শুরু করি বাসন্তিকে দিয়েই। ১৯৭৪ সালের সেই জালপরা বাসন্তি। বাসন্তির ছবি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দু'বার। ৩১ জুলাই, ১৯৭৪ প্রথম প্রকাশ। ইত্তেফাকের ভেতরের ক্রোড়পত্রে দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৭৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ছবিটি যিনি তুলেছিলেন তার নাম ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদ। যখন পত্রিকায় ছাপা হয় তখন ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন।
এই ছবিটি যে ভুয়া ছবি, সেই তথ্য উদঘাটিত হতেও সময় লেগেছে অনেক বছর। ছবিতে দু'জন নারী। একজন বাসন্তী, আর একজন বাসন্তীর চাচাতো বোন দুর্গাতি। জালপরা মেয়েটি বাসন্তী। সেই ছবি তোলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী রাজো বালা। রাজো বালা জানান, ৭৪ সালে যখন বাসন্তী- দুর্গাতিদের ছবি তোলা হয় তখন বর্ষাকাল। চারিদিকে জল আর জল। তিনজন লোক আসে বাসন্তীদের বাড়িতে। একজন সেই সময়ের স্থানীয় রিলিফ চেয়ারম্যান আনছার। অপর দু'জনকে রাজো বালা চিনেন নাই। বাসন্তী- দুর্গাতিদের একটি কলাগাছের ভেলায় করে বাড়ি থেকে বের করা হয়। আর অন্য একটি ভেলায় করে তাদের ছবি তোলা হয়। বাঁধের উপর মাঝিদের জাল ছিল যা রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। সেই জাল এনে বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ির উপর পড়ানো হয়। বাসন্তির কাকা বুদুরাম আপত্তি জানান। বলেন ছেঁড়া হলেও একটা শাড়ীতো পরা আছে। তার উপর জাল পরানো দরকার কী? বাসন্তী ছিলেন এক বাকপ্রতিবন্ধী এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সেই নারীকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার কাজে ব্যবহার করা হয়।
এই ছবি এবং ইত্তেফাকে তা প্রকাশ ছিল সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক ভয়াল জুচ্চুরি এবং এক কালো থাবা। এক জঘন্য প্রতারণা।
সেদিন কারও মাথায় আসেনি একটি জালের দাম একটি শাড়ির দাম থেকে কম নয়। সদ্য স্বাধীন একটি দেশে বাংলাদেশ নামক একটি যুদ্ধের ময়দানকে বিনির্মাণে যখন দিশেহারা বঙ্গবন্ধু, তখন এই সব বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্র ও প্রোপাগান্ডা চলতে থাকে। চলতে থাকে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র। সব ষড়যন্ত্র এক হয়ে তৈরি করে ১৫ আগস্টের ভয়াল ট্রাজেডি। বাঙালি জাতিসত্তাকে ধংস করার এক ভয়ানক অপপ্রয়াস।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার এই নেগেটিভ উদাহরণ থেকেই এই লেখাটা শুরু করলেও আমি এবং আমরা কেউই মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী নই।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা কী?
সোজাসাফটা সরল অঙ্ক। আমার বাক স্বাধীনতা মানে আমি যা খুশ তাই বলবো। কাউকে তেল মারতে ইচ্ছা হলে উৎকটভাবে তেল মারবো। কাউকে গালি দিতে ইচ্ছে হলে নিজের ভাণ্ডারে যত কঠিন শব্দ আছে তা দিয়ে গালি দিব। নিজের ভাণ্ডারে ফুরিয়ে গেলে অন্যের কাছ থেকে ধার-দেনা করে কঠিন শব্দ জোগাড় করে গালি দিব। খাঁটি বঙ্গ ভাষায় গালি দিব। খাঁটি বঙ্গ ভাষা না কুলালে আঞ্চলিক ভাষায় গালি দিব। তাতেও না কুলালে ইংরেজী, উর্দু, আরবি, ফারসি, হিন্দি যে ভাষায় উৎকট শব্দ আছে সে ভাষা থেকে শব্দ চয়ন করে গালি দিব। এমন ভাষা প্রয়োগ করবো যাতে যাকে উদ্দেশ্য করে ভাষাটি প্রয়োগ হচ্ছে তার শ্রবণ শক্তি যেন ঝালাপালা হয়ে যায়। অন্তর যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। যে শব্দটি তার কাছে সবচেয়ে কষ্টদায়ক সেই শব্দ দিয়েই তাকে জব্দ করবো। যে হাঁটতে পারে না- তাকে লেংলা বলে কষ্ট দিব। যে কথা বলতে পারে না- তাকে বোবা শয়তান বলে গালি দিব। যে নারী ডিভোর্সি- তাকে সেই প্রেক্ষাপট তুলে তুলোধুনা করবো। ভাল নারীকে কারণে বা অকারণে বেশ্যা বলে কলঙ্ক দিব। কেন দিব? কারণ এটা আমার বাক স্বাধীনতা। বাক স্বাধীনতা মানে আমার যা খুশি আমি তাই বলবো।
বাক স্বাধীনতা মানে কি এমন?
জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ইউনিভার্সাল ডিকলারেশন অব হিউম্যান রাইটস এর ১৯নং আর্টিকেলে মানুষের বাক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার বিধান করা হয়েছে। সভ্যতার দাবিদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের কনভেনশন ফর দ্যা প্রকেটশন অব হিউম্যান রাইটস এন্ড ফান্ডামেন্টাল ফ্রিডম এর ১০নং আর্টিকেলে বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তার বিধান করেছে।
এবার স্বদেশ প্রসঙ্গ
স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনের দশ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার দ্রুততম সময়ে সংবিধান প্রণয়ন করে। রক্তের অক্ষরে লেখা সেই সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ মত প্রকাশের তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংক্রান্ত। এই অনুচ্ছেদে নিখুঁত ভাষায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা, ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি সংবাদপত্র এবং মিডিয়ার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। তবু আমাদের দিকে আঙ্গুল তোলে আমেরিকা। আঙ্গুল তোলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলে বিভিন্ন ফোরামে হইচই ফেলে দেয়। হইচই ফেলে দেয় বিভিন্ন মিডিয়ায়। মাঝে মধ্যে আমরাও তাদেরকে ডেকে এনে অযাচিত মন্তব্য করাই। কেন?
আঙ্গুল তোলার কারণ কি এই যে বাংলাদেশে আসলেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনুপস্থিত? নাকি কেবলই মোড়লিপনা?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে সাদামাটা ভাষায় কিছু বিশ্লেষণ করি। মত প্রকাশের স্বাধীনাত কি অবাধ? সোজাসাপটা উত্তর- নিশ্চয়ই নয়। জাতিসংঘের ঘোষণা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট অংশেই সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত আছে এই অধিকারের সীমাবদ্ধতাসমূহ।
একটা উদাহরণ দেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কনভেনশনের আর্টিক্যাল ৮ হলো ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ তার অনুরূপ। দু’টাই অধিকার। কোন অধিকার হতে কোন অধিকার ছোট নয়।
করিম একজন সাংবাদিক কিংবা ব্লগার। তার অধিকার আছে মত প্রকাশের। তিনি রহিম সম্পর্কে যা পেয়েছেন তা প্রকাশ করবেন অনায়াসে। অপরদিকে রহিমেরও অধিকার আছে ব্যক্তিগত বিষয় গোপন রাখার। অধিকারের সঙ্গে অধিকারের দ্বন্দ্ব।
এ বিষয়ে ইউরোপীয়ান আদালত সমূহে অনেক মামলা আছে। অনেক যুগান্তকারী রায় আছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার এখানে সীমারেখা টেনে দেওয়া আছে। কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমি কতটুকু বলতে পারবো তার সীমারেখা নিয়ে বিরোধ থাকলেও একটা সীমারেখা যে আছে তা নিয়ে কোন বিরোধ নেই।
এবার আদালত প্রসঙ্গ
আদালত হচ্ছে একটি শুভ্র চাদর। এতে দাগ লাগলে তা দেখা যায়। অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠানে দাগ লাগলে যে রকম দেখা যায়, আদালতের গায়ে দাগ লাগলে দেখা যায় তার থেকে অনেক বেশি। সে জন্য আদালত নিয়ে আচার আচরণের এবং কথাবার্তার সীমারেখা তামাম দুনিয়াজোড়া স্বীকৃত। আমরা ছবি তুলি। ফটোসেশন করি। ফ্রি স্টাইলে করি। কিন্তু আমরা আদালতের ভেতরে ছবি তুলি না। কিংবা আদালতে বসা অবস্থায় মাননীয় বিচারপতির বা বিচারকের ছবি তুলি না। এটি হচ্ছে সীমারেখা।
আদালতে বিচারাধীন বিষয় সম্পর্কে আমরা কথা বলি মেপে মেপে। কারণ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে যে কোন কথা মাননীয় বিচারপতির দৃষ্টিগোচর হতে পারে। এবং তিনি তার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। কিন্তু নিস্পত্তিকৃত মামলা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করা বা মন্তব্য করা আমাদের অধিকার এবং তা আদালতে উৎকর্ষতা এবং মান বৃদ্ধির জন্য একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সেখানেও সমালোচনা বা মন্তব্যের ভাষা হতে হবে শালিন এবং যুক্তিসংগত। আদালত হচ্ছে আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর একটি সীমারেখা।
এবার মানহানি প্রসঙ্গে দুটো কথা বলি। সকল মানুষের একটা মান আছে। ধনীর যেমন আছে, দরিদ্রেরও আছে। স্কুল শিক্ষকের যেমন মান আছে, ছাত্রেরও আছে। উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির যেমন মান আছে, নিম্ন পদের পিয়ন চাপরাশিরও মান আছে। মুসলিমের যেমন মান আছে, হিন্দুরও আছে। পুরুষের যেমন মান আছে, নারীরও মান আছে। মূল ভূখণ্ডের মানুষের যেমন মান আছে, উপজাতিয়দেরও মান আছে। সকলের মান তার কাছে গুরত্বপূর্ণ।
মান একটি সার্বজনীন অধিকার। যেমন বাক স্বাধীনতা একটি অধিকার। এখানেও অধিকারের সঙ্গে অধিকারের দ্বন্দ্ব এবং বাক স্বাধীনতার আরেকটি সীমাবদ্ধতা। এগুলো হচ্ছে বাক স্বাধীনতার আইনী এবং যৌক্তিক সীমাবদ্ধতা। কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাত বড়ই নির্মম। সাংবাদিক লড়াই করে মানুষকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সরবরাহের জন্য। আঘাত আসে সামরিক জান্তার বুলেট আর বেয়নেট থেকে। স্বৈরাশাসকের বন্দুক থেকে। বড় এবং ছোট কিছিমের মাস্তান থেকে। আঘাত আসে সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের আস্তানা থেকে।
হুমায়ুন আজাদ, অভিজিতসহ কত কত জন জঙ্গি হামলার শিকার। তাদের অপরাধ তারা মুক্ত চিন্তার মানুষ। আবার অঢেল টাকার এক মালিকের বিরুদ্ধে একবারতো সকল প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া সীমাহীন নীরবতা পালন করে। আবার একজনের উদ্যত বাক দমিয়ে দেয় আরেকজনের বিনম্র বাক। মানুষকে সঠিক তথ্য জানাতে যেয়ে পৃথিবীর বাঁকে বাঁকে ঝরে গেছে কতো কতো অকুতোভয় প্রাণ। আবার মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন কত সাধুকে চোর বানায়, কতো সম্ভ্রান্ত মানুষকে অকারণে লাঞ্চিত করে। একই মুদ্রা, এপিঠ ওপিঠ।
সংবাদ বিরুদ্ধে গেলে নিপীড়িত হয় সাংবাদিক। আবার অসাধু কলমের খোঁচায় বা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার আঘাতে দিগন্তজোড়া অবয়ব নিয়ে দাঁড়ানো ভালো মানুষ নিমিষেই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। এখনতো কেবল সাংবাদিকরাই নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রল করে, ভাইরাল করে মিথ্যাকে। ভাইরাল করে গুজবকে। জীবিত ব্যক্তিকে অনায়াসে মেরে ফেলে।
অবাধ তথ্য প্রবাহ
কোন কোন সুশীলকে দেখি সকাল থেকে গভীর রাত অবধি মিটিং মিছিল টকশোতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে শেষমেষ বলে কথা বলতে পারছি না, বাক স্বাধীনতা নেই। তবু শেষ অনুভূতি ব্যক্ত করি।
চাই অবাধ তথ্য প্রবাহ
কোন অবস্থাতেই অন্যের সর্বনাশ করে নয়। নিজ ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের মাধ্যমে নয়। দুনিয়াজোড়া বিবেদ হানাহানি সৃষ্টি রক্তপাত করার জন্য নয়। যুদ্ধের উসকানি দেওয়ার জন্য নয়। জাতির জনককে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য নয়। অবাধ তথ্য প্রবাহ চাই। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। সভ্যতার জন্য। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। একটি মানবিক পৃথিবী সৃষ্টির জন্য। তবেই হবে মুক্তচিন্তা শব্দটির প্রকৃত স্বার্থকতা।
লেখক: মো. আবদুন নূর দুলাল, সদ্য সাবেক সম্পাদক- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি