প্রকৃতির নিয়তির কাছে পাহাড়ের মানুষগুলো বড় অসহায়। ফের পাহাড়ে একই পরিবারের তিনজন মাটিচাপা পড়ে মারা গেলেন। বড় ধরনের দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। চামেলীবাগে মাসাধিকাল ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাতের দরুন চামেলীবাগের টিলা ধসের অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। পাহাড় ধসের সময় ছিল না কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তারপরও পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিনজন চাপা পড়ে অকালে চলে গেলেন।
প্রতি বছরই এরকম ঘটনার অবতারণা ঘটছে। তাহলে তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? পাহাড়ের কোন অঞ্চল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ তা প্রশাসন চিহ্নিত করেছেন। তাহলে সেখানে বলিষ্ট এবং শক্ত ভূমিকা কেন নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ সরল প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়।
একটি ঘটনা পর আমাদের টনক নড়ে। কিছুদিন তা বহাল থাকে। আবার সবকিছু আগের নিয়মে চলতে থাকে। এভাবে আমরা পাহাড়ের অনেক বোবা কান্নার সাক্ষী হয়েছি। সামনের দিনগুলো আমাদের প্রকৃতির ভয়াবহ তাণ্ডব মোকাবিলা করেই পাহাড়ে জীবনযাপন করতে হবে। তাহলেই কি আমরা এভাবেই পাহাড় চাপা পড়ে মরব?
পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হলো পাহাড় কেটে আমরা নগ্ন করে ফেলেছি। ফলে সে এখন দাঁড়াতে পারছে না। পাহাড়ের অবকাঠামোগত আবরণ বিনষ্ট করায় প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে মাটি ধরে রাখা পাহাড়ের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আমারা নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় উজাড় করে ফেলেছি। গাছের শিকড় মাটি শক্ত করে ধরে রাখার কাজটি করে যেত। গাছ কেটে ফতুর করায় পাহাড় তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
একেকটি পাহাড় ধরিত্রীর জন্য খিলান স্বরূপ। পাহাড়ের মাটি এবং গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাত এবং ভূমিকম্পে মাটি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় প্রবল ভূমি ধসে পাহাড়ের মাটি গলে নিচে দিকে নামতে থাকে। কিছু লোভী মানুষ পাহাড়ের পাদদেশের জায়গা দখল করে সেখানে নিম্নআয়ের মানুষের কাছে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকে। এভাবে একসময় খেটে খাওয়া মানুষগুলোর নীরব মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।
২০০-৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই ভূমি ধসের জন্য যথেষ্ট। সেখানে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে ২০০৭ সালে ৯৫০ মিলিমিটার পর্যস্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। চামেলীবাগের টিলা ধসে একই পরিবারের চারজন চাপা পড়েছিল। একজনকে তাৎক্ষণিক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।
টিলা ধসের পেছনে রয়েছে এক নির্মম ও ভয়ানক তথ্য। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি টিলা দখল করে তা সমতল ভূমি বানানোর জন্য টিলার গায়ে সরু নালা কেটে রেখেছেন যাতে বৃষ্টিপাত হলে উপরের মাটি ধীরে ধীরে গলে পাদদেশে পড়ে। টিলা সরকারি সম্পদ হওয়ায় তা দখল করা একটু কষ্টসাধ্য। তার দরুন টিলার শ্রেণিই তারা মুছে দিতে চান। এভাবেই সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় টিলার মাটি ব্যাপকভাবে ধসে পড়ে। এতেই হতাহতের ঘটনা ঘটে।
চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ছয় ঘণ্টা লেগেছে। মানুষ এভাবে আরও ১১টি পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানানোর সব আয়োজন করে রেখেছেন। নগরীর ব্রাহ্মশাসন, দুসকি, হাওলাদারপাড়া, মেজরটিলা, খাদিমতলা, মালানীছড়া, বালুরচর, চন্দ্রসটিলাসহ অন্তত ৩০টি স্থানে টিলার পাদদেশে হাজার হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। তাছাড়া বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার টিলায়ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক স্থানে সতর্কবার্তা হিসেবে লাল নিশানা টাঙিয়ে রাখার পরও তাদের সচেতন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সিলেট এলাকা এবং দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি কক্সবাজারে পাহাড় রয়েছে। তবে বৃহত্তম চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮০৯ বর্গমাইল বিস্তৃত এলাকাই মূলত পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে ঘনবসতি এবং মানুষের বিচরণ বেশি সেসব পাহাড় টিলাতেই দুর্যোগ-দুর্বিপাক বেশি ঘটছে। এ এলাকার বান্দরবান ও আলীকদম উপজেলায় দুর্যোগপূর্ণ বেশি। এর মধ্যে লামা উপজেলার হরিণমারা, চিউসিমারা, ফাইতং, তেলুনিয়া, জামালিয়া, কামিয়াখালী ও রূপসী এলাকা। লামা পৌর এলাকার হাসপাতালপাড়া, লুনারবিল, কুড়ালিয়ার টেক, টিএনটি পাহাড় এবং আলী কদম উপজেলার ক্রপ পাতা, পোয়ামহরী, আমতলী ও বাবুপাড়া সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
তাছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৩টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম জেলার মহানগরীতেও ১৩টি পাহাড়কে ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, জালালাবাদ পাহাড়, নবীনগর পাহাড়, হামজারবাগ, দেব পাহাড়, কুমবাগ পাহাড়, গোল পাহাড়, কৈবল্য পাহাড়, খুলশী পাহাড়, বার্মা কলোনী পাহাড়, হিলভিউ পাহাড়, জামতলা পাহাড়, এনায়েত বাজার পাহাড় ও বাটালী হিল পাহাড় অন্যতম।
তাছাড়া কক্সবাজার শহরে পাহাড় কেটে কতগুলো অবৈধ বাড়ি তৈরি করা হয়েছে সরকারি দপ্তরে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। পরিবেশবাদী সংগঠন এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের হিসাবে, জেলার ১১ কিলোমিটার আয়তনের ছোট-বড় ৫১টি সরকারি পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে ৬৬ হাজারের বেশি বাড়ি। কয়েকতলা বিশিষ্ট রয়েছে ৫ হাজারের বেশি। আধা পাকা রয়েছে ৮ হাজার এবং বাকিগুলো সব বাঁশের বেড়া, ত্রিপল দিয়ে তৈরি বাড়ি। এসব বাড়িতে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে ।
এসব এলাকায় গত ১৫ বছরে শতাধিক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। উচ্চ আদালতে নিষেধাজ্ঞা থাকার পর ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস থেকে মানুষকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না। তার কারণ, খেটে খাওয়া গরিব মানুষ শহরের ভাড়া দিয়ে কুলাতে পারে না। অল্প আয়ের মানুষই মূলত পাহাড়ের পাদদেশের ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছেন।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগে মেরং রেঞ্জের ৫ হাজার ৮৯৯ দশমিক ৬২ একর, হাজাছড়া রেঞ্জের ১২ হাজার ৩৫০ একর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের নাড়াইছড়ি রেঞ্জের ৫৪ হাজার ১১২ একর বনাঞ্চলে গাছ নেই বললেই চলে। ১৯৮৬ সালে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বনাঞ্চল থেকে রেঞ্জ কার্যালয় গুটিয়ে নেওয়ায় এসব বনের অধিকাংশ গাছ দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের পাহাড় ধসের সবেচেয় বড় কারণ বোধ করি পাহাড় কর্তন। গত তিন দশকে কেবল চট্টগ্রামে তিন শতাধিক পাহাড় কাটা পড়েছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে পার্বত্য চটগ্রাম ও কক্সবাজারে। শুধু দুটি কারণে পাহাড় কাটা হচ্ছে। প্রথম মাটি কেটে ইটভাটায় ব্যবহার। দ্বিতীয় প্লট তৈরি করে বসত নির্মাণ। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বড় বড় ডেভেলপার কোম্পানি জড়িত। আর এই প্লট ও ফ্ল্যাট ব্যবসায় নির্বিচারে অনুমোদন দিয়ে কর্তৃপক্ষ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার এ মহোৎসব চলছে মূলত খুলশী লাল খান বাজার, পাচলইশ, বায়েজীদ বোস্তামী, ফয়সলেক, পাহাড়তলী, কাটলী ও ভাটিয়ারীকে ঘিরে থাকা পাহাড়ে। অপরিকল্পিতভাবে এসব পাহাড়ের পাদদেশ কেটে ফেলার কারণে তা দুর্বল হয়ে যায়। বর্ষার পানি উপরে আটকে যায়। এ সময় শো শো শব্দে প্রবলবেগে তাতে ধস নামে। ২০০৭ সালে পাহাড়ে মহাবিপর্যয়ের পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ২৮টি কারণ এবং ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই। সেটি কার্যকর করা হলে পাহাড় ধসের পরিমাণ অনেক কমে যেত।
পাহাড় ধসের ২৮টি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো- ভারী বর্ষণ, বালুর আধিক্য, পাহাড়ের উপরি ভাগে গাছ না থাকা। গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকির্পূণ বসবাস, বৃষ্টিপাতের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করা অপরদিকে ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে ছিল জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন করা, গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ও শক্ত করে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা, পাহাড়ের পানি ও বালু অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বসতি স্থাপন টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালু উত্তোলন না করা, পাহাড় এলাকার ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প করতে না দেওয়া, মতিঝর্না এবং বাটালী হিলের পাদদেশে বসতি স্থাপন উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, পাহাড় কাটার জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি এ ক্ষেত্রে। আর তাতেই মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। গত কয়েক দশকে হাজারের মতো মানুষের প্রাণ গেছে পাহাড় ধসের ঘটনায়। এ মধ্যে ১৯৯৬ সাণে ৭ জন, ১৯৯৭ সালে ৭ জন, ১৯৯৯ সালে ৩ জন, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ৫ জন, ২০০৫ সালে ৩ জন, ২০০৬ সালে ২ জন, ২০০৭ সালে ১২৭ জন, ২০০৮ সালে ১৩ জন, ২০০৯ এবং সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ৫৬ জন, ২০১১ সালে ১৩ জন, ২০১২ সালে ৯০ জন, ২০১৫ সালে ১৯ জন, ২০১৭ সালে ১৮০ জন, ২০২৩ সালে মারা গেছে ৪ জন।
এ পরিসংখ্যান বলছে পাহাড় ধস হবে আর তাতে মৃত্যুর মিছিল বাড়বে। প্রশাসনিক কোনো দায় ও দায়িত্ব যেন এখান যেন অচল। ক্ষমতাবানরা পাহাড় কেটে বাড়ি তৈরি করবে। তাতে নিম্ন শ্রেণির মানুষ বসবাস করবে। আর প্রকৃতিক ধসে তাদের সমাধি ঘটবে।
অলিউর রহমান ফিরোজ: সাংবাদিক
[email protected]