ভাষা সৈনিক আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হক, যিনি আ ন ম গাজীউল হক নামে পরিচিত। আজ ১৭ জুন তার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ১৪৪ ধারা অমান্যকারীদের অন্যতম ছিলেন আ ন ম গাজীউল হক।
আ ন ম গাজীউল হক ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, গীতিকার এবং ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন।
আজ ১৭ জুন। এই দিনটি আমার জন্য একটি কষ্টের দিন। এই দিনে ২০০৯ সালে হারিয়ে ফেলেছি, আমার অভিভাবককে। যিনি আমার পিতা। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক আমতলার জনসভায় সভাপতির আসনে থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যাঁর জীবনের অনেকটা বছর কেটেছে অন্ধকার কারাগারে। যিনি বাংলা ও বাংলা ভাষা নিয়ে তৃণমূল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে সরাসরি জড়িত থেকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় অধিষ্ঠিত করেন এবং সুপ্রিম কোর্টে বাংলা ও বাঙালির মায়ের ভাষা চালু জন্য লড়াই করেন।
লড়াকু ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বগুড়ার হাইকমান্ড (সমর) নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৪৭, ১৯৪৮ ,১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও পরবর্তীতে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দলনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন।
৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে শুধু অন্যতমই নন বরং এই সিদ্ধান্ত আ ন ম গাজীউল হক ঘোষণা করেন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রায় ১২টার দিকে ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মাঝখানে যে পুকুর আছে তার পূর্ব ধারের সিঁড়িতে বিভিন্ন হলের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের নিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এবং ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসুচি স্থির করার জন্য যে ১১ জনের বৈঠক হয়, সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় যে সভা অনুষ্ঠিত হবে তার সভাপতিত্ব করবেন আ ন ম গাজীউল হক।
যে ১১ জন ছাত্রনেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন- আ ন ম গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমেন, এস এ বারী এটি, এম আর আক্তার মুকুল, কামরুদ্দিন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, আনোয়ার হোসেন ও মন্জুর আহমদ।
তার লেখা গান ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গেয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত প্রভাতফেরি করা হতো।
ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি (পহেলা ফাল্গুন) ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে। তার বাবা হযরত মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং একজন সুফী সাধক। মায়ের নাম নূরজাহান বেগম। পড়াশুনা শুরু করেন মক্তবে। পরে কাশিপুর স্কুলে ভর্তি হন।
সে সময় চলছিল খেলাফত আন্দলন। তখন তিনি তৎকালীন স্থানীয় থানার জোকোভিচ পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর জন্য অবশ্য তাকে চার ঘন্টা জেল খাটতে হয়েছিল।
কাশিপুর স্কুল থেকে তিনি উচ্চ প্রাইমারি বৃত্তি লাভ করেন। এই স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি শিক্ষক সুরেন বাবুর সান্নিধ্যে এসে দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন। ১৯৪১ সালে তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনিতে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে এই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপরই তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে আইএ ভর্তি হন।
কলেজের অধ্যক্ষ ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্যারের সংস্পর্শে এসে বাম রাজনীতিতে আসেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ওই বছরই কুষ্টিয়ার নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কনফারেন্সে যোগ দেন।
তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, গীতিকার এবং মহান ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি বগুড়ার হাই কমান্ড (সমর) নিযুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত তিনি বগুড়াকে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত রাখেন। ভাষা আন্দোলনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে গাজীউল হক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন এই ভাষাযোদ্ধা বহুবার কারাবরণ করেছেন।
ভাষার জন্য দেশ যখন উত্তাল তখন ছাত্রাবস্থায় তিনি নেতৃত্ব দেন বগুড়ায়। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা পালন এবং ৪ মার্চের সভায় সভাপতিত্ব করে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন তিনি।
গাজীউল হক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় ঐতিহাসিক সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা করেন।
অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কণ্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্সের ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামে তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত, শফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকের সঙ্গে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন।
২৩ ফেব্রুয়ারি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাজীউল হক পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। বগুড়ায় এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার আলতাফুন্নেছা মাঠে তার গায়েবানা জানাজাও পড়ানো হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনার আগেই এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে আন্দোলনের কারণে গাজীউল হকের বিরুদ্ধে জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হলে তিনি এম এ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি চার বছরের জন্য বহিষ্কার হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর এম এ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলনে চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গাজীউল হকের এম এ ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয়।
শুধু ভাষা আন্দোলনে এই মহান সেনানী অবদান রাখেননি, পরবর্তী সব অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় সংগ্রামে গাজীউল হক অংশ নিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে।
১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪’র সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯’র গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে সরাসরি অংশগ্রহন করেন।
তাঁকে পাওয়া গেছে ১৯৮০’র দশক জুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি অংশ নিয়ে বগুড়ার মুসলিম লীগকে শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করেন এবং কাগমারী সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে আওয়ামী লীগের সর্বাঙ্গীন প্রতিকূলতা প্রতিরোধে মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
তিনি এপ্রিল মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বগুড়াকে হানাদারমুক্ত রাখেন। হিলিতে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৭ সালে আইনজ্ঞ সৈয়দ নওয়াব আলীর অধীনে বগুড়া বারে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পূর্বপাকিস্তান ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসার সনদ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে যোগদান করেন। সর্বোচ্চ আদালতে একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন।
গাজীউল হক তাঁর সৃজনশীলতার অনেক স্বাক্ষর রেখেছেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯টি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম লেখা বই ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘আমার দেখা আমার লেখা’ এবং বাংলাদেশ আনচেইনড যা এখন মালয়েশিয়ার মোনাস ও লন্ডনে অক্সর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য গাজীউল হক ছিলেন আপোষহীন। ‘উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন’ বইটিতে তিনি সে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন।
২০০৯ সালের ১৭ জুন বিকালে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ করেন। পরে তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দিনটি আমার জন্য এতটাই কষ্টদায়ক যে আমি তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান হয়েও আমার পিতার স্মৃতি রক্ষায় কোনো কিছুই করতে পারিনি। আমার এবং আমাদের পরিবারের একটাই আশা তাঁকে শুধু তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া হোক। আমার বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন। তাঁর জন্য আমাদের চির শ্রদ্ধা।
অমিয়/