সম্প্রতি ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক অন্য এক পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা ও সংকট নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যম না যতটুকু তার থেকে কয়েক কাঠি এগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে কনস্টেবল কর্তৃক কনস্টেবল হত্যায় অনেকেই সন্তুষ্টির ঢেঁকুড় তুলেছে। এই যে পুলিশকে নিজের করে না ভাবা, পুলিশের দুঃসময়ে পাশে না থাকা, পুলিশকে মানসিকভাবে সমর্থন না করা ইত্যাদি বিষয়ে এক ধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশের মধ্যকার যেকোনো ধরনের নেতিবাচক সংবাদে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার একটি ব্যতিক্রমী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো পুলিশ সদস্যদেরও অজানা নয়। অথচ যখনই কোনো সংকটের মুখোমুখি হই কিংবা কোনোভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা আমাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে কেউ ক্রোক করে এবং অপরাধীদের দ্বারা কোনোরকম ভয়ভীতি প্রাপ্ত হলে আমরা তৎক্ষণাৎ পুলিশের দ্বারস্থ হই। তদুপরি পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচার ও সৃষ্টকরণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে।
খবরে জানা যায়; রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি পুলিশ কনস্টেবল কাওসার আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। কাওসারের স্ত্রী নিলুফারের ভাষ্যে; কাওসারের দুই সন্তান আছে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। সংসারে কোনো ঝামেলা বা কলহ ছিল না। তবে তিনি জানান, ‘কাওসারের মানসিক সমস্যা ছিল। রাঙামাটির বরকলে চাকরি করার সময় তিনি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত তিনবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল। নিয়মিত ওষুধও সেবন করতেন। কাওসারের কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে। সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। তবে চাকরি নিয়ে খুবই টেনশন করেন তিনি। ছয় ঘণ্টার ডিউটি আট ঘণ্টা হতো।’
ইংল্যান্ডে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন মানসিক সমস্যায় ভোগেন- গবেষণা জরিপে এমন তথ্যের আভাস পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ যেহেতু তাদের সদস্যদের মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেছে কিংবা উদ্যোগ নিয়েছে তাহলে সমস্যা-পরবর্তী সমাধানের আভাসও পাওয়া গেছে। ইংল্যান্ডের মতো দেশে; যে দেশে পুলিশ পাবলিকের একটি চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান, সেই দেশে পুলিশ সদস্যদের একটি বড় অংশের মানসিক সমস্যার উদাহরণ একটি বড় প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে আমাদের। বাংলাদেশ পুলিশ কি আদৌ তাদের সদস্যদের মানসিক অবস্থানকে তুলে ধরার কিংবা যাচাই করার কোনোরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে? অন্যান্য দেশে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে প্রত্যেক ইউনিটে আলাদা করে সেন্টার স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার বিষয়ে সেন্ট্রালি পুলিশ হাসপাতাল রয়েছে, যেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং ইউনিট কিংবা রেঞ্জভিত্তিক চিকিৎসা সেন্টার কিংবা ডাক্তারদের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার তেমন ব্যবস্থা নেই।
বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের চাকরিতে নানা রকমের চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তথাপি এ ধরনের পেশাগত চাপকে ব্যবহারিকভাবে প্রশমনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সঙ্গত কারণেই পেশাগত প্রতিকূলতার আকার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি অঘোষিত নেতিবাচকতাকে সব সময় পুলিশ সদস্যদের মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের পেশাগত চাপকে মোকাবিলা করতে বিশেষ ধরনের সাপোর্ট সেন্টার নেই। সাধারণত পুলিশ সদস্যরা যে ধরনের চাপকে মোকাবিলা করে থাকেন তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, পুলিশের চাকরিতে সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। সবসময়ই পুলিশকে সজাগ থাকতে হয়, কখন কোন নির্দেশনা চলে আসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে; এ ধরনের একটা তাড়না সবসময়ই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থাকে। আমরা সবাই জানি, জরুরি যেকোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের সব ধরনের ছুটিও বাতিল হয়ে যায়। পুলিশের মূল কাজই হচ্ছে জনসাধারণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং জনগণের সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া। জায়গা থেকে পুলিশে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সারা দেশে ঈদের ছুটিকে সামনে রেখে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং হলফ করে বলা যায়, এ ইউনিটের সদস্যদের অধিকাংশ ঈদের ছুটি থেকে দায়িত্বের কারণে বঞ্চিত হন।
দ্বিতীয়ত, সিনিয়র, জুনিয়র ও ব্যাচমেটদের সঙ্গে নানা বিষয়ে সম্পর্কের ঘাটতি একজন পুলিশ সদস্যের মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে থাকে। বিসিএস অফিসারদের মধ্যে এমন দেখা যায়, কোনো এক ব্যাচের কর্মকর্তা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন আবার ওই একই ব্যাচের কর্মকর্তা এখনো এসপি হতে পারেননি। এমন নজির ও উদাহরণ বাংলাদেশ পুলিশে রয়েছে। এ ব্যাপারগুলো একজন অফিসারকে মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে ফেলে রাখে, ফলে পুলিশিংসহ অন্যান্য কাজে তার একটি নমুনা পাওয়া যায়। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পদোন্নতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়গুলোকে সামনে রেখে একই ব্যাচের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, জুনিয়র বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বিশেষ করে ছুটি ও কর্মঘণ্টা ইত্যাদি বিষয়ে। উপরন্তু আলোচনার জায়গা থেকে ব্যাচভিত্তিক ও রেঞ্জভিত্তিক সুযোগ-সুবিধার রকমফেরের কারণে মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পুলিশের পারফরম্যান্স ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবান্বিত করে থাকে।
তৃতীয়ত, একঘেয়েমি কাজ। নিয়মিত একই কাজে অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিরক্তিবোধ চলে আসে। সে কারণেই কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এমনও দেখা যায়, কেউ সরাসরি পেট্রোল নিয়ে ব্যস্ত আবার অনেক পুলিশ সদস্য অফিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ আছেন একই রেঞ্জ কিংবা একই ইউনিটে দীর্ঘদিন কাজ করায় তার কাজের মান ও কাজের ধরনে উন্নতি না হয়ে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে আসছে। এ বিষয়গুলোকে সমন্বয়ে করে পোস্টি ও পদায়ন করা জরুরি, তা না হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের কাজের মানে তেমন তারতম্য দেখা যাবে না।
চতুর্থত, পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা। দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক ধারণার ব্যাপারটি পুলিশের মনে ও মগজে গেঁথে আছে এবং এ ব্যাপারগুলো পুলিশ কর্তৃক ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের হাজার ভালো কাজ থাকলেও নেতিবাচক কাজটিকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুলিশ একটি মানসিক অশান্তি নিয়ে দিনাতিপাত করে। বিপদে-আপদে পুলিশের সাহায্যের দ্বারস্থ হই এবং পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাই কিন্তু মূল্যায়নের সময় পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নিয়েই যেন আমরা মতামত দিয়ে থাকি। এ ব্যাপারগুলো পুলিশ সদস্যদের গোচরীভূত এবং দায়িত্ব পালনের সময় উল্লিখিত বিষয়গুলো তাদের ট্রমার মধ্যে রাখে, যা পারফরমেন্সে প্রভাব ফেলে।
পঞ্চমত, পদোন্নতি, বদলি ও পদকপ্রাপ্তিতে বৈষম্য ইত্যাদি কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। পদোন্নতি নিয়ে সংস্থাটির বাইরে সরাসরি কোনো সদস্য কথা না বললেও তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অভিমান বিরাজ করে। কমিউনিটিতে পরিচয় ও প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে দেয় পদোন্নতি সংক্রান্ত ইস্যুগুলো, সে কারণেই পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এ ব্যাপারগুলো সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পারিবারিক ও কর্মময় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
ষষ্ঠত, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে স্বাধীনতা হরণ করা হয়, এ ধারণা রয়েছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের। এ দোদুল্যমান অবস্থা থেকে পুলিশের অনেকেই বের হয়ে আসতে চান। পুলিশকে সংস্কারের ব্যাপারে প্রায় সবাই মতামত দেন। তথাপি কেন, কীসের জন্য পুলিশের সংস্কার আটকে গেছে, সেটি খুঁজে বের করে দ্রুততর সময়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে পুলিশের পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক হবে নিশ্চিতভাবেই। আমরা মনে করি ও বিশ্বাস রাখি, পুলিশকে যদি আমরা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারি তাহলে পুলিশের কাছ থেকে আরও ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করতে পারি। যেমনটি দেখেছিলাম করোনার সময়ে। সর্বোপরি পুলিশের সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করে সামনের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা অচিরেই সমাধান হয়ে আসবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]