খুঁজে বেড়ায়, তারা কী জবাব দেবে। আমি সেই জবাব চাই। মানবাধিকার সংস্থা, বিচার বিভাগ, যারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়, আমাদের ওপর খবরদারি করে তাদের কাছে জবাব চাই।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি কেন মারা যাবে, এ প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘ওইরকম মায়ের কোল থেকে নিয়ে হত্যা করা, শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন করা এটা তো সম্পূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘন করা।’ গত মার্চে নিউ ইয়র্কের কুইন্সে পুলিশ উইন রোজারিও নামে এক বাংলাদেশি তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। সে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। পুলিশের অভিযানের সময় মা তাকে কোলে আগলে রেখেছিল। এ ঘটনার পর উইনের পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া নিউ ইয়র্কের বাফেলো শহরে দুই বাংলাদেশিকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। বিশ্বের কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করে থাকে। এটি খুবই ইতিবাচক ও প্রশংসার দাবি রাখে। তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন; লক্ষ্য করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে ওইসব দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মারাত্নক আকার ধারণ করে থাকে। আবার যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় সেসব দেশে সহিংস ঘটনার অবতারণা হলেও যুক্তরাষ্ট্র সেসব আমলে নিচ্ছে না। মায়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক জাতি নিধনের ঘটনার পরেও যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে। আবার ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কর্তৃক শিশু ও নারী হত্যার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে প্রকারান্তরে সমর্থন প্রদান বাকি বিশ্বের শান্তিকামী জনতা কেউই মেনে নিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আত্নরক্ষার স্বার্থে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এ ধরনের অজুহাত ও অদ্ভুত যুক্তি আমাদের হচকচিত করেছে, স্তম্ভিত করেছে। এমন বিবেকহীন বিবৃতি ইসরায়েলকে আরও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে, ক্ষণে ক্ষণে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের খড়গ অব্যাহত রেখেছে। অথচ বাকি পৃথিবী ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে এর ওপর মামলাও হয়েছে।
এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও ঘৃণা দেখা দিয়েছে। মায়ানমারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে একেবারে নিধন করে দিয়েছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা এবং সেখানে মৌন সমর্থন ও সম্মতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট যেখানে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে সেই জায়গায় তারা কোনোভাবেই সমাধানে উদ্যোগী না হয়ে উল্টো মানবাধিকার লঙ্ঘনকেই মৌন সমর্থন প্রদান করে। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে ও সাম্রাজ্যবাদ নীতি প্রতিষ্ঠায় শুরু থেকেই তৎপর ছিল এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন ইস্যু ও স্পর্শকাতর বিষয়ে দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের সূত্র ধরে মোড়লগিরি ধরে রাখার চেষ্টা করেছে অব্যাহতভাবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদের নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার একটি অঘোষিত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা তাদের পরিকল্পনা মতো এগিয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে তাদের গৃহীত ও ঘোষিত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববাসী তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে সহজেই অবগত হয়েছে। আবার অনেকেই এমনও বলে থাকে পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষ করে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদকে জিইয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সংযুক্ততাকে দায়ী করে থাকেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী অনেকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। গবেষকরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এ সংস্থার তথ্য উপাত্ত মূল্যায়ন করে গবেষণা কার্য সম্পাদনের চেষ্টা করে থাকেন। কিছুদিন আগে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের যুদ্ধের ওপর এ সংস্থাটির দাখিল করা প্রতিবেদনে ব্যাপক পক্ষপাতিত্বের স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। বিশেষ করে গবেষণা সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও ইসরায়েলের সরকারের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে ফিলিস্তিনের ভুক্তভোগীদের কোনোরূপ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। এ সংক্রান্ত রিপোর্ট বের হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সমালোচনার ঝড় উঠে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিশ্বব্যাপী সব দেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়ে তেমন বিস্তারিত প্রতিবেদনে উঠে আসে না কিংবা ইচ্ছে করেই প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। এটি এক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র ও অবস্থানকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক লক্ষণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরলেও নিজের দেশের মানবাধিকার নিয়ে একেবারেই উদাসীন। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত বিরতিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে, পুলিশের হেফাজতে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে। মানুষের মধ্যে অস্বস্তি ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে, তথাপি সরকার কিংবা রাষ্ট্র এসবের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বর্তমান প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করে বলেছেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে নিজ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করুন। তিনি বলবার চেষ্টা করেছেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থনের কারণেই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার তেমন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে দেখা যায়, এ যুদ্ধের কারণে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রের বোধোদয় হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে নিজ দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, জানমালের সুরক্ষা, দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতি বজায় রাখা, অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। সর্বোপরি বর্ণ, গোত্র বৈষম্যের ব্যবধান গুছিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যাওয়া।
কিছু দিন পর পর সংবাদমাধ্যমের বরাতে শোনা যায়, বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তী সংবাদে প্রতিকারমূলক কোনোরূপ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে তেমন উল্লেখযোগ্য অর্জনের সংবাদ আমাদের গোচরীভূত হয় না। এর মানে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে, তা না হলে যে সংবাদমাধ্যমের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সম্বন্ধে আমরা জেনে থাকি সেই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে পরের সংবাদটুকুও প্রচার করা। যেহেতু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে কোনো সংবাদ গোচরীভূত হয়নি সেহেতু ধরে নেওয়া যায় এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে না। তাহলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নীরবে নিভৃতে বিচারের বাণী ক্রন্দনে পর্যবসিত হয়ে থাকে। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের দেশে অভিবাসী হয়ে যারা গমন করছে কিংবা তাদের দেশের স্থায়ী নাগরিক তাদের প্রত্যেকের মানবাধিকার নিশ্চিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া। কেননা রাষ্ট্রের মূল এবং মৌলিক কাজ হচ্ছে নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া এবং অধিকার নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]