শুকনো খটখটে, এবড়োথেবড়ো, উঁচুনিচু, ঢেউ খেলানো ভূমি। শুকনো রুক্ষ মাটি রোদে পুড়ে খাঁখাঁ করছে। কৃষিজমির সামান্য মাটিটুকুও পাথর, কাঁকর আর বালির মিশেলে কালচে হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ ধু ধু মাঠে ঝাঁকড়া মাথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু তালগাছ। একটা মাত্র নদী, নাম ‘অজয় নদ’ মৃতপ্রায় অবস্থায় বেঁচে আছে। গ্রীষ্মের সময় পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। শুকনো মৌসুমে নদীর ওপর দিয়ে চলে ঘোড়ার গাড়ি। বর্ষার প্রারম্ভে এই নদীই দুকূল ছাপিয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এদিকে-ওদিকে ছোট বড় পাহাড় জঙ্গল থাকলেও কয়লাখনির দূষিত বাতাসে চারদিক বিষণ্ন হয়ে থাকে সবসময়। এই স্থানের নামই চুরুলিয়া, যা বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমায় অবস্থিত।
প্রকৃতির এই বিরুদ্ধ পরিবেশের ছোঁয়ায় মানুষের চালচলন, মেজাজ-মর্জিও প্রকৃতির মতোই রুক্ষ-কর্কশ হয়ে যায়। এই বিরুদ্ধ পরিবেশেই ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, বাংলা সন ১৩০৬, ১১ জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। নবজাতকের নাম রাখা হয় কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী আলী হোসেন নামে নজরুলের এক ভাই এবং উম্মে কুলসুম নামে এক বোন ছিল। এ ছাড়া কাজী ফকির আহমেদের ঔরসে প্রথম স্ত্রীর গর্ভে সাজেদুন্নেসা নামে একজন কন্যাসন্তান ছিল।
মুঘল সম্রাট শাহ্ আলমের শাসনকালে বিহারের রাজধানী পাটনার হাজিপুর থেকে নজরুল-পরিবার চুরুলিয়ায় আবাস গড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সম্রাটের আদেশে স্থানীয়ভাবে আদালত স্থাপন করা হয়। সম্রাটের প্রতিনিধি সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। নতুন আসা পরিবারের একজন সদস্য সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দেন। দুপক্ষই তার রায় মেনে নিলে সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে কাজী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সম্রাটের দরবার থেকে দান হিসেবে দেওয়া হয় বেশকিছু জায়গাজমি। তখন থেকে পরিবারটির উপাধি হয়ে যায় কাজী পরিবার। এই পরিবারেরই সদস্য ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের বাড়ির পাশে ছিল নরোত্তম রাজার গড়। গড়ের উল্টো দিকে হাজি পালোয়ানের পুকুর। হাজি পালোয়ান নামে এক আধ্যাত্মিক ফকির রুক্ষ মাটির বুকে এই পুকুর খনন করেছিলেন। পুকুরপাড়ে ছিল হাজি পালোয়ানের মাজার। মাজারের পাশে ছিল একটি মসজিদ। এই মসজিদের খাদেম ছিলেন নজরুল। বাল্যকালে নজরুল এই মসজিদে আজান দেওয়া, নামাজ পড়ানো ছাড়াও ছোটদের হাদিস পড়াতেন। এখান থেকেই তিনি কোরআন-হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন।
চাচা বজলে করিমের কাছ থেকে ফারসি ভাষা এবং কবিতার পাঠ নিয়ে আরবি-ফারসির সমন্বয়ে একদিন নজরুল লিখে ফেলেন একটি পদ্য। এটাই নজরুলের হাতে লেখা প্রথম কবিতা।
মেরা দিল বেতার কিয়া তেরী আব্রুয়ে কামান;
জ্বলা যাতা হ্যায় ইশ্বক্ মে জান পেরেশান।
হেরে তোমার ধ্বনি
চন্দ্ৰ কলঙ্কিনী
মরি কী যে বদনের শোভা, মাতোয়ারা প্রাণ।
বুলবুল করতে এসেছে তাই মধু পান॥
এরপর চাষার সং, শকুনি বধ, মেঘনাদ বধ, দাতা কর্ণসহ আরও অসংখ্য পালা গান ও নাটক রচনা করেন। লেটো গানের দলে তাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। বিখ্যাত কবিয়াল 'গোদা কবি' শেখ চকোর লেটো গানের দলে নজরুল প্রতিভা নিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলেন, এই ব্যাঙাচি বড়ো হয়ে সাপ হবে। নিজেকে নজরুলের অধীন বলে স্বীকার করে লেটো গানের দলে সুর ধরতেন এই বলে,
আমরা এই অধীন হয়েছি ওস্তাদহীন
ভাবি তাই নিশিদিন,
বিষাদ মনে।
নামেতে নজরুল ইসলাম,
কি দিব গুণের প্রমাণ।
কিন্তু নজরুল বাল্যকাল থেকেই ছিলেন বাঁধনহারা। কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তাকে আটকে রাখতে পারেনি। লেটো গানের দলে তার কাব্যিক যাত্রা শুরু করলেও একদিন দলের ধরাবাঁধা নিয়মকানুন ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, দল ছেড়ে যাত্রা করেন অজানার পথে। হাজির হন আসানসোলে। গ্রাম্য লেটো দলের ‘ব্যাঙাচি কবি’ নজরুল হয়ে উঠেছিলেন আসানসোলের বেকারি বয়। রুটির দোকানের পাঁচ টাকা মাইনের ভৃত্য হয়ে কাটালেন কিছুদিন। সেখান থেকে ময়মনসিংহ দরিরামপুর গ্রাম। ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে ছুটে গেলেন করাচিতে। নজরুলের জীবনই যেন একজন বাউন্ডুলে যাযাবরের আত্মকাহিনি। তার জীবনের বাঁধনহারা উল্লাসের রূপক হয়ে বারবার আবির্ভূত হয়েছেন আরবের বেদুইন, ভবঘুরে আর বাউন্ডুলেরা। আর তাই তো চেঙ্গিস, কালা পাহাড়, গজনি মামুদরা বারবার উঠে এসেছে তার কাব্যে ও কবিতায় বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে।
লেটোর দল ছেড়ে কাশিমবাজারের কাছে মাথরুন গ্রামে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউট, যা মাথরুন স্কুল নামে পরিচিত ছিল-সেখানে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। নজরুল, শৈলেন আর শৈলজা মুসলমান, খ্রিষ্টান আর ব্রাহ্মণ এই তিনজনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় সম্পর্ক। জ্ঞান অর্জনের পথে ভাষা কখনো তার কাছে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি।
নজরুলের জীবন দুঃখে-কষ্টে ভরা ছিল বিধায় তিনি কারও দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। রুটির দোকানে কাজ করার সময় ঘুঙ্ঘুর বাঁধা লাঠি হাতে এক ফকির ঘুরে বেড়াত। সে কারও কাছে ভিক্ষা চাইত না। তার নাম ছিল মৌনি ফকির। নজরুল ফকিরকে দেখামাত্রই ছুটে যেতেন। ভিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গান শোনাতেন। একদিন মর্মান্তিকভাবে ঘোড়াগাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৌনি ফকির মারা যান। ব্যথাতুর কবি সেদিনই অর্থাৎ ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে মৌনি ফকিরকে নিয়ে একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম ক্ষমা। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় (১৯১৯ সালের জুলাই-আগস্ট) ‘ক্ষমা’ কবিতাটিই ‘মুক্তি’ নামে প্রকাশিত হয়। মুক্তি নজরুলের প্রকাশিত প্রথম কবিতা। এ কবিতার ফল্গুধারা থেকেই তার কাব্যজীবনের সূচনা হয়।
১৯১৭ সাল, নজরুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ করেছেন। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। রানীগঞ্জের দেয়ালে পোস্টার পড়ল : কে বলে বাঙালি যোদ্ধা নয়? কে বলে বাঙালি ভীতু? জাতির কলঙ্ক মোচন করা একান্ত কর্তব্য, আর তা পারে একমাত্র বাংলার যুবশক্তি। ঝাঁপিয়ে পড় সিংহবিক্রমে। বাঙালি পল্টনে যোগ দাও।
মেট্রিক পরীক্ষার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে চুরুলিয়াকে বিদায় জানিয়ে যোগ দেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে। লাহোর থেকে পেশোয়ার, পেশোয়ার থেকে করাচি নৈশেরা শুরু হয় সৈনিক জীবন। সেনানিবাসে থাকাকালে তিনি দ্রুতই প্রমোশন পেয়ে হাবিলদার পদে উপনীত হন। সেখানে এক পাঞ্জাবি মৌলবির সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে।
রুবাইয়াৎ-ই হাফিজ মুখবন্ধে কবি বলেন, আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। ১৯১৭ সালের কথা। সেখানে আমার হাফিজের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন মৌলবি থাকতেন। একদিন তিনি দ্বীওয়ান ই-হাফিজ থেকে কতগুলো কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমন মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেদিন থেকে তার কাছে ফারসি শিখতে আরম্ভ করি। তারই কাছে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত কাব্যই পড়ে ফেলি।
১৯২০ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল কলকাতায় ফিরে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে আসেন। নজরুল তার জীবনে সৈনিককালীন স্মৃতি বহন করতেন। গায়ে থাকত গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, গেরুয়া রঙের চাদর, হাতে একখানা হাতপাখা, মাথায় একরাশ এলোচুল কাঁধ পর্যন্ত ঝোলানো। তার বিচিত্র পোশাকের সঙ্গে পায়ে থাকত মিলিটারি বুট। অদ্ভুত পোশাকে এক অনন্য ব্যতিক্রম হয়ে চলতেন তিনি। তাকে দেখে চমকে উঠত আকাশের মেঘ আর মাটির কানন। উচ্ছল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর নজরুল তার জীবনের রূপকথায় সত্যের পরশ পাথরের স্পর্শ পেয়ে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন বিদ্রোহের শব্দাবলি।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সহকারী সম্পাদক মুজফফর আহমেদের সঙ্গে ছিল নজরুলের প্রগাঢ় সম্পর্ক। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই দুজনে এক সঙ্গে মিলে ‘নবযুগ’ নামের সান্ধ্য পত্রিকা বের করেন। নজরুল বারবার প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু কুমিল্লার পল্লিবালা নার্গিসের প্রেমের বারিধারায় সিক্ত হয়েছিল তার মনপ্রাণ। কিন্তু ঘরজামাই থাকার হীনশর্তের কারণে বাসর রাতে নার্গিসকে ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। নজরুলের বক্ষে পারিজাত মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েছিলেন নার্গিস। নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে বেদনার আগুনে দগ্ধ হয়ে সৃষ্টি হয়েছে অগ্নিবীণা আর ধূমকেতুর জ্বালা। কুমিল্লা থেকে ফিরে নজরুল কলকাতায় এসে মুজফফর আহমেদের ৩/৪-সি তালতলা লেনের বাসায় ওঠেন। এই বাড়িতেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে কবি রচনা করেন তার কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’।
১৯২২ সালে তার প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকায় আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা প্রকাশের কারণে রাজদ্রোহিতার অপরাধ এনে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যন্ত্রণার নীলবিষে দগ্ধ হয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি হিসেবে কবিতা লেখার জন্য কারাদণ্ড স্বীকার করে নেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় বন্দিদের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে তিনি অনশন করেন। তাকে নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলো। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কবি বদ্ধ ঘরে উচ্চারণ করেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’ অর্ফিয়াসের মতো তার হিরণ্ময় সুরে চারপাশ সাড়া পড়ে যায়। চিরবিদ্রোহী নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অর্ফিয়াস। তার উদয়ে থেমে গিয়েছিল বাংলা কবিতার চিরন্তন ভাষা। ছন্দের অক্ষরে সূচিত হয়েছিল বিদ্রোহের প্রবল জোয়ার।
কারামুক্তির পর আশালতা সেনগুপ্তকে (প্রমীলা) বিয়ে করেন। ১৯২৪ সালের ১৬ আগস্ট নজরুলের প্রথম পুত্রের জন্ম হয়। ডিসেম্বরের এক রাতে চার মাস বয়সী আজাদ কামাল মারা যায়। একই সময়ে পরপর দুটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হয়। একদিকে দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব; অন্যদিকে পুত্রশোকে পর্যুদস্ত হয়েও তিনি বিদ্রোহের দামামা বাজিয়ে চলছিলেন নিত্যনিয়ত।
নজরুল ছিলেন চিরদিনই সেরা। তার ভেতরে ছিল জাত নেতৃত্ব। তিনি যখন দুষ্টুমি করতেন, তখন ছিলেন দুষ্টু দলের সর্দার। মসজিদে কাজ করার সময় হয়েছিলেন সেখানকার ইমাম। লেটো দলে তাকে দেওয়া হয় ওস্তাদের আসন। সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন হাবিলদার। আর কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি। সমাজের বৈষম্য, অনাচার ও ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম একক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সমাজের সর্বস্তরে ন্যায় ও সাম্য বিধান করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। যখনই সমাজে অসাম্য এবং অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণের করাঘাতে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল’ দেখা দেবে, তখনই ধূমকেতুর দীপ্ত শিখা হয়ে নজরুল যুগে যগে ফিরে আসবে মানুষের অভয় বাণী হয়ে।