বিশ্ব পরিবেশ দিবস সাধারণত পালিত হচ্ছে প্রতি বছর জুন মাসের ৫ তারিখ। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে বিশ্বের সঙ্গে সমতা বজায় রেখে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকারসহ দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। সংগঠনগুলো রাজধানীসহ দেশব্যাপী কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সভা-সেমিনারের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তারা। প্রতি বছরের মতো এবারও জনসচেতনা বৃদ্ধির প্রয়াসে এগিয়ে এসেছে সংগঠনগুলো। তাই আমাদের পক্ষ থেকে সংগঠনগুলোর জন্য রইল অজস্র সাধুবাদ।
প্রতি বছর বিশ্বে নানান ধরনের দিবস পালিত হচ্ছে। তার মধ্যে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ অন্যতম। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিবসটি বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদা, আলোচনা বা সভা-সেমিনারের মাধ্যমে পালিত হয়ে আসছে। আর সরকারি-বেসরকারিভাবেও দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে। মূলত, জনসচেতনা বৃদ্ধির প্রয়াসই হচ্ছে এই দিবসের মূল উদ্দেশ; যা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো তাৎপর্যের সঙ্গে তুলে ধরছে সর্ব সাধারণের কাছে। এতে করে আমাদের লাভ বৈ লোকসান হচ্ছে না; বরং যে মানুষটি পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতন তিনিও বিষয়টি জেনে সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন; অর্থাৎ বিষয়টি অবগত হয়ে জনসাধারণ যথেষ্ট সজাগ হচ্ছে।
এবার আসা যাক, বিশ্ব পরিবেশ দিবসের গোড়ার দিকের আলোচনায়। বিশ্ব পরিবেশ দিবস সর্বপ্রথম পালিত হয় ১৯৭২ সালে। তবে তারও আগে এই দিবসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের ২০ মে সুইডেন সরকার প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে চিঠি পাঠায়। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা। বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে ১৯৬৯ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মূলত সেই সম্মেলনটি বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশদিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। যার ধারাবাহিকতায় দিবসটি বাংলাদেশেও যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে। তবে প্রতি বছরই আলাদা আলাদা শহরে, ভিন্ন প্রতিপাদ্য বা বিষয় নিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৪-এর স্লোগান হচ্ছে, ‘ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ এবং খরা স্থিতিস্থাপকতা’। অপরদিকে এ বছরের থিম হচ্ছে, ‘ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার’।
উল্লেখ্য, দিবসটির তারিখ নিয়ে আরেকটি কথা জানাতে হচ্ছে, উত্তর গোলার্ধে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দিবসটি ভিন্ন সময়ে পালিত হয়। তাই দুই গোলার্ধে দিবসের দিন-ক্ষণেরও হেরফের রয়েছে। যা নিয়ে আমাদের মধ্যে যেন বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়, এ লেখার মাধ্যমে সেটাই জানানোর চেষ্টা করা হলো।
আমরা আগেও বলেছি বিশ্ব পরিবেশ দিবস অন্যসব দিবস থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিবস। পরিবেশকে ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে অথবা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে জনসচেতনা বৃদ্ধির প্রয়াস এই দিবসের মূল বিষয়বস্তু। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি রোধে অথবা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্ব পরিবেশ দিবস অনন্য একটি দিবস। কারণ পরিবেশের সঙ্গেই সম্পৃক্ত জলবায়ুর উপাদানগুলো। যে উপাদানগুলোর হেরফের ঘটেই পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অথবা পরিবেশের বিপর্য ঘটে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পায়। যেমন জলবায়ুর উপাদানগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে প্লাস্টিক বর্জ্য, ই-বর্জ্য, ইটভাটা, বৃক্ষনিধন, বর্জ্যের ভাগাড় ইত্যাদির অব্যবস্থাপনার কারণে। পরিবেশ দিবসের মাধ্যমে যদি এসব বিষয় মানুষের কাছে তুলে ধরা যায়, তাহলেই দিবসটি পালন সার্থক হবে বলে মনে করছি আমরা। সুতরাং বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সঙ্গে আমাদের প্রথম জলবায়ু সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিতে হবে। জলবায়ুর উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। শুধু বৃক্ষরোপণ, বন্যপ্রাণী নিধন কিংবা পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা অব্যাহত রাখলেই হবে না, অবশ্যই জলবায়ু সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে হবে। মুখে মুখে বললেও জনসাধারণ জলবায়ু সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানে না। গণমাধ্যমে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ শব্দটা প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হওয়ায় অনেকের কানে বাজলেও বিষয়টার গুরুত্ব এবং ব্যাখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন বুঝতে পারেন। ফলে বেশির ভাগ মানুষের কাছে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে করণীয় কী কী তা অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে। এতে করে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তার যে ভূমিকা সেটা অনুধাবন করতে পারছে না। ফলে তারা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে এমন কর্মকাণ্ড থেকেও বিরত থাকছে পারছে না। ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। অথবা বৃক্ষনিধন, বন্যপ্রাণী নিধনসহ যাবতীয় অনিষ্ট করে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এটা কিন্তু তাদের দোষ নয়, কারণ তারা জানেনই না পরিবেশের ভারসাম্য বিনাশের বিষয়টি। সেই দিক বিবেচনা করে হলেও আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, পরিবেশ অথবা জলবায়ু সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা। কারণ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনের উদ্দেশ্য একটাই- পরিবেশ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যেন সবাই সম্পৃক্ত থাকে সেটি জানান দেওয়া। বিশেষ করে আমাদের দেশের তরুণসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যাতে তারা ফেসবুকে বেশি সময় না কাটিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে মনোযোগী হয়। এখানে আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে, দিবস পালনের মাধ্যমেই যেন কর্মকাণ্ডের সমাপ্তি না ঘটে। মনে রাখতে হবে, সর্বশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করা। যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা। যে দায়িত্ব সমাজের প্রতিটি নাগরিকের ঘাড়ে বর্তায়। যা আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই মোটেও।
আমাদের মনে রাখতে হবে- সমস্ত সৌরজগতে আপাতত বাসযোগ্য গ্রহ মাত্র একটি। অদূর ভবিষ্যতে বাসযোগ্য গ্রহ আবিষ্কার হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। সেই বিষয় মাথায় না নিয়ে আমাদের এই একটা মাত্র পৃথিবী নিয়েই ভাবতে হবে। পৃথিবীটাকে ধ্বংসের হাত থেকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এই সচেতনতা জনসাধারণের মাঝে জাগ্রত করে দিতে পারলে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালন সার্থক হবে। এবং জনসাধারণের ভেতর আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
[email protected]