ঢাকা ২৯ ভাদ্র ১৪৩১, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সিদ্ধার্থ গৌতম ও যশোধারার দিনগুলো

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম
আপডেট: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৪২ পিএম
সিদ্ধার্থ গৌতম ও যশোধারার দিনগুলো
সংঘানন্দ মহাথের

বহু দূরে উত্তর ভারতের প্রায় শেষান্তে ছিল কপিলাবস্তু- প্রাচীন রাজধানী নগরী। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, সেখানে নগর ও প্রাসাদ আনন্দে-উৎসবে মেতে উঠেছিল যখন রাজকুমার সিদ্ধার্থ জন্মগ্রহণ করেন। যারা রাজার নিকট সুসংবাদ নিয়ে এল, রাজা সেই খবরবাহকদের বহু দামি উপহার দিলেন, আরও যারা কাজ করেছিল তা যৎসামান্যই হোক, প্রত্যেকে বহু উপহার পেল। কারণ যে সন্তান জন্ম নিয়েছে তা রাজা এবং পুরো রাজ পরিবারের বহু প্রার্থনা ও সাধনার ফল ছিল। এ কারণেই যে, রাজা শুদ্ধোধন এবং রানি মহামায়া দুজনই দীর্ঘকাল নিঃসন্তান ছিলেন। এরপর রাজা বসলেন অন্দরের একটি কক্ষে, যেখানে একদল প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কাগজ, বই এবং অপরিচিত যন্ত্রপাতির ওপর ঝুঁকে কিছু কাজ করছেন।

আপনি কি জানতে চান তারা কী করছিলেন? খুব অদ্ভুত ব্যাপার। শিশু রাজকুমার সিদ্ধার্থের সময়ের তারা-নক্ষত্রের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং তার থেকে কুমারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিলেন। অদ্ভুত শোনালেও এই ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন রীতি যা আজও লোকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ দ্বারা এই ভবিষ্যদ্বাণী হলো একজন মানুষের ঠিকুজি কোষ্ঠী। আমি এমনও মানুষের কথা জানি, যার কাছে বেশ কয়েক পূর্বপুরুষের নাম ও কোষ্ঠী আছে। আমাদের দেশেও এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। কপিলাবস্তুর জ্ঞানী ব্যক্তিদের বহু সময় লেগেছিল রাজকুমারের কোষ্ঠী তৈরি করতে। কারণ তাতে যে ভবিষ্যৎ তারা দেখেছিলেন, তা এতই অসাধারণ ছিল যে, তারা ঘোষণা করার আগে সবার সহমত নিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন যে কাজটি নির্ভুল হয়েছে কি না। তবুও পাঁচজন পণ্ডিত মহাশয় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন এবং দুটো মতামত জানিয়েছিলেন মহারাজকে। অবশেষে তারা এসে রাজার সামনে দাঁড়ালেন। ‘বেশ এবার বলুন’ রাজা উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শিশুপুত্র আমার বাঁচবে তো?’ সবচেয়ে প্রবীণ জ্যোতিষী জবাব দিলেন, ‘বাঁচবে, মহারাজ।’

‘আহ’ বললেন মহারাজ, ‘বেশ বেশ।’ এ সংবাদ জানার পর এবার ধৈর্যসহকারে বাকিগুলো শোনা যেতে পারে। ‘সে বাঁচবে’ পুনরুক্তি করলেন বৃদ্ধ জ্যোতিষী এবং তারপর নিজের বক্তব্য জানালেন, ‘কিন্তু যদি এ কোষ্ঠী ঠিক হয়ে থাকে, তা হলে আজ থেকে সপ্তম দিনে, শিশুর মা, মহিষী মহামায়া মৃত্যুবরণ করবেন। এবং সেটাই ইঙ্গিত দেবে মহারাজ যে, আপনার পুত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজা হবেন, না সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে বস্তু জগৎ পরিত্যাগ করে মহান ধার্মিক গুরু হবেন।’ এই বলে তিনি পিতাকে কাগজগুলো অর্পণ করে সঙ্গীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

মহামায়া মারা যাবেন- মহান রাজা অথবা ধার্মিক গুরু, কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল মহারাজের কানে। তিনি একা বসে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা ভাবতে লাগলেন। যে ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলেছে তা তার কাছে সেরকম সাংঘাতিক মনেই হলো না শেষ কথাগুলোর তুলনায়। ‘ধার্মিক গুরু’- ভিখারি- এই কথাগুলোর অর্থ একই? রাজা শিউরে ওঠেন। চিন্তার জগতে নিমগ্ন হতে থাকেন। কিন্তু দাঁড়াও! কথাগুলো ছিল ‘সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে, বস্তুজগৎ পরিত্যাগ’- ‘আমার পুত্র কোনোদিন সাধারণের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখবে না।’ পিতা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন, ভাবলেন এভাবেই পুত্রকে তিনি তার পছন্দের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবেন- এক পরাক্রমী মহারাজা।

সিদ্ধার্থ কুমারের জন্মের সাত দিনের মধ্যে মহারানি মহামায়া মৃত্যুবরণ করেন ঠিক যেমনটি সেই পণ্ডিতেররা বলেছিলেন। বিগত সাত দিনে তাকে প্রাণভরে সব রকমের যত্ন ও সেবা করা হলো। যত্নের কোনো ত্রটি ছিল না, বাঁচানোর সবরকম চেষ্টাই করলেন রাজা শুদ্ধোধন। কিন্তু লাভ হলো না। নির্ধারিত দিনে তিনি শিশুর মতো নিদ্রা গেলেন, আর উঠলেন না। রাজা শুদ্ধোধন এত শোকের মধ্যেও কিছুটা আশঙ্কিত, কারণ এখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে জ্যোতিষীরা সত্য কথা বলেছে। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, তার সন্তানকে তিনি ভিখারি হওয়ার ভবিতব্য থেকে বাঁচাবেনই। পরিবর্তে তাকে করে তুলবেন এই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও প্রতিপত্তিশালী রাজা; একে বৌদ্ধ সাহিত্য চক্রবর্তী রাজা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

শিশু যখন ধীরে ধীরে বালক হলো এবং বড় হতে লাগল, তার আশপাশের লোকেরা মনে করতেন তার সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। তিনি এত বুদ্ধিমান, প্রাণচঞ্চল, লেখাপড়া ও খেলায় এত চমৎকার ছিলেন এবং সব থেকে বড়ো কথা- এত প্রেমে পরিপূর্ণ যে তার একটি কথায় বা একবার দৃষ্টিপাতে যে কেউ তার অনুরাগী হয়ে পড়ে। তার কোনো শত্রু নেই। সবাই তার সম্বন্ধে সর্বদা বলে, তিনি ‘করুণায়’ পরিপূর্ণ’। তিনি ডানাভাঙা পাখিকে অশেষ যত্নে সেবা করতেন; কোনোদিন পশুপাখিদের তীরধনুক দিয়ে শিকার করেননি। যেমন কপিলাবস্তুর অনেক বন্ধু অভিজাত তরুণরা করত। তিনি বলতেন, নিরীহ ও অবলা জীবদের হত্যা করা পুরুষোচিত কাজ বলে তিনি মনে করেন না। তাহলে তিনি তীরের আঘাতের বেদনার কথা জানতেন। কিন্তু অন্য কোনোরকম দুঃখ-যন্ত্রণার কথা তিনি কখনো শোনেননি। তার গৃহ এক রাজপ্রাসাদ। তার চারদিকে মনোরম বাগান, বাগানের পর উত্তরে মাইলের পর মাইল উন্মুক্ত ক্ষেত্র রাজধানীর চারধারে বিস্তৃত। এগুলোর বাইরে তিনি কখনো বালক বয়সে যাননি। এখানে তিনি ঘোড়ায় চড়তে পারতেন, তীর চালনা করতে পারতেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে, দেখে, ভেবে, স্বপ্ন দেখতে পারতেন। এখানে কোনো দুঃখ ছিল না, দুঃখের কথা কেউ বলতও না। কারণ রাজা কর্তৃক দুঃখের কথা বলা নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই পরিবেষ্টিত জায়গাটি নিজেই এক রাজ্য ছিল। তিনি এর বাইরে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেনওনি। এবং তার বাবা সবাইকে বারণ করে দিয়েছিলেন তার সামনে যেন কোনো প্রকারের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা না বলে। কারণ শুদ্ধোধনের সবসময় মনে হতো ‘সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে’ সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করবেন। এই যন্ত্রণার জ্ঞান থেকে তিনি পুত্রকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

একজন ভারতীয় যুবকের অধ্যয়নকাল হওয়া উচিত তার ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর সে স্বাধীন। যখন তরুণ গৌতম সে বয়সের কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন তিনি নিজেই দেশ ছেড়ে অন্য দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিতে পারতেন। কেউ বারণ করতে পারত না তাকে, নিজের পিতাও না- কারণ তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন। তাই এই সময়ে তারা তাকে বাঁধতে চাইলেন, ফুলডোরে। তাকে প্রস্তাব দিলেন বিয়ে করে সংসারী হতে। তাদের মনে হলো, এ এখন শুধু সময়ের প্রশ্ন। তার কাছাকাছি যদি এক সুন্দরী সহধর্মিণী এবং ফুটফুটে আদরের সন্তান থাকে তা হলে তিনি আনন্দ ও ভালোবাসার বন্ধনে এমন বাঁধা পড়ে যাবেন যে বাড়ি ত্যাগ করতে পারবেন না। তিনি তাদের জন্য আরও ধন-সম্পদ সংগ্রহ করতে প্রয়াসী হবেন এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ও ক্ষমতাশালী সম্রাট হয়ে উঠবেন। ঠিক যেমনটি তার জন্মের সময় জ্ঞানী পণ্ডিতরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু গৌতম একটা ব্যাপারে মনস্থির করেছিলেন। তিনি নিজে পাত্রী দেখবেন ও পছন্দ করবেন। তাই সমস্ত তরুণ সভাপদ যাদের বিবাহযোগ্য ভগিনী ছিল একসঙ্গে সাত দিনের জন্য সভায় নিমন্ত্রিত হলেন। প্রতিদিন সকালে নানারকম খেলাধুলা চলতে লাগল, হয় গদা খেলা, বা তলোয়াল খেলা বা অশ্বলায়ন। বিকেলে নানা ধরনের খেলার প্রদর্শনী যেমন লোফালুফির খেলা, সাপ খেলা ইত্যাদি এবং নাটকের আয়োজন হতো। এগুলো রাজপ্রাসাদের প্রদর্শনালাতেই হতো এবং সবাই একসঙ্গে বিনোদনের আনন্দ নিতেন।

রাজা নিজে, মন্ত্রীরা এমনকি সভাসদরাও সবাই একজন বিশেষ নারীর কথা ভাবছিলেন, যাকে গৌতম পছন্দ করবেন। তার সৌন্দর্য, গুণ ও কৌলীন্য অন্য সবার চেয়ে বিশিষ্ট ছিল। তার নাম যশোধারা। যেদিন শেষদিন এল, গৌতম দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে একে একে অতিথিদের কোনো না কোনো অসাধারণ বিদায় উপহার দিয়ে বিদায় জানালেন- কাউকে কল্কহার, কাউকে কঙ্কন, কাউকে বহুমূল্য রত্ন। যখন যশোধারার পালা এল তাকে দেওয়ার মতো একটি ফুল ছাড়া গৌতমের কাছে আর কিছু ছিল না। তিনি নিজের পোশাকের ভিতর থেকে একটি ফুল বের করে যশোধারার হাতে দিলেন। যারা দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, মনে করলেন যশোধরাকে বুঝি তার পছন্দ নয়, তাই এই অবহেলা। যশোধরা নিজে ছাড়া আর সবাই খুব দুঃখিত হলেন। তার কাছে ওই একটি ফুল অন্য বান্ধবীদের মূল্যবান উপহারের চেয়েও আরও মূল্যবান বলে মনে হলো। পরদিন কপিলাবস্তুর রাজা যখন নিজে তার বাবার কাছে এসে ছেলের জন্য তাকে চাইলেন, তিনি একেবারেই  আশ্চর্য হলেন না। তার শুধুই এটাই অবাক লাগল যে সবকিছু যেন কী স্বাভাবিক ও সরল। তিনি মনে মনে হয়তো আবছাভাবে সচেতন ছিলেন যে, পূর্বতন বহু জীবনের শৃঙ্খলে তিনিই তো তার স্ত্রীর ছিলেন। কিন্তু যশোধারা এমনই একজন যার নামে বহু পাণিপ্রার্থী আকৃষ্ট হতো। এবং মর্যাদার রীতি অনুসারে গৌতমকে তার শৌর্য প্রমাণ করেই তাকে জয় করতে হবে। রাজবংশের এমনই ধারা ছিল। এই রীতি অনুযায়ী রাজপুত্রের প্রস্তাব কন্যার পিতা গ্রহণ করলেন।

গৌতম তার প্রস্তাব গ্রহণে উৎফুল্ল হলেন এবং সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্ধারিত দিনে প্রতিযোগিতার আহ্বান জানালেন। তার আত্মীয়রা বললেন, হায়! তুমি কী করবে? তুমি কোনোদিন উড়ন্ত পাখিকে বা পলায়মান হরিণকে নিশানা করোনি, কখনো দৌড়রত শূকর হত্যা করনি? তুমি কী করে বিশাল ধনুকে প্রসিদ্ধ তিরন্দাজদের পরাস্ত করবে? তিনি হাসি ছাড়া উত্তরে কিছু বললেন না। ভয় তার কাছে অজানা আর নিজের অন্তরে তিনি এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করছেন। নির্দিষ্ট সময়ে দেখা গেল তার আত্মবিশ্বাস সঠিক ছিল, কারণ তিনি সবার থেকে এগিয়ে সব পুরস্কার নিয়ে বিজয়ী হলেন।

রাজকুমার গৌতমের সঙ্গে যশোধারার বিয়ে হয়ে গেল। তাদের ভাবী বাসভবনকে পুরোনোটির চেয়েও বেশি সুন্দর করা হলো। নতুন রাজপ্রাসাদ একটি জলাধারের ওপর। প্রাসাদের খিলান সব গোলাপরাঙা পাথরের আর ঘন বাদামি রঙের কাঠের, বাগানের একপ্রান্তে শ্বেত পাথর নির্মিত এক দ্বীপ ঘিরে উচ্ছল একটি ঝরনা। সেই দ্বীপে গ্রীষ্মবাস- শ্বেত, শীতল, মর্মরকক্ষ তৈরি হলো। সারা প্রাসাদ ঘিরে নদীর বুকে গোপন ফোয়ারারা যখন ইচ্ছে তখন জল দান করে। জানালাগুলোতে হয় কাঠের জাফরি, নয় ছিদ্র করা মর্মরের ঝরোখা। যার ফলে আব্রু থাকবে, আলো থাকবে, ছায়া থাকবে। এই জানালা দিয়ে দেখা যাবে প্রসারিত ফুল গাছশোভিত বাগান, পুষ্পলতার বিভাজিকা। প্রতিটা বড় রাজকীয় হলঘরের কোনে ছাদের বর্গা থেকে লম্বা শিকলে ঝুলছে দুজনে বসে দোল খাওয়ার মতো দোলনা- তার তিন দিক ঘেরা, ভিতরে গদি, বালিশ।  গ্রীষ্মের দিনে এতে বসে দোল খাওয়া যায় ও শীতল বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যায়, আবার মনে হলে অলসভাবে শুয়েও থাকা যায়। সেবিকারা ধীর লয়ে পাখা দুলিয়ে বাতাস করতে পারে। সিংহাসনে বসবেন যিনি সেই রাজকুমারকে ঘিরে যারা থাকবে, তাদের সযত্নে তাদের সুন্দর চেহারা বা প্রাণবন্ত দেখে নির্বাচন করলেন এক মন্ত্রী। রাজকুমারের কানে কোনো বিলাপ, কোনো অশ্রুমোচনের শব্দ যেন না পৌঁছায়। তিনি যেন কোনোভাবেই রোগ, জরা ক্ষয়ের সম্মুখীন না হন। তিনি যদি কখনো নগরীতে যেতে চান তাকে যেন তখনই নানা বিনোদন, আনন্দে অন্যমনস্ক করে দেওয়া হয়। এমনই ছিল রাজার কড়া হুকুম। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন কে খণ্ডাবে? রাজা এই সত্যের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি যে, তার সব প্রচেষ্টা নির্দিষ্ট সময়ে তার আশঙ্কাই আরও বাড়িয়ে দেবে। তিনি ছেলের জন্য যে জীবন সাজিয়েছেন, তা বাস্তব নয়- একটা স্বপ্ন, একটা নাটক। সত্য সর্বদাই মিথ্যার চেয়ে শ্রেয়, এবং কোনো না কোনো সময়ে কুমারের মনে সত্যের প্রতি আগ্রহ জাগবেই। ঠিক তাই হলো। একদিন গৌতম নিজের সারথীকে বললেন, প্রাসাদের পাঁচিলের বাইরে নিজের নগরী কপিলাবস্তুতে তাকে নিয়ে যেতে, তার ভবিষ্যৎ রাজ্যের রাজধানীতে। হতবাক সারথীর আদেশ পালন ছাড়া উপায় ছিল না। তার অমান্য করার কোনো সাধ্য নেই। কিন্তু রাজা জানতে পারলে কী হবে ভেবে রাজার ক্রোধকেও যেন ভয় পেল প্রচণ্ড।

তারা কপিলাবস্তু গেলেন এবং সেদিন প্রথমবারের জন্য গৌতম বাস্তব জীবনকে কাছ থেকে দেখলেন। ঘিঞ্জি রাস্তায় বাচ্চাদের খেলতে দেখলেন। বাজারে খোলা দোকানে ব্যবসায়ীরা বসে খদ্দেরদের সঙ্গে দরদাম করছে, সামনে পসরা সাজানো। সূচিশিল্পী, কুমোর, পিতলের কামার- সবাই নিজের নিজের পসরা সাজিয়ে বসে কাজে ব্যস্ত। তার সাগরেদ পাশে বসে হাঁপর টানছে, আগুন জ্বলে উঠে ধাতুকে গরম করছে। কুমারের সাগরেদ তার জন্য চাক ঘুরিয়ে চলেছে। মালবাহকরা মাল নিয়ে নিয়ে ক্লান্ত মুখে যাওয়া-আসা করছে। ছাইমাখা এক সাধু লম্বা লাঠি নিয়ে হেঁটে চলেছে। অর্ধভুক্ত কুকুরগুলো একে অন্যকে দেখে খাবার নিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে গজরাচ্ছে, গ্রাম থেকে আসা ফল, শস্য, তুলাভরা গরুর গাড়ি দেখেও সরছে না। খুব কম মহিলা চোখে পড়ল, তাও অল্পবয়সি নয়, কারণ দুপুর হয়ে এসেছে। সকালের স্নানের সময় শেষ হয়ে  গেছে অনেকক্ষণ, তবু এক-আধজন যুবতীকে দেখা যাচ্ছে- ঘোমটা টানা, মাথায় বড় পিতলের কলসি। বাড়িতে জল নিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও রাস্তাঘাট রঙিন। কারণ পুবের মানুষদের পোশাকের অঙ্গ উজ্জ্বল রঙের রেশম বা পশমের শাল বা চাদর, বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে ফেলে ডান হাতের নিচ দিয়ে টানা। তাই শহরের ভিড়ে মেয়েদের পায়ের নুপুরের রুনুঝুনু ধ্বনি শোনা না গেলেও, প্রচুর ফিকে সবুজ, গোলাপি, বেগুনি, হলুদ, তুঁতে নীলের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। জনবহুল রাস্তা উজ্জ্বল ও রঙিন দেখতে লাগে। গৌতম সারথির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এখানে দেখছি শ্রম, দারিদ্র্য, ক্ষুধা- তাও কত সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দের মধ্যে মিশে আছে- সত্যি জীবন এতসব সত্ত্বেও কী মধুর!

তিনি নিজের মনেই এই কথাগুলো বললেন এবং ধীরে ধীরে সেই তিন অমোঘ শব্দের কাছাকাছি উপনীত হলেন- মানুষের তিনটি দুঃখ- ক্লান্তি, ব্যাধি ও মৃত্যু। গৌতমের জীবনে সেই মহাক্ষণটি এসে গেল। প্রথমে এল ক্লান্তি। এক বৃদ্ধ, অতি বৃদ্ধ মানুষ, তার মাথায় চুল নেই, মুখ দন্তহীন, হাত কাঁপছে- এই রূপ ধরে এল ক্লান্তি। ক্লান্তি তাকে জীবন্মৃত করে রেখেছে। লাঠিতে ভর দিয়ে সে তার শীর্ণ রোগগ্রস্ত হাত বাড়াল ভিক্ষার জন্য। রাজকুমার ঝুঁকে পড়ে ভিক্ষা দান করলেন আগ্রহভরে- বৃদ্ধ যা আশা করতে পারত তার চেয়ে অনেক বেশি। তার মনে হলো, তার নিজের আত্মাই বোধহয় ডুবে যাচ্ছে। ‘ও ছন্দক’ তিনি সারথিকে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী, এটা কী? এ কী? ওর কী হয়েছে?

ছন্দ সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘না, সেরকম কিছু না। মানুষটি শুধু হয়েছে।’ ‘বৃদ্ধ!’ গৌতম বললেন, আর কল্পনা করতে লাগলেন পিতার পাকা চুল এবং রাজ্যের বৃদ্ধ মন্ত্রীদের কথা। ‘কিন্তু সব বৃদ্ধ তো এরকম হয় না।’ সারথি বলল, হ্যাঁ হয়, যদি যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়। ‘আমার পিতা?’ কুমার বললেন, কিন্তু তার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল, ‘পিতা? যশোধারা? আমরা সবাই এরকম?’ সারথি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সবাই বৃদ্ধ হবেন, আর কেউ যদি অতি বৃদ্ধ হয়, তার এই দশাই হবে।’ গৌতম নীরব হয়ে গেলেন, ভয় এবং করুণা দুই-ই তাকে আচ্ছন্ন করল। কিন্তু মাত্র এক মুহূর্তের জন্য, কারণ ততক্ষণে রথের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এমন একজন ভয়ংকরদর্শন মানুষ যার শরীরের চামড়ায় গোলাপি ছোপ- এবং যে হাত সে মেলে ধরেছে, তার অনেক গাঁট নেই। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই দেখলে চোখ ঢেকে তাড়াতাড়ি সরে যেতাম। কিন্তু গৌতম সে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালেন না- মায়াভরা কণ্ঠে বললেন,  ‘আমার ভাই!’ এবং করুণায় উদ্বেলিত হয়ে শ্রদ্ধাভরে তাকে একটি মুদ্রা দান করলেন। ‘ও কুষ্ঠরোগী’ ছন্দক বলে উঠল, ‘ও কুষ্ঠরোগী, আমরা এগিয়ে যাই।’ ইতোমধ্যে লোকটি গৌতমের কণ্ঠস্বরের কোমলতায় চমকে উঠেছে। ‘এর মানে কী ছন্দক?’ গৌতম জিজ্ঞেস করলেন। ‘এর অর্থ রোগ ওকে গ্রাস করেছে, প্রভু।’ ‘রোগ! রোগ! সেটা কী?’ কুমার আবার প্রশ্ন করলেন। ‘প্রভু, এ এক যাতনা যা শরীরকে আক্রমণ করে। কেউ জানে না কেন বা কীভাবে। এ আরামকে নষ্ট করে দেয়। চরম গ্রীষ্মে অসুস্থ মানুষের শীত করে, পাহাড়ি বরফেও গরম অনুভব করে। এর প্রকোপে কেউ পাথরের মতো ঘুমায়, কেউ উত্তেজনায় পাগল হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীর গলে গলে পড়ে আবার কোনো ক্ষেত্রে শরীর আকৃতি ঠিক রাখে কিন্তু এমন শীর্ণ হতে থাকে যে হাড় গোনা যায়। আবার কখনো এমন ফুলে উঠে বীভৎস আকার ধারণ করে। রোগ এমনই হয়। কেউ জানে না কোথা থেকে হয়, কী থেকে হয় বা কখন আমাদের আক্রমণ করবে।

‘এই হলো জীবন- যে জীবনকে আমি মধুর ভাবতাম’, বললেন গৌতম। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ তুলে চাইলেন, ‘মানুষ কীভাবে জীবন থেকে নিষ্কৃতি পায়?’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষের কে এমন বন্ধু আছে যে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে?’

‘মৃত্যু’ বলল ছন্দক। ‘দেখুন, ওই আসছে শববাহীরা। নদীর ধারে নিয়ে যাবে শবদেহকে পোড়াতে।’

রাজকুমার তাকিয়ে দেখলেন চারজন বলশালী লোক, কাঁধে একটি নিচু চৌকি, তার ওপর শায়িত সাদা চাদরে ঢাকা একটি মনুষ্য আকৃতি। মানুষটি নড়ছে না, সে চাদরের তলায় স্থির এবং যদিও বাহকরা প্রত্যেক পদক্ষেপে বলে যাচ্ছে, ‘হরি বোল,’ যাকে তারা নিয়ে যাচ্ছে, সে এই প্রার্থনায় নিরুত্তর। সারথি বলল, ‘কিন্তু মানুষ মৃত্যু ভালোবাসে না। তাদের কাছে মৃত্যু বন্ধু নয়- বরং তারা আয়ু ও রোগের থেকেও মৃত্যুকে বড় শত্রু বলে মনে করে। মৃত্যু তাদের আচমকা হানা দেয় এবং তারা একে ঘৃণা করে ও প্রাণপণ এড়ানোর চেষ্টা করে।

গৌতম এবার শবযাত্রার মিছিলের দিকে ভালো করে তাকালেন। তার ভিতরে যেন অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন মানুষ কেন মৃত্যুকে ঘৃণা করে। মনে হলো যেন তার চোখের সামনে দিয়ে ছবির সারি চলমান। তিনি দেখতে পেলেন যে, মৃত ওই মানুষটির আগে বহুবার মৃত্যু হয়েছে এবং প্রতিবারই তার নবজন্ম হয়েছে। তিনিও এও দেখলেন যে, এই মৃত্যুর পরও ব্যক্তিটি নিশ্চিত এই পৃথিবীতে ফিরবেন। ‘যার জন্ম হয়, তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, যার মৃত্যু হয় তার জন্ম অবশ্যম্ভাবী।’ তিনি বললেন, ‘এই জীবনচক্রের ঘূর্ণিতে কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। ছন্দক, বাড়ি চলো।’

সারথি আদেশ পালন করল। রাজকুমার আর কোনো প্রশ্ন করলেন না, তিনি চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদে ফিরে- যা যা তার এতকাল মনোহর লাগত সব বিষময় মনে হতে লাগল। সবুজ মখমলি ঘাসের বাগিচা আর পুষ্পিত বৃক্ষ কীই-বা কাজের, এ সবই তো সত্য থেকে আড়াল করার খেলনা মাত্র। তিনি ও যশোধারা তো শিশুর মতো এসব খেলনা নিয়ে সেই বাগানে বসে খেলা করেন, যে বাগানের নিচে অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি যে কোনো মুহূর্তে উদ্গিরণ করে তাদের ধ্বংস করবে। শুধু তারাই নন, অন্য সব মানুষই এই সত্য ভোলানো খেলা খেলে চলেছে, হয়তো-বা তাদের চেয়ে খেলা উপভোগ করার কিছু কম কারণ আছে তাদের। তার হৃদয় এক মহান উদ্বেলিত করুণার সাগরে পরিবর্তিত হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয়, সব জীবের জন্য ভালোবাসার ক্ষমতা আছে ও কষ্ট সহ্য করারও ক্ষমতা আছে। ‘জীবন ও মৃত্যু এক দুঃস্বপ্ন।’ তিনি নিজের মনে মনে বলছিলেন, ‘আমরা কী করে একে চূর্ণ করে জেগে উঠব?’

মানুষের জীবনের তিনটি মহান দুঃখ তাকে বিদ্ধ করল ঠিক যেমনটি তার জন্মের সময় সেই জ্ঞানী ব্যক্তিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি খেতেও পারলেন না, বিশ্রাম নিতেও পারলেন না। প্রায় মাঝরাতে যখন পুরো রাজপ্রাসাদ ঘুমে মগ্ন, তিনি উঠে নিজের ঘরে পায়চারী করতে লাগলেন। একটি জানালা খুলে বাইরে ঘন অন্ধকার রাতের দিকে চেয়ে রইলেন। বাতাসের এক ঝটকা গাছের মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেল, মনে হলো মাটি যেন কেঁপে উঠল। এই বিশ্ব যেন তাকে বলল, ‘জাগো! তুমি যে জেগে উঠেছ, ওঠো, বিশ্বকে সাহায্য করো।’ কুমারের মন নিঃসন্দেহে এই অমোঘ ডাক শুনলেন এবং শব্দে উচ্চারিত না করেও এর মহাত্ম্য বুঝলেন। তিনি বাইরে রাতের তারার দিকে তাকিয়ে নিজের অন্তরে পথ খুঁজতে চাইলেন, কীভাবে এই জীবনের স্বপ্ন থেকে তিনি বেরিয়ে আসবেন ও তার নিয়তি নির্ধারিত স্থানে পৌঁছবেন। এভাবে ব্যাকুল মনে যখন তিনি দিশা হাতড়াচ্ছেন তখন তার হঠাৎ মনুষ্যজাতির প্রাচীন জ্ঞানী ঋষিদের কথা মনে এল। তিনি বলে উঠলেন, ‘এই খোঁজই তো সেই খোঁজ বা যুগে যুগে মানুষকে সংসার ত্যাগ করে গহন বনে, ভস্ম মেখে জীবনধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা নিশ্চয় কিছু জানতে পারেন। এই সেই উপায়। আমিও সেই রাস্তাতেই যাব। তারা তো অর্জিত জ্ঞান বিতরণ করার জন্য আর সংসারে ফেরেন না। তারা নিজেদের মধ্যেই সেই জ্ঞান সঞ্চিত রাখেন বা অন্য জ্ঞানীদের সঙ্গে বিনিময় করেন। আমি যখন এই গোপন রহস্যোদ্ধার করতে পারব, তখন আমি ফিরব, সব মানুষকে আমার জ্ঞানের কথা বলব। তখন নিম্ন থেকে নিম্নতম বর্গের যে সেও জানবে, উচ্চতম বর্গের যে সেও জানবে। মুক্তির উপায় গোটা বিশ্ব জানবে। এই কথা কয়টি নিজ মনে উচ্চারণ করে, জানালা বন্ধ করলেন এবং নিজের ঘুমন্ত পত্নীর শয্যাপাশে এলেন। ধীরে পর্দাগুলো সরিয়ে যশোধারার মুখপানে চাইলেন। এই সময়ই তার মনে প্রথম দ্বন্দ্ব শুরু হলো। তার কি যশোধারাকে পরিত্যাগ করার কোনো অধিকার আছে? তিনি আর কখনো নাও ফিরতে পারেন। একজন রমণীকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিধবা করা কি সাংঘাতিক ও নিষ্ঠুর কর্ম নয়? তার শিশু পুত্রকেও বড় হতে হবে পিতৃস্নেহ ছাড়া? জগতের জন্য আত্মত্যাগ ভালো কিন্তু অপরকে সেই ত্যাগে বাধ্য করা কি উচিত?

তিনি পর্দা আবার টানলেন এবং জানালার কাছে ফিরে গেলেন। তারপরই তার মধ্যে এক উপলব্ধি এল। মনে পড়ল যশোধারার মন সময়ে কত উচ্চ ও মহান মনে হয়েছে তার কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি যা করতে চলেছেন তার মধ্যে যশোধারারও অংশ থাকবে। তাকে হারানোর যে তীব্র বেদনা, তাতে গৌতমের ত্যাগের অর্ধেক যশোধারার হয়ে উঠবে, আবার তিনি যে জ্ঞান ও আলোকপ্রাপ্ত হবেন তারও অর্ধেক যশোধারার হবে। তিনি আর দ্বিধা করলেন না। আবার বিদায় জানাতে কাছে গেলেন। রেশমের পরদাগুলো সরিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। তাকে জাগাতে চাইলেন না, তাই সামনে ঝুঁকে তার পায়ের পাতায় চুম্বন করলেন। ঘুমের মধ্যে যশোধারা একটু আওয়াজ করে পা গুটিয়ে নিলেন। 

নিচে নেমে তিনি ঘুমন্ত ছন্দককে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগালেন এবং বললেন, রথের সঙ্গে এক্ষুনি নিঃশব্দে ঘোড়া বাঁধতে। তারপর তারা চুপচাপ সিংহদ্বার থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পড়লেন এবং ঘোড়া দ্রুত ছুটতে লাগল। ধীরে ধীরে কুমার পিতৃগৃহ থেকে বহুদূর চলে গেলেন। ভোর হতে উনি থামলেন এবং রথ থেকে নামলেন। তারপর একের পর এক তার পোশাক ও আভরণ খুলতে লাগলেন। ছন্দকের হাত দিয়ে সব ফেরত পাঠালেন। সেগুলো প্রেমপূর্ণ উপহাররূপে একে-তাকে বার্তা দিয়ে পাঠালেন। তারপর নিজে ভিক্ষুকের পোশাক গোলাপি বস্ত্র পরলেন, গায়ে ভস্ম মাখলেন। হাতে নিলেন লাঠি আর ভিক্ষাপাত্র। ছন্দক অশ্রুপূর্ণ চোখে তার পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালেন। গৌতম বললেন, ‘পিতাকে বলো, আমি ফিরে আসব।’ তারপর সংক্ষিপ্ত বিদায় জানিয়ে, জঙ্গলে মিলিয়ে গেলেন। ছন্দক সেই স্থানে রাজকুমার অদৃশ্য হওয়ার পরও অনকেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঝুঁকে শ্রদ্ধাবণত চিত্তে যেখানে কুমার দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানকার ধুলো তুলে মাথায় ঠেকালেন, তারপর রথ ঘুরিয়ে খবর দিতে গেলেন রাজাকে।

একটানা ছয় বছর রাজকুমার গৌতম তার সন্ধানে নিমগ্ন রইলেন। অবশেষে এক রাত্রে ধ্যানস্থ অবস্থায়, বোধিবৃক্ষের নিচে তিনি গভীর সত্য উপলব্ধি করলেন এবং সব জ্ঞানের উন্মেষ ঘটল। তখন থেকে তার আর সব নাম হারিয়ে গেল এবং তিনি পরিচিত হলেন ‘বুদ্ধ’ নামে। সেই আলোকপ্রাপ্তীর চরম মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করলেন যে জীবনের প্রতি তৃষ্ণাই সব দুঃখের কারণ। বাসনা থেকে মুক্ত হলে মানুষ সত্যেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। এবং তিনি এই মুক্তির নাম দিলেন, ‘নির্বাণ’ এবং নির্বাণের প্রতিকূলতা ভরা এই পথকে তিনি আ্যখ্যা দিলেন ‘শান্তির’ পথ।

এই সবই ঘটেছিল সেই বনে, যার নাম আজ বুদ্ধগয়া, এবং আজও যেখানে সেই মহান বোধিবৃক্ষের পাশে একটি সুপ্রাচীন মন্দির আছে, যার প্রাচীনতা ঠিক বোধিবৃক্ষের পরই। বুদ্ধ সেখানে কিছুদিন থাকলেন, অনেক কথা ভাবলেন, তারপর সেই বন ছেড়ে বারাণসীতে এলেন এবং সেখানে মৃগবনে পাঁচজন সন্ন্যাসীর কাছে প্রথম বাণী প্রচার করলেন। এই সময় থেকেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল এবং বহু সংখ্যক মানুষ তার অনুগামী হলেন। দুই ব্যবসায়ী কপিলাবস্তু যাাচ্ছিলেন, তাদের মাধ্যমে তিনি পিতা ও যশোধারাকে খবর পাঠালেন যে তিনি নিশ্চয় বাড়ি যাবেন। অবশেষে বুদ্ধের খবর পেয়ে তাদের আর আনন্দের সীমা রইল না। বৃদ্ধ রাজা চাইছিলেন পুত্রের জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনার আয়োজন করতে কিন্তু তিনি দেখলেন বহু লোকের ভিড় জমেছে, রাজদ্বারে সেনারা প্রস্তুত, অস্থির ঘোড়ারা হ্রেষারব তুলছে আর সেখানে আগত আপাদমস্তক হলুদ রঙে আবৃত এক ভিক্ষু, তিনি মানুষের ভিক্ষা গ্রহণ করছেন। মহারাজের তাঁবুর পাশ দিয়ে তিনি যখন যাচ্ছিলেন, রাজা দেখলেন এ তো তারই পুত্র। যিনি সাত বছর আগে গহিন রাতে রাজ্যে ত্যাগ করেছিলেন আর আজ বুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ভিক্ষু বুদ্ধ কোথাও না থেমে সোজা এগিয়ে গেলেন নিজের প্রাসাদের দিকে এবং নিজের ঘরে স্ত্রী-পুত্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন। যশোধারাও হলুদ বস্ত্র ধারণ করেছিলেন। যেদিন সকালে তিনি জেগে উঠে জেনেছিলেন তার স্বামী সংসার ত্যাগ করে বনে গেছেন, সেই দিন থেকে তিনি তার স্বামীর জীবনধারার অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি ফলমূল ছাড়া কিছু খাননি, ছাদ বা বারান্দার মেঝেতে ছাড়া আর কোথাও শয়ন করেননি। তিনি রাজকুমারীর সব আবরণ ও আভরণ দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি শ্রদ্ধাভরে গৌতমের পায়ের কাছে বসলেন ও তার পরিহিত বস্ত্রের প্রান্তের বাঁ-দিকে চুম্বন করলেন। তারা প্রায় কোনো কথাই বললেন না। বুদ্ধ তাকে আশীর্বাদ করলেন ও চলে গেলেন। তখন যশোধারার মনে হলো তিনি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেন। তাড়াতাড়ি পুত্রকে ডেকে বললেন, ‘যাও পিতার কাছে, গিয়ে চাও তোমার উত্তরাধিকার। ‘মা, আমার বাবা কে?’ বালকটি ভীতুস্বরে মুণ্ডিত মস্তক, হলুদ পরিহিত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু যশোধারা কোনো বর্ণনা দিলেন না, ‘তোমার পিতা’ তিনি বললেন, ‘ওই পুরুষসিংহ যিনি তোরণের দিকে যাচ্ছেন।’ বালকটি সোজা পিতার কাছে গিয়ে বলল, ‘পিতা, আমাকে পৈতৃক উত্তরাধিকার দিয়ে যান।’ সে কথা তিনবার বলার পর, বুদ্ধের প্রধান শিষ্য আনন্দ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি দিতে পারি?’ বুদ্ধ বললেন, ‘দাও’ এবং সেই হলুদ বস্ত্র বালকের গায়ে ফেলে দেওয়া হলো। তারা ফিরে দেখলেন, পেছনে মা আসছেন, তার মাথায় ঘোমটা টানা। তিনি নিশ্চিত স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাইছেন। কোমল হৃদয় আনন্দ আবার জিজ্ঞেস করল, ‘প্রভু, কোনো নারী কী আমাদের সংঘে আসতে পারেন না? তিনি কি আমাদের একজন হতে পারেন না?’ বুদ্ধ বললেন, ‘মানুষের জীবনের তিন যন্ত্রণা কি পুরুষদের মতো নারীদের জীবনেও ঘটে না? তা হলে শান্তির পত্রে তাদের চরণচিহ্ন পড়বে না কেন? আমার সত্য, আমার সংঘ সবার জন্য। তবু এই অনুরোধ তোমরই করা ভবিতব্য ছিল, আনন্দ।’ যশোধারাও সংঘে গৃহিত হলেন। তিনি বুদ্ধের কাছাকাছি একই কাননে বাস করতে লাগলেন ও সংঘের ধর্মপালন করতে শুরু করলেন। তার দীর্ঘ বৈধব্যের অবসান ঘটল এবং অবশেষে তিনিও শান্তির পথে পা বাড়ালেন।

জগতের সব প্রাণী সুখী হোক

লেখক: অধ্যক্ষ, সিলেট বৌদ্ধবিহার

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও কিছু প্রশ্ন

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০০ পিএম
মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও কিছু প্রশ্ন
সিরাজুল ইসলাম

অত্যন্ত আলোচিত-সমালোচিত নাম আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। তিনি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে। এই আযমীর সঙ্গে আমার শত্রুতা বা বন্ধুত্ব নেই। তিনি গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’-এ আট বছর বন্দি ছিলেন এবং শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর তিনি সেখান থেকে মুক্তি পান বলে তিনি দাবি করেন। সেখানে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তার এই দাবিকে সত্য ধরে নিয়েছি আমি। এ কারণে তার প্রতি আমার একটা সফট কর্নার আছে। তবে তার কয়েকটি দাবি আমাকে, আমাদের বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন এবং সংবিধান পুনরায় লেখার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই দাবিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এর পেছনে দুরভিসন্ধি আছে বলে মনে হয়। হয়তো অনেকে বলবেন- এটা একান্ত তার ব্যক্তিগত অভিমত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে। হ্যাঁ, আছে। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা বলা নয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা বিষয়ে বিতর্ক কারও কাছে কাম্য নয়। আযমীর মতো একজন মানুষের কাছে গঠনমূলক; দেশ-জাতির কল্যাণ হয়- এমন মতামত মানুষ প্রত্যাশা করে।

২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের তথ্যকে ‘কাল্পনিক’ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলেছিলেন আযমী। এবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহিদ বলে বলে তারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আপনারা জরিপ করে বের করুন, একচুয়ালি ৩০ লাখ হোক আর ৩ কোটি হোক। আমার জানামতে, এটা ২ লাখ ৮৬ হাজার। তারা ৩ লাখকে ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছে। এখনো সময় আছে, জাতিকে সত্য ইতিহাস জানতে দিন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মিথ্যার ওপরে আপনারা গড়ে তুলতে দেবেন না। সত্যিকার একটা জরিপ করে আপনারা ব্যবস্থা করুন।’

এখানে আযমীর কাছে আমি কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। প্রথমত, শেখ মুজিব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন। আপনি এই তথ্য কোথায় পেলেন? শেখ মুজিবের সঙ্গে আপনার কখনো কথা হয়েছে? নাকি শেখ মুজিব অন্য কাউকে বলেছেন? এ বিষয়ে আপনার কাছে কোনো ডকুমেন্ট আছে? থাকলে সেটা প্রকাশ করুন। জাতি সত্যটা জানুক।

আপনি স্ববিরোধী কথা বলছেন। আপনি বলছেন ২ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আবার বলছেন ৩ লাখকে তারা (আওয়ামী লীগ) ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছেন। তার মানে আপনি ৩ লাখ নিহত হয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন। ২ লাখ ৮৬ হাজার নাকি ৩ লাখ মানুষ মারা গেছেন; সেটা ক্লিয়ার করুন।

আপনার বাবা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ছিলেন। স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং সে সময় ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল ৪২ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। তার মধ্যে গোলাম আযমও ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন। কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। এ কারণে আপনার দেওয়া নিহতের সংখ্যা নিয়ে মানুষ ষড়যন্ত্র ভাবতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। আপনার অবস্থান ক্লিয়ার করাও আপনার দায়িত্ব। 

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ে আপনি সরকারের কাছে জরিপ করার দাবি জানিয়েছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এই জরিপ করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আশা করি সরকার একটা পদক্ষেপ নেবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করে মানুষের মন থেকে ভ্রান্তি দূর করবে সরকার। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের মা-বোনের সম্ভ্রম লুটে নিয়েছেন; সেটা কিন্তু আপনি বলেননি। আপনি ভুল করেছেন; নাকি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন- সেটা খুব জানতে ইচ্ছা করে। 

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ বলছেন আযমী। তিনি বলেন, ‘১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই? আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।’

আযমীর এই দাবি অনেকের মতো সঠিক মনে হবে। হ্যাঁ। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা যেতেই পারে। দেশের প্রয়োজনে; মানুষের চাহিদার কারণে সেটা হতে পারে। কিন্তু দেশে এমন কী ঘটল যে জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে? একটা সংগীত দেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি হয় কীভাবে? দেশ যখন ক্রান্তিকাল পার করছে; একটার পর একটা সমস্যা সামনে আসছে; সেগুলোর দিকে নজর না দিয়ে আপনি পড়ে আছেন জাতীয় সংগীত নিয়ে। বিষয়টা নিয়ে খুবই অবাক হচ্ছি।

বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়েছেন আযমী। তিনি বলেন, ‘১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেড নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি- আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।’ 

তারা (আওয়ামী লীগ) জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি বলে আযমী যে প্রশ্ন তুলেছেন; সেটাকে আমি অবান্তর প্রশ্ন বলতে চাই। কারণ আওয়ামী লীগ তো যুদ্ধ করার জন্যও ম্যান্ডেড নেয়নি। তার মানে কী যুদ্ধটা অবৈধ? এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেলাম; সেটাও কী অবৈধ? যদি স্বাধীনতা অবৈধ না হয়; তাহলে সংবিধান প্রণয়নও অবৈধ নয়। আর স্বাধীনতা বৈধ হলে সংবিধানও বৈধ। কারণ স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রয়ণনের জন্য ম্যান্ডেড নিতে হয় না। বিশ্বের কোনো দেশ স্বাধীনতা লাভের পর সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেড নিয়েছে- এমন নজির নেই। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধান বৈধ। 

আবার আসি জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি কালজয়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষেত্রে গানটির গুরুত্ব অপরিসীম। ১১৯ বছরের পুরোনো গানটি আজও মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে; উজ্জীবিত করে। এর আবেদন একটুও কমেনি। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচয় ঘটাতে এ গানের ভূমিকা অনেক। এ গানের একটা ইতিহাস আছে। সুতরাং এটা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে আযমী একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। ভাগ্যিস তিনি জাতীয় সংগীত বাদ দেওয়ার দাবি তোলেননি। আফগানিস্তানে এর আগে তালেবান শাসনের সময় জাতীয় সংগীত বাদ দেওয়া হয়। নতুন করে আবার সেটা চালু করা হয়েছে। 

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিল। ওই বছরের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে একটি প্রতিবাদ সভায় এই গান প্রথম গাওয়া হয়। সেই বছর ৭ সেপ্টেম্বর (২২ ভাদ্র, ১৩১২ বঙ্গাব্দ) ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরে গানটি ছাপা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী রাজনীতিক, স্বদেশি কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে এই গান প্রচার করেন। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’-তে এই গান ব্যবহৃত হয়। জহির রায়হান নির্মিত এই সিনেমায় তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে গানটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত জনসভায় গানটি গাওয়া হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি গাওয়া হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো। 

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন হলে এর ৪.১ অনুচ্ছেদে ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম ১০ চরণ (মোট চরণ ২৫ চরণ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। গানের প্রথম ১০ ছত্র কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ ছত্র যন্ত্রসংগীত ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয়।

আযমীর প্রতি ভালোবাসা এবং তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখাটি শেষ করব। তিনি বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনের দাবি তোলেননি- এ কারণে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; সে কারণে তার প্রতি ভালোবাসা। নতুন বাংলাদেশে যেন কেউ আর নির্যাতনের শিকার না হয়- এই প্রত্যাশা করছি সরকারের কাছে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ।
[email protected]

এখন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোই জরুরি

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৪ পিএম
এখন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোই জরুরি
অরূপ তালুকদার

নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ হয়েও এবারে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের কমপক্ষে ১১টি জেলা; যার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের ৭৭ উপজেলা; বিগত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল এবং ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে যেভাবে প্লাবিত হয়েছে তা রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ এবারের মতো বন্যা বিগত দুই যুগেও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

দক্ষিণবঙ্গের মানুষ আমরা। আমাদের জল-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে কম-বেশি রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় প্রতিবছর। আমাদের জন্য এসব এখন আর নতুন কিছু নয়। 

বরিশাল বিভাগের যেমন বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার শহর এলাকার নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানের কাছাকাছি কোনো নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠে গেলে এবং জোয়ারের পানির চাপে প্লাবিত হলেও  দুই-একদিনের মধ্যেই সে পানি আবার নেমে যায়। এখন যেমন দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ফলে পানির চাপে কোনো কোনো স্থান প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এবারের অস্বাভাবিক প্লাবনের ফলে ইতোমধ্যে যেভাবে ডুবে গেছে অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ট্রেন লাইন; বিপর্যস্ত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা- তার কোনো তুলনা হয় না। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। 

কোথাও কোথাও পানির প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে গৃহপালিত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ বাড়িঘরের আসবাবপত্র, মাছের ঘের; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। ভাঙন শুরু হয়েছে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোয়। 

পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কমপক্ষে প্রায় ৬ লাখ পরিবারের প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ, জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তারা দিনাতিপাত করছে মহাদুর্ভোগের মধ্যে। অনেক পরিবারেই খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে দুর্যোগকবলিত এসব এলাকার অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। যে কারণে এসব অঞ্চলে বসবাসকারীদের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য স্থানের মানুষজনের যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। 

তবে ইতোমধ্যে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা, যারা ইতোমধ্যেই বন্যাদুর্গত অঞ্চল থেকে উদ্ধার করেছে পানিবন্দি থাকা শিশুসহ ২৭২ জনক।

এদিকে আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানির ন্যায্য হিসাব পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুরের বেগম রোকেয়া এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

তারা বলেছেন, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর কুমিল্লা ও ফেনী প্লাবিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর যোগাযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টি নদীতে তারা বাঁধ দিয়েছে।

তারা অভিযোগ করেন, ভারত গ্রীষ্ম মৌসুমে বাঁধ বন্ধ রাখে, আবার বর্ষা মৌসুমে খুলে দেয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভারতের আধিপত্য প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও ভয়াবহ বন্যার কারণে রাজ্যের কমপক্ষে আটটি জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। 

এনডিটিভির খবরসূত্রে জানা যায়, এসব জেলার প্রায় ৭ হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছে। মৃত্যু হয়েছে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২২ জনের। উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ত্রিপুরার ‘ডুম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট’-এর গেট খুলে দিয়েছেন রাজ্যটির প্রশাসক। 

ত্রিপুরার জেলা শাসক তড়িৎ কান্তি চাকমা জানিয়েছেন, গোমতী নদীতে জলসীমা বেড়ে যাওয়ায় ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জলস্তর বিপৎসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। সেক্ষেত্রে বাঁধ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে গেট খুলে পানি ছেড়ে দিতে হয়েছে। তিনি জানান, ভয়াবহ এই বন্যায় রাজ্যটিতে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে।’ 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আমরা উল্লেখ করতে চাই যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছরের সবচাইতে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে এই বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকে বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলোতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি একটি যৌথ সমস্যা। এটা উভয় দেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগের জন্ম দেয়। এ সমস্যার সমাধানে ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।’

এদিকে সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম সম্প্রতি সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বন্যায় জনগণের জানমাল রক্ষায় সার্বিকভাবে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত রয়েছে।

সম্প্রতি হবিগঞ্জে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘পানি ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে জানানোর বিষয়টি ভারত প্রতিপালন করেনি।’

বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিয়োজিত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। এই সময় প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার কারণ জানতে চাইলে হাইকমিশনার জানান, ত্রিপুরার বন্যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এর ফলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৈঠকে বাংলাদেশকে সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেন হাইকমিশনার।  

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের বন্যা মোকাবিলার প্রয়োজনে দুপক্ষেরই সহযোগিতা এবং উভয় দেশের সরকার এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়ভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, এবারের বন্যা একেবারে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে দেশের কমপক্ষে ১১টি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। বন্যার পানি এখনো নামতে শুরু করেনি। আশা করা যাচ্ছে, বৃষ্টি থেমে গেলে পানির চাপ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।

তবে বন্যার কারণে এসব জেলায় কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা বোঝা যাবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর। তখন শুরু হবে আসল কাজ। বন্যার্তদের পুনর্বাসন ও তাদের বাড়িঘর পুনঃনির্মাণসহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের প্রয়োজনীয় মেরামত এবং ক্ষতিগ্রস্ত খেত-খামারের তদারকি বাড়িয়ে তা আবার পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে তখন শুরু হবে বিরাট এক কর্মযজ্ঞ। 

তবে এখন সবার জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, বন্যা-উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর ইতোমধ্যেই দুর্গত এলাকার সেই লাখ লাখ অসহায় পানিবন্দি মানুষের পাশে মানবিক সাহায্যের হাত নিয়ে দাঁড়িয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দেখা গেছে, প্রতিদিন তাদের কাছে ত্রাণ দিতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে।

শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও নানা সংস্থাসহ সাধারণ মানুষ নানাভাবে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ জেলার কমপক্ষে ৪৫ লাখ মানুষ। গত মঙ্গলবার থেকে এ পর্যন্ত শিশুসহ প্রাণহানি ঘটেছে অন্তত ১৫ জনের। বন্যায় প্লাবিত ৭৭টি উপজেলার ৫৮৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদ্ভূত সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে উপদ্রুত এলাকায় ৩১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ জন আশ্রয়হীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি বন্যাকবলিত এলাকায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দানের লক্ষ্যে ৬৩৭টি মেডিকেল টিম কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, দুর্গত এলাকার মানুষদের সহায়তা দিতে ইতোমধ্যে নগদ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দসহ খাদ্য সহায়তা বাবদ ১৫০ টন চাল এবং ১৫০০০ খাদ্যের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।

এদিকে বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সকল স্তরের মানুষ প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে অনুদান প্রদান করতে পারবেন। যেভাবে দিতে হবে : সোনালী ব্যাংক, কর্পোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, হিসাব  নম্বর : ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩।

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব পদবির সেনাসদস্যদের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সাহায্য-সহযোগিতার  নিমিত্তে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হয়েছে।

একইভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ( বিজিবি)-এর সব সদস্যের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সহায়তায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

ত্রিমুখী অবস্থানে ভারত-বাংলাদেশ-চীন: কোন পথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক?

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৩৭ পিএম
ত্রিমুখী অবস্থানে ভারত-বাংলাদেশ-চীন: কোন পথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক?
সেতু খানম

বন্যায় ভাসছে বাংলার মানুষ। বন্যার পানিতে যখন বাংলার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তখন একদিকে আগাম সতর্কবার্তা ছাড়াই হঠাৎ ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের পাশাপাশি ফারাক্কা বাঁধও খুলে দিয়েছে ভারত। অন্যদিকে বন্যার্তদের সহযোগিতায় কিছুটা এগিয়ে এসেছে চীন। সব মিলে যেন সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক রহস্যময় ধূম্রজাল।

পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি চীন। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যখন বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে ভোট হয় তখন ১৫টি দেশের মধ্যে একমাত্র চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু অর্ধশতক পেরিয়ে ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের সব থেকে বড় বাণিজ্য সহযোগী চীন। অপরদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক প্রকার মাতৃছায়ায় আগলে রাখা ভারতের সাথে বাংলাদেশ জন্মের শুরু থেকেই আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে ভারতের সাথে টানাপড়েন সম্পর্কে এখন বাংলাদেশ। 

২০২৪ সালে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী, শিশু কিংবা বৃদ্ধের মনে ভারতকে নিয়ে জমা হওয়া ক্ষোভ প্রকাশ হতে থাকে। বন্ধুত্বের সুবাদে কতটা দেওয়া হলো এবং কতটা পাওয়া গেল, সেই হিসাবও কষতে শুরু করেছে নতুন প্রজন্ম। তবে প্রাপ্তির খাতায় যেন শুধুই হতাশা। বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে ভারতের প্রভাব নিয়ে ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির মাঝেই চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার হাতে বন্যার্তদের সাহায্যে ২০ হাজার মার্কিন ডলারের চেক তুলে দেন এবং চীনের রেড ক্রসের পক্ষ থেকে ১ লাখ মার্কিন ডলারের অনুদান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের জন্য চীনের নজরে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণার জন্য চীনের সোস্যাল সায়েন্স একাডেমিতে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ ইনস্টিটিউট’ খোলা হয়েছে। চীনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট- বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন বিগত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ভারতপ্রীতির কথা কারোরই অজানা নয়। অনেক প্রকল্প এবং চুক্তির প্রস্তাব চীন-ভারত দুই দেশ থেকে পেলেও ভারতকেই বারবার বেছে নিয়েছেন তিনি। তাই শেখ হাসিনার এই পতন ভারতের জন্য কূটনৈতিক পরাজয় এবং সেই সাথে চীনের জন্য কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতপন্থি নয় বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাই ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণে ভারতের চেয়ে চীনই বেশি প্রাধান্য পাবে বলে আশা করছে চীন। তবে এই পথ এতটা মসৃণও নয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আমেরিকাকে প্রয়োজন হবে বাংলাদেশের। এই সম্পর্কই চীনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি অনেকটাই পরিষ্কার হলেও, চীনের সাথে এই সম্পর্ক গড়ে উঠতে অন্য কোনো পরাশক্তি প্রভাব বিস্তার করবে কি না, সেই উপসংহারে এখনই যাওয়ার কোনো উপায় নেই। অতএব, বাংলাদেশের জন্য সামনে পথচলা এতটা সহজও হবে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং সম্প্রতি ঘটনাগুলোর কারণে দুর্বল অর্থনীতিকে আবার স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরাতে কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে বাংলাদেশকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]

উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ
সংগীত কুমার

বেকারত্ব আমাদের দেশের সামাজিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিগত কয়েক বছর ধরে বেকারত্বের কশাঘাতে জর্জরিত আমাদের তরুণ সমাজ। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের পরিসংখ্যান যদি তুলে ধরি, তাহলে দেখতে পাবো ২০১৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ছিল ৪ লাখ। ২০২২ সালের শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখে (সূত্র : বিবিএস)। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। 

দেশে বর্তমানে প্রতি তিনজন বেকারের মধ্যে একজন উচ্চশিক্ষিত। তারা বিএ কিংবা এমএ ডিগ্রি নিয়েও শোভন চাকরি পাচ্ছে না। ফলে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে টিউশনি, পাঠাও-উবারে ভেলিভারিম্যান, বিক্রয়কর্মী এবং কেউ কেউ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিগুলোতেও যোগ দিচ্ছেন। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সর্বশেষ রেলের পরিচ্ছতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সবাই স্নাতক ডিগ্রিধারী। বিভিন্ন জরিপ মতে দেশের ৭৮ শতাংশ তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবন ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্নতা বিরাজ করছে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘন্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়ম অনুসারেই বেকারত্বের হিসাব দিয়েছে। কোভিড মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি শ্লথগতি হয়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করে ফেলে। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। 

দীর্ঘ দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষকে গড় আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করতে হয় খাবার ক্রয়ে। বৈদেশিক মুদ্রায় সংকট চলছে, যথেষ্ট দেশি বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি বিনিয়োগ গত এক দশক ধরে জিডিপির ২২-২৩ শতাংশে আটকে আছে। ফলে বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না এবং বেকারত্ব বাড়ছে। 

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৭ লাখ ৯৯ হাজার। অর্থাৎ মোট বেকারের ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। তাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। অর্থাৎ তরুণদের সংখ্যাটাই বেশি। বেকারদের মধ্যে ৫১ শতাংশ আবার উচ্চমাধ্যমিক পাস। 

বিবিএসের আরেকটি সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ অনুসারে বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনায় নাই, কর্মসংস্থানে নাই, এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০-২২ লাখ তরুণ গোষ্ঠী নতুন করে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে ১২-১৩ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু তাদের ৮৫ শতাংশ মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা শোভন চাকরি পায়। আর বাকি ৮-৯ লাখ জনগোষ্ঠী প্রবাসে যান চাকরির খোঁজে। 

দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৭টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৭১ হাজারের কিছু বেশি সরকারি চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছর যত শোভন কর্মসংস্থান বা চাকরি সৃষ্টি হয়, তার চার ভাগের তিন ভাগই হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাহিদার তুলনায় সরকারি চাকরি সৃষ্টি খুবই কম হচ্ছে।

আরও ভয়াবহ চিত্র পাবো যদি গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করি। দেখা যাবে যতগুলো পদের জন্য আবেদন আহ্বান করা হচ্ছে তার চেয়ে ২০০ গুন বেশি আবেদন জমা পড়েছে। সর্বশেষ ৪৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৪০ টি। প্রাথমিকভাবে আবেদন জমা পড়ে ৩ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। ৪৫ তম বিসিএসে ২ হাজার ৩০৯টি পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার। ৪৪তম বিসিএসে আবেদন জমা পড়ে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬০টি। পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭১০টি।

বাংলাদেশে তরুণেরা যে ধরনের শিক্ষা পাচ্ছেন এবং তারা যে কাজ করতে পারেন সেই ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার যে ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে, এখনকার শিক্ষিত তরুণেরা সেই ধরনের কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, ‘লোকে বলে চাকরি কই, চাকরি বলে লোক কই’! ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব তরুণদের জন্য নির্মম অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এই অভিশাপ থেকে নিস্তারের চ্যালেঞ্জগুলো আলোচনা করা করা যাক। শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রে সামঞ্জস্যহীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাস্তবমুখী দক্ষতা তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

তথ্য প্রযুক্তি এবং ই-কমার্সের ঘাটতি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি ও ই-কমার্সের দিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় উচ্চশিক্ষিতদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে না। ডিজিটাল দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার অভাব রয়েছে, যা উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। উদ্যোক্তা সৃষ্টির অনুপ্রেরণার অভাবও ভীষণভাবে পরিলক্ষিত। ফলে দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহের অভাব দৃশ্যমান। এর মূল কারণগুলো হলো পুঁজিবাজারের অভাব, বিনিয়োগের সুযোগ কম এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান ও নেতৃত্বের অভাব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এখনও শ্রমবাজারে তরুণদের সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যার্থ হচ্ছে। সামাজিকভাবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা বেশি। এবার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া যেতে পারে তা আলোচনা করা যাক: 

শিক্ষা ব্যবস্থার পুর্নগঠন এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক এবং কর্মমুখী করতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা, সফট স্কিল এবং ভোকেশনাল ট্রেনিংকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জন করতে পারে। উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাংকিং এবং মাইক্রোফিন্যান্স ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করতে হবে। যাতে উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো সহজে পুঁজি পেতে পারে। উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শের সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির প্রসার বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আইটি ও সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট, ফিন্যান্সিং এবং ই-কমার্সের বিকাশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি নীতিমালা ও আর্থিক সহায়তা আরো জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের জন্য ট্যাক্স ছাড়, ঋণ সুবিধা এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। বৈশ্বিক মানের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম এমন দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশন প্রসার বাড়াতে হবে। 

গত কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগের পরিস্থিতি অনেকটা স্থবির। নতুন বিনিয়োগ না হলে শিক্ষিত যুবকদের জন্য চাকরির বাজার সৃষ্টি হবে না। তাই আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। অন্যদিকে পরিবর্তিত চাকরির বাজারের উপযোগী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৩ এএম
ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান
ফখরুল ইসলাম নোমানী

ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। ইসলাম পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীকে পুরুষের সমান অধিকারী করেছে ও অত্যন্ত সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছে। নবী করিম (সা.) স্বয়ং নারীদের শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। 

সমাজসভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ সমান। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নর-নারী, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব অথবা সাদা-কলোর কোনো পার্থক্য নেই। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান।

আদিম যুগ থেকেই নারী অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। সবদিক দেশে তার অধিকার আদায়ে তার মর্যাদায় তার স্বাধীনতা ও তার ক্ষমতায়নে। ইসলাম পূর্ব-যুগে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত উপেক্ষিত ও শোচনীয়। সমাজে নারীরা ছিল অপাঙ্‌ক্তেয়। তাদের মানুষরূপেই ভাবা হতো না। নারীরা ছিল পুরুষের লালসার শিকার, ভোগ্যপণ্য হিসেবে তাদের ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় পৌত্তলিক আরবে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। হিন্দুরা নারীকে সব পাপ, অন্যায় ও অপবিত্রতার কেন্দ্র বলে ঘৃণা করত। ইহুদিরা নারীকে সব পাপের মূল হিসেবে জানত। খ্রিষ্টানরা নারীকে নরকের কীট ও অকল্যাণের উৎস মনে করত। চীনে নারীদের দ্বারা লাঙল টানাতো। পাশের দেশ ভারতে হিন্দুরা নারীদের দাসীর মতো ব্যবহার করত এবং সতীদাহের মতো ঘৃণা প্রথা প্রচলিত ছিল। ঘোড়ার লোজের অগ্রভাগ নারীর চুল বেঁধে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো। ইসলাম পৃথিবীর বুক থেকে যাবতীয় অত্যাচার নির্যাতন ও অসমতা দূর করে। নারীকে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়েছে।

মানব জাতির ওইসব ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মুক্তির দিশারি ও শান্তির দূত হিসেবে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। নারী জাতির ওপর অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, শোচনীয় ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে পরিত্রাণ দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সমাজে নারী জাতির অবস্থান নিরূপণের জন্য পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন সুরা আননিসা। উক্ত সুরার প্রথমেই আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ জাতি তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দুজন থেকে অসংখ্য নর-নারী পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ শুধু সূরা আননিসা নয়। পবিত্র কোরানের অনেক সুরায় নারীর অধিকার ও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। 

আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের যেমন অংশ রয়েছে তেমনি নারীরও অংশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় বিভিন্নভাবে নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং নারীর মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি অধিকার দিয়েছেন। 

আল্লাহ্ বলেন, আমি তোমাদের কোনো কর্মী বা সহপাঠীর কাজ নষ্ট করি না। সে নারী হোক বা পুরুষ হোক। তোমরা পরস্পর এক। অন্য এক আয়াতে বলা হয়। ঈমানদার পুরুষ ও রমনীরা একে অপরের সহায়ক ও বন্ধু। তারা একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজের নিষেধ করবে। ইসলাম ধর্মে নারীর জীবনব্যবস্থা ও সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্ত্রী কন্যা মাতা ও ভগ্নী হিসেবে তার ব্যক্তিগত মর্যাদা অধিকার ও স্বাধীনতার সঙ্গে সামগ্রিক সব বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়ার কথাও বলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিটি বিষয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও উৎসাহিত করেছে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, বিশ্বে বহু অমূল্য সম্পদ রয়েছে। আর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে নেককার নারী। তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। ইসলাম স্ত্রী হিসেবে নারীকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। আল্লাহ্ বলেন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ করো। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যে বিয়ে করে সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে। ইসলাম নারীকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান দিয়েছে মা হিসেবে। মা হিসেবে ইসলাম নারীকে যে মহান মর্যাদায় আসীন করেছে তার নজির আর কোথাও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। 

তিনি আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। ঐতিহাসিক হজের ভাষণে তিনি বলেছেন ভ্রাতৃগণ শ্রবণ করো ইসলামে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। নারীদের প্রতি তোমরা সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমরা অন্যায় আচরণ করবে না।

ইসলাম ধর্ম প্রথম নারীর স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা এবং ভোগ-দখলের অখণ্ড অধিকার দিয়েছে নারীকে। মাবন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে অর্থনৈতিক অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কন্যা, স্ত্রী, বোন ও মাতা হিসেবে মুসলিম নারীর মিরাস বা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক পিতা ও স্বামী উভয়দিক থেকে উত্তরাধিকার লাভ করে তারা পেয়েছে মালিকানাস্বত্ব এবং তা স্বাধীনভাবে ব্যয় করার পূর্ণ অধিকার। ইসলাম নারীকে পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার দিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে মতামত প্রকাশ ও সমাজকল্যাণের যেকোনো কর্মকাণ্ডে নারীরা পুরুষের মতোই অংশগ্রহণ করতে পারবে। এই মর্মে হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, যোগ্যতানুসারে নারীরা প্রধান বিচারপতির পদও অলংকৃত করতে পারবে।

ইসলামে আরও উল্লেখ আছে নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োগ করা সম্পদ এবং লাভ একমাত্র তারই আওতাধীন। স্বামী কিংবা অভিভাবকদের এক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ চলবে না। যদি না স্বেচ্ছায় তা দান না করে। সুরা আন নিসার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। একজন পুরুষের যেমন অধিকার আছে নিজের পছন্দের কাউকে বেছে নেওয়ার তেমনটি নারীর জন্যও রয়েছে। ইসলাম বলেছে কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ দেওয়া আইনগত অপরাধ। বিবাহবিচ্ছেদ ও তালাকের ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন স্বামী তার অবাধ্য স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি অত্যাচারী অযোগ্য অকর্মন্য স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য একজন স্ত্রীরও তালাক দেওয়ার অধিকার আছে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মর্যাদা ও পারিবারিক সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদা লাভে সহায়তা করেছে ইসলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান সমাজব্যবস্থা নারীদের ইসলামের চোখে যেমন দেখে না তেমনি নারীকে বাজারের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যে কর্তব্য তা পালন করা হচ্ছে না। তাকে তার অধিকার দিচ্ছে না। দিন দিন প্রতিযোগিতা দিয়ে বেড়ে চলছে আমাদের গণমাধ্যমের সংখ্যা।

ইসলাম নারীকে সব ধরনের মর্যাদা যেমন দিয়েছে তেমনি দিয়েছে সংযত হওয়ার নির্দেশগুলো। কর্মক্ষেত্রে নারীর বাধা নেই ইসলামে তবে সেখানে তাকে চলতে হবে পর্দার মাঝে। রাস্তাঘাটে নারীকে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে উপস্থাপন করছে। এমনভাবে করছে যেন পণ্যের গুরুত্বের সঙ্গে নারীকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। যেখানে নারীর কোনো প্রয়োজন নেই সেখানেও নারীকে দেখাচ্ছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক পোশাকের ব্যবস্থা করছে যা আমাদের মুসলিম নারীদের জন্য শোভা পায় না। ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছে তবে পণ্য করেনি। বর্তমানে স্বাধীনতার নামে নারীকে পণ্যই বানাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো উপস্থাপক হিসেবে নারীকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। 

এটা নারীর জন্য ভালো। নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে কিন্তু তাই বলে সে উপস্থাপনায় অমুসলিম দেশকে অনুকরণ করা নারীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক ছাড়া চাকরি করা যাবে না বলে অনেক নারীকে চাকরি হারাতে হয় আবার অনেক নারী বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয় ইসলামের মর্যাদাকে ভুলে যেতে। নারীদের পর্দা নিয়ে কিছু বললেই বলা হয় নারীকে নারী ঘরে তুলতে বলা হচ্ছে। আসলে তা কিন্তু নয়। নারীকে কাজ করতে হবে তবে সেই ইসলামের পথ নির্দেশনা মেনে চলে। বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীর সাফল্য আসছে। তাই বলে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারও বেড়ে চলছে।

মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত ঘোষণা করে ইসলাম নারী জাতিকে সর্বোত্তম মর্যাদায় ভূষিত করেছে। যে মর্যাদা পুরুষকে দেওয়া হয়নি। ইসলামে একজন নারী একজন পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ও মর্যাদার অধিকারী। নারী তার নারীত্বের মর্যাদা বজায় রেখেই সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন। নারী ছাড়া অন্য কেউই মাতৃত্বের সেবা ও সহধর্মিণীর গঠনমূলক সহযোগী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়। মায়েদের ত্যাগ ও ভালোবাসা ছাড়া মানবীয় প্রতিভার বিকাশ ও সমাজের স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মায়েরাই সমাজের প্রধান ভিত্তি তথা পরিবারের প্রশান্তির উৎস। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলামই নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করে সেটি রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]