ঢাকা ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫
English

নতুন শরণার্থী গ্রহণের চাপ রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর করবে

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৪, ০৪:২২ পিএম
নতুন শরণার্থী গ্রহণের চাপ রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর করবে
কামাল উদ্দিন মজুমদার

রাখাইনে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি এর মধ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ আরও রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য তীব্র চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। আনুমানিক ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নাফ নদীর একটি এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের অধিকার অফিসের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেন। মায়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত থমাস অ্যান্ড্রুস বাংলাদেশ সরকারের কাছে "তার বন্ধ সীমান্ত নীতি প্রত্যাহার করতে" এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মানবিক সমর্থন আবারও প্রদর্শন করার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে যে, তারা ইতোমধ্যে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আতিথ্য করেছে এবং আর গ্রহণ করতে পারবে না।

ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক ঘটনাগুলোর ভিড়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে  বসবাস করা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুর্দশার দিক থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। মায়ানমার থেকে সমস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা এখনও কোনও দৃঢ় পদক্ষেপে নিতে পারেনি। তারা শুধু মুখে মুখে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মায়ানমারে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকদের প্রত্যাবর্তনের বার বার আশ্বাস দিলেও গত প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে ফেরাতে পারেনি। 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং অধিকার গোষ্ঠীগুলোকে বুঝতে হবে যে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারে না বা নতুন কোনো অনুপ্রবেশের অনুমতি দিতে পারে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকার করে যে- রেশনের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সহিংসতা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা জোরপূর্বক নিয়োগ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন ও মঙ্গলকে হুমকির মুখে ফেলেছে। একইভাবে তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে নতুন শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করা রোহিঙ্গারাদের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলময় হবে না। 

পুরনো সমস্যা, নতুন চ্যালেঞ্জ  
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, আর কোনো রোহিঙ্গা বা মায়ানমারের নাগরিককে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। গত কয়েক দশক ধরে এখানে স্থানান্তরিত হওয়া দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বিশাল বোঝায় পরিণত হয়েছে। তাই মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের কোনো নতুন আগমনকে তা বাংলাদেশের জন্য হবে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। 

শরণার্থীদের স্থায়ী আবাসস্থল খুঁজে বের করার কোনো সমাধান না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ১৯৮০ এর দশক থেকে বয়ে বেড়ানো বোঝা আর বইতে রাজি নয়। দাতারা ২০২০ সালে প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র ৬০ শতাংশ দিয়েছিল, যা ২০২২ সালে ৪৯ শতাংশ ও ২০২৩ সালে প্রায় ৫১.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

আন্তর্জাতিক সাহায্য হ্রাসের ফলে বাংলাদেশ প্রতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল আর্থিক বোঝা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য ঋণ চাইতে বাধ্য করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশচ প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ঋণ চেয়েছিল - যার মধ্যে ৫৩৫ মিলিয়ন ঋণ এবং ৪৬৫ মিলিয়ন অনুদান রয়েছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কীভাবে আরও রোহিঙ্গাকে স্বাগত জানাবে! 

রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ শুধু আর্থিক সীমাবদ্ধতাই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বিশেষ করে যুবকরা যারা সশস্ত্র সংগঠন এবং অপরাধচক্রে যোগদান করেছে, তারা অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, স্বর্ণ চোরাচালান এবং অন্যান্য অপরাধে জড়িত হওয়ায় শরণার্থী শিবিরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই আবার এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে এগুলোই জড়িয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫০০টিরও বেশি অপহরণ এবং ১৮৬টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা ও রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি বিশাল আর্থিক চাপ তৈরি করছে।

এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটছে। বাংলাদেশ এখন এমন একটি ফাঁদে আটকা পড়েছে যে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারে না, যেখানে তারা আরও রক্তপাতের সম্মুখীন হতে পারে। আবার তারা স্থানীয়দের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের জন্য উপযোগী পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারছে না। সুতরাং, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যেটি কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামান্য সহায়তায় কয়েক হাজার শরণার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আবাসন দিয়ে আসছে, বার বার এটি করেই যাবে আর অন্যরা চুপচাপ দেখে যাবে তা আশা করা কপটতা ছাড়া আর কিছু নয়।  

চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ বারবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে, তবুও প্রত্যাবাসনের আন্তর্জাতিক কোনো অর্থবহ ও আপাত প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। গত প্রায় আট বছরে, উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহায়তার পরিবর্তে শুধু ফাকা বুলি ও বিবৃতিই দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, উন্নত দেশ, যাদের বিশাল ভূমি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব কম, তারা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ কমানোর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারে। তাছাড়া, তারা মায়ানমার কর্তৃপক্ষ বা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর প্রদান করতে চাপ দিতে পারে যাতে তারা বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য না হয়। 

যেহেতু রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি গুরুতর এবং আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে পুনরায় সংঘর্ষের কারণে প্রত্যাবাসনের আপাত কোনো লক্ষন নেই, তাই বাংলাদেশে অবস্থান করা ১ দশমিক ৩ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার জীবন টিকিয়ে রাখা দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অভিবাসীদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে বাধ্য করার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি সংকটের দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হওয়া। 

লেখক: গবেষক
[email protected]

জনসংযোগকর্মী মানেই মুখপাত্র নয়, মুখপাত্র হয়ে ওঠতে হয়

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৫, ১১:৫১ এএম
জনসংযোগকর্মী মানেই মুখপাত্র নয়, মুখপাত্র হয়ে ওঠতে হয়
মো. কামরুল ইসলাম

আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রতিদিন কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবেই। পরিচয় হবে টেলিযোগাযোগ কিংবা সরাসরি অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। জনসংযোগ পেশা কেমন জানি নতুন পরিচয়ের নেশায় বুদ হয়ে থাকা। একজন জনসংযোগকর্মী হিসোবে ৩০ বছরের সময়কাল যেন এক অভিজ্ঞতার পসরা সাজিয়ে সম্মুখপানে তাকিয়ে থাকা। নতুন পরিচয়, নতুন অভিজ্ঞতালব্ধ হওয়ার জন্য। 

অন্যসব ডিপার্টমেন্টের এক্সিকিউটিভদের মতো জনসংযোগ কর্মকর্তাদের সকাল-সন্ধ্যা অফিসের সময়, কালাকানুন সবই মেনে নিতে হয়। অতিরিক্ত হিসাবে ২৪ ঘণ্টাকেই কর্মঘণ্টা মেনে নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, দিনটি যদি ৩৬ ঘণ্টায় হতো তাহলে ভালোই হতো। 

আজকাল বনেদী খেলা ক্রিকেটে টি-টেন, টি-টুয়েন্টি, ওয়ানডে দিনদিন জনপ্রিয় উঠছে। কিন্তু টেস্ট ম্যাচের জৌলুস কিন্তু রয়ে গেছে আদি ও অকৃত্রিমতায়। জনসংযোগ পেশাটা ঠিক সেই রকমই একটা টেস্ট ম্যাচ। ধৈর্য্যের টেস্ট ম্যাচ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমহারে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। আর যদি কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ পেশা হয়ে থাকে তবে তো আপনাকে যেকোনো সময়ে যেকোনো বিষয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

জনসংযোগ পেশাটাই এমন আপনাকে প্রতিষ্ঠানের সব বিষয়ে কিংবা আপনার প্রতিষ্ঠান যে ধরণের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সেই ব্যবসা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হয়। উদাহরণ হিসেবে- অ্যাভিয়েশন সেক্টরের ব্যবসার কথাই উল্লেখ করা হলো- একজন সেলস্ কিংবা মার্কেটিং প্রতিনিধি সেলস অথবা মার্কেটিং বিষয়ক সম্যক জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট, অ্যাকাউন্টিং কিংবা  রেভিনিউ ডিপর্টেমেন্টের কাজের ধরণও হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত যেখানে কাজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পাইলট উভয়েরই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষায়িত হতে হয়। আবার অ্যাডমিন কিংবা এইচআর ডিপার্টমেন্টেরও কাজের সীমাবন্ধতা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বিভাগ যেমন পারচেজ, ক্যাটেরিং, ইন-ফ্লাইট সার্ভিস, কাস্টমার সার্ভিস, সিকিউরিটি, ক্লিনিং, ট্রান্সপোর্ট প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট কাজের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। 

জনসংযোগকর্মীকে যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতে হয়। খুব বেশি সচেতনতার সঙ্গে বক্তব্য রাখতে হয়। ভুল বক্তব্য প্রতিষ্ঠানকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। কঠিন সময়ে সাবলীলভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারাই একজন জনসংযোগবিদের কাজ। যা অন্যদের থেকে আলাদা, তাই প্রকাশ করা। 

একজন জনসংযোগকর্মীর প্রয়োজনীয়তা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সবসময়ই আছে। যেমন প্রয়োজন ভালো সময়ে তেমনি প্রয়োজন মন্দ সময়ে। তবে ভালো সময়ের চেয়ে মন্দ সময়ে জনসংযোগকর্মীকে খুব বেশি প্রয়োজন বলেই মনে হয়। প্রতিষ্ঠানের যেকোনো মন্দ সময়ে একজন জনসংযোগকর্মী তার সুসম্পর্ক দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ভালো সময়ের দিকে এগিয়ে নিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন জনসংযোগবিদ তার সাবলিল উপস্থাপনা দিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে সকল স্তরের নাগরিকদের নিকট সঠিক বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে তুলে ধরতে পারেন। যা অন্য কর্মকর্তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।

প্রয়োজন থাকলেই সংবাদকর্মীদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা আর প্রয়োজন শেষ হলেই সম্পর্ক শেষ এই নীতিতে যারা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য জনসংযোগ পেশা নয়। যারা নির্দিষ্ট সময় মেনে জনসংযোগ পেশায় কাজ করতে চান তাদের জন্যও এই পেশা খুব বেশী মানানসই হবে না। 

সরকারী কিংবা বেসরকারী উভয় সেক্টরেই জনসংযাগ কর্মীকে অফিস সময়ের বাহিরেও সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখতে হয় নিজেকে। আপনি হয়তো রাত ১১টা কিংবা ১২ টায় ও ফোন কল পেতে পারেন। আপনার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পরিচয়ের সূত্র ধরে কেউ জরুরী একটা সেবার জন্য আপনার দারস্থ হয়ে থাকলে প্রয়োজন বুঝে সহায়তা করা। এটাও জনসংযোগ কর্মীর সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। কারো সাথে পরিচয় হবে প্রফেশনালী কিন্তু সম্পর্ক তৈরী হবে পারসোনালী। যে সম্পর্কটা থাকবে আজীবন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারনে লাভবান হবে প্রতিষ্ঠান।

শুধুমাত্র এক্সটার্নাল রিলেশন ভালো রাখতে হবে ব্যাপারটা আসলে তা নয়, আপনার ইন্টারনাল রিলেশনও অনেক ভালো হতে হবে। ইন্টারনাল রিলেশন যতবেশী শক্তিশালী হবে আপনি জনসংযোগ কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠানে আপনার ভূমিকা ততবেশী গ্রহণযোগ্য হবে। আপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কোনো বার্তা খুব সহজেই মিডিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যা প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো কর্মীর পক্ষে সম্ভব নয়।         

ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে বড় মিডিয়া কিংবা ছোট মিডিয়া বলতে কিছু নেই। একজন জনসংযোগ কর্মী হিসেবে আপনাকে সব মিডিয়াই সমান ধারনা পোষণ করতে হবে। কোনো ঘটনা কিংবা দূর্ঘটনার সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে সত্য ঘটনা তুলে ধরাই কাম্য হবে নতুবা ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে নানাবিধ কল্পকাহিনীর সম্মুখীন হতে পারেন, যা ব্যবসার সুনাম ক্ষুন্ন হতে পারে, ভবিষ্যৎ ব্যবসার জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে। সত্য সংবাদ প্রকাশে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠান লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রত্যেকটি মিডিয়া হাউজের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এমনকি সংবাদকর্মীদের কমিউনিটি বেজড্ অনেক প্রতিষ্ঠান থাকে তাদের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে যেমন জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ক্রাইম রিপোটার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব), ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ইত্যাদি। একজন জনসংযোগ কর্মী হিসেবে সংবাদকর্মীদের মনোভাব অনুধাবন করা খুবই জরুরী।

জনসংযোগ কর্মীর কাজ এবং সময়ের কোনো রুটিন মাফিক সীমাবদ্ধতা নেই। সবসময়ই ফ্রি আবার আবার সবসময়ই ব্যস্ত। প্রতি মূহূর্তেই ব্যস্ততার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কঠিন সময়েও উপলব্ধি এমনই হওয়া উচিত- কথার মাধ্যমেই আপনি একজনকে কষ্ট দিতে পারেন আবার কথার মাধ্যমেই আপনি একজনকে সন্তুষ্টি দিতে পারেন। কথা বলবেন আপনি। আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কি কষ্ট দিবেন নাকি সন্তুষ্টি দিবেন।  

একজন জনসংযোগকর্মী আপাদমস্তক কোম্পানীর মুখপাত্র হয়ে উঠার জন্য আপনাকে সৎ, নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, অভিজ্ঞতালব্ধ হওয়া খুবই জরুরী।

লেখক: মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

রিজার্ভ গাড়িতে ঈদযাত্রা: চালকের ঘুমও জরুরি

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০২ পিএম
রিজার্ভ গাড়িতে ঈদযাত্রা: চালকের ঘুমও জরুরি
রিয়াজুল হক

ঈদ মানেই আনন্দ। দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার, গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন কাটানোর, কিংবা শহরের কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসার এক অবকাশ। এবারের কোরবানির ঈদে যেহেতু একটানা বড় ছুটি পাওয়া গেছে, অনেকেই কর্মস্থল ছেড়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হচ্ছেন। অনেকে বাস বা ট্রেনের ভিড় এড়িয়ে রিজার্ভ প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ভাড়া করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। সঠিক পরিকল্পনা, আরামদায়ক যাত্রা ঠিক আছে, তবে একটি বিষয়ে আমরা খুব কমই নজর দিই। সেটা হচ্ছে, গাড়ির চালকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা।

যে চালক আপনাকে ১৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে পৌঁছে দেবেন, তিনি হয়তো আগের দিনই এমন আরেকটি ভ্রমণ শেষ করেছেন। ঈদের এই মৌসুমে অতিরিক্ত আয়ের আশায় টানা তিন-চার দিন ধরে একটানা ট্রিপ দিয়ে চলেছেন। কখনও ঘুমোতে পারেননি ঠিকঠাক, কখনও খাওয়ার সময়ও পাননি। এভাবে অবসন্ন, ক্লান্ত, ঘুমে ঢুলে পড়া এক চালকের হাতে আপনার পরিবার, আপনার প্রাণ!

দীর্ঘ সময় ধরে একটানা গাড়ি চালানো চালকের জন্য যেমন শারীরিকভাবে কষ্টকর, তেমনি মানসিকভাবে বিপজ্জনকও। নিদ্রাহীনতা মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মনোযোগ বিঘ্নিত করে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। 

যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক নিরাপত্তা সংস্থার মতে, ঘুম ঘুম ভাব বা ক্লান্তি নিয়ে গাড়ি চালানো মদ্যপ অবস্থায় চালানোর মতোই বিপজ্জনক। বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা না থাকলেও ঈদের সময়ে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে ক্লান্ত চালকদের ভূমিকা যে থাকে, সেটা আমরা দেখতে পাই। চালক যদি ক্লান্ত বা নিদ্রাচ্ছন্ন থাকেন, তবে একটি মুহূর্তের ভুলেই ঘটে যেতে পারে কোনো জীবনের পরিসমাপ্তি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার করণীয় কী? 
আপনি যখন গাড়ি রিজার্ভ করছেন, তখন কেবল গাড়ির অবস্থা, এসি কাজ করছে কিনা কিংবা ভাড়া কত হবে, এসবই মাথায় রাখেন। কিন্তু চালকের অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ এটা আপনার প্রথম দায়িত্ব। কারণ, আপনার জীবনের নিরাপত্তা এরসঙ্গে জড়িত। গাড়ি রিজার্ভ করার সময়েই জানতে চান, ‘চালক গত কয়েক দিনে কতগুলো ট্রিপ দিয়েছেন? তিনি কোথা থেকে এসেছেন? ঘুমাতে পেরেছেন কিনা?’

অনেক ড্রাইভার ইচ্ছে করেই ক্লান্তি গোপন করেন। কারণ, তারা জানেন, যাত্রী জানলে ভয় পাবে এবং ভরসা হারাবে। অনেক চালক আবার গাড়ির মালিক বা ট্রাভেল অ্যাজেন্সির চাপে পড়ে একের পর এক যাত্রায় বাধ্য হন। সুতরাং, যদি আপনি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস না করেন, তবে কেউ আপনাকে আগে থেকে সতর্ক করবে না।

যেসব ট্রাভেল অ্যাজেন্সি বা গাড়ির মালিক গাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন, তাদেরও উচিত গাড়ির পাশাপাশি চালকদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া। একের পর এক ট্রিপে বাধ্য করার পরিবর্তে শিফট ভিত্তিক চালক রাখা। প্রতিটি ট্রিপের পরে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা এবং চালকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। কারণ, গাড়ির ব্র্যান্ড নতুন হলে কী হবে, যদি তার ক্লান্ত চালক স্টিয়ারিং-এর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন? এক ফোঁটা ঘুম, এক সেকেন্ডের অসতর্কতা, যার ফলাফল হতে পারে প্রাণঘাতী।

ঈদের মৌসুমে আমরা অনেক কিছু ভেবে ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। কোথায় খাব, কোথায় থাকব, কোন রাস্তায় যাব, সবই চিন্তা করি। কিন্তু চালকের সুস্থতার বিষয়টিই ভুলে যাই। অথচ আপনার ভ্রমণের সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করে চালকের উপর।

যারা আগে বিষয়টি আমলে নেননি, এবারের ঈদে সেই সচেতনতা শুরুতেই গ্রহণ করুন। যাত্রা শুরুর আগে একবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন, ‘শেষ কবে ঘুমিয়েছেন?’ 

আপনার এই প্রশ্নে হয়তো কিছুটা অস্বস্তি হবে, কিন্তু এই অস্বস্তিই বাঁচাতে পারে অনেক প্রাণ। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনাকে প্রায়ই দুর্ভাগ্য হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পেছনে বহু এড়িয়ে যাওয়া কারণ থাকে। নিজের প্রয়োজনেই সচেতন যাত্রী হিসেবে আপনার দায়িত্ব এই কারণগুলোকে আগে থেকেই চিহ্নিত করা, প্রতিরোধ করা। গাড়ি রিজার্ভ করা মানেই দায়িত্ব শেষ নয়, চালকের খোঁজ নেওয়াও যাত্রার অংশ। এবারের ঈদে সেই সচেতনতা নিয়েই শুরু হোক সবার গন্তব্যের পথে যাত্রা।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

রাষ্ট্র সংস্কারের আগে শিক্ষা সংস্কার কেন জরুরি

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১০:৫৩ এএম
রাষ্ট্র সংস্কারের আগে শিক্ষা সংস্কার কেন জরুরি
হাসিবুল হাসান

৫ আগস্টের পর দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের লক্ষ্যে নতুন সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেন সেগুলো হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, খুন ও গুমসংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। দুঃখের বিষয়, উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন আমলের প্রেক্ষিতে। কিন্তু রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু শিক্ষা খাত সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। অথচ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানান কারণে শিক্ষায় সমস্যা ও সংকট বহু গুণে বেড়েছে। নানান কারণে বির্তকিত হয়েছে শিক্ষা খাত বিভিন্ন সময়ে। শিক্ষার বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে জনগণ বাতিল করেছে, সংস্কার করার জন্য রাজপথে নামলেও কোনো ফল আসেনি। দিনের পর দিন শিক্ষায় সংকট, সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে, দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে সমস্যাই বেড়েছে সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হলে জনগণ বিশেষ করে শিক্ষক সমাজ ভেবেছিল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, প্রায় ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান, সংস্থাকে সংস্কারের আওতায় আনলেও শিক্ষায় কোনো সংস্কারের উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেনি। অথচ পাহাড়সমান সমস্যা নিয়ে টিকে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এ সমস্যা শিক্ষকরা যতটুকু বোধ করেন অন্যরা ততটুকু হয়তো বোঝেন না। ২০২০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। টানা ৬৭ সপ্তাহ বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা বিশ্বে রেকর্ড। বন্ধের এই ধারাবাহিকতার মধ্যেই শুরু হয় অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট নামের পানি পড়া অটোপাস, পুরোনো কারিকুলাম বাতিল করে, নতুন কারিকুলাম চালু, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি নানান সংকটে ভেঙে পড়ে শিক্ষাব্যবস্থা।

২০২০ সালের করোনা মহামারির পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর কেউই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ক্লাসে ফিরতে পারেনি। পুরোনো সৃজনশীল কারিকুলাম বুঝে ওঠার আগেই একমুখী নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের তোড়জোড়- সব মিলিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় চরম অস্থির অবস্থা পার করছে। বিভিন্ন সময় নানান দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষকদের রাজপথে অবস্থান, নন-এমপিও শিক্ষকদের আন্দোলন, বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন, প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেডপ্রাপ্তির আমলাতান্ত্রিক সমস্যা, বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, বেতনবৈষম্য নিয়ে শিক্ষকদের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ, ইএফটি জটিলতায় গত পাঁচ মাসের বেতন-বোনাসবঞ্চিত শিক্ষকদের অমানবিক জীবনযাপন, এনটিআরসির নিয়োগবাণিজ্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুমাত্রিক সমস্যা, শিক্ষকতার নিম্নমান ইত্যাদির কারণে দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। চলতি বছরের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে তবুও সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে এসে পৌঁছায়নি, রয়েছে চলমান নানান জটিলতা। সবমিলিয়ে চরম এক বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত শিক্ষা খাত। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় সব অনিয়ম দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা আইন বাস্তবায়নের কথা বলা থাকলেও সেটার বাস্তবায়ন বিগত দিনগুলোয় রাজনৈতিক কারণেই সম্ভব হয়নি। বিপ্লবের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে শিক্ষক সমাজ আশায় বুক বাঁধে এই ভেবে যে, স্বতন্ত্র একটি কমিশন গঠন করে সরকার শিক্ষায় চলমান সব সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে আশাও ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে। নতুন সরকার সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার উদ্যোগ শুরু করলেও শিক্ষা খাত এখনো রয়ে গেল উপেক্ষিত। অথচ বিগত ৫০ বছরের অধিক সময় কল্যাণমুখী, গণমুখী পদক্ষেপ দৃশমান হয়নি। শিক্ষায় যথার্থ পরিকল্পনা আর বিনিয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে পেরেছে, আমরা করেছি উল্টোটা। একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতিকে  উন্নত, ধনী, ঐশ্বর্যবান সর্বোপরি স্বাস্থ্যবান করে তোলে। এজন্য প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, রাষ্ট্রের আর্থিক স্বক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বাস্তবায়নের আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা। নতুন বাংলাদেশের পুনর্নির্মাণ সফল করতে সংস্কার অপরিহার্য, প্রয়োজনীয় বটে তবে সেটা শিক্ষাকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করে নয় বরং সঙ্গে নিয়ে। নতুন সরকার সেদিকে নজর দেবে, প্রত্যাশিত পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে, এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

প্রোগ্রাম অফিসার, দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।
সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, এসইডিপি প্রোগ্রাম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।
[email protected]

অপ্রকাশিত অনুভূতি

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১০:৫৮ এএম
অপ্রকাশিত অনুভূতি
মো. ইব্রাহিম আজাদ

সকাল বেলার রোদটা আজ যেন একটু বেশি নরম। কলেজের পাশে ছোট একটা বাসায় একাই থাকেন রায়হান সাহেব। সাহিত্যের অধ্যাপক। স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় থাকে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথার চুলে পাক ধরেছে। চোখে রিডিং চশমা লাগে। শ্যামল বর্ণের মাঝারি গড়ন। প্রথম দেখাতেই আকর্ষণীয় কোনো ভাব নেই। নিরীহ গোছের গোবেচারা টাইপের মানুষ। নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু ক্লাসে যখন পড়ান, তখন তিনি পড়ার মধ্যে নিজেকে একাত্ম করে নেন। ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো রায়হান সাহেবের কথা শোনেন।

আজ রায়হান সাহেব নিজের কক্ষের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে আনমনে চুমুক দিতে দিতে দেখেন সামনের কাঁঠাল গাছ থেকে আকাশে উড়ে যাচ্ছে এক জোড়া শালিক। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মনের মণিকোঠায় একটা মুখ হালকা মেঘের মতো উঠেই পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। অনেক মুখের ভিড়ে কোনো একটা মুখ বিশেষ কোনো ক্ষণে কেন ভেসে আসে তার ব্যাখ্যা রায়হান সাহেব খুঁজে পান না। তার মনে হয় এ বয়সে এসে মানুষ যখন পেছন ফিরে তাকায় তখন যা মনে থাকে, তা আর কোনো ঘটনা নয়- তা হয় কিছু অনুভব, কিছু গন্ধ, কিছু না বলা কথার দাগ।

সময়টা ছিল আশির দশকের শুরুর দিকে। গ্রামের ছেলে রায়হান। তার অনেকটা চরের মতো চারপাশে আবাদি জমি ছিল, আবার প্রচুর বালুময় রাস্তাও ছিল। প্রতি বছর প্রায় বন্যা হতো। রায়হান নিজের বাড়ির পাশের বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে গ্রামে অবস্থিত উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়।

সে সময় নিয়ম ছিল ছেলেরা নিজ নিজ ক্লাসে বসে থাকত আর মেয়েরা তাদের জন্য নির্ধারিত কমন রুমে থাকত। ক্লাস শুরু হওয়ার সময় স্যারের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে আসত আবার ক্লাস শেষ হলে স্যারের সঙ্গে সঙ্গে কমন রুমে ফিরে যেত। প্রথম দিন রায়হান দুরুদুরু বুকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। প্রথম দিন কারও সঙ্গে তেমন একটা কথা হয়নি। সে দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে। রায়হান ছাত্র হিসেবে ভালোর দিকে ছিল। প্রতিদিনের পড়া তৈরি করে যেত। অবশ্য এর কারণও ছিল। সে সময় শিক্ষকরা পড়া না পারলে শাস্তি দিত। হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে যাওয়া এক প্রকার নিয়ম ছিল। 

ধীরে ধীরে রায়হান নতুন সহপাঠীদের নাম, পরিচয় আত্মস্থ করে। কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যায়। আবার আশপাশের এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় অনেকের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কের যোগসূত্র বেরিয়ে আসে। শাহিন, শওকত, মোল্লা, বাদল, রতনের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়। ফলে তার মনের মধ্যে যে দুরুদুরু ভাব ছিল তা দূর হয়ে যায়। গ্রামে সে সময় মেয়েদের পড়াশোনা বেশ ভালো মতোই শুরু হয়ে গেছে। তাদের ক্লাসে আটজন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। কোনো কোনো মেয়ের নামও জেনে গেছে। এর মধ্যে যা তার মনে গভীর দাগ রেখে যায় তা হলো জ্যোতি ও মলি। তারা দুই বোন একই ক্লাসে অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণিতে রায়হানদের সঙ্গে পড়ত। জ্যোতি ছোট মলি বড়। বাবা ছিলেন উকিল। তাই তাদের মধ্যে আলাদা কী যেন একটা কাজ করত। ক্লাসের বাইরে তাদের সঙ্গে রায়হানের কখনো কোনো কথা হয়নি। কিন্তু কেন রায়হান নিজেও জানে না, জ্যোতির মুখ মাঝে মাঝে মেঘের মতো ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যায়। শুধু তাই নয় ছাত্রজীবনে অনেকের সঙ্গেই তো পড়েছে তাদের কারও মুখ-মনের গহীনে ভেসে ওঠে না। তবে কি জ্যোতিকে ভালোবাসত। না, সেরকম কিছু না। কেননা রায়হান জানে ভালোবাসা আলাদা। হয়তো ভালো লাগা। কোনো কূলকিনারা খুঁজে পান না। তবে কি লিকলিকে কালো বর্ণের হীনম্মন্যতায় ভোগা রায়হানের কাছে সে ছিল রূপকথার পরী।

সপ্তম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে যে যার মতো ছুটি কাটানো শেষে নতুন বছরের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে রায়হান জানতে পারে জ্যোতি ও মলি তাদের সঙ্গে পড়বে না। তারা শহরের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এতে রায়হানের মনে বেশ ব্যথা করে। কেন করে তাও জানে না। এ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কিছু বলতেও পারে না। শুধু কষ্টটা বয়ে বেড়ায়। 

কিছুদিন পর রায়হান শুধু ওই বিদ্যালয় নয় নিজ এলাকা ছেড়ে দেশের অন্য প্রান্তে চলে যায় এবং সেখানে একটা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সময়ের আবর্তনে রায়হান নতুন পরিবেশ, নতুন পরিচয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। পড়াশোনা শেষ করে সরকারি কলেজে চাকরি হয়, বিয়ে হয়। চাকরি, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে অনেকটা গুছানো জীবন। তারপরও কিছু ক্ষণ, কিছু মুহূর্ত থেকে থেকে আসে যখন বাতাসে শালিকের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনে কিংবা নীল আকাশে বকের ভেসে যাওয়া সারি দেখে স্থির হয়ে যায়। কিছু শব্দ হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যায়। যেমন কিছু অনুভব বেঁচে থাকে নিশ্বাসে। 

মাঝে মাঝে কৈশোরের অবাধ্য সময়গুলো; স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, স্মৃতিগুলো একটার পর একটা দৃশ্যকল্প এঁকে চলে যায়। এসবের কোনো অর্থ সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। কেনই-বা এগুলো হয় তা বুঝতে পারে না। তবুও কেন জ্যোতির মুখ মনের মাঝে ভাসে। তিনি ভাবেন জ্যোতিকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কাউকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারেন না। তা ছাড়া নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করেন। কেন আমি তাকে খুঁজব? অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো নিজের হৃদয়ে হাতড়ান। কোনো কিছু নেই। তারপরও কী অদম্য আগ্রহ।

বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেছে। রায়হান একসময় জানতে পারে জ্যোতি একজন সুখী মানুষ। স্বামী সংসার হয়েছে। শুধু তাই নয় সেও একজন সাহিত্যের অধ্যাপক। শুনে জ্যোতিকে দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থিরতা অনুভব করে রায়হান। কিন্তু একা দেখা করার সাহস হয় না। কেননা জ্যোতির সঙ্গে তার সরাসরি কোনো কথাই হয়নি কখনো। এখন ৪০ বছর পর দেখা হলে জ্যোতিই-বা রায়হানকে চিনবে কেন? মনের মাঝে ক্ষীণ আলো রেখা দেখে যদি চেনে?

অনেক ভেবে রায়হান তার বাল্যবন্ধু সহপাঠী রতনকে খুলে বলে জ্যোতির কথা। রতনও জ্যোতিকে দেখেনি ক্লাস সেভেনের পর। রায়হান ও রতন সিদ্ধান্ত নেয় কোনো একদিন হঠাৎ জ্যোতির বাসায় হাজির হবে। আবার দুজনে কী জন্য কিংবা কী পরিচয়ে যাবে। নানা শঙ্কা কাজ করে ভেতরে ভেতরে।

কিন্তু আবিষ্কারের নেশায় সব আশঙ্কাকে অসার মনে হয়। উচিত অনুচিতের প্রশ্নকে আড়ালে রেখে সব আশঙ্কাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখে একদিন দুই বন্ধু হাজির হয় জ্যোতির বাসার সামনে। অধ্যাপক হিসেবে তাকে পাড়ার সবাই জানেন। রতন বাসার কলিং বেল টিপ দিতেই একজন বাসা থেকে বের হয়ে জানতে চান আমরা ঠিক কাকে খুঁজছি। রতন জ্যোতির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল আমিই জ্যোতি। কিন্তু আপনাদের তো চিনলাম না। রতন জ্যোতিকে জিজ্ঞেস করল আমরা যে বিদ্যালয়ে পড়তাম তার কথা। তারা দুই বোন পড়ত কি না। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রতন জিজ্ঞেস করল তাকে চিনতে পারছি কি না। সে আবার না সূচক মাথা নাড়ল। রতন নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, তবুও জ্যোতির কোনো স্মৃতি মনে করতে পারছিল না।

রায়হান চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন শুনতে শুনতে ভাবছিল তার আশঙ্কা সত্য হয়ে যায় কি না। ভেতরে উৎকণ্ঠা কাজ করছিল।

এটাও ভাবছিল এতদিনের ব্যবধানে তাদের না চেনাটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া সময়ের আবর্তনে মানুষ তার কত কিছুই ভুলে যায়। খানিকটা বিরক্ত হয়ে রতনের হাতে টান দিয়ে বলে, চল আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ঘরের ছেলে ঘরে চল। অকস্মাৎ চিৎকার করে জ্যোতি বলে, আরে থাম, তুই রায়হান না। রায়হান হতবিহ্বল হয়ে যায়। নিজের কানকে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। জ্যোতি শুধুই যে তাকে চিনতে পেরেছে তা নয়, তার নাম পর্যন্ত মনে রেখেছে। রায়হানের নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সে শুধু অনুভব করে, যাকে দেখার জন্য এত অপেক্ষা তা সার্থক হয়েছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (অর্থনীতি বিভাগ), পলাশবাড়ী সরকারি কলেজ, গাইবান্ধা

সড়ক দুর্ঘটনা: বাস্তবতা ও করণীয়

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১২:১৪ পিএম
সড়ক দুর্ঘটনা: বাস্তবতা ও করণীয়
রিয়াজুল হক

গত সপ্তাহের ঘটনা। চোখের সামনে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সারা জীবনের স্বপ্ন এক মুহূর্তে শেষ। আর তিনি চলে যাবার পর পুরো পরিবার এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। অগণিত মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাব মতে, দেশে বছরে পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্য, এ মৃত্যুর সংখ্যা ২১ হাজারের বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা সেন্টারের তথ্যমতে, দেশে বছরে ১১ হাজারের মতো লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।

সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো বেপরোয়া গাড়ি চালানো। বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে অনেক সময় ঘুষ ও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়, ফলে অপেশাদার চালকরা রাস্তায় নামছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যানবাহনের ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং গাড়ির ওভারলোডিং।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতা। অপ্রশস্ত সড়ক, ফুটপাতহীন পথ, অপরিকল্পিত বাসস্ট্যান্ড ও মার্কেট এলাকায় যাত্রী ওঠানামা, সব মিলিয়ে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। এ ছাড়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগে শৈথিল্য দুর্ঘটনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনা কেবল একটি ব্যক্তির জীবন শেষ করে না, তার সঙ্গে একটি পরিবার ধ্বংস করে দেয়। দুর্ঘটনায় একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিহত বা পঙ্গু হলে তার পরিবারে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি একটি বড় ধাক্কা।

আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ক্ষতি হয় প্রতি বছর।

সড়ক দুর্ঘটনার সমাধানের পথ কোথায়? 
প্রথমত, চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদান ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে। একটি পেশাদার ও কঠোর ড্রাইভিং ট্রেনিং ও পরীক্ষার পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে। লাইসেন্স যেন সত্যিকারের যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয়, তা কঠোরভাবে মনিটর করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে যে আইন আছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল এবং কারাদণ্ডের বিধান কার্যকর করতে হবে।

তৃতীয়ত, গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে মালিক-শ্রমিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রতিযোগিতার নামে বাসচালকদের গতির প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক রুটে নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী বাস চালনা নিশ্চিত করতে হবে।

চতুর্থত, সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি। শহর ও গ্রামে সড়কের প্রশস্ততা, ইউটার্ন, স্পিডব্রেকার, ফুটওভারব্রিজ ও ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে হবে। পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জেব্রাক্রসিং ও ফুটপাতকে ব্যবহারযোগ্য ও বাধামুক্ত রাখতে হবে।

পঞ্চমত, সড়ক দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত ডেটাবেজ তৈরি ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে। কোথায় কোন ধরনের দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে, কোন সময়ে বেশি হচ্ছে, এসব তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।

আইন ও অবকাঠামো ছাড়াও জনগণের সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে ট্রাফিক সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেমিনার, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব। যাত্রীরা নিজেদের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল রাখতে শিখলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে।

আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, কিন্তু তা অসম্ভব নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনসম্পৃক্ততা। আমাদের সড়ক যেন মৃত্যুকূপ না হয়ে বরং নিরাপদ যাত্রার পথ হয়, এই প্রত্যাশাই সবসময় করি।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক