ঢাকা ২২ আশ্বিন ১৪৩১, সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪

উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ
সংগীত কুমার

বেকারত্ব আমাদের দেশের সামাজিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিগত কয়েক বছর ধরে বেকারত্বের কশাঘাতে জর্জরিত আমাদের তরুণ সমাজ। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের পরিসংখ্যান যদি তুলে ধরি, তাহলে দেখতে পাবো ২০১৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ছিল ৪ লাখ। ২০২২ সালের শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখে (সূত্র : বিবিএস)। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। 

দেশে বর্তমানে প্রতি তিনজন বেকারের মধ্যে একজন উচ্চশিক্ষিত। তারা বিএ কিংবা এমএ ডিগ্রি নিয়েও শোভন চাকরি পাচ্ছে না। ফলে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে টিউশনি, পাঠাও-উবারে ভেলিভারিম্যান, বিক্রয়কর্মী এবং কেউ কেউ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিগুলোতেও যোগ দিচ্ছেন। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সর্বশেষ রেলের পরিচ্ছতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সবাই স্নাতক ডিগ্রিধারী। বিভিন্ন জরিপ মতে দেশের ৭৮ শতাংশ তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবন ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্নতা বিরাজ করছে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘন্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়ম অনুসারেই বেকারত্বের হিসাব দিয়েছে। কোভিড মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি শ্লথগতি হয়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করে ফেলে। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। 

দীর্ঘ দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষকে গড় আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করতে হয় খাবার ক্রয়ে। বৈদেশিক মুদ্রায় সংকট চলছে, যথেষ্ট দেশি বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি বিনিয়োগ গত এক দশক ধরে জিডিপির ২২-২৩ শতাংশে আটকে আছে। ফলে বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না এবং বেকারত্ব বাড়ছে। 

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৭ লাখ ৯৯ হাজার। অর্থাৎ মোট বেকারের ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। তাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। অর্থাৎ তরুণদের সংখ্যাটাই বেশি। বেকারদের মধ্যে ৫১ শতাংশ আবার উচ্চমাধ্যমিক পাস। 

বিবিএসের আরেকটি সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ অনুসারে বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনায় নাই, কর্মসংস্থানে নাই, এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০-২২ লাখ তরুণ গোষ্ঠী নতুন করে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে ১২-১৩ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু তাদের ৮৫ শতাংশ মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা শোভন চাকরি পায়। আর বাকি ৮-৯ লাখ জনগোষ্ঠী প্রবাসে যান চাকরির খোঁজে। 

দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৭টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৭১ হাজারের কিছু বেশি সরকারি চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছর যত শোভন কর্মসংস্থান বা চাকরি সৃষ্টি হয়, তার চার ভাগের তিন ভাগই হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাহিদার তুলনায় সরকারি চাকরি সৃষ্টি খুবই কম হচ্ছে।

আরও ভয়াবহ চিত্র পাবো যদি গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করি। দেখা যাবে যতগুলো পদের জন্য আবেদন আহ্বান করা হচ্ছে তার চেয়ে ২০০ গুন বেশি আবেদন জমা পড়েছে। সর্বশেষ ৪৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৪০ টি। প্রাথমিকভাবে আবেদন জমা পড়ে ৩ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। ৪৫ তম বিসিএসে ২ হাজার ৩০৯টি পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার। ৪৪তম বিসিএসে আবেদন জমা পড়ে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬০টি। পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭১০টি।

বাংলাদেশে তরুণেরা যে ধরনের শিক্ষা পাচ্ছেন এবং তারা যে কাজ করতে পারেন সেই ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার যে ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে, এখনকার শিক্ষিত তরুণেরা সেই ধরনের কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, ‘লোকে বলে চাকরি কই, চাকরি বলে লোক কই’! ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব তরুণদের জন্য নির্মম অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এই অভিশাপ থেকে নিস্তারের চ্যালেঞ্জগুলো আলোচনা করা করা যাক। শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রে সামঞ্জস্যহীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাস্তবমুখী দক্ষতা তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

তথ্য প্রযুক্তি এবং ই-কমার্সের ঘাটতি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি ও ই-কমার্সের দিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় উচ্চশিক্ষিতদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে না। ডিজিটাল দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার অভাব রয়েছে, যা উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। উদ্যোক্তা সৃষ্টির অনুপ্রেরণার অভাবও ভীষণভাবে পরিলক্ষিত। ফলে দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহের অভাব দৃশ্যমান। এর মূল কারণগুলো হলো পুঁজিবাজারের অভাব, বিনিয়োগের সুযোগ কম এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান ও নেতৃত্বের অভাব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এখনও শ্রমবাজারে তরুণদের সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যার্থ হচ্ছে। সামাজিকভাবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা বেশি। এবার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া যেতে পারে তা আলোচনা করা যাক: 

শিক্ষা ব্যবস্থার পুর্নগঠন এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক এবং কর্মমুখী করতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা, সফট স্কিল এবং ভোকেশনাল ট্রেনিংকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জন করতে পারে। উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাংকিং এবং মাইক্রোফিন্যান্স ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করতে হবে। যাতে উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো সহজে পুঁজি পেতে পারে। উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শের সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির প্রসার বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আইটি ও সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট, ফিন্যান্সিং এবং ই-কমার্সের বিকাশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি নীতিমালা ও আর্থিক সহায়তা আরো জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের জন্য ট্যাক্স ছাড়, ঋণ সুবিধা এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। বৈশ্বিক মানের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম এমন দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশন প্রসার বাড়াতে হবে। 

গত কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগের পরিস্থিতি অনেকটা স্থবির। নতুন বিনিয়োগ না হলে শিক্ষিত যুবকদের জন্য চাকরির বাজার সৃষ্টি হবে না। তাই আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। অন্যদিকে পরিবর্তিত চাকরির বাজারের উপযোগী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় কবি গেজেট প্রসঙ্গ

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২১ পিএম
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১২ পিএম
জাতীয় কবি গেজেট প্রসঙ্গ
এইচ এম সিরাজ

শুক্রবার ৩০ আগস্ট, ২০২৪। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ‘বিব্রত’ হলাম। ফেসবুক খুলতেই দেখলাম ‘না ভাই গেজেট হয়নি’। লিখেছেন খান আখতার হোসেন, আমাকে উদ্দেশ করে। তিনি ‘গাঙচিল’ নামীয় বিরাট সাহিত্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। 

এবার বলি। প্রায় গায়ের জোরে ‘রণ-ক্লান্ত নজরুল’ শিরোনামে কথিত জীবনীগ্রন্থ রচনা মারফতে ‘নজরুল জাতীয় কবি নয়’ সাব্যস্ত করার খায়েশে ওই প্রশ্ন জোর দিয়ে উত্থাপন করেন সদ্য মরহুম অধ্যাপক ড. গোলাম মুর্শিদ। নজরুল পরিবার, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট- এদের সম্মতি ছাড়াই ‘নজরুল জীবনী’ কেন তিনি লিখলেন এবং ‘প্রথমা’ কেন তা প্রকাশ করল, একদিন নিশ্চয়ই গবেষণা হবে। তবে, আমরা তাকে (গোলাম মুর্শিদকে) কোনোদিন কবুল করব না। বরঞ্চ আজকে এ লেখার মাধ্যমেও তার ‘একুশে পদক’ খারিজের দাবি জানাচ্ছি। 

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সর্বপ্রথম বাঙালির জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয়েছে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। সেদিন কলকাতার আলবার্ট হলে হিন্দু-মুসলিম মিলিত উদ্যোগে কবিকে স্বর্ণের দোয়াত-কলম দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু। মানপত্র পাঠ করেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলী। আরও অনেক হিন্দু-মুসলিম গুণীজন ওই মহতী সভায় হাজির ছিলেন। শুধু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন না! এর কারণ আজও জানা যায়নি। 

বাংলাদেশে নির্বাক কবি কাজী নজরুল ইসলাম আসেন ১৯৭২ সালের ২৪ মে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত আগ্রহে কবিকে আনা হয়। পরদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে) নজরুল-জন্মজয়ন্তী পালন উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী-আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন-ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার...’। সেদিন থেকে ধানমন্ডির ‘কবি ভবনে’ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড্ডীন হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্মানে।

১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র মোতাবেক ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (পরিবর্তিত বর্ষপঞ্জি অনুসারে বর্তমানে ২৭ আগস্ট) কবি কাজী নজরুল ইসলাম পিজি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ত্বরিত ছুটে এসে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে শাহবাগে সমাহিত করার উদ্যোগ নেন এবং নিজের কাঁধে খাটিয়া তুলে কবির শবদেহ বহন করেন। অতঃপর কবির শবদেহ কবরের পাশে রেখে একটি চৌকস সেনাদল দ্বারা ২১বার তোপধ্বনি দিয়ে কবিকে জাতীয় বীরের সম্মান দেখানো হয়ে। 

জানা যায়, এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক বঙ্গবীর আতাউল গনি ওসমানী, জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ ও মঞ্জুর হোসেন- এই চারজন জেনারেল মহাপ্রাণ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একযোগে স্যালুট দেন। কবিকে কবরে শায়িত করার সময় উপস্থিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু মোহাম্মদ সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের পরামর্শ অনুসারে কবিকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি’ ঘোষণা করেন।
 
উল্লেখ্য, কবির মৃত্যুর খবরে ভারত সরকার কবির শবদেহ তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করলেও কবিপ্রেমী জিয়াউর রহমানের কৌশলী ভূমিকায় ভারতের সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়। আমরা মনে রাখব, একই বছর ২২ জানুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবির অছিয়ত অনুসারে এ দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে মসজিদের পাশে কবর দেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, আর ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। এখানে মরহুম তিনজন রাষ্ট্রপতিই অপার শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এমন সমান্তরাল ঘটনা ইতিহাসে কমই দেখা যায়। 

বাংলাদেশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় বিল মহান জাতীয় সংসদে তুলে, আলোচনা-অন্তে অনুমোদন করা হয়। এর পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দেন। 

এ ছাড়া ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন’ একইভাবে মহান জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে থাকে। তবু কিছু মানুষ ‘জাতীয় কবি গেজেট’ দাবি করেন? মরহুম গোলাম মুর্শিদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য দেখি না আমি। 

মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বহু আগে ‘নজরুল জাতীয় কবি’ হন মাত্র ৩০ বছর বয়সে।

লেখক: সাংবাদিক ও নজরুল গবেষক

পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও আমাদের করণীয়

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ এএম
আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও আমাদের করণীয়
শফিকুল ইসলাম খোকন

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়, জন্ম হয় নতুন লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের পতাকা। স্বাধীনতা আমাদের অর্জিত সম্পদ, এ সম্পদ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে, এ সম্পদ টিকিয়ে রাখতে এর বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়ও রয়েছে অনেক। এ দেশে রয়েছে বহুমাত্রিক সম্ভাবনা, এর মধ্যে অন্যতম পর্যটনশিল্প।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। প্রচীনকাল থেকে মানুষ বিনোদন ও প্রকৃতির সৌন্দর্য পিয়াস মেটানোর জন্য রূপ-সুগন্ধে ভরা নৈসর্গিক প্রকৃতিতে অবগাহন করছে। বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের কাছে চিরসবুজে ঘেরা এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে পরিচিত। সপ্তম শতকে প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে এর সৌন্দর্যকে কুয়াশা ও পানি থেকে উন্মোচিত ঘুমন্ত সৌন্দর্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সভ্যতার একটি কেন্দ্র হিসেবে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এই দেশে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, বাগেরহাট, কুমিল্লা, সিলেট, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, পাবনাসহ প্রতিটি জেলা পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভ্রমণপিপাসা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে আয় প্রায় ৭৮ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৮ লাখ মানুষ। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। 

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। অথচ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫, তাইওয়ানের ৬৫, হংকংয়ের ৫৫, ফিলিপাইনের ৫০ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন অবদান রাখে ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপিতে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ অবদান। করোনার প্রবণতা কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছালে বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৩ সাল নাগাদ পর্যটনশিল্প থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন, যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হবে পর্যটনশিল্পের অবদান। পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল।
 
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর  ৪৩ অনুযায়ী বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বিপিসি) গোড়াপত্তন হয়। ১৯৯২ সালে প্রণিত জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সে নীতিমালা হালনাগাদ করে ২০১০ সালে আরও যুগোপযোগী করা হয়। নীতিমালার পঞ্চম অধ্যায়ে এর বাস্তবায়নে গৃহীত প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পর্যটন আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, ‘দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্নত পর্যটন সেবা প্রদান এবং পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি-বেসরকারি সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে নতুন ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং সময়ে সময়ে বিদ্যমান আইনগুলো হালনাগাদকরণ’। এর পর সাত বছর পার হলেও পর্যটন নীতি বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপটি উপেক্ষিতই থেকেছে। 

কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশে প্রত্যাশিত ও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। করোনাভাইরাস পর্যটনশিল্পকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বিধায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা। এমনকি ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষের আয়ের ওপর এবং চাকরি হারিয়েছে অনেক লোক। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পর্যটনশিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। 

দেশের সর্বদক্ষিণে বরগুনা একটি সম্ভাবনাময় জেলা। বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনঘেঁষা বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা নদী বেষ্টিত বরগুনা। বিষখালী ও বলেশ্বর নদে খোলা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝাউবন। দক্ষিণের খোলা বাতাস ঝাউবন স্পর্শ করে যাচ্ছে পরম আবেশে। বাতাসের ছোঁয়ায় প্রেমিকার উড়ন্ত চুলের মতো দুলছে ঝাউগাছগুলো। জন্ম থেকেই সমুদ্রের খোলা বাতাস গায়ে মেখে ঝাউগাছগুলো এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ আর ঝাউগাছ এ যেন দৃষ্টিনন্দন এক সৈকত! সমুদ্রের মৃদু ঢেউ, বালুময় দীর্ঘ সৈকত আর ঝাউবনের সবুজ সমীরণের এ দৃশ্যটি যেন প্রকৃতি প্রেমের একটি উদাহরণ। শুধু তাই নয় এ জেলায় রয়েছে শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত, সোনাকাটা ইকোপার্ক, হরিণঘার্টা, মোহনা পর্যটনকেন্দ্র, বিবিচিনি শাহী মসজিদ, বুকাবুনিয়া মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, তালতলী উপজেলার রাখাইন পল্লি, বেতাগী উপজেলার খ্রিষ্টান পল্লি, কাউমিয়া জমিদারবাড়ি, সিডর স্মৃতিস্তম্ভ, বিহঙ্গ দ্বীপ, নীলিমা পয়েন্ট, সুরঞ্জনা, জ্যোৎস্না উৎসব, ইলিশ উৎসব, এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে মুজিব অঙ্গন, ইলিশ চত্বর, বিউটি অব বরগুনা, টাউন হল সংলগ্ন অগ্নিঝরা একাত্তর, সার্কিট হাউস সংলগ্ন ইলিশ ফোয়ারাকেন্দ্রিক উন্মুক্ত ময়দান, এ ছাড়া রয়েছে পাথরঘাটায় দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, বিষখালী নদীর সাদের ইলিশ। প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে উপমহাদেশে একমাত্র জ্যোৎস্না উৎসব পালিত হয় প্রতি বছর এ জেলায়। একদিকে সীমাহীন সাগর; আরেক দিকে দীর্ঘ ঝাউবন, তিন তিনটি নদীর বিশাল জলমোহনা। সব মিলিয়ে নদনদী আর বনবনানীর এক অপরূপ সমাহার- শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতেই জ্যোৎস্না উৎসব পালিত হয়ে থাকে। 

এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কেমন জানি আমরা এখনো পর্যটন খাতে পিছিয়ে রয়েছি। এর কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আগে কারণ খুঁজে বের করা, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করা এবং ইচ্ছা, মনোবল শক্তিতে রূপান্তর করা। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির এ বিষয় কঠোর নির্দেশনা থাকতেও কেমন জানি এখনো আমরা পিছিয়ে রয়েছি। পর্যটকের উন্নত সেবার জন্য দক্ষ ও মার্জিত জনবলের অভাব, উন্নত ও দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব, ইলেকট্রনিক্স-প্রিন্ট মিডিয়া বাংলাদেশের পর্যটন অঞ্চলগুলোর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন না করা, প্রচার প্রয়োজন মতো না করা, পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন না করা, বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা, দক্ষ গাইডের অভাব, এ ছাড়া রয়েছে সামাজিক অনেক বাধা। অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৫ শতাংশ দখল করে আছে পর্যটনশিল্প। এই শিল্প আমাদের দেশের মানুষ ও ভ্রমণ করতে ১০ বার চিন্তা করে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্যই। দেশে একটু বিশৃঙ্খলা দেখলেই তো পর্যটক তো দূরের কথা অন্য দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলও পাঠাতে সে দেশ ভয় পায়। এই ভয়, সংশয় দূর করার জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাতেই হবে। কিন্তু বরগুনায় এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনো প্রকল্প এ খাতে দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের যেমন সদিচ্ছা থাকতে হবে তেমনি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও উদ্যোগ এবং ইচ্ছা থাকতে হবে। 

পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী এবং বরগুনা সদর, আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলাকে ঘিরে বিশেষ পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। ‘পায়রা বন্দরনগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ-পর্যটনভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’ নামে এই প্রকল্পটি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পরিকল্পনা কমিশন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। বরগুনার স্থানগুলোকে এক্সক্লুসিভ পর্যটন কেন্দ্র করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সোনার চরের ২০ হাজার ২৬ হেক্টর বিস্তৃত বনভূমিসহ ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতজুড়ে গড়ে তোলা হবে এক্সক্লুসিভ পর্যটনকেন্দ্র। এজন্য ‘প্রিপারেশন অব পায়রা-কুয়াকাটা রিজিওনাল প্ল্যান’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার।  মূলত কুয়াকাটা, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলার সমন্বয়ে পর্যটন জোন স্থাপন করা হবে। এর লক্ষ্যে চলতি সময় থেকে শুরু করে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চলবে সার্ভের কাজ। সরকার থেকে এতকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও বাস্তবে কতটুকু হচ্ছে এটিও প্রশ্নবিদ্ধ। এ জন্য শুধু সরকারই নয়, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদেরও মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। সরকারের উদ্যোগে কোনো ত্রুটি থাকলে জনগণের এগিয়ে আসতে হবে। 

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উল্লিখিত পর্যটন প্রসার প্রয়োজন। অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে সমবায় পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড পর্যটন আরও সম্প্রসারিত হবে। এ ছাড়া গ্রামের মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, একতা, সাম্য বৃদ্ধি পাবে যা বর্তমানে চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সহযোগিতা করবে এবং বাস্তবায়িত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। এভাবেই নবদিগন্তে ভোরের সূর্যের প্রজ্বলিত শিখার মতো আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো প্রচারণা চালাতে হবে। বিশ্বের যতগুলো দেশে বাংলাদেশ বিমানসহ আমাদের দেশের প্রাইভেট বিমানগুলো যাতায়াত করে সেসব দেশে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ প্যাকেজ কর্মসূচি গ্রহণ করে কার্যকরী ব্যবস্থাও পর্যটনশিল্প বিকাশে অনেক অগ্রগতি হবে। পর্যটনশিল্প বিকাশে সুষ্ঠু ও যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, পর্যটন করপোরেশনকে অধিকতর কার্যকরও দক্ষ প্রতিষ্ঠানের রূপান্তর করা, বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে চাহিদা অনুসারে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, প্রয়োজনে ফরেন জোন গড়ে তোলা। স্থানীয় পর্যায় উদ্যোক্তাদের উদ্ভুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়াসহ পর্যটনশিল্পকে আরও প্রসারিত করতে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বলয় রাখা, অবকাশ যাপনের জন্য হোটেল ও মোটেলগুলোতে প্যাকেজ কর্মসূচি রাখা, হোটেলগুলোতে পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা ও গাইডের ব্যবস্থা রাখা‬, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক-অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, পর্যটন কেন্দ্রগুলোর স্থির চিত্রের প্রয়োজনীয় দৃশ্য স্থির প্রদর্শনী রাখা ইত্যাদি।

পর্যটনশিল্প বিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের কপালে জ্বল জ্বল করছে। এখন এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলে এ শিল্প এখানে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশে পর্যটনের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগই একমাত্র উদ্যোগ। সরকার বা সরকারি উদ্যোগের সীমাবদ্ধতার কথা সব ক্ষেত্রেই আমাদের শোনা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। তাই পর্যটনে কিছু বৈচিত্র্য ও সুযোগ সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিভৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলাসহ সুযোগসুবিধা সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিভৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলাসহ সুযোগসুবিধা সৃষ্টি করার কথা আমরা বলেছি।

পরিশেষে বলতে চাই, এ দেশটি আমাদের, এ দেশ সবার। এ দেশে আমাদেরই রক্ষা করতে হবে, তেমনি দেশের পর্যটনশিল্পকে আমাদেরই টিকিয়ে রাখতে হবে এর বিকাশ ও বহুমাত্রিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে একটি সুন্দর দেশ হিসেবে পরিচিত করি, একটি পর্যটন দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করি। 

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:১৯ পিএম
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়
মো. নূরন নবী

শিশুরা আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন। অনাগত দিনের নতুন ইতিহাস। এরা বড় হবে। এরা ফুলের মতো বিকশিত হবে। জন্ম-মুহূর্ত থেকে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই পথপ্রান্তে কত শিশু নিঃশব্দে অকালে ঝরে যায়। ওদের জীবনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য চাই যথার্থ পরিবেশ, চাই স্বহৃদয় মানসিকতা, চাই মাতৃস্নেহের পরিচর্চা। আর এই পরিচর্চার জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা আর এই শিক্ষা অর্জনের মৌলিক ভিত্তি তৈরির স্থানগুলো হলো প্রাথমিক শিক্ষা। যা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই হতেখড়ি হয়ে থাকে।

প্রাথমিক শিক্ষা যে দেশে যত সুষ্ঠুভাবে দেওয়া হয় সে দেশ তত উন্নত। তাই দেশের সঠিক উন্নয়নের জন্য সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থী নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসায় মূল ধারা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশ অভিভাবক অসচেতন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং শিক্ষার্থীদের শিশুশ্রমের প্রতি আগ্রহী। এসব শিক্ষার্থীর বাড়িতে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব।

তাছাড়া অনেক অভিভাবকের ধারণা, পড়ালেখা করে গরিব মানুষের সন্তানের চাকরি পাওয়া কঠিন। শিক্ষার গুরুত্ব বা সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার শক্তিও এসব অভিভাবকের নেই। এসব শিক্ষার্থীর পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস সম্বন্ধে পুরোপুরি ধারণা করতে হলে বাস্তব কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

ক) প্রথমে শ্রেণি শিক্ষক দৈনিক শ্রেণি কার্যক্রম শেষে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রস্তুত করবেন।

খ) তার পর সেই শিক্ষক তালিকা অনুযায়ী মোবাইলের মাধ্যমে অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খোঁজখবর নেবেন এবং শ্রেণিপাঠের কার্যক্রম সম্পর্কে অভিহিত করবেন।

গ) প্রতি বৃহস্পতিবার এসব শিক্ষার্থীর পড়ালেখার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান শিক্ষককে অভিহিত করবেন। ফলে এসব শিক্ষার্থী এক সময় পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী হবে এবং বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হবে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার শূন্যের কোটায় চলে আসবে। 

ঘ) এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টার অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে বরাদ্দ ব্যবস্থা করবেন।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান:
সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে সব শিক্ষার্থীকে অর্থাৎ শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে বন্ধুসূলভ আচরণ করবে এবং অভিভাবকদের পড়ালেখার গুরুত্ব অনুধাবন করাতে সচেষ্ট হবেন। এ ক্ষেত্রে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় অভিভাবক বাড়িতে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরি করবেন এবং শিক্ষকের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থী বাড়িতে পড়ালেখা করবে। ফলে শিক্ষার্থীর মাঝে পড়ালেখার আগ্রহ সৃষ্টি হবে, বিদ্যালয়ভীতি দূর হবে এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসবে। ফলে শতভাগ উপস্থিতির দিকে বিদ্যালয় অগ্রসর হবে। আর তখনই মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন হবে।

বাস্তবায়নে সুফল:
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি একটি বিরাট সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ও অনগ্রসর এলাকায় এ সমস্যা খুব বেশি দেখা যায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিট ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। শিক্ষক সঠিক উপায়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় যখন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত, কেন অনুপস্থিত, কবে উপস্থিত হবে এ বিষয় অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবেন এবং দৈনিক পাঠ সম্পর্কে শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ দেবেন। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে, বিদ্যালয়ভীতি দূর হবে, নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসবে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কও দৃঢ় হবে এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে।

মো. নূরন নবী: উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার

পোশাকশ্রমিকরা আর কত দিন রাস্তা অবরোধ করবেন

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৭ এএম
পোশাকশ্রমিকরা আর কত দিন রাস্তা অবরোধ করবেন
দীপংকর গৌতম

পোশাক খাত আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো শক্ত না হওয়া ও পুঁজির অসম বিকাশের মধ্য দিয়ে গ্রামের অজস্রর পেশা হারিয়ে গেলে পোশাক কারখানায় ঢুকে জীবন রক্ষা করেন। পোশাকশ্রমিকদের বেতন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম বলে এখানে পোশাক ব্যবসায় লাভ বেশি। ফলে দেশের টঙ্গী, গাজীপুর, আশুলিয়া, জিরাবো, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পোশাক কারখানা।

ভোর হতেই দেখা যায় লাঞ্চবক্স হাতে জোরপায়ে হেঁটে চলেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক সেলাই দিদিমনি ও ভাইয়েরা। উদয়াস্ত পরিশ্রম তো করেনই। তার পর বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে হয়। এর পর গার্মেন্টসে কাজের পরিবেশ কেমন সেটা বোধকরি গণমাধ্যমের সুবাদে সবার জানা। এক্ষেত্রে তাজরীন বা রানা প্লাজার কথা বললেই বোঝা যাবে যে, সরু সিঁড়ি, কলাপসিবল গেট এমন করে তালা দেওয়া থাকে এখান থেকে লাফিয়ে পড়ারও কায়দা নেই। অধিকাংশ গার্মেন্টসেই কাজ করার উপযোগী পরিবেশ নেই। এর পর বেতন তো আরেক বিড়ম্বনা। যে বেতন পান তা ঢাকায় ভালোভাবে বসবাসের উপযোগী না। তার পরও সে বেতন নিয়মিত না। এ অবস্থা অধিকাংশ গার্মেন্টসের।

২০২৩ সালে বেশ কিছুদিন গার্মেন্টসশিল্পে অস্থিরতা চলে। ওই বছরের নভেম্বরে ন্যূনতম মজুরি ইস্যুতে আন্দোলন চলাকালীন শতাধিক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই শিল্পের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি মোটাদাগে সামনে আসে। সে সময় পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ ও গ্রেডের সংখ্যা সাত থেকে কমিয়ে পাঁচে কমিয়ে এনে গেজেট প্রকাশ করে তৎকালীন সরকার। সরকার কর্তৃক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হওয়ার পর অসন্তোষ থাকলেও ধীরে ধীরে কাজে ফিরতে শুরু করেন শ্রমিকরা। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে (ডিসেম্বর মাসের বেতনে) ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠান সেটি আমলে নেয়নি বলেও সময় সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছিল।

কোনো কোনো মালিক জানিয়েছিল তারা নতুন কাঠামোতে বেতন দিতে পারবে না। ফলে নতুন করে শুরু হতে থাকে আন্দোলন। আন্দোলন চলতে থাকলে সেটা বন্ধের বড় ওষুধ হলো গার্মেন্টস বন্ধ রাখা। গার্মেন্টস কেন বন্ধ রাখা হয়? গার্মেন্টস মালিকরা টাকা পায় ডলারে। ১ ডলার সমান ১২০ টাকা। তাদের কারখানা এক মাস বন্ধ রাখলে কিছু যায় আসে না। কিন্তু শ্রমিকরা এক মাস কাজ না করলে খাবেন কী? এ অঙ্ক সরল অঙ্ক। তার পরও মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করে সেটা নজিরবিহীন।

অল্পদিনে অজস্র টাকার মালিক বনে যাওয়া গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের শ্রম শোষণ না করে চলতেই পারে না। এবার বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ ছিল, ধীরে ধীরে অনেক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এখনো আন্দোলন চলছে। গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। ওই মহাসড়কের উভয় পাশে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে যাত্রী, চালক ও স্থানীয়রা দুর্ভোগে পড়েছেন।

গত রবিবার সকাল ৮টা থেকে জয়দেবপুর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকায় মণ্ডল ইন্টিমেন্টস নামে ওই কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ ছাড়া গাজীপুর মহানগরীর খাইলকুর এলাকার এমএম ফ্যাশন অ্যান্ড কম্পোজিট লিমিটিড, টঙ্গী পশ্চিম থানার খাঁ পাড়া সড়কের সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেড পোশাক কারখানা, সাতাইশ বাগানবাড়ি এলাকায় অবস্থিত প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করছেন। শ্রমিকদের দাবিগুলো হলো হাজিরা বোনাস ১ হাজার টাকা করতে হবে, নাইট বিল ১০০ টাকা, কারখানায় মোবাইল নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে, অর্ধ বেলা ছুটি অথবা দুই ঘণ্টা গেট পাস নিলে হাজিরা বোনাস কাটা যাবে না, অসুস্থ হলে কারখানার মেডিকেল সেন্টারে বিশ্রামে না রেখে ছুটি দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে তারা অবরোধ করে।

মণ্ডল ইন্টিমেন্টস কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকরা বলেন, ‘আশপাশের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে তাদের দাবি পূরণ করে নিয়েছেন। আমরা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি জানিয়ে আসলেও তারা তা পূরণে উদাসীন। তাই আমরা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছি।’

গত ২২ সেপ্টেম্বর শ্রমিকরা কারখানার সামনে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং যাত্রী, সাধারণ মানুষ ও চালকরা ভোগান্তিতে পড়েন। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ, জয়দেবপুর থানা পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত রয়েছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র গাজীপুর জেলা সভাপতি জিয়াউল কবীর খোকনের সঙ্গে আন্দোলন প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ‘কারখানায় প্রবেশে যেসব শ্রমিক দেরি করেন না এবং নিয়মিত কাজ করেন, তাদের প্রতি মাসে ৭৫০ টাকা অতিরিক্ত হাজিরা বোনাস দিচ্ছে বিভিন্ন পোশাক কারখানা। আমি মনে করি, এটি শ্রমিকদের অধিকার এবং যৌক্তিক দাবি।’

গাজীপুর শিল্পপুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন জানান, গত রবিবার সকাল ৮টা থেকে গাজীপুর মহানগরীর খাইলকুর এলাকার এমএম ফ্যাশন অ্যান্ড কম্পোজিট লিমিটিডের তিন শতাধিক শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করেন। আধ ঘণ্টা পর থেকে তারা আগস্ট মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে উৎপাদন কাজ বন্ধ করে কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করছেন। মালিক পক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা চলছে।

একই সময়ে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পশ্চিম থানা খাঁ পাড়া সড়কের সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেড নামে পোশাক কারখানার ১৫০০ শ্রমিক জুলাই মাসের অর্ধেক বেতনের দাবিতে উৎপাদন কাজ বন্ধ করে কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করছেন। আন্দোলন চলছে। সড়কে দীর্ঘ সময়ের যানজটে জনগণের ভোগান্তির কথা বললে, গার্মেস্টস কর্মী নিপা চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘৪-৫ ঘণ্টা গাড়িতে বসলে আপনাগোর ভোগান্তি অয়। আর আমার বাচ্চা যখন দিনভর খাওনের জন্য কান্দে হেইডারে ভোগান্তি মনে হয় না?’

গার্মেন্টস শ্রমিকদের এই আন্দোলন সারা বছরই চলে। ঈদের আগেও তাদের রাস্তা বন্ধ করে বসতে হয় বেতন-বোনাসের দাবিতে। কোনো গার্মেন্টস মালিকের এই টাকা দিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তার পরও মালিক বলে কথা। তাদের হিসাব আর আমাদের হিসাব মিলবে না। মালিক সবসময় মালিক। আর আমরা সবাই শ্রমিক। হিসাব তাই মেলে না। কিন্তু শ্রমিকদের রাস্তায় বসা বন্ধ করতে বোধ করি মালিকদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। সেই সদিচ্ছা কবে হবে? শ্রমিকদের কারখানা, পরিবার-পরিজন রেখে আর কত দিন রাস্তা অবরোধ করে রাখতে হবে?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল

পুলিশ কাজে ফিরবে, পুলিশ কাজে ফিরবে না

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ পিএম
পুলিশ কাজে ফিরবে, পুলিশ কাজে ফিরবে না
তানজির কচি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর দেশে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাড়ছে পরিবর্তনের প্রত্যাশাও। সরকারি-বেসরকারি নানা দপ্তরে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে চলছে দেনদরবার। দাবি আদায়ে সোচ্চার সাধারণ মানুষ থেকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাও। অফিসগুলোয় এখনো স্বাভাবিক ছন্দ ফেরেনি। টুকটাক কাজ চললেও অনেক জায়গায় বিরাজ করছে স্থবিরতা। বিষয়গুলো নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক উপদেষ্টাও। স্বাভাবিকতা ফেরানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চললেও সফলতার হারও খুবই কম।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। স্থবিরতা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে বাংলাদেশ পুলিশকে। এর উপযুক্ত কারণও রয়েছে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক সরকারেরই বাজে ব্যবহারের শিকার হয়েছে পুলিশ। ফলস্বরূপ অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে শুরু করে অপেশাদারত্বের সর্বোচ্চ রূপ আমরা দেখেছি। দেখেছি দলীয়করণের বিরল দৃষ্টান্ত, পুলিশকে রাজনৈতিক লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করতে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা সরকার পুলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ গণশত্রু বনে যায়। পুলিশের গুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। আবার এই আন্দোলনকে ঘিরেই প্রাণ দিতে হয় পুলিশের অসংখ্য সদস্যকে। দেশের অসংখ্য থানা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুট হয় পুলিশের অস্ত্র-গুলি-সম্পদ। পালিয়ে জীবন রক্ষা করে পুলিশ সদস্যরা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতা নিহতের সংখ্যা নিরূপণে কাজ করা হলেও পুলিশের মৃত্যুর সংখ্যা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। আদৌ এ নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে কি না, জানি না। 

সরকার পতনের পর কর্মবিরতিতে যায় পুলিশ সদস্যরা। পুলিশে সংস্কারের দাবি নিয়ে তাদের এই আন্দোলন চলে বেশ কিছুদিন। কয়েক দফা প্রচেষ্টা চালানোর পর পুলিশ সদস্যরা থানায় ফেরে। কিন্তু অদ্যাবধি স্থবির হয়ে আছে এ বাহিনী। 

মাঝে পুলিশ সক্রিয় নানা থাকায় আমরা নানা অরাজকতা দেখেছি। যা চলছে এখনো। ফলস্বরূপ যে জনতা পুলিশকে গণশত্রু বলেছে, তারাই পুলিশকে দ্রুত সক্রিয় করার দাবি তুলছে। 

এখন প্রশ্ন পুলিশ পুরোদমে কাজে নামছে না কেন? কেনইবা কাটছে না স্থবিরতা? 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অন্তত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। ১. পুলিশকে আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গণশত্রুতে পরিণত করা, ২. সরকার পতনের আগে পরে পুলিশের অসংখ্য সদস্যের প্রাণহানি ও ৩. রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে আইজিপির নামে অসংখ্য মামলা। 

রাজপথে বিরোধীদের লাঠিপেটা করবে পুলিশ, প্রাণ দেবে পুলিশ, মামলা খাবে পুলিশ আর ফল নেবে সরকার- এটা তো হতে পারে না। এজন্যই তাদের পুলিশ সংস্কারের প্রথম দাবি ‘পুলিশকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বাহিনীতে রূপান্তর’ এর দাবিটি অত্যন্ত যৌক্তিক। এই দাবি পূরণ না হলে তো তাদের মাঠেই নামার কথা নয়। 

আবার ৫ আগস্টের পর পুলিশ সদস্যদের নামে যে ধারাবাহিক মামলা হচ্ছে, এই মামলা ঘাড়ে নিয়ে কাজে ফিরতে তারা কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, তাও ভাবার বিষয়। 

সরকারের উপদেষ্টারা তাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা না করে বরং এখনো প্রকাশ্যে বিষোদগার করছেন। দায়িত্বশীলরা যদি পুলিশকে গালি দিতেই থাকে, তবে সাধারণ মানুষ কেন পুলিশের কথা শুনবে বা পুলিশকে মানবে? এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। পুলিশ অ্যাকশন নিলে তা এক পক্ষের বিরুদ্ধেই যাবে। দোষী হলেও সেই পক্ষ সংক্ষুব্ধ হবে, এটা তো আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। 

এই প্রসঙ্গে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদের কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই। সংবাদটির শিরোনাম ছিল “পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন ‘অ্যাকশনে’ যেতে, বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার।” প্রকাশিত ওই সংবাদের বিষয়বস্তু হলো, রবিবার কাকরাইলের অডিট ভবনের সামনের সড়কটি অবরোধ করে রেখেছিলেন বাংলাদেশের মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীন ১৫০ থেকে ২০০ অডিটর। তাদের দাবি, ১১তম গ্রেড থেকে তাদের পদকে দশম গ্রেডে উন্নীত করতে হবে। আন্দোলনরত অডিটরদের অবরোধ তুলে নিয়ে সড়কের এক পাশে অবস্থান নিতে পুলিশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারা শোনেননি। একপর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সড়ক থেকে আন্দোলনকারীদের সরাতে ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি নিয়ে পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু অধস্তন সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে দাঁড়িয়ে থাকেন। 

এ থেকে আরেকটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়। তা হলো- পুলিশ সদস্যরা আন্দোলন দমনের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে ঠিক করেছে কি না কিংবা এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের আসলে কী করা উচিত। 

এ প্রসঙ্গে আরও একটি সংবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আজকের পত্রিকার ১০ সেপ্টেম্বরের ওই খবরটির শিরোনাম ছিল ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বেআইনি আদেশ মানা যাবে না: র‌্যাবকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।’ আসলে কোন আদেশ আইনি আর কোনটি বেআইনি এটা পরিমাপের সুযোগ পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যদের আছে কি না। থাকলে সেই পরিমাপক কী? আর যদি আদেশ বেআইনি হয়, তাহলেও বা অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের করণীয় কী? 

এবার আসা যাক পুলিশের সেলফ ডিফেন্স প্রসঙ্গে। জুলাই-আগস্টে যা ঘটেছে আমরা সবাই দেখেছি। এখন আদেশ আইনি হলেও অ্যাকশনে যাওয়ার পর পুলিশের সেলফ ডিফেন্স পলিসি কী হবে? এটাও বড় প্রশ্ন। 

ইউনূস, খালেদা বা হাসিনা- ক্ষমতায় যেই থাকুক এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে পুলিশে যেমন স্থবিরতা কাটবে না, তেমনি পেশাদার দেশপ্রেমিক পুলিশও আমরা পাব না বা পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন তারা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছেন কি না। 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও সমালোচক