ঢাকা ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪

ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৩ এএম
ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান
ফখরুল ইসলাম নোমানী

ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। ইসলাম পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীকে পুরুষের সমান অধিকারী করেছে ও অত্যন্ত সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছে। নবী করিম (সা.) স্বয়ং নারীদের শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। 

সমাজসভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ সমান। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নর-নারী, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব অথবা সাদা-কলোর কোনো পার্থক্য নেই। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান।

আদিম যুগ থেকেই নারী অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। সবদিক দেশে তার অধিকার আদায়ে তার মর্যাদায় তার স্বাধীনতা ও তার ক্ষমতায়নে। ইসলাম পূর্ব-যুগে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত উপেক্ষিত ও শোচনীয়। সমাজে নারীরা ছিল অপাঙ্‌ক্তেয়। তাদের মানুষরূপেই ভাবা হতো না। নারীরা ছিল পুরুষের লালসার শিকার, ভোগ্যপণ্য হিসেবে তাদের ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় পৌত্তলিক আরবে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। হিন্দুরা নারীকে সব পাপ, অন্যায় ও অপবিত্রতার কেন্দ্র বলে ঘৃণা করত। ইহুদিরা নারীকে সব পাপের মূল হিসেবে জানত। খ্রিষ্টানরা নারীকে নরকের কীট ও অকল্যাণের উৎস মনে করত। চীনে নারীদের দ্বারা লাঙল টানাতো। পাশের দেশ ভারতে হিন্দুরা নারীদের দাসীর মতো ব্যবহার করত এবং সতীদাহের মতো ঘৃণা প্রথা প্রচলিত ছিল। ঘোড়ার লোজের অগ্রভাগ নারীর চুল বেঁধে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো। ইসলাম পৃথিবীর বুক থেকে যাবতীয় অত্যাচার নির্যাতন ও অসমতা দূর করে। নারীকে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়েছে।

মানব জাতির ওইসব ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মুক্তির দিশারি ও শান্তির দূত হিসেবে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। নারী জাতির ওপর অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, শোচনীয় ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে পরিত্রাণ দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সমাজে নারী জাতির অবস্থান নিরূপণের জন্য পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন সুরা আননিসা। উক্ত সুরার প্রথমেই আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ জাতি তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দুজন থেকে অসংখ্য নর-নারী পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ শুধু সূরা আননিসা নয়। পবিত্র কোরানের অনেক সুরায় নারীর অধিকার ও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। 

আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের যেমন অংশ রয়েছে তেমনি নারীরও অংশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় বিভিন্নভাবে নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং নারীর মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি অধিকার দিয়েছেন। 

আল্লাহ্ বলেন, আমি তোমাদের কোনো কর্মী বা সহপাঠীর কাজ নষ্ট করি না। সে নারী হোক বা পুরুষ হোক। তোমরা পরস্পর এক। অন্য এক আয়াতে বলা হয়। ঈমানদার পুরুষ ও রমনীরা একে অপরের সহায়ক ও বন্ধু। তারা একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজের নিষেধ করবে। ইসলাম ধর্মে নারীর জীবনব্যবস্থা ও সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্ত্রী কন্যা মাতা ও ভগ্নী হিসেবে তার ব্যক্তিগত মর্যাদা অধিকার ও স্বাধীনতার সঙ্গে সামগ্রিক সব বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়ার কথাও বলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিটি বিষয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও উৎসাহিত করেছে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, বিশ্বে বহু অমূল্য সম্পদ রয়েছে। আর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে নেককার নারী। তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। ইসলাম স্ত্রী হিসেবে নারীকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। আল্লাহ্ বলেন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ করো। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যে বিয়ে করে সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে। ইসলাম নারীকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান দিয়েছে মা হিসেবে। মা হিসেবে ইসলাম নারীকে যে মহান মর্যাদায় আসীন করেছে তার নজির আর কোথাও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। 

তিনি আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। ঐতিহাসিক হজের ভাষণে তিনি বলেছেন ভ্রাতৃগণ শ্রবণ করো ইসলামে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। নারীদের প্রতি তোমরা সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমরা অন্যায় আচরণ করবে না।

ইসলাম ধর্ম প্রথম নারীর স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা এবং ভোগ-দখলের অখণ্ড অধিকার দিয়েছে নারীকে। মাবন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে অর্থনৈতিক অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কন্যা, স্ত্রী, বোন ও মাতা হিসেবে মুসলিম নারীর মিরাস বা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক পিতা ও স্বামী উভয়দিক থেকে উত্তরাধিকার লাভ করে তারা পেয়েছে মালিকানাস্বত্ব এবং তা স্বাধীনভাবে ব্যয় করার পূর্ণ অধিকার। ইসলাম নারীকে পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার দিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে মতামত প্রকাশ ও সমাজকল্যাণের যেকোনো কর্মকাণ্ডে নারীরা পুরুষের মতোই অংশগ্রহণ করতে পারবে। এই মর্মে হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, যোগ্যতানুসারে নারীরা প্রধান বিচারপতির পদও অলংকৃত করতে পারবে।

ইসলামে আরও উল্লেখ আছে নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োগ করা সম্পদ এবং লাভ একমাত্র তারই আওতাধীন। স্বামী কিংবা অভিভাবকদের এক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ চলবে না। যদি না স্বেচ্ছায় তা দান না করে। সুরা আন নিসার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। একজন পুরুষের যেমন অধিকার আছে নিজের পছন্দের কাউকে বেছে নেওয়ার তেমনটি নারীর জন্যও রয়েছে। ইসলাম বলেছে কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ দেওয়া আইনগত অপরাধ। বিবাহবিচ্ছেদ ও তালাকের ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন স্বামী তার অবাধ্য স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি অত্যাচারী অযোগ্য অকর্মন্য স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য একজন স্ত্রীরও তালাক দেওয়ার অধিকার আছে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মর্যাদা ও পারিবারিক সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদা লাভে সহায়তা করেছে ইসলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান সমাজব্যবস্থা নারীদের ইসলামের চোখে যেমন দেখে না তেমনি নারীকে বাজারের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যে কর্তব্য তা পালন করা হচ্ছে না। তাকে তার অধিকার দিচ্ছে না। দিন দিন প্রতিযোগিতা দিয়ে বেড়ে চলছে আমাদের গণমাধ্যমের সংখ্যা।

ইসলাম নারীকে সব ধরনের মর্যাদা যেমন দিয়েছে তেমনি দিয়েছে সংযত হওয়ার নির্দেশগুলো। কর্মক্ষেত্রে নারীর বাধা নেই ইসলামে তবে সেখানে তাকে চলতে হবে পর্দার মাঝে। রাস্তাঘাটে নারীকে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে উপস্থাপন করছে। এমনভাবে করছে যেন পণ্যের গুরুত্বের সঙ্গে নারীকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। যেখানে নারীর কোনো প্রয়োজন নেই সেখানেও নারীকে দেখাচ্ছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক পোশাকের ব্যবস্থা করছে যা আমাদের মুসলিম নারীদের জন্য শোভা পায় না। ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছে তবে পণ্য করেনি। বর্তমানে স্বাধীনতার নামে নারীকে পণ্যই বানাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো উপস্থাপক হিসেবে নারীকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। 

এটা নারীর জন্য ভালো। নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে কিন্তু তাই বলে সে উপস্থাপনায় অমুসলিম দেশকে অনুকরণ করা নারীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক ছাড়া চাকরি করা যাবে না বলে অনেক নারীকে চাকরি হারাতে হয় আবার অনেক নারী বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয় ইসলামের মর্যাদাকে ভুলে যেতে। নারীদের পর্দা নিয়ে কিছু বললেই বলা হয় নারীকে নারী ঘরে তুলতে বলা হচ্ছে। আসলে তা কিন্তু নয়। নারীকে কাজ করতে হবে তবে সেই ইসলামের পথ নির্দেশনা মেনে চলে। বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীর সাফল্য আসছে। তাই বলে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারও বেড়ে চলছে।

মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত ঘোষণা করে ইসলাম নারী জাতিকে সর্বোত্তম মর্যাদায় ভূষিত করেছে। যে মর্যাদা পুরুষকে দেওয়া হয়নি। ইসলামে একজন নারী একজন পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ও মর্যাদার অধিকারী। নারী তার নারীত্বের মর্যাদা বজায় রেখেই সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন। নারী ছাড়া অন্য কেউই মাতৃত্বের সেবা ও সহধর্মিণীর গঠনমূলক সহযোগী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়। মায়েদের ত্যাগ ও ভালোবাসা ছাড়া মানবীয় প্রতিভার বিকাশ ও সমাজের স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মায়েরাই সমাজের প্রধান ভিত্তি তথা পরিবারের প্রশান্তির উৎস। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলামই নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করে সেটি রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]

পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও আমাদের করণীয়

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ এএম
আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও আমাদের করণীয়
শফিকুল ইসলাম খোকন

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়, জন্ম হয় নতুন লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের পতাকা। স্বাধীনতা আমাদের অর্জিত সম্পদ, এ সম্পদ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে, এ সম্পদ টিকিয়ে রাখতে এর বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়ও রয়েছে অনেক। এ দেশে রয়েছে বহুমাত্রিক সম্ভাবনা, এর মধ্যে অন্যতম পর্যটনশিল্প।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। প্রচীনকাল থেকে মানুষ বিনোদন ও প্রকৃতির সৌন্দর্য পিয়াস মেটানোর জন্য রূপ-সুগন্ধে ভরা নৈসর্গিক প্রকৃতিতে অবগাহন করছে। বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের কাছে চিরসবুজে ঘেরা এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে পরিচিত। সপ্তম শতকে প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে এর সৌন্দর্যকে কুয়াশা ও পানি থেকে উন্মোচিত ঘুমন্ত সৌন্দর্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সভ্যতার একটি কেন্দ্র হিসেবে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এই দেশে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, বাগেরহাট, কুমিল্লা, সিলেট, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, পাবনাসহ প্রতিটি জেলা পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভ্রমণপিপাসা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে আয় প্রায় ৭৮ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৮ লাখ মানুষ। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। 

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। অথচ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫, তাইওয়ানের ৬৫, হংকংয়ের ৫৫, ফিলিপাইনের ৫০ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন অবদান রাখে ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপিতে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ অবদান। করোনার প্রবণতা কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছালে বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৩ সাল নাগাদ পর্যটনশিল্প থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন, যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হবে পর্যটনশিল্পের অবদান। পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল।
 
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর  ৪৩ অনুযায়ী বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বিপিসি) গোড়াপত্তন হয়। ১৯৯২ সালে প্রণিত জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সে নীতিমালা হালনাগাদ করে ২০১০ সালে আরও যুগোপযোগী করা হয়। নীতিমালার পঞ্চম অধ্যায়ে এর বাস্তবায়নে গৃহীত প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পর্যটন আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, ‘দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্নত পর্যটন সেবা প্রদান এবং পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি-বেসরকারি সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে নতুন ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং সময়ে সময়ে বিদ্যমান আইনগুলো হালনাগাদকরণ’। এর পর সাত বছর পার হলেও পর্যটন নীতি বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপটি উপেক্ষিতই থেকেছে। 

কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশে প্রত্যাশিত ও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। করোনাভাইরাস পর্যটনশিল্পকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বিধায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা। এমনকি ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষের আয়ের ওপর এবং চাকরি হারিয়েছে অনেক লোক। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পর্যটনশিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। 

দেশের সর্বদক্ষিণে বরগুনা একটি সম্ভাবনাময় জেলা। বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনঘেঁষা বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা নদী বেষ্টিত বরগুনা। বিষখালী ও বলেশ্বর নদে খোলা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝাউবন। দক্ষিণের খোলা বাতাস ঝাউবন স্পর্শ করে যাচ্ছে পরম আবেশে। বাতাসের ছোঁয়ায় প্রেমিকার উড়ন্ত চুলের মতো দুলছে ঝাউগাছগুলো। জন্ম থেকেই সমুদ্রের খোলা বাতাস গায়ে মেখে ঝাউগাছগুলো এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ আর ঝাউগাছ এ যেন দৃষ্টিনন্দন এক সৈকত! সমুদ্রের মৃদু ঢেউ, বালুময় দীর্ঘ সৈকত আর ঝাউবনের সবুজ সমীরণের এ দৃশ্যটি যেন প্রকৃতি প্রেমের একটি উদাহরণ। শুধু তাই নয় এ জেলায় রয়েছে শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত, সোনাকাটা ইকোপার্ক, হরিণঘার্টা, মোহনা পর্যটনকেন্দ্র, বিবিচিনি শাহী মসজিদ, বুকাবুনিয়া মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, তালতলী উপজেলার রাখাইন পল্লি, বেতাগী উপজেলার খ্রিষ্টান পল্লি, কাউমিয়া জমিদারবাড়ি, সিডর স্মৃতিস্তম্ভ, বিহঙ্গ দ্বীপ, নীলিমা পয়েন্ট, সুরঞ্জনা, জ্যোৎস্না উৎসব, ইলিশ উৎসব, এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে মুজিব অঙ্গন, ইলিশ চত্বর, বিউটি অব বরগুনা, টাউন হল সংলগ্ন অগ্নিঝরা একাত্তর, সার্কিট হাউস সংলগ্ন ইলিশ ফোয়ারাকেন্দ্রিক উন্মুক্ত ময়দান, এ ছাড়া রয়েছে পাথরঘাটায় দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, বিষখালী নদীর সাদের ইলিশ। প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে উপমহাদেশে একমাত্র জ্যোৎস্না উৎসব পালিত হয় প্রতি বছর এ জেলায়। একদিকে সীমাহীন সাগর; আরেক দিকে দীর্ঘ ঝাউবন, তিন তিনটি নদীর বিশাল জলমোহনা। সব মিলিয়ে নদনদী আর বনবনানীর এক অপরূপ সমাহার- শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতেই জ্যোৎস্না উৎসব পালিত হয়ে থাকে। 

এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কেমন জানি আমরা এখনো পর্যটন খাতে পিছিয়ে রয়েছি। এর কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আগে কারণ খুঁজে বের করা, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করা এবং ইচ্ছা, মনোবল শক্তিতে রূপান্তর করা। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির এ বিষয় কঠোর নির্দেশনা থাকতেও কেমন জানি এখনো আমরা পিছিয়ে রয়েছি। পর্যটকের উন্নত সেবার জন্য দক্ষ ও মার্জিত জনবলের অভাব, উন্নত ও দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব, ইলেকট্রনিক্স-প্রিন্ট মিডিয়া বাংলাদেশের পর্যটন অঞ্চলগুলোর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন না করা, প্রচার প্রয়োজন মতো না করা, পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন না করা, বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা, দক্ষ গাইডের অভাব, এ ছাড়া রয়েছে সামাজিক অনেক বাধা। অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৫ শতাংশ দখল করে আছে পর্যটনশিল্প। এই শিল্প আমাদের দেশের মানুষ ও ভ্রমণ করতে ১০ বার চিন্তা করে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্যই। দেশে একটু বিশৃঙ্খলা দেখলেই তো পর্যটক তো দূরের কথা অন্য দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলও পাঠাতে সে দেশ ভয় পায়। এই ভয়, সংশয় দূর করার জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাতেই হবে। কিন্তু বরগুনায় এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনো প্রকল্প এ খাতে দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের যেমন সদিচ্ছা থাকতে হবে তেমনি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও উদ্যোগ এবং ইচ্ছা থাকতে হবে। 

পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী এবং বরগুনা সদর, আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলাকে ঘিরে বিশেষ পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। ‘পায়রা বন্দরনগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ-পর্যটনভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’ নামে এই প্রকল্পটি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পরিকল্পনা কমিশন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। বরগুনার স্থানগুলোকে এক্সক্লুসিভ পর্যটন কেন্দ্র করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সোনার চরের ২০ হাজার ২৬ হেক্টর বিস্তৃত বনভূমিসহ ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতজুড়ে গড়ে তোলা হবে এক্সক্লুসিভ পর্যটনকেন্দ্র। এজন্য ‘প্রিপারেশন অব পায়রা-কুয়াকাটা রিজিওনাল প্ল্যান’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার।  মূলত কুয়াকাটা, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলার সমন্বয়ে পর্যটন জোন স্থাপন করা হবে। এর লক্ষ্যে চলতি সময় থেকে শুরু করে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চলবে সার্ভের কাজ। সরকার থেকে এতকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও বাস্তবে কতটুকু হচ্ছে এটিও প্রশ্নবিদ্ধ। এ জন্য শুধু সরকারই নয়, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদেরও মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। সরকারের উদ্যোগে কোনো ত্রুটি থাকলে জনগণের এগিয়ে আসতে হবে। 

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উল্লিখিত পর্যটন প্রসার প্রয়োজন। অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে সমবায় পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড পর্যটন আরও সম্প্রসারিত হবে। এ ছাড়া গ্রামের মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, একতা, সাম্য বৃদ্ধি পাবে যা বর্তমানে চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সহযোগিতা করবে এবং বাস্তবায়িত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। এভাবেই নবদিগন্তে ভোরের সূর্যের প্রজ্বলিত শিখার মতো আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো প্রচারণা চালাতে হবে। বিশ্বের যতগুলো দেশে বাংলাদেশ বিমানসহ আমাদের দেশের প্রাইভেট বিমানগুলো যাতায়াত করে সেসব দেশে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ প্যাকেজ কর্মসূচি গ্রহণ করে কার্যকরী ব্যবস্থাও পর্যটনশিল্প বিকাশে অনেক অগ্রগতি হবে। পর্যটনশিল্প বিকাশে সুষ্ঠু ও যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, পর্যটন করপোরেশনকে অধিকতর কার্যকরও দক্ষ প্রতিষ্ঠানের রূপান্তর করা, বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে চাহিদা অনুসারে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, প্রয়োজনে ফরেন জোন গড়ে তোলা। স্থানীয় পর্যায় উদ্যোক্তাদের উদ্ভুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়াসহ পর্যটনশিল্পকে আরও প্রসারিত করতে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বলয় রাখা, অবকাশ যাপনের জন্য হোটেল ও মোটেলগুলোতে প্যাকেজ কর্মসূচি রাখা, হোটেলগুলোতে পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা ও গাইডের ব্যবস্থা রাখা‬, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক-অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, পর্যটন কেন্দ্রগুলোর স্থির চিত্রের প্রয়োজনীয় দৃশ্য স্থির প্রদর্শনী রাখা ইত্যাদি।

পর্যটনশিল্প বিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের কপালে জ্বল জ্বল করছে। এখন এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলে এ শিল্প এখানে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশে পর্যটনের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগই একমাত্র উদ্যোগ। সরকার বা সরকারি উদ্যোগের সীমাবদ্ধতার কথা সব ক্ষেত্রেই আমাদের শোনা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। তাই পর্যটনে কিছু বৈচিত্র্য ও সুযোগ সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিভৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলাসহ সুযোগসুবিধা সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিভৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলাসহ সুযোগসুবিধা সৃষ্টি করার কথা আমরা বলেছি।

পরিশেষে বলতে চাই, এ দেশটি আমাদের, এ দেশ সবার। এ দেশে আমাদেরই রক্ষা করতে হবে, তেমনি দেশের পর্যটনশিল্পকে আমাদেরই টিকিয়ে রাখতে হবে এর বিকাশ ও বহুমাত্রিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে একটি সুন্দর দেশ হিসেবে পরিচিত করি, একটি পর্যটন দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করি। 

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:১৯ পিএম
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়
মো. নূরন নবী

শিশুরা আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন। অনাগত দিনের নতুন ইতিহাস। এরা বড় হবে। এরা ফুলের মতো বিকশিত হবে। জন্ম-মুহূর্ত থেকে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই পথপ্রান্তে কত শিশু নিঃশব্দে অকালে ঝরে যায়। ওদের জীবনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য চাই যথার্থ পরিবেশ, চাই স্বহৃদয় মানসিকতা, চাই মাতৃস্নেহের পরিচর্চা। আর এই পরিচর্চার জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা আর এই শিক্ষা অর্জনের মৌলিক ভিত্তি তৈরির স্থানগুলো হলো প্রাথমিক শিক্ষা। যা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই হতেখড়ি হয়ে থাকে।

প্রাথমিক শিক্ষা যে দেশে যত সুষ্ঠুভাবে দেওয়া হয় সে দেশ তত উন্নত। তাই দেশের সঠিক উন্নয়নের জন্য সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থী নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসায় মূল ধারা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশ অভিভাবক অসচেতন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং শিক্ষার্থীদের শিশুশ্রমের প্রতি আগ্রহী। এসব শিক্ষার্থীর বাড়িতে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব।

তাছাড়া অনেক অভিভাবকের ধারণা, পড়ালেখা করে গরিব মানুষের সন্তানের চাকরি পাওয়া কঠিন। শিক্ষার গুরুত্ব বা সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার শক্তিও এসব অভিভাবকের নেই। এসব শিক্ষার্থীর পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস সম্বন্ধে পুরোপুরি ধারণা করতে হলে বাস্তব কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

ক) প্রথমে শ্রেণি শিক্ষক দৈনিক শ্রেণি কার্যক্রম শেষে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রস্তুত করবেন।

খ) তার পর সেই শিক্ষক তালিকা অনুযায়ী মোবাইলের মাধ্যমে অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খোঁজখবর নেবেন এবং শ্রেণিপাঠের কার্যক্রম সম্পর্কে অভিহিত করবেন।

গ) প্রতি বৃহস্পতিবার এসব শিক্ষার্থীর পড়ালেখার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান শিক্ষককে অভিহিত করবেন। ফলে এসব শিক্ষার্থী এক সময় পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী হবে এবং বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হবে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার শূন্যের কোটায় চলে আসবে। 

ঘ) এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টার অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে বরাদ্দ ব্যবস্থা করবেন।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান:
সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে সব শিক্ষার্থীকে অর্থাৎ শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে বন্ধুসূলভ আচরণ করবে এবং অভিভাবকদের পড়ালেখার গুরুত্ব অনুধাবন করাতে সচেষ্ট হবেন। এ ক্ষেত্রে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় অভিভাবক বাড়িতে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরি করবেন এবং শিক্ষকের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থী বাড়িতে পড়ালেখা করবে। ফলে শিক্ষার্থীর মাঝে পড়ালেখার আগ্রহ সৃষ্টি হবে, বিদ্যালয়ভীতি দূর হবে এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসবে। ফলে শতভাগ উপস্থিতির দিকে বিদ্যালয় অগ্রসর হবে। আর তখনই মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন হবে।

বাস্তবায়নে সুফল:
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি একটি বিরাট সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ও অনগ্রসর এলাকায় এ সমস্যা খুব বেশি দেখা যায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিট ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। শিক্ষক সঠিক উপায়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় যখন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত, কেন অনুপস্থিত, কবে উপস্থিত হবে এ বিষয় অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবেন এবং দৈনিক পাঠ সম্পর্কে শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ দেবেন। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে, বিদ্যালয়ভীতি দূর হবে, নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসবে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কও দৃঢ় হবে এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে।

মো. নূরন নবী: উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার

পোশাকশ্রমিকরা আর কত দিন রাস্তা অবরোধ করবেন

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৭ এএম
পোশাকশ্রমিকরা আর কত দিন রাস্তা অবরোধ করবেন
দীপংকর গৌতম

পোশাক খাত আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো শক্ত না হওয়া ও পুঁজির অসম বিকাশের মধ্য দিয়ে গ্রামের অজস্রর পেশা হারিয়ে গেলে পোশাক কারখানায় ঢুকে জীবন রক্ষা করেন। পোশাকশ্রমিকদের বেতন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম বলে এখানে পোশাক ব্যবসায় লাভ বেশি। ফলে দেশের টঙ্গী, গাজীপুর, আশুলিয়া, জিরাবো, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পোশাক কারখানা।

ভোর হতেই দেখা যায় লাঞ্চবক্স হাতে জোরপায়ে হেঁটে চলেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক সেলাই দিদিমনি ও ভাইয়েরা। উদয়াস্ত পরিশ্রম তো করেনই। তার পর বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে হয়। এর পর গার্মেন্টসে কাজের পরিবেশ কেমন সেটা বোধকরি গণমাধ্যমের সুবাদে সবার জানা। এক্ষেত্রে তাজরীন বা রানা প্লাজার কথা বললেই বোঝা যাবে যে, সরু সিঁড়ি, কলাপসিবল গেট এমন করে তালা দেওয়া থাকে এখান থেকে লাফিয়ে পড়ারও কায়দা নেই। অধিকাংশ গার্মেন্টসেই কাজ করার উপযোগী পরিবেশ নেই। এর পর বেতন তো আরেক বিড়ম্বনা। যে বেতন পান তা ঢাকায় ভালোভাবে বসবাসের উপযোগী না। তার পরও সে বেতন নিয়মিত না। এ অবস্থা অধিকাংশ গার্মেন্টসের।

২০২৩ সালে বেশ কিছুদিন গার্মেন্টসশিল্পে অস্থিরতা চলে। ওই বছরের নভেম্বরে ন্যূনতম মজুরি ইস্যুতে আন্দোলন চলাকালীন শতাধিক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই শিল্পের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি মোটাদাগে সামনে আসে। সে সময় পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ ও গ্রেডের সংখ্যা সাত থেকে কমিয়ে পাঁচে কমিয়ে এনে গেজেট প্রকাশ করে তৎকালীন সরকার। সরকার কর্তৃক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হওয়ার পর অসন্তোষ থাকলেও ধীরে ধীরে কাজে ফিরতে শুরু করেন শ্রমিকরা। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে (ডিসেম্বর মাসের বেতনে) ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠান সেটি আমলে নেয়নি বলেও সময় সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছিল।

কোনো কোনো মালিক জানিয়েছিল তারা নতুন কাঠামোতে বেতন দিতে পারবে না। ফলে নতুন করে শুরু হতে থাকে আন্দোলন। আন্দোলন চলতে থাকলে সেটা বন্ধের বড় ওষুধ হলো গার্মেন্টস বন্ধ রাখা। গার্মেন্টস কেন বন্ধ রাখা হয়? গার্মেন্টস মালিকরা টাকা পায় ডলারে। ১ ডলার সমান ১২০ টাকা। তাদের কারখানা এক মাস বন্ধ রাখলে কিছু যায় আসে না। কিন্তু শ্রমিকরা এক মাস কাজ না করলে খাবেন কী? এ অঙ্ক সরল অঙ্ক। তার পরও মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করে সেটা নজিরবিহীন।

অল্পদিনে অজস্র টাকার মালিক বনে যাওয়া গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের শ্রম শোষণ না করে চলতেই পারে না। এবার বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ ছিল, ধীরে ধীরে অনেক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এখনো আন্দোলন চলছে। গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। ওই মহাসড়কের উভয় পাশে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে যাত্রী, চালক ও স্থানীয়রা দুর্ভোগে পড়েছেন।

গত রবিবার সকাল ৮টা থেকে জয়দেবপুর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকায় মণ্ডল ইন্টিমেন্টস নামে ওই কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ ছাড়া গাজীপুর মহানগরীর খাইলকুর এলাকার এমএম ফ্যাশন অ্যান্ড কম্পোজিট লিমিটিড, টঙ্গী পশ্চিম থানার খাঁ পাড়া সড়কের সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেড পোশাক কারখানা, সাতাইশ বাগানবাড়ি এলাকায় অবস্থিত প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করছেন। শ্রমিকদের দাবিগুলো হলো হাজিরা বোনাস ১ হাজার টাকা করতে হবে, নাইট বিল ১০০ টাকা, কারখানায় মোবাইল নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে, অর্ধ বেলা ছুটি অথবা দুই ঘণ্টা গেট পাস নিলে হাজিরা বোনাস কাটা যাবে না, অসুস্থ হলে কারখানার মেডিকেল সেন্টারে বিশ্রামে না রেখে ছুটি দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে তারা অবরোধ করে।

মণ্ডল ইন্টিমেন্টস কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকরা বলেন, ‘আশপাশের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে তাদের দাবি পূরণ করে নিয়েছেন। আমরা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি জানিয়ে আসলেও তারা তা পূরণে উদাসীন। তাই আমরা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছি।’

গত ২২ সেপ্টেম্বর শ্রমিকরা কারখানার সামনে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং যাত্রী, সাধারণ মানুষ ও চালকরা ভোগান্তিতে পড়েন। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ, জয়দেবপুর থানা পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত রয়েছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র গাজীপুর জেলা সভাপতি জিয়াউল কবীর খোকনের সঙ্গে আন্দোলন প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ‘কারখানায় প্রবেশে যেসব শ্রমিক দেরি করেন না এবং নিয়মিত কাজ করেন, তাদের প্রতি মাসে ৭৫০ টাকা অতিরিক্ত হাজিরা বোনাস দিচ্ছে বিভিন্ন পোশাক কারখানা। আমি মনে করি, এটি শ্রমিকদের অধিকার এবং যৌক্তিক দাবি।’

গাজীপুর শিল্পপুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন জানান, গত রবিবার সকাল ৮টা থেকে গাজীপুর মহানগরীর খাইলকুর এলাকার এমএম ফ্যাশন অ্যান্ড কম্পোজিট লিমিটিডের তিন শতাধিক শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করেন। আধ ঘণ্টা পর থেকে তারা আগস্ট মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে উৎপাদন কাজ বন্ধ করে কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করছেন। মালিক পক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা চলছে।

একই সময়ে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পশ্চিম থানা খাঁ পাড়া সড়কের সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেড নামে পোশাক কারখানার ১৫০০ শ্রমিক জুলাই মাসের অর্ধেক বেতনের দাবিতে উৎপাদন কাজ বন্ধ করে কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করছেন। আন্দোলন চলছে। সড়কে দীর্ঘ সময়ের যানজটে জনগণের ভোগান্তির কথা বললে, গার্মেস্টস কর্মী নিপা চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘৪-৫ ঘণ্টা গাড়িতে বসলে আপনাগোর ভোগান্তি অয়। আর আমার বাচ্চা যখন দিনভর খাওনের জন্য কান্দে হেইডারে ভোগান্তি মনে হয় না?’

গার্মেন্টস শ্রমিকদের এই আন্দোলন সারা বছরই চলে। ঈদের আগেও তাদের রাস্তা বন্ধ করে বসতে হয় বেতন-বোনাসের দাবিতে। কোনো গার্মেন্টস মালিকের এই টাকা দিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তার পরও মালিক বলে কথা। তাদের হিসাব আর আমাদের হিসাব মিলবে না। মালিক সবসময় মালিক। আর আমরা সবাই শ্রমিক। হিসাব তাই মেলে না। কিন্তু শ্রমিকদের রাস্তায় বসা বন্ধ করতে বোধ করি মালিকদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। সেই সদিচ্ছা কবে হবে? শ্রমিকদের কারখানা, পরিবার-পরিজন রেখে আর কত দিন রাস্তা অবরোধ করে রাখতে হবে?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল

পুলিশ কাজে ফিরবে, পুলিশ কাজে ফিরবে না

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ পিএম
পুলিশ কাজে ফিরবে, পুলিশ কাজে ফিরবে না
তানজির কচি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর দেশে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাড়ছে পরিবর্তনের প্রত্যাশাও। সরকারি-বেসরকারি নানা দপ্তরে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে চলছে দেনদরবার। দাবি আদায়ে সোচ্চার সাধারণ মানুষ থেকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাও। অফিসগুলোয় এখনো স্বাভাবিক ছন্দ ফেরেনি। টুকটাক কাজ চললেও অনেক জায়গায় বিরাজ করছে স্থবিরতা। বিষয়গুলো নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক উপদেষ্টাও। স্বাভাবিকতা ফেরানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চললেও সফলতার হারও খুবই কম।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। স্থবিরতা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে বাংলাদেশ পুলিশকে। এর উপযুক্ত কারণও রয়েছে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক সরকারেরই বাজে ব্যবহারের শিকার হয়েছে পুলিশ। ফলস্বরূপ অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে শুরু করে অপেশাদারত্বের সর্বোচ্চ রূপ আমরা দেখেছি। দেখেছি দলীয়করণের বিরল দৃষ্টান্ত, পুলিশকে রাজনৈতিক লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করতে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা সরকার পুলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ গণশত্রু বনে যায়। পুলিশের গুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। আবার এই আন্দোলনকে ঘিরেই প্রাণ দিতে হয় পুলিশের অসংখ্য সদস্যকে। দেশের অসংখ্য থানা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুট হয় পুলিশের অস্ত্র-গুলি-সম্পদ। পালিয়ে জীবন রক্ষা করে পুলিশ সদস্যরা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতা নিহতের সংখ্যা নিরূপণে কাজ করা হলেও পুলিশের মৃত্যুর সংখ্যা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। আদৌ এ নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে কি না, জানি না। 

সরকার পতনের পর কর্মবিরতিতে যায় পুলিশ সদস্যরা। পুলিশে সংস্কারের দাবি নিয়ে তাদের এই আন্দোলন চলে বেশ কিছুদিন। কয়েক দফা প্রচেষ্টা চালানোর পর পুলিশ সদস্যরা থানায় ফেরে। কিন্তু অদ্যাবধি স্থবির হয়ে আছে এ বাহিনী। 

মাঝে পুলিশ সক্রিয় নানা থাকায় আমরা নানা অরাজকতা দেখেছি। যা চলছে এখনো। ফলস্বরূপ যে জনতা পুলিশকে গণশত্রু বলেছে, তারাই পুলিশকে দ্রুত সক্রিয় করার দাবি তুলছে। 

এখন প্রশ্ন পুলিশ পুরোদমে কাজে নামছে না কেন? কেনইবা কাটছে না স্থবিরতা? 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অন্তত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। ১. পুলিশকে আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গণশত্রুতে পরিণত করা, ২. সরকার পতনের আগে পরে পুলিশের অসংখ্য সদস্যের প্রাণহানি ও ৩. রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে আইজিপির নামে অসংখ্য মামলা। 

রাজপথে বিরোধীদের লাঠিপেটা করবে পুলিশ, প্রাণ দেবে পুলিশ, মামলা খাবে পুলিশ আর ফল নেবে সরকার- এটা তো হতে পারে না। এজন্যই তাদের পুলিশ সংস্কারের প্রথম দাবি ‘পুলিশকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বাহিনীতে রূপান্তর’ এর দাবিটি অত্যন্ত যৌক্তিক। এই দাবি পূরণ না হলে তো তাদের মাঠেই নামার কথা নয়। 

আবার ৫ আগস্টের পর পুলিশ সদস্যদের নামে যে ধারাবাহিক মামলা হচ্ছে, এই মামলা ঘাড়ে নিয়ে কাজে ফিরতে তারা কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, তাও ভাবার বিষয়। 

সরকারের উপদেষ্টারা তাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা না করে বরং এখনো প্রকাশ্যে বিষোদগার করছেন। দায়িত্বশীলরা যদি পুলিশকে গালি দিতেই থাকে, তবে সাধারণ মানুষ কেন পুলিশের কথা শুনবে বা পুলিশকে মানবে? এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। পুলিশ অ্যাকশন নিলে তা এক পক্ষের বিরুদ্ধেই যাবে। দোষী হলেও সেই পক্ষ সংক্ষুব্ধ হবে, এটা তো আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। 

এই প্রসঙ্গে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদের কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই। সংবাদটির শিরোনাম ছিল “পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন ‘অ্যাকশনে’ যেতে, বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার।” প্রকাশিত ওই সংবাদের বিষয়বস্তু হলো, রবিবার কাকরাইলের অডিট ভবনের সামনের সড়কটি অবরোধ করে রেখেছিলেন বাংলাদেশের মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীন ১৫০ থেকে ২০০ অডিটর। তাদের দাবি, ১১তম গ্রেড থেকে তাদের পদকে দশম গ্রেডে উন্নীত করতে হবে। আন্দোলনরত অডিটরদের অবরোধ তুলে নিয়ে সড়কের এক পাশে অবস্থান নিতে পুলিশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারা শোনেননি। একপর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সড়ক থেকে আন্দোলনকারীদের সরাতে ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি নিয়ে পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু অধস্তন সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে দাঁড়িয়ে থাকেন। 

এ থেকে আরেকটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়। তা হলো- পুলিশ সদস্যরা আন্দোলন দমনের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে ঠিক করেছে কি না কিংবা এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের আসলে কী করা উচিত। 

এ প্রসঙ্গে আরও একটি সংবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আজকের পত্রিকার ১০ সেপ্টেম্বরের ওই খবরটির শিরোনাম ছিল ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বেআইনি আদেশ মানা যাবে না: র‌্যাবকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।’ আসলে কোন আদেশ আইনি আর কোনটি বেআইনি এটা পরিমাপের সুযোগ পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যদের আছে কি না। থাকলে সেই পরিমাপক কী? আর যদি আদেশ বেআইনি হয়, তাহলেও বা অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের করণীয় কী? 

এবার আসা যাক পুলিশের সেলফ ডিফেন্স প্রসঙ্গে। জুলাই-আগস্টে যা ঘটেছে আমরা সবাই দেখেছি। এখন আদেশ আইনি হলেও অ্যাকশনে যাওয়ার পর পুলিশের সেলফ ডিফেন্স পলিসি কী হবে? এটাও বড় প্রশ্ন। 

ইউনূস, খালেদা বা হাসিনা- ক্ষমতায় যেই থাকুক এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে পুলিশে যেমন স্থবিরতা কাটবে না, তেমনি পেশাদার দেশপ্রেমিক পুলিশও আমরা পাব না বা পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন তারা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছেন কি না। 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও সমালোচক

এস আলম গ্রুপকে সরকারের সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:২৪ এএম
আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৭ এএম
এস আলম গ্রুপকে সরকারের সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন
নেছার আহমদ

হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অনন্য ভৌগলিক নগরীর নাম চট্টগ্রাম। প্রাচ্যের রানিখ্যাত চট্টগ্রাম সুপ্রাচীনকাল থেকে ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। শিল্প ও বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাণিজ্যনগরী বা শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত পাওয়ার নেপথ্যে আদিকাল থেকে বন্দর ও পোতাশ্রয়ের সুবাধে আরব, ইউরোপীয়, চাইনিজ, আফ্রো-এশিয়ান বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশে চট্টগ্রামকে প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে হাজার বছর ধরে চট্টগ্রামের অধিবাসীরা সওদাগর বা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সেই সুনামের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে জন্ম নিয়েছে কিংবদন্তিসম সওদাগর, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা। মেধা ও দক্ষতায় তাদের ব্যবসার পরিধি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভৌগলিক অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে ব্রিটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বৃহৎ শিল্পকারখানা যেমন- ইস্পাত, মোটরগাড়ি, পাট, বস্ত্র, সুতা, তামাক, ম্যাচ, ওষুধ ইত্যাদি চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে। বাঙালি মালিকানাধীন প্রধান ব্যাংক ও বিমার দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছিল। ষাটের দশকে মুষ্টিমেয় যে কজন বাঙালি উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে এ কে খান, মীর্জা আবু ও এস আর সিদ্দিকী ছিলেন চট্টগ্রামের লোক। বর্তমান সময়ে তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ যেমন- এ কে খান, ইলিয়াছ ব্রাদার্স, আলহাজ খলিলুর রহমানের কেডিএস গ্রুপ, আখতারুজ্জামান চৌধুরী, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপসহ বহু শিল্প গ্রুপ স্বমহিমায় তাদের শিল্পের প্রসার ঘটিয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামের এ উন্নয়ন ও আলোকিত অধ্যায়কে স্বার্থন্বেষী মহল কখনো ভালো চোখে দেখেনি। সেই পাকিস্তান শাসনামল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত তাদের ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা বারবার চট্টগ্রামকে সব পর্যায় থেকে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাদের সাফল্য তাদের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। ছলে বলে কৌশলে ও প্রচারণায় চট্টগ্রামের শিল্পমালিকদের হেয় করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বর্তমান সময়েও এর ব্যতিক্রম নয়।

দেশের একটি স্বনামধন্য পত্রিকা নিয়মিতভাবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের চরিত্র হরণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমন কোনো চটকদার কাহিনি নেই যা তারা তৈরি করেনি। তাদের ভাষা দেখলেই বোঝা যায় হিংসা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা কত নিলর্জ্জ হতে পারে! প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের প্রধান শিকার বর্তমান সময়ের চট্টগ্রামের স্বনামধণ্য শিল্প গ্রুপ এবং সাধারণ মানুষের ত্রাণকর্তা এস আলম গ্রুপ এবং এই গ্রুপের কর্ণধার ‘সাইফুল ইসলাম মাসুদ’-এর কথা বলার চেষ্টা করছি। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার দৃষ্টিতে যা দেখছি দেশবাসীর সম্মুখে তা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আশির দশকে পরিবহন ব্যবসা দিয়ে যাত্রা শুরু করা এস আলম গ্রুপ আজ হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা সফলভাবে পরিচালনা করেছে, নিজেও একাধিক ব্যাংকের মালিক হয়ে সেগুলোকে ব্যবসার জন্য ব্যবহার করেছে। আজ পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেছে, ঋণ খেলাপি হয়নি কখনো। দেশের সংবাদ মাধ্যমে তাকে দোষারোপ করা হচ্ছে বিদেশে টাকা পাচার করার অপবাদে। বিদেশে বিনিয়োগ নাকি ষড়যন্ত্র? বিদেশে ব্যবসা করা মানে বিদেশে টাকা পাচার? এস আলম বৈধভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায় হাত বাড়িয়েছে। বিদেশিরা যেমন এ দেশে বিনিয়োগ করেছে। তেমনি এস আলমও বিদেশে বিনিয়োগ করেছে। এতে দোষের কী থাকতে পারে? এতে যদি কোনো অসংগতি থাকে বা কোনো অনিয়ম থাকে সরকার তা সংশোধন করতেই পারে। কিন্তু এখন প্রতিনিয়ত যা হচ্ছে তা এক ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক এবং ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমণ, যা দেশের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের সব বিবেকবান মানুষের কাছে আবেদন, দল-মতনির্বিশেষে এস আলম গ্রুপকে রক্ষা করার জন্য সোচ্চার হন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ আবেদন করতে বাধ্য হচ্ছি। আজ এ সময়ে এটা কেবল এস আলমের একার লড়াই নয়, এটা আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ লড়াই। একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে বেশি সময় লাগে না, কিন্তু গড়ে তুলতে লাগে বছরের পর বছর। এস আলমের এই দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত অর্জনকে এক নিমেষে শেষ হতে দেওয়া যায় না। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে এস আলম গ্রুপকে রক্ষা করি, তাদের পাশে দাঁড়াই। আমাদের মানবিক দায়িত্ব কেবল এই শিল্প গ্রুপকে রক্ষা করাই নয়, বরং আমাদের প্রাচ্যের রানি চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক ঐতিহ্যকেও রক্ষা করা। দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করা, আসুন, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চট্টগ্রামবিরোধী এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। আমাদের জাতীয় স্বার্থে এবং চট্টগ্রামের বৃহত্তর কল্যাণে এস আলম শিল্প গ্রুপকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষায় আমাদের দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটি একটি মহাবিপদের সময়। লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এখন সময়ের দাবি। এস আলম শিল্প গ্রুপ দেশি-বিদেশি মহলে একটি গৌরবের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আজ সেই প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বিদ্বেষী কূটকৌশলে দেউলিয়া হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে এস আলমকে বাঁচাতে দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি এবং প্রকৃত সত্য জানার ও অনুধাবন করার অনুরোধ করছি। 

এস আলম গ্রুপ দীর্ঘ সময় ধরে তিলে তিলে শ্রম, মেধা এবং সৃজনশীলতায় আজকের এই অবস্থানে এসেছে। কারোর দয়ায় নয়। কোনো না কোনো কারণে আজ এটি ষড়যন্ত্রের শিকার। লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য এই গ্রুপের সঙ্গে জড়িত, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। যেখানে আমরা এখনো শতভাগ বেকারত্ব দূর করতে পারিনি, সেখানে এস আলমকে দেউলিয়া করে লাখ লাখ কর্মরত মানুষকে বেকার করার অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আজ এ ষড়যন্ত্র শুধু এস আলমের বিরুদ্ধে নয়, এই ষড়যন্ত্র চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে, চট্টগ্রামের উন্নয়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ।

এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে লাগামহীন ষড়যন্ত্রের কারণ কী হতে পারে? বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে এস আলমের ব্যবসা ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র চলছে। এ কাজে তারা একশ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। এ ধরনের শত্রুতা এবং অপরিণত ব্যবসায়িক কৌশলগুলো তাদের এই ষড়যন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি।

এ গ্রুপের অতুলনীয় ধারাবাহিক সাফল্য এবং তাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব একশ্রেণির চট্টগ্রাম বিদ্বেষী মহলকে অসন্তুষ্ট করেছে। তারা মনে করে এস আলম গ্রুপের সাফল্য তাদের স্বার্থসিদ্ধির পথে বাধা।

এর পেছনে রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। অনেক সময় একটি সফল প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাব এবং চাপ প্রয়োগ করে তার স্বার্থবিরোধী কাজ করানোর চেষ্টা করা হয়। বিরোধীদের স্বার্থ রক্ষা এবং দেশের কিছু প্রভাবশালী মহল তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এস আলম গ্রুপকে ধ্বংস করতে চাইছে। এ ষড়যন্ত্র আওয়ামী সরকারের সময় হতেই শুরু। এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা এবং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে রাখা।

বর্তমানে দেশ ও জনগণের স্বার্থে গণসমর্থন গড়ে তোলা জরুরি। এ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশনে ও লেখার মাধ্যমে দেশবাসীকে সত্য বিষয় জানিয়ে এস আলম গ্রুপের পক্ষে জনগণের সমর্থন দেশের অর্থনীতির স্বার্থে গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যও অত্যাবশ্যক।

একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, এস আলমের ঋণের চেয়েও বিনিয়োগ বেশি।

ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার পঞ্চম টাইগার অর্থনীতি হিসেবে বিবেচিত। যদিও এটি বর্তমানে অবাস্তব শোনাতে পারে, কয়েক দশক আগে এমনকি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিকে বিশ্বমঞ্চে একটি ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিশাপকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩৮ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্রুপটির অবদান ছাড়া বাংলাদেশের এই অসামান্য সাফল্য সম্ভব ছিল না। আগেই বলেছি, চট্টগ্রাম বন্দর শহরভিত্তিক অন্যতম বৃহৎ শিল্প সংগঠন এস আলম গ্রুপ।

এই গ্রুপটি ১৯৮৫ সাল থেকে ৩৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে তার দীর্ঘ যাত্রায় প্রয়োজনীয় পণ্য, বিদ্যুৎ খাত, আমদানি ও পরিশোধন, অর্থনৈতিক অঞ্চল, স্বাস্থ্য, টেক্সটাইল, আইটি এবং অন্যান্য ব্যবসা স্থাপনে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। 

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড গুগল এবং দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের গুগল নিজউ চ্যানেলের তথ্যমতে, এ শিল্পগ্রুপের উদ্যোগের ফলে ২ লাখেরও বেশি মানুষ সরাসরি চাকরি পেয়েছে ছয়টি ভোজ্য তেল ও দুটি চিনি শোধনাগারের মাধ্যমে অধিকাংশ দেশীয় তেল, গম ও চিনির চাহিদা পূরণ করে আসছে। দেশীয় ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য সরকারের হাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দেশের বাজারে চিনি, গম, ছোলা, পেঁয়াজ, তেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও প্রক্রিয়াকরণের অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে।

পরিসংখ্যানুযায়ী ২০২৩ সালে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন চিনি আমদানি করেছিল সংস্থাটি, মূল্য ৪৯ কোটি ডলার। গত তিন বছরে (২০২০, ২০২২, ২০২১) চিনি আমদানির পরিমাণ ১৪ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন, যার মূল্য ৮২ কোটি ৬১ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ ডলার।

পাশাপাশি গত বছর ৫ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছে, যার মূল্য ১৪ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। তিন বছরের পরিসংখ্যানে (২০২০, ২০২২, ২০২১) আমদানিকৃত গমের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১০ হাজার টন মূল্যের ৪৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

২০২৩ সালের পাম ও সয়াবিন তেলের মোট আমাদিন ছিল প্রায় ৩ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন, যেখানে পাম তেল ছিল প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন এবং সয়াবিন তেল ছিল প্রায় ৩৬ থো স্যান্ড ৭০০ মেট্রিক টন। এর আর্থিক বাজারমূল্য ছিল পাম তেলের জন্য প্রায় ২৫ কোটি ৯১ লাখ ৪৭ হাজার ১৫২ ডলার এবং সয়াবিন তেলের জন্য ৪ কোটি ১৯ লাখ ১ হাজার ৭২ ডলার। গত তিন বছরে (২০২০, ২০২২, ২০২১) মোট তেল আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১০৬ মেট্রিক টন, যার মূল্য ছিল ১৫৬ কোটি ৮২ লাখ ৪২ হাজজার ৩৩১ ডলার।

দেশীয় বাজারে তারা তেল, গম ও চিনির চাহিদার ৩০, ২০ ও ৩৫ শতাংশ পূরণ করেছে। এই বছর ৫০ শতাংশ পূরণের পরিকল্পনা ছিল।

এস আলম গ্রুপের বর্তমানে ছয়টি ভোজ্য তেল শোধনাগার এবং দুটি সক্রিয় চিনি শোধনাগার রয়েছে। আরেকটি প্রকল্প নির্মাণাধীন পর্যায়ে। স্ব-অর্থায়নে ইউরোপীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ প্রকল্পে প্রতিদিন ৪,৮০০ মেট্রিক টন ভোজ্য তেল এবং ৫,১০০ মেট্রিক টন চিনি পরিশোধন করা হয়। এর মধ্যে দুটি চিনি শোধনাগার চট্টগ্রামে অবস্থিত। ২০২৬ সালের মধ্যে নির্মাণাধীন মেগা সুগার রিফাইনারির কাজ শেষ করে উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। 

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে দেশের প্রথম বৃহৎ বেসরকারি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে। প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এসএস বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রকল্পে এস আলম গ্রুপের ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, বাকি ৩০ শতাংশ চীনা কোম্পানি, সেপকো ৩ এবং এইচটিজি প্রতিষ্ঠিত।

গত বছর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডে একীভূত করা হয়, যেখানে দুটি ইউনিট সমন্বিত, প্রতিটি ৬৬০ মেগাওয়াট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। প্রথম ইউনিট ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে উদ্বোধন করা হয়। এই প্রকল্পের বিশেষ দিক হলো এর উৎপন্ন শক্তি অন্যান্য অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় বেশি।

এখানে প্রস্তাবিত সবুজ এবং পুনর্বীকরণযোগ্য শক্তি দ্বারা গৃহীত একটি মেঘা প্রকল্প। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সম্মিলিত সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে এবং প্রত্যাশিত ধারণক্ষমতা ৩ হাজার মেগাওয়াট। শুরু থেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৫০ শতাংশ সবুজ শক্তি দিতে সক্ষম হবে এবং তার পর ধীরে ধীরে তা ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। প্রকল্পটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার এবং এটি ২০২৭ সালে বাস্তবায়িত হবার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি সেখানে পরোক্ষভাবে ১ লাখ মানুষ সুবিধা ভোগ করবে।

জিই, সিমেন্স এবং মিতসুবিশির মতো নেতৃত্বস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানি থেকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সবুজ এবং পুনরায় নতুন শক্তিতে নিযুক্ত হবে। এই প্রকল্পের অনন্য প্রকৃতির কারণে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কার্বন ট্যাক্সেস সুবিধা পাবে দেশ।

এস আলম গ্রুপ ১৯৯৫ সালে গ্যালভানাইজিং এবং স্টিলের শিট প্রোডাকশন প্রক্রিয়া শুরু করে। চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে এসব ফ্যাক্টরি অবস্থিত। জাপানি এবং ইতালীয় প্রযুক্তিভিত্তিক ফ্যাক্টরিগুলোতে, ‘সিআই এবং জিপি শিট, কালার কোটেড সিজিআই শিট, কোল্ড রোল্ড স্টিল শিট এবং আরও অনেক কিছু তৈরি করা হয়।

এই গ্যালভানাইজিং প্ল্যান্ট এবং ফ্ল্যাট রোলিং প্ল্যান্টগুলোতে বিনিয়োগের মূল্য ৬৪০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০০ এরও বেশি কর্মচারী এই শিল্পে কাজ করেন। গ্যালভানাইজিং শিল্পের চারটি ইউনিটের মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৯৩০ মেট্রিক টন প্রতিদিন। এ ছাড়া দুটি ফ্ল্যাট রোলিং প্ল্যান্টের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন।

এস আলম গ্রুপ ২০০০ সাল থেকে চট্টগ্রামের চরপাথরঘাটায় পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু করে। ১৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নির্মিত এ প্রতিষ্ঠানে ১৫০০-এর বেশি কর্মী কাজ করেন। জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ইউনিটের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ১২০০ মেট্রিক টন।

৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং সরকারের ভিশন ৫০ হাজার চাকরি সৃষ্টির লক্ষ্যে। এস আলম গ্রুপ দুটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা করেছে, ১৮৪ একর জমি নিয়ে ‘বাঁশাখালী এস আলম ইকোনমিক জোন-১ ও ২৫৯ একর জমি নিয়ে ‘বাঁশখালী এস আলম ইকোনমিক জোন-২ এর প্রকল্পের কাজ প্রক্রিয়াধীন।

এই বিশেষ দুটি শিল্প অঞ্চলের জন্য ৫৮ হাজার কোটি টাকার দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত। যেখানে বিদ্যুৎ খাতের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা, এইচ আর কয়েল খাতের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা, ডিআরআই প্ল্যান্ট খাতের জন্য ৭৫০০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৫০০ কোটি টাকা। আগামী দিনে ৪০০ একর জমির অধিক জমি ‘বাঁশখালী এস আলম ইকোনমিক জোন-২ এ যোগ করা হবে এবং জাপানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়েকটি মাঝারি ও ভারী শিল্প স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বর্ণিত দুটি বিশেষ ইকোনমিক জোন, যা বর্তমানে চট্টগ্রামে নির্মাণাধাীন, তাদের কার্যক্রম শুরু করলে সেখানে ৫০ হাজারও বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে এবং সরকার বিপুল পরিমাণে রাজস্ব পাবে। ৫ লাখের বেশি মানুষকে সেবা দিতে স্বাস্থ্যসেবার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠান। তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রধান শহরগুলোতে ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো সুবিধাবঞ্চিতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা এবং স্বাস্থ্যসেবাকে সবার কাছে আরও সহজলভ্য করা। মানবসেবার দিকে দৃষ্টি রেখে এস আলম গ্রুপ চালু করেছে চট্টগ্রামে এস আলম ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল প্রকল্প, যা প্রায় সমাপ্তির পথে। এখানে অনকোলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, এন্ডোক্রিনোলজি, অর্থোপেডিক্স, শিশুরোগ, স্ত্রীরোগ এবং মাতৃত্বের যত্ন ইত্যাদি বিভাগে মানুষকে সেবা প্রদান করবে।

এ ছাড়া গ্রুপটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেডিকেল ও নার্সিং কলেজ ও অন্যান্য চিকিৎসা সুবিধা স্থাপন করে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে পূর্বাচল, বসুন্ধরা এবং অন্যান্য অঞ্চলে ভূমি উন্নয়নে কাজ করেছে।

এস আলম গ্রুপের স্বাস্থ্যসেবার এ উদ্যোগে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ইউরোপীয়, ইন্ডিয়ান এবং পূর্ব এশীয় ব্যবসায়িক অংশীদারির ওপর ভিত্তি করে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্রামাগতভাবে এ প্রকল্পে ৫ লাখ লোকের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। 

পরিশেষে, বর্ণিত বিষয়াদি এবং এস আলম গ্রুপের ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, একটি প্রতিষ্ঠান দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ উদ্যোগী হতে পারে? আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় দেখেছি, একটি দেশকে কীভাবে ব্যবসায়ীরা উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে? আমাদের দেশেও দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প গ্রুপ ‘ইয়ংওয়ান’ বিশাল বিনিয়োগ করে দেশকে সমৃদ্ধ করছে। সে হিসেবে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপের অবদানকে খাটো না করে সরকারি পর্যায় থেকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। যাতে তারা দেশের উন্নয়নে সহযোগী হতে পারে। ধ্বংস নয়, সৃষ্টিই হোক আমাদের লক্ষ্য। কাউকে বড় করা বা খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক