ঢাকা ২৯ ভাদ্র ১৪৩১, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ০৪:০৩ পিএম
আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ০৪:০৪ পিএম
রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা
ছবি : সংগৃহীত

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে-
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥’

জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে চাষিদের প্রতি যে গভীর ভালোবাসা ও পল্লীপ্রকৃতি সৌন্দর্যদৃশ্য ধ্বনির অপরূপরতার কাব্যিক বর্ণনা ‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতায় স্পষ্ট দেখা যায়।

সময়টা ১৯৮০ সাল, দেবেন্দ্রনাথ তার কনিষ্ঠ ছেলে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারির কাজ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। তখনো রবীন্দ্রনাথের ওপর জমিদারির সব দায়িত্ব অর্পণ হয়নি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর কঠোর শিক্ষানবিশির কাজ শেষে ১৮৯৫ সালের ৮ আগস্ট ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নির’ মাধ্যমে পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে সমগ্র জমিদারি কর্তৃত্ব পান অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি জমিদার রূপে নিযুক্ত হন। জমিদার হয়ে রবীন্দ্রনাথ পুণ্যাহ উৎসব যোগ দিতে শিলাইদহে যান। সেখানে গিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি তার পূর্বসূরিদের পথে হাঁটবেন না। উৎসবের শুরুতে ভাষণে বলেন, ‘সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে। এটাই আমার সর্বপ্রধান কাজ’। মহাজন অর্থে ‘সাহা’ শব্দের ব্যবহার করেছেন, দরিদ্র প্রজা বলতে তিনি ‘শেখ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন কারণ তার জমিদারিতে অধিকাংশ প্রজাই দরিদ্র মুসলমান। দরিদ্র প্রজার অসহায়ত্ব তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। তাই তো বলেছেন-

‘সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে-
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে। এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা- এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা- ডাকিয়া বলিতে হবে-
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে’

রবীন্দ্রনাথ তার জমিদারিতে পল্লী উন্নয়নের দিকে নজর দেন এবং বুঝতে পারলেন কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ ছাড়া পল্লী উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষির উন্নতির জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টা ছিল অভিনব। তিনি বুঝতে পারেন নতুন চাষের প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রামের আর্থিক অবস্থার উন্নতিসাধন করতে হবে। তাই শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন জমিতে নতুন ধরনের ধান চাষ, পাটনাই মটর, কপি চাষ শুরু করেন। ধান ও পাটের ওপর নির্ভরশীল না থেকে অন্যান্য অর্থকরী শস্যের দিকে কৃষকদের দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করেন। তাই পরগণায় মাছ চাষ, আলুর চাষ, খেতের আলে কলা আনারস চাষে উৎসাহিত করেন। ১৯০৮ সালে এক কর্মীকে কবি চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘প্রজাদের বাস্তুবাড়ি, খেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদের উৎসাহিত করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাইর হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্য। শিমুল, আঙ্গুর গাছ, বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাইর করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে।’

রাজশাহীতে রেশমচাষের অবস্থা বেশ রমরমা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টা এ দেশে চাষের উপযোগী করেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে চিঠিতে লিখেন: ‘আমার চাষাবাসের কাজ মন্দ চলিতেছে না। আমেরিকার ভুট্টার বীজ আনাইয়াছিলাম। তাহার গাছগুলি দ্রুতবেগে বাড়িয়া উঠিতেছে।’

রবীন্দ্রনাথের কৃষি বিষয়ে প্রবল জ্ঞান ছিল বলেই যখন পতিসর ও শিলাইদহে সারের অভাব দেখা দেয়, এ অভাব মেটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ একটি উপায় বের করেন। তখন বেশ কয়েক বছর থেকে পদ্মা নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে, বেড়াজালে একসময় এত মাছ ওঠে যে শিকারিরা নিতে চায় না। দেখা যায় ডিম বের করে নিয়ে নুন দিয়ে তা রাখছে আর মাছগুলো নদীর জলে ফেলে দিচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে কৃষকরা নৌকাবোঝাই মাছ কিনে নিয়ে তা চুন দিয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন। এক বছর পর মাটি খুঁড়ে দেখা যায় চমৎকার সার হয়েছে। তখন মাছের সার প্রচলন করা হয়।

‘মানুষ যেমন একদিন হাল লাঙল, চরকা তাঁত, তীর ধনুক, চক্রবান যানবাহনকে গ্রহণ করে তাকে নিজের জীবনযাত্রার অনুগত করেছিল, আধুনিক যন্ত্রকেও আমাদের সেইরকম করতে হবে। যন্ত্রে যারা পিছিয়ে আছে, যন্ত্রে অগ্রবর্তীদের সঙ্গে তারা কোনোমতেই পেরে উঠবে না।’- ‘পল্লীপ্রকৃতি’ প্রবন্ধে এমন লেখা কৃষিভাবনার সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন।

কৃষিকাজকে আরও বেগবান করতে ১৯০৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু পুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তার এক বছর পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও ওই একই বিষয়ে শিক্ষালাভ করার জন্য আমেরিকায় পাঠান। রথীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথের ব্যয়ভার বহন করতে স্ত্রীর গহনা, পুরীর বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত এই তিনজকে লেখেন: ‘তোমরাও দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের অনুগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ, ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণে যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে এই ক্ষতি পূরণ হয়ে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখ এই টাকা চাষীর, এই চাষীরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধাপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে- এদের এই অংশ সম্পূর্ণ শোধ করার দায় তোমাদের উপর রইল।’

১৯০৯ সালে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন রথীন্দ্রনাথ। শুরু করেন পতিসরের মাটিতে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিকাজ। পতিসরের মাটিতে প্রথম ট্রাক্টর চাষাবাদ শুরু হয়, ট্রাক্টর চালান রথীন্দ্রনাথ নিজে। সে অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লেখেন: ‘আমাদের দেশে তখনো ট্রাকটরের চলন হয়নি। ট্রাকটর তো পেলুম কিন্তু চালক পেলুম না। নিজেই চালাতে লাগলুম। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামের একটি ছোকরাকে চালানো শিখিয়ে দিলুম। হাজার হাজার লোক জমে গেল। ট্রাকটর নিয়ে আমি নেমে গেলুম ধান খেতে। তারা আশ্বাস দিল আপনি আলের ওপর দিয়ে চাষ দিয়ে যান, আমরা কোদাল নিয়ে থাকব, সঙ্গে সঙ্গে আল বসিয়ে নেব। ট্রাকটর দিয়ে চাষাবাদে কৃষকরা মহাখুশী।’

যে সময় মানুষ ব্যারিস্টারি, ডাক্তার ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সন্তানদের বিদেশে পাঠানো হয়, জমিদার হয়েও রবীন্দ্রনাথ কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য তার নিজ পুত্রকে কৃষিতে শিক্ষা নিতে বিদেশে পাঠিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন চাষির একার পক্ষ্যে কৃষির উন্নয়ন সম্ভব না। তাই ‘ভূমিলক্ষ্মী’তে বলেছেন, ‘আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে।’
‘শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন,‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই-
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।

কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’

একজন জমিদার রবীন্দ্রনাথ কোনো এক ভূমিহারা কৃষকের হাহাকার তার মনোকষ্টের প্রকাশ ঘটিয়েছেন এমন ভাবেই ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা বুঝতে পারতেন। কৃষকের হাহাকারের কারণ খুঁজতে গিয়ে ‘পল্লীপ্রকৃতি’ প্রবন্ধে বলেছেন- ‘জমিও পড়িয়া রহিল না, ফসলেরও দর বাড়িয়া চলিল, অথচ সম্বৎসর দুইবেলা পেট ভরিবার মতো খাবার জোটে না, আর চাষী ঋণে ডুবিয়া থাকে, ইহার কারণ কী ভাবিয়া দেখিতে হইবে। এমন কেন হয়- যখনই দুর্বৎসর আসে অমনি দেখা যায় কাহারো ঘরে উদ্বৃত্ত কিছুই নাই। কেন এক ফসল নষ্ট হইলেই আর এক ফসল না ওঠা পর্যন্ত হাহাকারের অন্ত থাকে না।’

তিনি দেখলেন দরিদ্র কৃষকদের কাছে অর্থ তো দূরের কথা, তারা সুদখোর মহাজনদের কবলে পড়ে সহায় সম্বলহীন হয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের আর্থিক সমস্যা দূর করতে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পতিসর কৃষি ব্যাংক। তখনো এই উপমহাদেশে লোন কোম্পানি বা ব্যাংক চালু হয়নি। বলা যায় পতিসর কৃষি ব্যাংক নতুন দিগন্ত। রবীন্দ্রনাথ এসব ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহ করেন তার ধনী বন্ধুদের থেকে ধার করে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকে ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্য, আত্মীয়স্বজন টাকা জমা রাখেন। নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা তিনি পতিসর কৃষি ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন। এই ব্যাংক থেকে কৃষক শতকরা তিন টাকা হারে সুদে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করত। ফসল ওঠার পর সুদসহ ঋণের টাকা পরিশোধ করে পরবর্তীতে আবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ পেত। এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় চাষিরা মহাজনের চক্রবৃদ্ধি হারে সর্বনাশা সুদের কবল থেকে রক্ষা পেতে থাকল।

১৩১৪ বঙ্গাব্দে পাবনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসভার প্রাদেশিক সম্মেলনে পল্লীর উন্নয়নের যে ১৫ দফা কর্মসূচি পেশ করেন তাতে ছিল আধুনিক কৃষি, কুটিরশিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ব্যাংক ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের এক সমবায়ভিত্তিক রূপরেখা। তার এই কাজে যুক্ত হন সমাজকর্মী কালীমোহন ঘোষ। পরবর্তীতে আসেন বিপ্লবী অতুল সেন। তার সহকারী হিসেবে ছিলেন উপেন ভদ্র, বিশ্বেশ্বর বসুসহ আরও অনেকেই। অতুল সেনের কাঁধেই কৃষি ব্যাংকের কাজে ভার পড়ে। এই কৃষি ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা ও প্রজাদের খাজনার সঙ্গে টাকা প্রতি এক আনা অতিরিক্তি অর্থ দিয়ে পতিসর, কমতা এবং রাতোয়ালে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়; যার উদ্দেশ্য দরিদ্র কৃষকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। একবার কালিগ্রামে মহামারিরূপে ওলাওঠা রোগ দেখা যায়। এই রোগ থেকে কৃষক ও প্রজাদের রক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথ অতুল সেনকে চিঠি লেখেন- ‘আমি কয়েকটি ওলাওঠার ওষুধের বাক্স পাঠাইতেছি এবং যদি হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার পাঠাইতে পারি, সেটা দেখবে।’

হোমিয়োপ্যাথি ঔষধের ওপর রবীন্দ্রনাথের ভরসা ও আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথকে লেখা শান্তি কবিরের একটা চিঠিতে বিষয়টি সহজেই জানা যায়। সেখানে ছিল- ‘সেবার বছর দুই আগে যখন শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, তখন কথায় কথায় একদিন আপনি হোমিওপ্যাথি দিয়ে ভীষ্ণ সব রোগ কেমন করে আরোগ্য করেছেন, সে কথা বলেছিলেন। আপনি তো জানেনই আমাদের দেশে হোমিওপ্যাথদের কি দুর্দশা। সে সমস্ত কারণে আমরা চেষ্টা করছি যাতে বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির একটা কেন্দ্রীয় সঙ্ঘ করে বিধি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্ত করা হয়’।

‘কিন্তু এবারে রাশিয়া ঘুরে এসে সেই সৌন্দর্যের ছবি আমার মন থেকে মুছে গেছে। কেবলই ভাবছি আমাদের দেশজোড়া চাষীদের দুঃখের কথা। আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট-পরিচয় হয়েছে। তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ ছিল দেখাশোনা- ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে। আমি জানি, ওদের মতো নিঃসহায় জীব অল্পই আছে। ওরা সমাজের যে তলায় তলিয়ে, সেখানে জ্ঞানের আলো অল্পই পৌঁছায়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয়’- রাশিয়ার চিঠিতে কবি এভাবেই চাষিদের দুঃখের কথা প্রকাশ করেন। তাই কৃষি ব্যাংক স্থাপন ও কৃষিতে উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতির পাশাপাশি তিনি ভেবেছিলেন সমবায়নীতি ও কৃষিক্ষেত্র একত্রীকরণ ছাড়া গ্রাম্যকৃষি ব্যবস্থার অগ্রগতি সম্ভব না। রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার কৃষিব্যবস্থা, যৌথখামার ইত্যাদি দেখে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়েছিলেন।

‘চাষিকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে- জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষির। দ্বিতীয়ত, সমবায়নীতি অনুসারে চাপের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না। মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল নিয়ে আলবাধা টুকরো জমিতে ফসল ফলানো আর ফুটো কলসিতে জল আনা একই কথা।’ রাশিয়ার চিঠিতে তিনি এভাবেই কৃষিতে সমবায়নীতির কথা তুলে ধরেন। তারপরই রাশিয়ার অনুরূপ কৃষিক্ষেত্রে একত্রীকরণের পরিকল্পনাও করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিকে একত্রিত করে সমবায়ের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের কাজে হাত দেন।

‘রাশিয়ার চিঠি’তে নির্দ্বিধায় বলেছেন ‘আমাদের দেশে আমাদের পল্লীতে ধান উৎপাদন ও পরিচালনার কাজে সমবায়নীতির জয় হোক, এই আমি কামনা করি’। কৃষিতে সমবায়নীতির একটা অংশ হচ্ছে কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় এবং সহজে উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করতে পারে সে জন্য তিনি ‘ট্যাগোর এন্ড কোম্পানি’ নামে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালু করেন।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, কাজের সঙ্গে আনন্দের মিশ্রণ করলে কৃষকরা কর্মে উজ্জীবিত হবে। গান-বাজনাসহ বিভিন্নি অনুষ্ঠান আয়োজন করলে কৃষকরা কাজে অনুপ্রেরণা পাবে, আত্মশক্তি জাগ্রত হবে। তাই কৃষি উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি গ্রামবাংলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সেসবের মাঝে ছিল গ্রামীণ মেলা, বাউল গান, যাত্রা, নাটক ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘গ্রামকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে হবে। সকলে শিক্ষা পাবে, গ্রামজুড়ে আনন্দের হাওয়া বইবে, গান-বাজনা-কীর্তন পাঠ চলবে, আগের দিনে যেমন ছিল’। তিনি জানতেন, কৃষকের মাঝে একতার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অপরিহার্য। তাই ‘কাত্যায়নী’ মেলা, ‘রাক-রাজ্যেশ্বরী’ মেলার আয়োজনসহ বৃক্ষরোপণ উৎসব, পৌষমেলা, মাঘোৎসব আয়োজন করেন। শিলাইদহ, পতিসর ও শ্রীনিকেতনে ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। ১৯২৮ সালে হলকর্ষণ নামে একটি উৎসবের আয়োজন করেন। হলকর্ষণ মানে জমি চাষের উৎসব। ‘পল্লীপ্রকৃতি’ প্রবন্ধে এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলেন- ‘আজকার অনুষ্ঠান পৃথিবীর সঙ্গে হিসাব-নিকাশের উপলক্ষ নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবার, পৃথিবীর অনুসূত্রে একত্র হবার যে বিদ্যা মানবসভ্যতার মূলমন্ত্র যার মধ্যে, সেই কৃষিবিদ্যার প্রথম উদ্ভাবনের আনন্দস্মৃতিরূপে গ্রহণ করব এই অনুষ্ঠানকে।’ এইসব উৎসবে বিভিন্ন গান হয়। রবীন্দ্রনাথের লেখার সেসব গানেও কৃষি ও ফসলের কথাই উঠে আসে। যেমন:

‘আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে॥
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে॥’

ফসল কাটার উৎসবে কৃষকদের উৎসাহিত করতে লিখেন :
‘আয় রে মোরা ফসল কাটি
বাদল এসে রচেছিল ছায়ার মায়াঘর,
রোদ এসেছে সোনার জাদুকর-
মোরা নেব তারি দান, তাই-যে কাটি ধান,
ও সে সোনার জাদুকর’
এমন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কৃষকদের একত্রীকরণ করে কৃষির উন্নতি ও সমবায়নীতি সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার, লুকোচুরি খেলারে ভাই, লুকোচুরির খেলা। নীল আকাশে কে ভাসাল, সাদা মেঘের ভেলারে ভাই, সাদা মেঘের ভেলা’। কৃষি উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের অবদান অসামান্য এবং অনুসরণীয়।

আদর্শ কৃষিক্ষেত্র সম্প্রসারণে তার বহুমুখী কর্মসূচি প্রশংসার দাবিরার। তিনি নিবিড়ভাবে অনুধাবন করতেন যে, কৃষক বাঁচলেই গ্রাম বাচবে। আর তাহলেই ‘গ্রামগুলো বেঁচে উঠবে এবং সমস্ত দেশকে বাঁচাবে’। তাই বলেছিলেন- ‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না, আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি গ্রাম। আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা, অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরী হবে।’

রবীন্দ্রনাথের সে ভাবনাই আজ একুশ শতকে পৌঁছে বাংলাদেশে স্লোগান: ‘আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’।

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও কিছু প্রশ্ন

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০০ পিএম
মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও কিছু প্রশ্ন
সিরাজুল ইসলাম

অত্যন্ত আলোচিত-সমালোচিত নাম আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। তিনি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে। এই আযমীর সঙ্গে আমার শত্রুতা বা বন্ধুত্ব নেই। তিনি গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’-এ আট বছর বন্দি ছিলেন এবং শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর তিনি সেখান থেকে মুক্তি পান বলে তিনি দাবি করেন। সেখানে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তার এই দাবিকে সত্য ধরে নিয়েছি আমি। এ কারণে তার প্রতি আমার একটা সফট কর্নার আছে। তবে তার কয়েকটি দাবি আমাকে, আমাদের বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন এবং সংবিধান পুনরায় লেখার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই দাবিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এর পেছনে দুরভিসন্ধি আছে বলে মনে হয়। হয়তো অনেকে বলবেন- এটা একান্ত তার ব্যক্তিগত অভিমত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে। হ্যাঁ, আছে। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা বলা নয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা বিষয়ে বিতর্ক কারও কাছে কাম্য নয়। আযমীর মতো একজন মানুষের কাছে গঠনমূলক; দেশ-জাতির কল্যাণ হয়- এমন মতামত মানুষ প্রত্যাশা করে।

২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের তথ্যকে ‘কাল্পনিক’ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলেছিলেন আযমী। এবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহিদ বলে বলে তারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আপনারা জরিপ করে বের করুন, একচুয়ালি ৩০ লাখ হোক আর ৩ কোটি হোক। আমার জানামতে, এটা ২ লাখ ৮৬ হাজার। তারা ৩ লাখকে ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছে। এখনো সময় আছে, জাতিকে সত্য ইতিহাস জানতে দিন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মিথ্যার ওপরে আপনারা গড়ে তুলতে দেবেন না। সত্যিকার একটা জরিপ করে আপনারা ব্যবস্থা করুন।’

এখানে আযমীর কাছে আমি কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। প্রথমত, শেখ মুজিব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন। আপনি এই তথ্য কোথায় পেলেন? শেখ মুজিবের সঙ্গে আপনার কখনো কথা হয়েছে? নাকি শেখ মুজিব অন্য কাউকে বলেছেন? এ বিষয়ে আপনার কাছে কোনো ডকুমেন্ট আছে? থাকলে সেটা প্রকাশ করুন। জাতি সত্যটা জানুক।

আপনি স্ববিরোধী কথা বলছেন। আপনি বলছেন ২ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আবার বলছেন ৩ লাখকে তারা (আওয়ামী লীগ) ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছেন। তার মানে আপনি ৩ লাখ নিহত হয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন। ২ লাখ ৮৬ হাজার নাকি ৩ লাখ মানুষ মারা গেছেন; সেটা ক্লিয়ার করুন।

আপনার বাবা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ছিলেন। স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং সে সময় ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল ৪২ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। তার মধ্যে গোলাম আযমও ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন। কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। এ কারণে আপনার দেওয়া নিহতের সংখ্যা নিয়ে মানুষ ষড়যন্ত্র ভাবতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। আপনার অবস্থান ক্লিয়ার করাও আপনার দায়িত্ব। 

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ে আপনি সরকারের কাছে জরিপ করার দাবি জানিয়েছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এই জরিপ করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আশা করি সরকার একটা পদক্ষেপ নেবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করে মানুষের মন থেকে ভ্রান্তি দূর করবে সরকার। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের মা-বোনের সম্ভ্রম লুটে নিয়েছেন; সেটা কিন্তু আপনি বলেননি। আপনি ভুল করেছেন; নাকি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন- সেটা খুব জানতে ইচ্ছা করে। 

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ বলছেন আযমী। তিনি বলেন, ‘১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই? আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।’

আযমীর এই দাবি অনেকের মতো সঠিক মনে হবে। হ্যাঁ। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা যেতেই পারে। দেশের প্রয়োজনে; মানুষের চাহিদার কারণে সেটা হতে পারে। কিন্তু দেশে এমন কী ঘটল যে জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে? একটা সংগীত দেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি হয় কীভাবে? দেশ যখন ক্রান্তিকাল পার করছে; একটার পর একটা সমস্যা সামনে আসছে; সেগুলোর দিকে নজর না দিয়ে আপনি পড়ে আছেন জাতীয় সংগীত নিয়ে। বিষয়টা নিয়ে খুবই অবাক হচ্ছি।

বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়েছেন আযমী। তিনি বলেন, ‘১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেড নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি- আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।’ 

তারা (আওয়ামী লীগ) জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি বলে আযমী যে প্রশ্ন তুলেছেন; সেটাকে আমি অবান্তর প্রশ্ন বলতে চাই। কারণ আওয়ামী লীগ তো যুদ্ধ করার জন্যও ম্যান্ডেড নেয়নি। তার মানে কী যুদ্ধটা অবৈধ? এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেলাম; সেটাও কী অবৈধ? যদি স্বাধীনতা অবৈধ না হয়; তাহলে সংবিধান প্রণয়নও অবৈধ নয়। আর স্বাধীনতা বৈধ হলে সংবিধানও বৈধ। কারণ স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রয়ণনের জন্য ম্যান্ডেড নিতে হয় না। বিশ্বের কোনো দেশ স্বাধীনতা লাভের পর সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেড নিয়েছে- এমন নজির নেই। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধান বৈধ। 

আবার আসি জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি কালজয়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষেত্রে গানটির গুরুত্ব অপরিসীম। ১১৯ বছরের পুরোনো গানটি আজও মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে; উজ্জীবিত করে। এর আবেদন একটুও কমেনি। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচয় ঘটাতে এ গানের ভূমিকা অনেক। এ গানের একটা ইতিহাস আছে। সুতরাং এটা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে আযমী একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। ভাগ্যিস তিনি জাতীয় সংগীত বাদ দেওয়ার দাবি তোলেননি। আফগানিস্তানে এর আগে তালেবান শাসনের সময় জাতীয় সংগীত বাদ দেওয়া হয়। নতুন করে আবার সেটা চালু করা হয়েছে। 

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিল। ওই বছরের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে একটি প্রতিবাদ সভায় এই গান প্রথম গাওয়া হয়। সেই বছর ৭ সেপ্টেম্বর (২২ ভাদ্র, ১৩১২ বঙ্গাব্দ) ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরে গানটি ছাপা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী রাজনীতিক, স্বদেশি কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে এই গান প্রচার করেন। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’-তে এই গান ব্যবহৃত হয়। জহির রায়হান নির্মিত এই সিনেমায় তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে গানটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত জনসভায় গানটি গাওয়া হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি গাওয়া হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো। 

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন হলে এর ৪.১ অনুচ্ছেদে ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম ১০ চরণ (মোট চরণ ২৫ চরণ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। গানের প্রথম ১০ ছত্র কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ ছত্র যন্ত্রসংগীত ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয়।

আযমীর প্রতি ভালোবাসা এবং তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখাটি শেষ করব। তিনি বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনের দাবি তোলেননি- এ কারণে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; সে কারণে তার প্রতি ভালোবাসা। নতুন বাংলাদেশে যেন কেউ আর নির্যাতনের শিকার না হয়- এই প্রত্যাশা করছি সরকারের কাছে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ।
[email protected]

এখন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোই জরুরি

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৪ পিএম
এখন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোই জরুরি
অরূপ তালুকদার

নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ হয়েও এবারে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের কমপক্ষে ১১টি জেলা; যার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের ৭৭ উপজেলা; বিগত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল এবং ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে যেভাবে প্লাবিত হয়েছে তা রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ এবারের মতো বন্যা বিগত দুই যুগেও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

দক্ষিণবঙ্গের মানুষ আমরা। আমাদের জল-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে কম-বেশি রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় প্রতিবছর। আমাদের জন্য এসব এখন আর নতুন কিছু নয়। 

বরিশাল বিভাগের যেমন বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার শহর এলাকার নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানের কাছাকাছি কোনো নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠে গেলে এবং জোয়ারের পানির চাপে প্লাবিত হলেও  দুই-একদিনের মধ্যেই সে পানি আবার নেমে যায়। এখন যেমন দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ফলে পানির চাপে কোনো কোনো স্থান প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এবারের অস্বাভাবিক প্লাবনের ফলে ইতোমধ্যে যেভাবে ডুবে গেছে অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ট্রেন লাইন; বিপর্যস্ত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা- তার কোনো তুলনা হয় না। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। 

কোথাও কোথাও পানির প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে গৃহপালিত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ বাড়িঘরের আসবাবপত্র, মাছের ঘের; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। ভাঙন শুরু হয়েছে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোয়। 

পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কমপক্ষে প্রায় ৬ লাখ পরিবারের প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ, জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তারা দিনাতিপাত করছে মহাদুর্ভোগের মধ্যে। অনেক পরিবারেই খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে দুর্যোগকবলিত এসব এলাকার অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। যে কারণে এসব অঞ্চলে বসবাসকারীদের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য স্থানের মানুষজনের যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। 

তবে ইতোমধ্যে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা, যারা ইতোমধ্যেই বন্যাদুর্গত অঞ্চল থেকে উদ্ধার করেছে পানিবন্দি থাকা শিশুসহ ২৭২ জনক।

এদিকে আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানির ন্যায্য হিসাব পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুরের বেগম রোকেয়া এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

তারা বলেছেন, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর কুমিল্লা ও ফেনী প্লাবিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর যোগাযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টি নদীতে তারা বাঁধ দিয়েছে।

তারা অভিযোগ করেন, ভারত গ্রীষ্ম মৌসুমে বাঁধ বন্ধ রাখে, আবার বর্ষা মৌসুমে খুলে দেয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভারতের আধিপত্য প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও ভয়াবহ বন্যার কারণে রাজ্যের কমপক্ষে আটটি জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। 

এনডিটিভির খবরসূত্রে জানা যায়, এসব জেলার প্রায় ৭ হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছে। মৃত্যু হয়েছে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২২ জনের। উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ত্রিপুরার ‘ডুম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট’-এর গেট খুলে দিয়েছেন রাজ্যটির প্রশাসক। 

ত্রিপুরার জেলা শাসক তড়িৎ কান্তি চাকমা জানিয়েছেন, গোমতী নদীতে জলসীমা বেড়ে যাওয়ায় ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জলস্তর বিপৎসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। সেক্ষেত্রে বাঁধ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে গেট খুলে পানি ছেড়ে দিতে হয়েছে। তিনি জানান, ভয়াবহ এই বন্যায় রাজ্যটিতে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে।’ 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আমরা উল্লেখ করতে চাই যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছরের সবচাইতে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে এই বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকে বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলোতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি একটি যৌথ সমস্যা। এটা উভয় দেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগের জন্ম দেয়। এ সমস্যার সমাধানে ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।’

এদিকে সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম সম্প্রতি সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বন্যায় জনগণের জানমাল রক্ষায় সার্বিকভাবে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত রয়েছে।

সম্প্রতি হবিগঞ্জে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘পানি ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে জানানোর বিষয়টি ভারত প্রতিপালন করেনি।’

বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিয়োজিত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। এই সময় প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার কারণ জানতে চাইলে হাইকমিশনার জানান, ত্রিপুরার বন্যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এর ফলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৈঠকে বাংলাদেশকে সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেন হাইকমিশনার।  

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের বন্যা মোকাবিলার প্রয়োজনে দুপক্ষেরই সহযোগিতা এবং উভয় দেশের সরকার এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়ভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, এবারের বন্যা একেবারে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে দেশের কমপক্ষে ১১টি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। বন্যার পানি এখনো নামতে শুরু করেনি। আশা করা যাচ্ছে, বৃষ্টি থেমে গেলে পানির চাপ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।

তবে বন্যার কারণে এসব জেলায় কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা বোঝা যাবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর। তখন শুরু হবে আসল কাজ। বন্যার্তদের পুনর্বাসন ও তাদের বাড়িঘর পুনঃনির্মাণসহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের প্রয়োজনীয় মেরামত এবং ক্ষতিগ্রস্ত খেত-খামারের তদারকি বাড়িয়ে তা আবার পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে তখন শুরু হবে বিরাট এক কর্মযজ্ঞ। 

তবে এখন সবার জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, বন্যা-উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর ইতোমধ্যেই দুর্গত এলাকার সেই লাখ লাখ অসহায় পানিবন্দি মানুষের পাশে মানবিক সাহায্যের হাত নিয়ে দাঁড়িয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দেখা গেছে, প্রতিদিন তাদের কাছে ত্রাণ দিতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে।

শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও নানা সংস্থাসহ সাধারণ মানুষ নানাভাবে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ জেলার কমপক্ষে ৪৫ লাখ মানুষ। গত মঙ্গলবার থেকে এ পর্যন্ত শিশুসহ প্রাণহানি ঘটেছে অন্তত ১৫ জনের। বন্যায় প্লাবিত ৭৭টি উপজেলার ৫৮৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদ্ভূত সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে উপদ্রুত এলাকায় ৩১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ জন আশ্রয়হীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি বন্যাকবলিত এলাকায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দানের লক্ষ্যে ৬৩৭টি মেডিকেল টিম কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, দুর্গত এলাকার মানুষদের সহায়তা দিতে ইতোমধ্যে নগদ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দসহ খাদ্য সহায়তা বাবদ ১৫০ টন চাল এবং ১৫০০০ খাদ্যের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।

এদিকে বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সকল স্তরের মানুষ প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে অনুদান প্রদান করতে পারবেন। যেভাবে দিতে হবে : সোনালী ব্যাংক, কর্পোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, হিসাব  নম্বর : ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩।

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব পদবির সেনাসদস্যদের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সাহায্য-সহযোগিতার  নিমিত্তে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হয়েছে।

একইভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ( বিজিবি)-এর সব সদস্যের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সহায়তায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

ত্রিমুখী অবস্থানে ভারত-বাংলাদেশ-চীন: কোন পথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক?

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৩৭ পিএম
ত্রিমুখী অবস্থানে ভারত-বাংলাদেশ-চীন: কোন পথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক?
সেতু খানম

বন্যায় ভাসছে বাংলার মানুষ। বন্যার পানিতে যখন বাংলার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তখন একদিকে আগাম সতর্কবার্তা ছাড়াই হঠাৎ ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের পাশাপাশি ফারাক্কা বাঁধও খুলে দিয়েছে ভারত। অন্যদিকে বন্যার্তদের সহযোগিতায় কিছুটা এগিয়ে এসেছে চীন। সব মিলে যেন সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক রহস্যময় ধূম্রজাল।

পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি চীন। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যখন বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে ভোট হয় তখন ১৫টি দেশের মধ্যে একমাত্র চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু অর্ধশতক পেরিয়ে ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের সব থেকে বড় বাণিজ্য সহযোগী চীন। অপরদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক প্রকার মাতৃছায়ায় আগলে রাখা ভারতের সাথে বাংলাদেশ জন্মের শুরু থেকেই আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে ভারতের সাথে টানাপড়েন সম্পর্কে এখন বাংলাদেশ। 

২০২৪ সালে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী, শিশু কিংবা বৃদ্ধের মনে ভারতকে নিয়ে জমা হওয়া ক্ষোভ প্রকাশ হতে থাকে। বন্ধুত্বের সুবাদে কতটা দেওয়া হলো এবং কতটা পাওয়া গেল, সেই হিসাবও কষতে শুরু করেছে নতুন প্রজন্ম। তবে প্রাপ্তির খাতায় যেন শুধুই হতাশা। বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে ভারতের প্রভাব নিয়ে ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির মাঝেই চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার হাতে বন্যার্তদের সাহায্যে ২০ হাজার মার্কিন ডলারের চেক তুলে দেন এবং চীনের রেড ক্রসের পক্ষ থেকে ১ লাখ মার্কিন ডলারের অনুদান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের জন্য চীনের নজরে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণার জন্য চীনের সোস্যাল সায়েন্স একাডেমিতে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ ইনস্টিটিউট’ খোলা হয়েছে। চীনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট- বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন বিগত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ভারতপ্রীতির কথা কারোরই অজানা নয়। অনেক প্রকল্প এবং চুক্তির প্রস্তাব চীন-ভারত দুই দেশ থেকে পেলেও ভারতকেই বারবার বেছে নিয়েছেন তিনি। তাই শেখ হাসিনার এই পতন ভারতের জন্য কূটনৈতিক পরাজয় এবং সেই সাথে চীনের জন্য কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতপন্থি নয় বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাই ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণে ভারতের চেয়ে চীনই বেশি প্রাধান্য পাবে বলে আশা করছে চীন। তবে এই পথ এতটা মসৃণও নয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আমেরিকাকে প্রয়োজন হবে বাংলাদেশের। এই সম্পর্কই চীনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি অনেকটাই পরিষ্কার হলেও, চীনের সাথে এই সম্পর্ক গড়ে উঠতে অন্য কোনো পরাশক্তি প্রভাব বিস্তার করবে কি না, সেই উপসংহারে এখনই যাওয়ার কোনো উপায় নেই। অতএব, বাংলাদেশের জন্য সামনে পথচলা এতটা সহজও হবে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং সম্প্রতি ঘটনাগুলোর কারণে দুর্বল অর্থনীতিকে আবার স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরাতে কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে বাংলাদেশকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]

উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ
সংগীত কুমার

বেকারত্ব আমাদের দেশের সামাজিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিগত কয়েক বছর ধরে বেকারত্বের কশাঘাতে জর্জরিত আমাদের তরুণ সমাজ। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের পরিসংখ্যান যদি তুলে ধরি, তাহলে দেখতে পাবো ২০১৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ছিল ৪ লাখ। ২০২২ সালের শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখে (সূত্র : বিবিএস)। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। 

দেশে বর্তমানে প্রতি তিনজন বেকারের মধ্যে একজন উচ্চশিক্ষিত। তারা বিএ কিংবা এমএ ডিগ্রি নিয়েও শোভন চাকরি পাচ্ছে না। ফলে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে টিউশনি, পাঠাও-উবারে ভেলিভারিম্যান, বিক্রয়কর্মী এবং কেউ কেউ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিগুলোতেও যোগ দিচ্ছেন। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সর্বশেষ রেলের পরিচ্ছতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সবাই স্নাতক ডিগ্রিধারী। বিভিন্ন জরিপ মতে দেশের ৭৮ শতাংশ তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবন ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্নতা বিরাজ করছে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘন্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়ম অনুসারেই বেকারত্বের হিসাব দিয়েছে। কোভিড মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি শ্লথগতি হয়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করে ফেলে। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। 

দীর্ঘ দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষকে গড় আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করতে হয় খাবার ক্রয়ে। বৈদেশিক মুদ্রায় সংকট চলছে, যথেষ্ট দেশি বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি বিনিয়োগ গত এক দশক ধরে জিডিপির ২২-২৩ শতাংশে আটকে আছে। ফলে বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না এবং বেকারত্ব বাড়ছে। 

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৭ লাখ ৯৯ হাজার। অর্থাৎ মোট বেকারের ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। তাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। অর্থাৎ তরুণদের সংখ্যাটাই বেশি। বেকারদের মধ্যে ৫১ শতাংশ আবার উচ্চমাধ্যমিক পাস। 

বিবিএসের আরেকটি সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ অনুসারে বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনায় নাই, কর্মসংস্থানে নাই, এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০-২২ লাখ তরুণ গোষ্ঠী নতুন করে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে ১২-১৩ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু তাদের ৮৫ শতাংশ মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা শোভন চাকরি পায়। আর বাকি ৮-৯ লাখ জনগোষ্ঠী প্রবাসে যান চাকরির খোঁজে। 

দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৭টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৭১ হাজারের কিছু বেশি সরকারি চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছর যত শোভন কর্মসংস্থান বা চাকরি সৃষ্টি হয়, তার চার ভাগের তিন ভাগই হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাহিদার তুলনায় সরকারি চাকরি সৃষ্টি খুবই কম হচ্ছে।

আরও ভয়াবহ চিত্র পাবো যদি গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করি। দেখা যাবে যতগুলো পদের জন্য আবেদন আহ্বান করা হচ্ছে তার চেয়ে ২০০ গুন বেশি আবেদন জমা পড়েছে। সর্বশেষ ৪৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৪০ টি। প্রাথমিকভাবে আবেদন জমা পড়ে ৩ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। ৪৫ তম বিসিএসে ২ হাজার ৩০৯টি পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার। ৪৪তম বিসিএসে আবেদন জমা পড়ে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬০টি। পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭১০টি।

বাংলাদেশে তরুণেরা যে ধরনের শিক্ষা পাচ্ছেন এবং তারা যে কাজ করতে পারেন সেই ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার যে ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে, এখনকার শিক্ষিত তরুণেরা সেই ধরনের কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, ‘লোকে বলে চাকরি কই, চাকরি বলে লোক কই’! ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব তরুণদের জন্য নির্মম অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এই অভিশাপ থেকে নিস্তারের চ্যালেঞ্জগুলো আলোচনা করা করা যাক। শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রে সামঞ্জস্যহীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাস্তবমুখী দক্ষতা তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

তথ্য প্রযুক্তি এবং ই-কমার্সের ঘাটতি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি ও ই-কমার্সের দিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় উচ্চশিক্ষিতদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে না। ডিজিটাল দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার অভাব রয়েছে, যা উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। উদ্যোক্তা সৃষ্টির অনুপ্রেরণার অভাবও ভীষণভাবে পরিলক্ষিত। ফলে দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহের অভাব দৃশ্যমান। এর মূল কারণগুলো হলো পুঁজিবাজারের অভাব, বিনিয়োগের সুযোগ কম এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান ও নেতৃত্বের অভাব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এখনও শ্রমবাজারে তরুণদের সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যার্থ হচ্ছে। সামাজিকভাবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা বেশি। এবার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া যেতে পারে তা আলোচনা করা যাক: 

শিক্ষা ব্যবস্থার পুর্নগঠন এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক এবং কর্মমুখী করতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা, সফট স্কিল এবং ভোকেশনাল ট্রেনিংকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জন করতে পারে। উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাংকিং এবং মাইক্রোফিন্যান্স ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করতে হবে। যাতে উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো সহজে পুঁজি পেতে পারে। উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শের সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির প্রসার বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আইটি ও সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট, ফিন্যান্সিং এবং ই-কমার্সের বিকাশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি নীতিমালা ও আর্থিক সহায়তা আরো জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের জন্য ট্যাক্স ছাড়, ঋণ সুবিধা এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। বৈশ্বিক মানের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম এমন দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশন প্রসার বাড়াতে হবে। 

গত কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগের পরিস্থিতি অনেকটা স্থবির। নতুন বিনিয়োগ না হলে শিক্ষিত যুবকদের জন্য চাকরির বাজার সৃষ্টি হবে না। তাই আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। অন্যদিকে পরিবর্তিত চাকরির বাজারের উপযোগী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৩ এএম
ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান
ফখরুল ইসলাম নোমানী

ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। ইসলাম পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীকে পুরুষের সমান অধিকারী করেছে ও অত্যন্ত সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছে। নবী করিম (সা.) স্বয়ং নারীদের শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। 

সমাজসভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ সমান। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নর-নারী, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব অথবা সাদা-কলোর কোনো পার্থক্য নেই। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান।

আদিম যুগ থেকেই নারী অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। সবদিক দেশে তার অধিকার আদায়ে তার মর্যাদায় তার স্বাধীনতা ও তার ক্ষমতায়নে। ইসলাম পূর্ব-যুগে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত উপেক্ষিত ও শোচনীয়। সমাজে নারীরা ছিল অপাঙ্‌ক্তেয়। তাদের মানুষরূপেই ভাবা হতো না। নারীরা ছিল পুরুষের লালসার শিকার, ভোগ্যপণ্য হিসেবে তাদের ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় পৌত্তলিক আরবে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। হিন্দুরা নারীকে সব পাপ, অন্যায় ও অপবিত্রতার কেন্দ্র বলে ঘৃণা করত। ইহুদিরা নারীকে সব পাপের মূল হিসেবে জানত। খ্রিষ্টানরা নারীকে নরকের কীট ও অকল্যাণের উৎস মনে করত। চীনে নারীদের দ্বারা লাঙল টানাতো। পাশের দেশ ভারতে হিন্দুরা নারীদের দাসীর মতো ব্যবহার করত এবং সতীদাহের মতো ঘৃণা প্রথা প্রচলিত ছিল। ঘোড়ার লোজের অগ্রভাগ নারীর চুল বেঁধে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো। ইসলাম পৃথিবীর বুক থেকে যাবতীয় অত্যাচার নির্যাতন ও অসমতা দূর করে। নারীকে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়েছে।

মানব জাতির ওইসব ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মুক্তির দিশারি ও শান্তির দূত হিসেবে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। নারী জাতির ওপর অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, শোচনীয় ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে পরিত্রাণ দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সমাজে নারী জাতির অবস্থান নিরূপণের জন্য পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন সুরা আননিসা। উক্ত সুরার প্রথমেই আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ জাতি তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দুজন থেকে অসংখ্য নর-নারী পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ শুধু সূরা আননিসা নয়। পবিত্র কোরানের অনেক সুরায় নারীর অধিকার ও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। 

আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের যেমন অংশ রয়েছে তেমনি নারীরও অংশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় বিভিন্নভাবে নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং নারীর মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি অধিকার দিয়েছেন। 

আল্লাহ্ বলেন, আমি তোমাদের কোনো কর্মী বা সহপাঠীর কাজ নষ্ট করি না। সে নারী হোক বা পুরুষ হোক। তোমরা পরস্পর এক। অন্য এক আয়াতে বলা হয়। ঈমানদার পুরুষ ও রমনীরা একে অপরের সহায়ক ও বন্ধু। তারা একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজের নিষেধ করবে। ইসলাম ধর্মে নারীর জীবনব্যবস্থা ও সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্ত্রী কন্যা মাতা ও ভগ্নী হিসেবে তার ব্যক্তিগত মর্যাদা অধিকার ও স্বাধীনতার সঙ্গে সামগ্রিক সব বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়ার কথাও বলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিটি বিষয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও উৎসাহিত করেছে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, বিশ্বে বহু অমূল্য সম্পদ রয়েছে। আর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে নেককার নারী। তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। ইসলাম স্ত্রী হিসেবে নারীকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। আল্লাহ্ বলেন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ করো। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যে বিয়ে করে সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে। ইসলাম নারীকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান দিয়েছে মা হিসেবে। মা হিসেবে ইসলাম নারীকে যে মহান মর্যাদায় আসীন করেছে তার নজির আর কোথাও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। 

তিনি আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। ঐতিহাসিক হজের ভাষণে তিনি বলেছেন ভ্রাতৃগণ শ্রবণ করো ইসলামে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। নারীদের প্রতি তোমরা সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমরা অন্যায় আচরণ করবে না।

ইসলাম ধর্ম প্রথম নারীর স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা এবং ভোগ-দখলের অখণ্ড অধিকার দিয়েছে নারীকে। মাবন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে অর্থনৈতিক অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কন্যা, স্ত্রী, বোন ও মাতা হিসেবে মুসলিম নারীর মিরাস বা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক পিতা ও স্বামী উভয়দিক থেকে উত্তরাধিকার লাভ করে তারা পেয়েছে মালিকানাস্বত্ব এবং তা স্বাধীনভাবে ব্যয় করার পূর্ণ অধিকার। ইসলাম নারীকে পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার দিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে মতামত প্রকাশ ও সমাজকল্যাণের যেকোনো কর্মকাণ্ডে নারীরা পুরুষের মতোই অংশগ্রহণ করতে পারবে। এই মর্মে হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, যোগ্যতানুসারে নারীরা প্রধান বিচারপতির পদও অলংকৃত করতে পারবে।

ইসলামে আরও উল্লেখ আছে নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োগ করা সম্পদ এবং লাভ একমাত্র তারই আওতাধীন। স্বামী কিংবা অভিভাবকদের এক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ চলবে না। যদি না স্বেচ্ছায় তা দান না করে। সুরা আন নিসার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। একজন পুরুষের যেমন অধিকার আছে নিজের পছন্দের কাউকে বেছে নেওয়ার তেমনটি নারীর জন্যও রয়েছে। ইসলাম বলেছে কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ দেওয়া আইনগত অপরাধ। বিবাহবিচ্ছেদ ও তালাকের ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন স্বামী তার অবাধ্য স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি অত্যাচারী অযোগ্য অকর্মন্য স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য একজন স্ত্রীরও তালাক দেওয়ার অধিকার আছে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মর্যাদা ও পারিবারিক সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদা লাভে সহায়তা করেছে ইসলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান সমাজব্যবস্থা নারীদের ইসলামের চোখে যেমন দেখে না তেমনি নারীকে বাজারের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যে কর্তব্য তা পালন করা হচ্ছে না। তাকে তার অধিকার দিচ্ছে না। দিন দিন প্রতিযোগিতা দিয়ে বেড়ে চলছে আমাদের গণমাধ্যমের সংখ্যা।

ইসলাম নারীকে সব ধরনের মর্যাদা যেমন দিয়েছে তেমনি দিয়েছে সংযত হওয়ার নির্দেশগুলো। কর্মক্ষেত্রে নারীর বাধা নেই ইসলামে তবে সেখানে তাকে চলতে হবে পর্দার মাঝে। রাস্তাঘাটে নারীকে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে উপস্থাপন করছে। এমনভাবে করছে যেন পণ্যের গুরুত্বের সঙ্গে নারীকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। যেখানে নারীর কোনো প্রয়োজন নেই সেখানেও নারীকে দেখাচ্ছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক পোশাকের ব্যবস্থা করছে যা আমাদের মুসলিম নারীদের জন্য শোভা পায় না। ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছে তবে পণ্য করেনি। বর্তমানে স্বাধীনতার নামে নারীকে পণ্যই বানাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো উপস্থাপক হিসেবে নারীকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। 

এটা নারীর জন্য ভালো। নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে কিন্তু তাই বলে সে উপস্থাপনায় অমুসলিম দেশকে অনুকরণ করা নারীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক ছাড়া চাকরি করা যাবে না বলে অনেক নারীকে চাকরি হারাতে হয় আবার অনেক নারী বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয় ইসলামের মর্যাদাকে ভুলে যেতে। নারীদের পর্দা নিয়ে কিছু বললেই বলা হয় নারীকে নারী ঘরে তুলতে বলা হচ্ছে। আসলে তা কিন্তু নয়। নারীকে কাজ করতে হবে তবে সেই ইসলামের পথ নির্দেশনা মেনে চলে। বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীর সাফল্য আসছে। তাই বলে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারও বেড়ে চলছে।

মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত ঘোষণা করে ইসলাম নারী জাতিকে সর্বোত্তম মর্যাদায় ভূষিত করেছে। যে মর্যাদা পুরুষকে দেওয়া হয়নি। ইসলামে একজন নারী একজন পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ও মর্যাদার অধিকারী। নারী তার নারীত্বের মর্যাদা বজায় রেখেই সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন। নারী ছাড়া অন্য কেউই মাতৃত্বের সেবা ও সহধর্মিণীর গঠনমূলক সহযোগী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়। মায়েদের ত্যাগ ও ভালোবাসা ছাড়া মানবীয় প্রতিভার বিকাশ ও সমাজের স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মায়েরাই সমাজের প্রধান ভিত্তি তথা পরিবারের প্রশান্তির উৎস। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলামই নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করে সেটি রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]