ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্র এখন কী জবাব দেবে?

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ০৩:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৩ মে ২০২৪, ০৪:৪৩ পিএম
যুক্তরাষ্ট্র এখন কী জবাব দেবে?
মো. সাখাওয়াত হোসেন

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহতের ঘটনার জবাব চেয়েছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি উল্লেখ করে দেশটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তারও সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রে চলা ইসরায়েলবিরোধী মিছিলে পুলিশের হামলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর মানবাধিকার রিপোর্ট লেখে কিন্তু আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না। এ ছাড়া জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে কাজ করে যাচ্ছে কিংবা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিচ্ছে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রবিক্ষোভে পুলিশের হামলার ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই দেশে মানবাধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বাঙালি মারা গেছে। সেই দিনও দুজন মারা গেল। আমি প্রতিবাদ জানাই। তারা জীবন-জীবিকার জন্য গেছে। কিন্তু তাদের এভাবে হত্যা করবে কেন? তারা তো কোনো অপরাধ করেনি।’ বাচ্চা ছেলেও তাদের হাত (যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ) থেকে রেহাই পায় না উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যারা এখন মানবাধিকারের গীত গায় এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার খুঁজে বেড়ায়, তারা কী জবাব দেবে। আমি সেই জবাব চাই। মানবাধিকার সংস্থা, বিচার বিভাগ, যারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়, আমাদের ওপর খবরদারি করে তাদের কাছে জবাব চাই।’

যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি কেন মারা যাবে, এ প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘ওইরকম মায়ের কোল থেকে নিয়ে হত্যা করা, শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন করা এটা তো সম্পূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘন করা।’ গত মার্চে নিউ ইয়র্কের কুইন্সে পুলিশ উইন রোজারিও নামে এক বাংলাদেশি তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। সে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। পুলিশের অভিযানের সময় মা তাকে কোলে আগলে রেখেছিল। এ ঘটনার পর উইনের পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া নিউ ইয়র্কের বাফেলো শহরে দুই বাংলাদেশিকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। বিশ্বের কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করে থাকে। এটি খুবই ইতিবাচক ও প্রশংসার দাবি রাখে। তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন; লক্ষ্য করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে ওইসব দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মারাত্নক আকার ধারণ করে থাকে। আবার যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় সেসব দেশে সহিংস ঘটনার অবতারণা হলেও যুক্তরাষ্ট্র সেসব আমলে নিচ্ছে না। মায়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক জাতি নিধনের ঘটনার পরেও যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে। আবার ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কর্তৃক শিশু ও নারী হত্যার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে প্রকারান্তরে সমর্থন প্রদান বাকি বিশ্বের শান্তিকামী জনতা কেউই মেনে নিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আত্নরক্ষার স্বার্থে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এ ধরনের অজুহাত ও অদ্ভুত যুক্তি আমাদের হচকচিত করেছে, স্তম্ভিত করেছে। এমন বিবেকহীন বিবৃতি ইসরায়েলকে আরও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে, ক্ষণে ক্ষণে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের খড়গ অব্যাহত রেখেছে। অথচ বাকি পৃথিবী ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে এর ওপর মামলাও হয়েছে।

এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও ঘৃণা দেখা দিয়েছে। মায়ানমারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে একেবারে নিধন করে দিয়েছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা এবং সেখানে মৌন সমর্থন ও সম্মতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট যেখানে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে সেই জায়গায় তারা কোনোভাবেই সমাধানে উদ্যোগী না হয়ে উল্টো মানবাধিকার লঙ্ঘনকেই মৌন সমর্থন প্রদান করে। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে ও সাম্রাজ্যবাদ নীতি প্রতিষ্ঠায় শুরু থেকেই তৎপর ছিল এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন ইস্যু ও স্পর্শকাতর বিষয়ে দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের সূত্র ধরে মোড়লগিরি ধরে রাখার চেষ্টা করেছে অব্যাহতভাবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদের নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার একটি অঘোষিত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা তাদের পরিকল্পনা মতো এগিয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে তাদের গৃহীত ও ঘোষিত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববাসী তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে সহজেই অবগত হয়েছে। আবার অনেকেই এমনও বলে থাকে পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষ করে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদকে জিইয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সংযুক্ততাকে দায়ী করে থাকেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী অনেকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। গবেষকরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এ সংস্থার তথ্য উপাত্ত মূল্যায়ন করে গবেষণা কার্য সম্পাদনের চেষ্টা করে থাকেন। কিছুদিন আগে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের যুদ্ধের ওপর এ সংস্থাটির দাখিল করা প্রতিবেদনে ব্যাপক পক্ষপাতিত্বের স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। বিশেষ করে গবেষণা সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও ইসরায়েলের সরকারের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে ফিলিস্তিনের ভুক্তভোগীদের কোনোরূপ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। এ সংক্রান্ত রিপোর্ট বের হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সমালোচনার ঝড় উঠে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিশ্বব্যাপী সব দেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়ে তেমন বিস্তারিত প্রতিবেদনে উঠে আসে না কিংবা ইচ্ছে করেই প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। এটি এক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র ও অবস্থানকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক লক্ষণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরলেও নিজের দেশের মানবাধিকার নিয়ে একেবারেই উদাসীন। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত বিরতিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে, পুলিশের হেফাজতে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে। মানুষের মধ্যে অস্বস্তি ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে, তথাপি সরকার কিংবা রাষ্ট্র এসবের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বর্তমান প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করে বলেছেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে নিজ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করুন। তিনি বলবার চেষ্টা করেছেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থনের কারণেই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার তেমন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে দেখা যায়, এ যুদ্ধের কারণে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রের বোধোদয় হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে নিজ দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, জানমালের সুরক্ষা, দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতি বজায় রাখা, অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। সর্বোপরি বর্ণ, গোত্র বৈষম্যের ব্যবধান গুছিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যাওয়া।

কিছু দিন পর পর সংবাদমাধ্যমের বরাতে শোনা যায়, বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তী সংবাদে প্রতিকারমূলক কোনোরূপ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে তেমন উল্লেখযোগ্য অর্জনের সংবাদ আমাদের গোচরীভূত হয় না। এর মানে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে, তা না হলে যে সংবাদমাধ্যমের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সম্বন্ধে আমরা জেনে থাকি সেই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে পরের সংবাদটুকুও প্রচার করা। যেহেতু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে কোনো সংবাদ গোচরীভূত হয়নি সেহেতু ধরে নেওয়া যায় এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে না। তাহলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নীরবে নিভৃতে বিচারের বাণী ক্রন্দনে পর্যবসিত হয়ে থাকে। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের দেশে অভিবাসী হয়ে যারা গমন করছে কিংবা তাদের দেশের স্থায়ী নাগরিক তাদের প্রত্যেকের মানবাধিকার নিশ্চিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া। কেননা রাষ্ট্রের মূল এবং মৌলিক কাজ হচ্ছে নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া এবং অধিকার নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

অপ্রকাশিত অনুভূতি

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১০:৫৮ এএম
অপ্রকাশিত অনুভূতি
মো. ইব্রাহিম আজাদ

সকাল বেলার রোদটা আজ যেন একটু বেশি নরম। কলেজের পাশে ছোট একটা বাসায় একাই থাকেন রায়হান সাহেব। সাহিত্যের অধ্যাপক। স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় থাকে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথার চুলে পাক ধরেছে। চোখে রিডিং চশমা লাগে। শ্যামল বর্ণের মাঝারি গড়ন। প্রথম দেখাতেই আকর্ষণীয় কোনো ভাব নেই। নিরীহ গোছের গোবেচারা টাইপের মানুষ। নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু ক্লাসে যখন পড়ান, তখন তিনি পড়ার মধ্যে নিজেকে একাত্ম করে নেন। ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো রায়হান সাহেবের কথা শোনেন।

আজ রায়হান সাহেব নিজের কক্ষের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে আনমনে চুমুক দিতে দিতে দেখেন সামনের কাঁঠাল গাছ থেকে আকাশে উড়ে যাচ্ছে এক জোড়া শালিক। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মনের মণিকোঠায় একটা মুখ হালকা মেঘের মতো উঠেই পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। অনেক মুখের ভিড়ে কোনো একটা মুখ বিশেষ কোনো ক্ষণে কেন ভেসে আসে তার ব্যাখ্যা রায়হান সাহেব খুঁজে পান না। তার মনে হয় এ বয়সে এসে মানুষ যখন পেছন ফিরে তাকায় তখন যা মনে থাকে, তা আর কোনো ঘটনা নয়- তা হয় কিছু অনুভব, কিছু গন্ধ, কিছু না বলা কথার দাগ।

সময়টা ছিল আশির দশকের শুরুর দিকে। গ্রামের ছেলে রায়হান। তার অনেকটা চরের মতো চারপাশে আবাদি জমি ছিল, আবার প্রচুর বালুময় রাস্তাও ছিল। প্রতি বছর প্রায় বন্যা হতো। রায়হান নিজের বাড়ির পাশের বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে গ্রামে অবস্থিত উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়।

সে সময় নিয়ম ছিল ছেলেরা নিজ নিজ ক্লাসে বসে থাকত আর মেয়েরা তাদের জন্য নির্ধারিত কমন রুমে থাকত। ক্লাস শুরু হওয়ার সময় স্যারের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে আসত আবার ক্লাস শেষ হলে স্যারের সঙ্গে সঙ্গে কমন রুমে ফিরে যেত। প্রথম দিন রায়হান দুরুদুরু বুকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। প্রথম দিন কারও সঙ্গে তেমন একটা কথা হয়নি। সে দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে। রায়হান ছাত্র হিসেবে ভালোর দিকে ছিল। প্রতিদিনের পড়া তৈরি করে যেত। অবশ্য এর কারণও ছিল। সে সময় শিক্ষকরা পড়া না পারলে শাস্তি দিত। হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে যাওয়া এক প্রকার নিয়ম ছিল। 

ধীরে ধীরে রায়হান নতুন সহপাঠীদের নাম, পরিচয় আত্মস্থ করে। কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যায়। আবার আশপাশের এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় অনেকের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কের যোগসূত্র বেরিয়ে আসে। শাহিন, শওকত, মোল্লা, বাদল, রতনের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়। ফলে তার মনের মধ্যে যে দুরুদুরু ভাব ছিল তা দূর হয়ে যায়। গ্রামে সে সময় মেয়েদের পড়াশোনা বেশ ভালো মতোই শুরু হয়ে গেছে। তাদের ক্লাসে আটজন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। কোনো কোনো মেয়ের নামও জেনে গেছে। এর মধ্যে যা তার মনে গভীর দাগ রেখে যায় তা হলো জ্যোতি ও মলি। তারা দুই বোন একই ক্লাসে অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণিতে রায়হানদের সঙ্গে পড়ত। জ্যোতি ছোট মলি বড়। বাবা ছিলেন উকিল। তাই তাদের মধ্যে আলাদা কী যেন একটা কাজ করত। ক্লাসের বাইরে তাদের সঙ্গে রায়হানের কখনো কোনো কথা হয়নি। কিন্তু কেন রায়হান নিজেও জানে না, জ্যোতির মুখ মাঝে মাঝে মেঘের মতো ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যায়। শুধু তাই নয় ছাত্রজীবনে অনেকের সঙ্গেই তো পড়েছে তাদের কারও মুখ-মনের গহীনে ভেসে ওঠে না। তবে কি জ্যোতিকে ভালোবাসত। না, সেরকম কিছু না। কেননা রায়হান জানে ভালোবাসা আলাদা। হয়তো ভালো লাগা। কোনো কূলকিনারা খুঁজে পান না। তবে কি লিকলিকে কালো বর্ণের হীনম্মন্যতায় ভোগা রায়হানের কাছে সে ছিল রূপকথার পরী।

সপ্তম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে যে যার মতো ছুটি কাটানো শেষে নতুন বছরের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে রায়হান জানতে পারে জ্যোতি ও মলি তাদের সঙ্গে পড়বে না। তারা শহরের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এতে রায়হানের মনে বেশ ব্যথা করে। কেন করে তাও জানে না। এ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কিছু বলতেও পারে না। শুধু কষ্টটা বয়ে বেড়ায়। 

কিছুদিন পর রায়হান শুধু ওই বিদ্যালয় নয় নিজ এলাকা ছেড়ে দেশের অন্য প্রান্তে চলে যায় এবং সেখানে একটা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সময়ের আবর্তনে রায়হান নতুন পরিবেশ, নতুন পরিচয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। পড়াশোনা শেষ করে সরকারি কলেজে চাকরি হয়, বিয়ে হয়। চাকরি, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে অনেকটা গুছানো জীবন। তারপরও কিছু ক্ষণ, কিছু মুহূর্ত থেকে থেকে আসে যখন বাতাসে শালিকের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনে কিংবা নীল আকাশে বকের ভেসে যাওয়া সারি দেখে স্থির হয়ে যায়। কিছু শব্দ হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যায়। যেমন কিছু অনুভব বেঁচে থাকে নিশ্বাসে। 

মাঝে মাঝে কৈশোরের অবাধ্য সময়গুলো; স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, স্মৃতিগুলো একটার পর একটা দৃশ্যকল্প এঁকে চলে যায়। এসবের কোনো অর্থ সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। কেনই-বা এগুলো হয় তা বুঝতে পারে না। তবুও কেন জ্যোতির মুখ মনের মাঝে ভাসে। তিনি ভাবেন জ্যোতিকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কাউকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারেন না। তা ছাড়া নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করেন। কেন আমি তাকে খুঁজব? অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো নিজের হৃদয়ে হাতড়ান। কোনো কিছু নেই। তারপরও কী অদম্য আগ্রহ।

বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেছে। রায়হান একসময় জানতে পারে জ্যোতি একজন সুখী মানুষ। স্বামী সংসার হয়েছে। শুধু তাই নয় সেও একজন সাহিত্যের অধ্যাপক। শুনে জ্যোতিকে দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থিরতা অনুভব করে রায়হান। কিন্তু একা দেখা করার সাহস হয় না। কেননা জ্যোতির সঙ্গে তার সরাসরি কোনো কথাই হয়নি কখনো। এখন ৪০ বছর পর দেখা হলে জ্যোতিই-বা রায়হানকে চিনবে কেন? মনের মাঝে ক্ষীণ আলো রেখা দেখে যদি চেনে?

অনেক ভেবে রায়হান তার বাল্যবন্ধু সহপাঠী রতনকে খুলে বলে জ্যোতির কথা। রতনও জ্যোতিকে দেখেনি ক্লাস সেভেনের পর। রায়হান ও রতন সিদ্ধান্ত নেয় কোনো একদিন হঠাৎ জ্যোতির বাসায় হাজির হবে। আবার দুজনে কী জন্য কিংবা কী পরিচয়ে যাবে। নানা শঙ্কা কাজ করে ভেতরে ভেতরে।

কিন্তু আবিষ্কারের নেশায় সব আশঙ্কাকে অসার মনে হয়। উচিত অনুচিতের প্রশ্নকে আড়ালে রেখে সব আশঙ্কাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখে একদিন দুই বন্ধু হাজির হয় জ্যোতির বাসার সামনে। অধ্যাপক হিসেবে তাকে পাড়ার সবাই জানেন। রতন বাসার কলিং বেল টিপ দিতেই একজন বাসা থেকে বের হয়ে জানতে চান আমরা ঠিক কাকে খুঁজছি। রতন জ্যোতির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল আমিই জ্যোতি। কিন্তু আপনাদের তো চিনলাম না। রতন জ্যোতিকে জিজ্ঞেস করল আমরা যে বিদ্যালয়ে পড়তাম তার কথা। তারা দুই বোন পড়ত কি না। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রতন জিজ্ঞেস করল তাকে চিনতে পারছি কি না। সে আবার না সূচক মাথা নাড়ল। রতন নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, তবুও জ্যোতির কোনো স্মৃতি মনে করতে পারছিল না।

রায়হান চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন শুনতে শুনতে ভাবছিল তার আশঙ্কা সত্য হয়ে যায় কি না। ভেতরে উৎকণ্ঠা কাজ করছিল।

এটাও ভাবছিল এতদিনের ব্যবধানে তাদের না চেনাটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া সময়ের আবর্তনে মানুষ তার কত কিছুই ভুলে যায়। খানিকটা বিরক্ত হয়ে রতনের হাতে টান দিয়ে বলে, চল আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ঘরের ছেলে ঘরে চল। অকস্মাৎ চিৎকার করে জ্যোতি বলে, আরে থাম, তুই রায়হান না। রায়হান হতবিহ্বল হয়ে যায়। নিজের কানকে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। জ্যোতি শুধুই যে তাকে চিনতে পেরেছে তা নয়, তার নাম পর্যন্ত মনে রেখেছে। রায়হানের নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সে শুধু অনুভব করে, যাকে দেখার জন্য এত অপেক্ষা তা সার্থক হয়েছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (অর্থনীতি বিভাগ), পলাশবাড়ী সরকারি কলেজ, গাইবান্ধা

সড়ক দুর্ঘটনা: বাস্তবতা ও করণীয়

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১২:১৪ পিএম
সড়ক দুর্ঘটনা: বাস্তবতা ও করণীয়
রিয়াজুল হক

গত সপ্তাহের ঘটনা। চোখের সামনে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সারা জীবনের স্বপ্ন এক মুহূর্তে শেষ। আর তিনি চলে যাবার পর পুরো পরিবার এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। অগণিত মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাব মতে, দেশে বছরে পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্য, এ মৃত্যুর সংখ্যা ২১ হাজারের বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা সেন্টারের তথ্যমতে, দেশে বছরে ১১ হাজারের মতো লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।

সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো বেপরোয়া গাড়ি চালানো। বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে অনেক সময় ঘুষ ও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়, ফলে অপেশাদার চালকরা রাস্তায় নামছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যানবাহনের ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং গাড়ির ওভারলোডিং।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতা। অপ্রশস্ত সড়ক, ফুটপাতহীন পথ, অপরিকল্পিত বাসস্ট্যান্ড ও মার্কেট এলাকায় যাত্রী ওঠানামা, সব মিলিয়ে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। এ ছাড়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগে শৈথিল্য দুর্ঘটনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনা কেবল একটি ব্যক্তির জীবন শেষ করে না, তার সঙ্গে একটি পরিবার ধ্বংস করে দেয়। দুর্ঘটনায় একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিহত বা পঙ্গু হলে তার পরিবারে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি একটি বড় ধাক্কা।

আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ক্ষতি হয় প্রতি বছর।

সড়ক দুর্ঘটনার সমাধানের পথ কোথায়? 
প্রথমত, চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদান ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে। একটি পেশাদার ও কঠোর ড্রাইভিং ট্রেনিং ও পরীক্ষার পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে। লাইসেন্স যেন সত্যিকারের যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয়, তা কঠোরভাবে মনিটর করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে যে আইন আছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল এবং কারাদণ্ডের বিধান কার্যকর করতে হবে।

তৃতীয়ত, গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে মালিক-শ্রমিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রতিযোগিতার নামে বাসচালকদের গতির প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক রুটে নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী বাস চালনা নিশ্চিত করতে হবে।

চতুর্থত, সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি। শহর ও গ্রামে সড়কের প্রশস্ততা, ইউটার্ন, স্পিডব্রেকার, ফুটওভারব্রিজ ও ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে হবে। পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জেব্রাক্রসিং ও ফুটপাতকে ব্যবহারযোগ্য ও বাধামুক্ত রাখতে হবে।

পঞ্চমত, সড়ক দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত ডেটাবেজ তৈরি ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে। কোথায় কোন ধরনের দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে, কোন সময়ে বেশি হচ্ছে, এসব তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।

আইন ও অবকাঠামো ছাড়াও জনগণের সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে ট্রাফিক সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেমিনার, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব। যাত্রীরা নিজেদের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল রাখতে শিখলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে।

আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, কিন্তু তা অসম্ভব নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনসম্পৃক্ততা। আমাদের সড়ক যেন মৃত্যুকূপ না হয়ে বরং নিরাপদ যাত্রার পথ হয়, এই প্রত্যাশাই সবসময় করি।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

মৌলিক চাহিদা, সময় ব্যবস্থাপনা ও সেবাই যেখানে মূখ্য

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ১০:০৭ এএম
মৌলিক চাহিদা, সময় ব্যবস্থাপনা ও সেবাই যেখানে মূখ্য
মো. কামরুল ইসলাম

দেশের অর্থনীতির গতিপথ নির্ভর করছে প্রবাসীদের আয়ের অর্থের উপর। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশকে, দেশের মানুষকে ভালো রাখার জন্য প্রাণান্ত কষ্ট করে যাচ্ছেন। আর এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জিডিপিতে প্রতিনিয়ত কন্ট্রিবিউট করে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষিত জনগোষ্টিকে কাজে লাগিয়ে বেকারত্ব লাগব করার চেষ্টা করছে ইউএস-বাংলা গ্রুপ। 

দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ইউএস-বাংলা গ্রুপ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে কাজ করছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদাকে দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে ইউএস-বাংলা।

ইউএস-বাংলা গ্রুপ প্রতিষ্ঠার শুরুতে দেশের মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বাসস্থান সমস্যার সমাধান খুঁজতে ইউএস-বাংলা এসেটস্ এর মাধ্যমে পূর্বাচল আমেরিকান সিটির আবির্ভাব ঘটায়। অধিক জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে বাসস্থান সংকট প্রকট। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত সব শ্রেণির নাগরিকদের জন্য আধুনিক সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রেখে একটি সবুজায়নে ভরপুর পূর্বাচল আমেরিকান সিটি উন্নত নাগরিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নের চেয়ে বেশি সুবিধা সম্পন্ন প্রকল্প পূর্বাচল আমেরিকান সিটি।

মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এই স্বাস্থ্য সেবাকে নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ইউএস-বাংলা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছে ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ইউএস-বাংলা মেডিকেলে শুধু চিকিৎসা সেবাই দেয় না, উপরন্তু মেডিকেল কলেজ থেকে প্রতিবছর মেধাসম্পন্ন ডাক্তার পাশ করে সারা বাংলাদেশে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, যা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গতিশীল রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

গ্রিন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, উচ্চ শিক্ষার অন্যতম দিগন্ত। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় অবস্থানে পৌঁছে দিতে ইউএস-বাংলা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের অন্যতম বিদ্যাপিট গ্রিন ইউনিভার্সিটি। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে গ্রিন ইউনিভার্সিটি প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।

ভাইব্রেন্ট আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে, নতুন প্রজন্মের চাহিদা অনুযায়ী দাম ও মানের প্রতি যত্নশীল থেকে পন্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে ভূমিকা রাখছে। নারী, পুরুষ, শিশুসহ সব বয়সের মানুষের জন্য লেদারসামগ্রী, গার্মেন্টস পণ্যসহ নানাবিধ বস্ত্রসামগ্রী দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ন্যনতম অংশীদারত্বের মাধ্যমে দেশের সেবা করে যাচ্ছে ভাইব্রেন্ট। সারা দেশে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে ভাইব্রেন্টের পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য নিজস্ব আউটলেট স্থাপন করে চলেছে।

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখানে সময় একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। খাদ্য তৈরিতে সময়ক্ষেপণ না করে নতুন প্রজন্ম রুচিসম্মত খাদ্যগ্রহণে সারাবিশ্বেই ফুড অ্যাপের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন প্রজন্মের জন্য সময়টাকে ক্যাশ করার জন্য ‘ফুডি’র আবির্ভাব। আর সেই আবির্ভাবে মূলে রয়েছে ইউএস-বাংলা গ্রুপ।

ইউএস-বাংলা গ্রুপ যাত্রা শুরুর পর থেকে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধির পরিকল্পনায় ছিল সেবা। সেবাই ধর্ম- এই ব্রত থেকেই ইউএস-বাংলা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ইউএস-বাংলার এয়ারলাইন্সের আবির্ভাব ঘটান। দেশের ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দেওয়ার মানসে, দেশের আকাশপথকে সাবলীল রাখার নিমিত্তে গড়ে তোলে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। বর্তমানে ৪৩৬ আসনের দুটি এয়ারবাস ৩৩০-৩০০, ৯টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ সহ মোট ২৪টি এয়ারক্রাফট রয়েছে। যা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর-সহ বিশ্বের ১০টি দেশের ১৪টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। 

পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নকে সাথে নিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে বাংলাদেশের আকাশপথে বিস্তৃতি লাভ করেছে। যা দিয়ে বাংলাদেশের এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজেম ইন্ডাস্ট্রিকে স্থিতিশীলতা দিতে পারছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ ইউরোপের গন্তব্য বিশেষ করে লন্ডন, রোম-সহ আরও অধিক গন্তব্য এবং ২০২৮ সাল নাগাদ টরেন্টো, নিউইয়র্কে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে।

অ্যাভিয়েশন ব্যবসা একটি সেবাধর্মী ব্যবসা। এয়ারলাইন্সকে আরো বেশি গতিশীল করার নিমিত্তে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ব্যবসাকে সাবলীল করার লক্ষ্যে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি অ্যাপসের মাধ্যমে এক প্লাটফর্মে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, এয়ার টিকেট, লোকাল ট্রান্সপোর্টসহ যাবতীয় চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে ইউএস-বাংলা গ্রুপ চারটি ওটিএ কোম্পানি তৈরি করেছে। কোম্পানিগুলো হচ্ছে ট্রিপলাভার, ফার্স্টট্রিপ, ট্রাভেলচ্যাম্প ও টেকট্রিপ। যা দিয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড ট্রাভেল ব্যবসায়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ট্রাভেলারদের যোগ করতে পারছে। সারাবিশ্বের সব এয়ারলাইন্স, হোটেলকে এক প্লাটফর্মে উপস্থাপন করতে পারছে। ট্রাভেলাররা চাহিদামতো সেসব প্লাটফর্ম থেকে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী টিকেট, হোটেলসহ অন্য সব সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে।

সময়কে প্রাধান্য দিয়ে সেবাকে উপস্থাপন করে ইউএস-বাংলা গ্রুপ ই-কমার্স ব্যবসায় যোগ করেছে ‘কার্টআপ’, অনলাইন ভিত্তিক ‘ক্যারিবি’। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের যেকোনো সংবাদ মুহুর্তে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনলাইন নিউজপেপার সকলের গ্রহণযোগ্য ঢাকাপোস্ট, ঢাকামেইল এবং অনলাইন ও প্রিন্ট ভার্সনে দৈনিক আজকের পত্রিকা পাঠকদের জন্য নিয়ে আসে ইউএস-বাংলা গ্রুপ। 

দেশের সফটওয়্যার ব্যবসাকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার তাগিদে উন্নত জাতি গঠনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দেশের সব শিল্পকে দ্রুততার সঙ্গে সেবা দেওয়ার জন্য ইউএস-বাংলা গঠন করে ‘টেকনোনেক্সট’।

শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে ‘সময়’ আধুনিক বিশ্বে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। সময় বাঁচিয়ে সেবাকে প্রাধান্য দিয়ে ইউএস-বাংলা গ্রুপ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে চলেছে, যা দিয়ে দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণসহ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। 

মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা গ্রুপ

প্রকৃতির এয়ার কন্ডিশনার নিম গাছ

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৫, ০২:৪৮ পিএম
প্রকৃতির এয়ার কন্ডিশনার নিম গাছ
রিয়াজুল হক

আমরা এক অস্বাভাবিক গরমের সময় পার করছি। প্রতিদিনের আবহাওয়ার খবরেই সেই প্রমাণ মেলে। দেশের সব অঞ্চলেই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। কোথাও কােথাও ৪০ ছাড়িয়ে গেছে। বাতাসে আর্দ্রতা কম, ঘাম শুকায় না, ঘর ঠান্ডা হয় না। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, আমরা কী কিছুই করতে পারি না? বিজ্ঞান ও প্রকৃতির উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, পারি। আর সেই উপায়ের নাম হলো, গাছ। বিশেষত দেশীয় গাছ। আর তার মধ্যেও যেটি সবচেয়ে কার্যকর ও উপকারী, তা হলো নিম গাছ।

সম্প্রতি ভারতের আহমেদাবাদ শহরের সিইপিটি ইউনিভার্সিটি একটি গবেষণা করেছে, যেখানে দেশীয় প্রজাতির গাছের মধ্যে বিশেষভাবে নিম গাছ শহুরে উষ্ণতা প্রশমনে কতটা কার্যকর, তা পরিমাপ করা হয়। এই গবেষণায় তারা তাপমাত্রা, বিকিরণ এবং মানবদেহ কতটা গরম অনুভব করে - এই তিনটি দিক পরিমাপ করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নিম গাছের কারণে বাতাসের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যায়। মোট বিকিরণ তাপমাত্রা কমে ২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। মানবদেহে তাপমাত্রা ২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম অনুভূত হয়।

এই গবেষণা নগর পরিকল্পনা ও জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোর পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের শহরগুলোতে, যেখানে ঘনবসতি, কংক্রিট এবং গাছপালা কম- সেখানে এ ধরণের দেশীয় ছায়াদানকারী গাছ লাগানো বাস্তবিক অর্থেই তাপমাত্রা কমাতে পারে।

সিইপিটি ইউনিভার্সিটির গবেষণার ফলাফল আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গেও মিলে যায়। আপনি যদি একটি বড় নিম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান, শরীর স্বস্তি পায়, যেন বাতাসও শীতল। কারণ, নিম গাছ ঘন ছায়া দেয়, ট্রান্সপিরেশন প্রক্রিয়ায় পরিবেশে আর্দ্রতা ছাড়ে এবং বিকিরণ তাপ শোষণ করে।

আমাদের দেশে নিম গাছ পরিচিত ও সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও আজ শহরাঞ্চলে এর দেখা মেলে না বললেই চলে। অথচ ঢাকার মতো শহরগুলোতে যেখানে কংক্রিট আর পিচঢালা রাস্তায় ঘেরা, সেখানে যদি প্রতি ব্লকে, প্রতি স্কুল বা হাসপাতালের পাশে অন্তত কয়েকটি নিম গাছ থাকত, তাহলে শহরের গড় তাপমাত্রা অনেকটাই কমে আসত।

নিম গাছের আরও কিছু দারুণ বৈশিষ্ট্য আছে। এটি খুব কম যত্নে বড় হয়, শুষ্ক ও অনুর্বর মাটিতেও জন্মাতে পারে। এতে পানির চাহিদা কম এবং কোনো রাসায়নিক সার না দিলেও চলে। পাশাপাশি এটি বায়ু বিশুদ্ধ করে, রোগজীবাণু দমন করে এবং কৃষিকাজে প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

আজকের প্রেক্ষাপটে নিম গাছ যেন একযোগে পরিবেশ রক্ষাকারী, স্বাস্থ্যরক্ষাকারী এবং জলবায়ু-যোদ্ধা। শহরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য যে সবুজ অবকাঠামো দরকার, নিম গাছ তারমধ্যে অন্যতম।

আমাদের নাগরিক জীবনে এখনই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে যদি প্রতিটি খোলা জায়গায় তিন থেকে পাঁচটি নিম গাছ রোপণ করা যায়, তবে কয়েক বছরের মধ্যে আমরা স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পাব। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, হাসপাতাল ও সরকারি অফিসে পরিকল্পিতভাবে নিম গাছ রোপণের কাজ চালানো যেতে পারে। 

একইসঙ্গে দরকার গাছ বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ। অনেক সময় দেখা যায়, গাছ লাগানো হলেও তা ঠিকমতো বড় হয় না, অথবা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শুকিয়ে যায়। তাই রোপণ থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা থাকা দরকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দিনে গরমের মাত্রা আরও বাড়বে। এই আগাম সংকেতের মোকাবিলা করতে হলে আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আর সেই প্রস্তুতির অন্যতম অংশ হলো, প্রতিটি অঞ্চলে দেশীয় গাছ লাগানো। আর যদি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, স্বল্প রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও দীর্ঘস্থায়ী উপকার বিবেচনায় আনা হয়, তখন নিম গাছ হয়ে ওঠে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। নিজের শহর, গ্রাম, পাড়া কিংবা স্কুলের প্রাঙ্গণে অন্তত একটি করে নিম গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এই ছোট উদ্যোগই হতে পারে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

বজ্রপাতের ভয়াবহতা বাড়ছে, করণীয় কী?

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৫, ০৮:০৭ পিএম
আপডেট: ১৯ মে ২০২৫, ০৮:৩৮ পিএম
বজ্রপাতের ভয়াবহতা বাড়ছে, করণীয় কী?
রিয়াজুল হক

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার এবং এর প্রাণঘাতী প্রভাব চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। একসময় বজ্রপাত ছিল বর্ষাকালের চেনা এক প্রাকৃতিক দৃশ্যমাত্র। এখন এটি হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। বজ্রপাত হলেই কিছু সময় পর নিউজ হচ্ছে, দেশে ১০ জন মারা গিয়েছে কিংবা ১২ জন মারা গেছ। ২০২৪ সালে বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা ছিল ৫০০ এর বেশি, যা আগের দশকগুলোর তুলনায় উদ্বেগজনকভাবে বেশি। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এত বজ্রপাত হচ্ছে এবং এই বজ্রপাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আমরা কী করতে পারি?

বজ্রমেঘ থেকে মূলত বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। এই মেঘ তৈরির প্রধান উপাদান হলো গরম ও আর্দ্র বাতাস। বাংলাদেশ একটি উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার দেশ। বিগত দশকে গড় তাপমাত্রা বাড়ায় বাষ্পীভবন বেড়েছে, ফলে আকাশে পানিবাষ্প জমে মেঘ তৈরির হার বেড়েছে। যখন উপরের ঠান্ডা বাতাস এই গরম, আর্দ্র বাতাসের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন শক্তিশালী বজ্রমেঘ তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রিক চার্জের অস্থিরতা তৈরি হয়, যার ফলশ্রুতিতে বজ্রপাত ঘটে। বিশেষ করে, এপ্রিল থেকে জুন মাসে বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডল থাকে অত্যন্ত অস্থির। এই সময়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে, আবার বর্ষার আগমনে বাতাসে আর্দ্রতাও বাড়ে। ফলে বজ্রপাতের হার এই সময় বেশি থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৃষ্টির শুরু এবং শেষের মধ্যবর্তী সময়ে—যখন আকাশে আংশিক মেঘ ও সূর্যের আলো একসঙ্গে থাকে, তখন বজ্রপাত বেশি হয়।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে উষ্ণতা বাড়ছে, যা বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গবেষণা বলছে, প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়ে প্রায় ১২ শতাংশ। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে প্রায়ই ৪০/৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই করে, যা বজ্রপাতের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

এর সাথে যোগ হয়েছে বনভূমি উজাড়, জলাভূমি ভরাট এবং খোলা জায়গায় ধাতব বস্তু ও বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর মতো মানবসৃষ্ট কার্যক্রম, যা বজ্রপাতের তীব্রতা বাড়ায়। এবং মানবদেহে আঘাত করার ঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় এখনো বজ্রপাত সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। অনেকেই খোলা মাঠে কাজ করেন, মোবাইল ব্যবহার করেন বা গাছের নিচে আশ্রয় নেন, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এছাড়া বজ্রপাত ঠেকাতে বা মোকাবিলা করতে ব্যবহৃত হয় এমন প্রযুক্তির ব্যবহারও নগণ্য। শহরে কিছু ভবনে লাইটনিং অ্যারেস্টর লাগানো থাকলেও গ্রামাঞ্চলে তা একেবারেই অনুপস্থিত।

তপ্রাণঘাতী বজ্রপাত প্রতিকারে আমাদের অবশ্যই কিছু করণীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।‌ নিম্নে কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।

স্কুল-কলেজে বজ্রপাত বিষয়ে সচেতনতামূলক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গ্রামের মসজিদ, ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় ক্লাবগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে বজ্রনিরোধক যন্ত্রপাতি (যেমন: লাইটনিং অ্যারেস্টর) বসানো যেতে পারে। বিশেষ করে স্কুল, হাট-বাজার, মসজিদ বা মাঠের ধারে এসব ব্যবস্থা নিতে হবে।

বজ্রপাত হওয়ার আগাম বার্তা মোবাইল ফোনে এসএমএস বা অ্যাপের মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বড় গাছ বজ্রপাত শোষণ করতে পারে এবং তা নির্দিষ্ট জায়গায় নির্গত করতে সাহায্য করে। পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ বজ্রপাতের তীব্রতা কমাতে সহায়ক হতে পারে।

বজ্রপাত প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও আমাদের অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনা এটিকে প্রাণঘাতী করে তুলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই এখনই বজ্রপাতকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। জীবন রক্ষা শুধু প্রযুক্তির মাধ্যমে নয়, সচেতনতা, শিক্ষা এবং পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমেও সম্ভব। প্রকৃতিকে সম্মান জানালে প্রকৃতিও আমাদের রক্ষা করবে।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সিফাত/