ঢাকা ৮ চৈত্র ১৪৩১, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
English

র‍্যাপ গান: তারুণ্যের বিপ্লবী জবান

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩৪ পিএম
আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩৬ পিএম
র‍্যাপ গান: তারুণ্যের বিপ্লবী জবান
নাজমুল হুদা আজাদ

আন্দোলন সংগ্রামের কিছু সাংস্কৃতিক অনুঘটক (Cultural Insurrection tool) থাকে। কখনো সেটা কবিতা বা উক্তি, কখনো গান বা স্লোগান, কখনো চিত্রকর্ম বা গ্রাফিতি কখনোবা সবকটাই। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে অন্যতম প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে যে সব উপায়- উপাদান, তার মধ্যে অন্যতম র‍্যাপ গান। এটা ঠিক গান না, আবার কবিতাও না, গান ও কবিতার মাঝামাঝি আফ্রো- আমেরিকান হিপ হপ জনরার একটা গ্রে সাংস্কৃতিক মাধ্যম। আফ্রো- আমেরিকানরা ‘প্লে দ্য ডজেন্স’ নামে একটি খেলা খেলে থাকতো যেখানে দুইজন প্রতিযোগী অডিয়েন্সের সামনে র‍্যাপ গান এর মাধ্যমে একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করত যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ হাল ছেড়ে দিচ্ছে। এই চর্চাটা অনেকটাই আমাদের কবিয়ালদের কবিগানের মতো। ষাটের দশকে আমেরিকার নিউইয়র্কে বহুল চর্চা হলেও পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে বর্ণবাদ,রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের বিপরীতে সোচ্চার হওয়ার অন্যতম প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে ওঠে এই র‍্যাপ গান। এরই ধারাবাহিকতায় ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশেও র‍্যাপ গান নিদারুণভাবে একটি বিপ্লবী সাংস্কৃতিক অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

যে র‍্যাপ গানগুলো প্রকাশিত হয়েছে লক্ষ্য করলে দেখা যায় গত ষোলো বছরের আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অত্যাচার, নিষ্পেষণ-নিপীড়নের ভয়ে মানুষ যা বলতে পারেনি বা বলার পরে সম্পূর্ণ অনায্যভাবে তার খেসারত দিতে হয়েছে এই বিষয়গুলো দুই থেকে পাঁচ-সাত মিনিটের একটা র‍্যাপ গানে যথেষ্ট বলিষ্ঠ ও স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। গান ও কবিতা যে একটা অলিখিত ও প্রমিত সাংস্কৃতিক সীমা-পরিসীমা মেনে রচিত ও চর্চিত হয় র‍্যাপ গান তা অতিক্রম করেছে বা তার বাইরে এসে রচিত ও বহুলভাবে চর্চিত হয়েছে ও হচ্ছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রতিটি র‍্যাপ গানই উপভাষায় (Dialect)  রচিত এবং গানের কনটেন্ট বিবেচনা করলে দেখা যায় এমন কোন প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নেই যা গানগুলোতে তোলা হচ্ছেনা। যেমন হান্নানের ‘আওয়াজ ওডা বাংলাদেশ’, সেজানের ‘কথা ক’, ‘২৪ এর গেরিলা’সহ প্রতিটি সৃষ্টি।  শাসককে বিভিন্ন অসংগতি নিয়ে ক্রমান্বয়ে প্রশ্নবানে জর্জরিত করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এই সব র‍্যাপ গানে। সামষ্ঠিক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা টেনে প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘৫২ টা ভুলতারি নাই, ২৪ এর টা ভুলবি ক্যা?’ দেশ সংস্কার নামের গানে প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘পরিশ্রম আর যোগ্যতার মানে বুঝবো কেমনে? অয়তো নিজেই টিকা আছে নিজের বাপের উপরে।’; এমনকি দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সামষ্ঠিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গানে প্রবলভাবে প্রচলিত গালিগালাজ এর ব্যবহার লক্ষণীয়। ফ্রেজ খান এর ‘এক দফা’ তে দেখা যায় খানকির পোলা, f*** the police, f***  the BGB, f*** the Kutta League, f*** your দুর্নীতি; ‘গদি ছাড়’ এ চুদির ভাই, চেটের বাল এই সমস্ত প্রপঞ্চের উপর ভর করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে।  তুই-তুকারি অর্থাৎ তুচ্ছার্থক সম্বোধন এর ব্যবহার গানে হরহামেশা। ’২৪ এর গেরিলা'ই তুচ্ছার্থক সম্বোধন যোগে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে ‘আমরা যহন রাজাকার, তাইলে ক তুই রাজা কার?’

কেউ কেউ গানের লিরিক্স এর শুরুতে অথবা শেষে কৌশলীভাবে সংযোজন করেছে শেখ মুজিবের ভাষণ বা মুক্তিযুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত স্লোগান। ‘এবং তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’ শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের এই অংশটি দিয়েই হান্নানের ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’ শুরু হয়।  ‘প্রশ্ন’ নামের একটি গানে ইমতিয়াজ আকিব বলছেন ‘আমি জানি এই গানের পর আমি আর নাও থাকতে পারি।’ তারপরেও সে দায় অনুভব করে লিখছে ও গাইছে। এ যেন শেক্সপিয়ারের ‘দ্য টেম্পেস্টে’র আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ দাস ক্যালিভানের প্রায় ভুলতে বসা মাতৃভাষায় গালিগালাজের মাধ্যমে ভাষিক প্রতিবাদ (Linguistic insurrection) শেতাঙ্গ প্রস্পারুর ভাষিক অবদমনের (Linguistic suppression) প্রতি। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ২৪ এর অভ্যুত্থানে র‍্যাপ গানের চেয়ে বিপ্লবী, দুঃসাহসিক এবং বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক প্রতিবাদী অনুষঙ্গ (বিষয়-আশয়ে, ভাবে ও প্রকাশে) দ্বিতীয়টি ছিল না।

অন্যদিকে শিল্পী ও অডিয়েন্সের দিকে তাকালে দেখা যায় শিল্পীরা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত স্বপ্নালু ও সংস্কারকামী তরুণ সম্প্রদায় এবং গানের কনটেন্ট ও ভাব ও তার প্রকাশ আমজনতার সামষ্টিক অভিজ্ঞতা ও দাবী হওয়াতে অডিয়েন্সও দল, মত, সম্প্রদায় নির্বিশেষে বিদ্যমান সকল সামাজিক স্তরের মানুষ। এই বিবেচনায় র‍্যাপ গান আম ছাত্র-জনতাকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করার দিক দিয়েও অনন্য।

যে প্রজন্ম ‘আই হেইট পলিটিক্স’ ধ্যানধারণার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেছে তারা তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে অবচেতনভাবে যে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছে তার বহিঃপ্রকাশ এইসব গানের উৎপাদন (বিশেষভাবে গানের লিরিক্সের ডিকশান), পুনরুৎপাদন, ও গণহারে গ্রহণ।  তাদের কনটেন্ট নির্বাচন, অনৈতিকভাবে জগদ্দল পাথরের মতো আমজনতার বুকে জেঁকে বসা অথরিটিকে উপর্যুপরি প্রশ্ন করার ধরণ, নির্যাতন- নিষ্পেষণ অপরিহার্য জেনেও ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা এবং আপোষহীন সংস্কারবাদী মানসিকতা তার স্বতঃস্ফূর্ত ও জ্বাজ্জল্যমান দৃষ্টান্ত।

লেখক: প্রভাষক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
[email protected]

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫: ‘একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০১ পিএম
আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০২ পিএম
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫: ‘একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’
এস এম নাজের হোসাইন

অন্যান্য বছরের মত এবারও আগামি ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২০ বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হতে হচ্ছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ‘ভোক্তাবাদ’ আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কর্তৃক মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ঐতিহাসিক দিনটির স্মরণে প্রতি বছরের ১৫ মার্চ বিশ্ব জুড়ে দিবসটি বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভোক্তা সংগঠনগুলো নানামুখী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের মূল প্রবক্তা মার্কিন সিনেটর ও মাল্টিন্যাশনাল মনিটর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা রাল্ফ নাদের। ক্রেতা-ভোক্তাদের আর্ন্তজাতিক সংগঠন কনজুমারস ইন্টারন্যাশনাল বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় এসব সংগঠনগুলো প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। কিন্তু ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে সেটা আজও এক বড় ধরনের প্রশ্ন। একই সাথে ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন ও কার্যকর করতে পেরেছি বা করেছি এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নয়। 

১৫ মার্চ বিশ্ব ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার দিবসটি ১৯৮৩ সালের থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বের ভোক্তা সংগঠনগুলোর ফেডারেশন Consumer International (CI) ভোক্তা অধিকার প্রচারণার একমাত্র সম্মিলিত কণ্ঠস্বর বা দাবি আদায়ের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক। সারা বিশ্বের ১১৫টি দেশের ২২০টিরও বেশি সংগঠন এর সদস্য। বাংলাদেশের একমাত্র ও শীর্ষস্থানীয় ভোক্তা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কনজুমার ইন্টারন্যাশনাল এর পূর্ণাঙ্গ সদস্য। বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলোঃ টেকসই ভোক্তা (A Just Transition to Sustainable Lifestyles)!। বাংলাদেশে বিষয়টি মুজিবর্ষের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারন করা হয়েছে “একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর”। বিষয়টি আমাদের সকলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। কারন ভোক্তা অধিকার কী রাস্ট্র, সমাজ, ব্যবসায়ী, উৎপাদক, প্রশাসন-আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সবাই ভোক্তা হলেও ভোক্তার করনীয় ও দায়িত্ব সর্ম্পকে ধারনার অভাব রয়েছে। 

“ভোক্তা” শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজী শব্দ কনজুমার যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কেউ কোন পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারীর সেবা গ্রহণ করে অর্থাৎ যারা ভোগ করে তাদেরকে ভোক্তা বলে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ২০০৯ এর আওতায় ভোক্তা হলেন “তিনিই যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন”। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা। আবার অনেকে বলে থাকেন “মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে যে সমস্ত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাগুলি রাস্ট্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত” এগুলিই ভোক্তা অধিকারের আওতায়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলির মধ্যে “অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পুরনের অধিকার”, “নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার”, “পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির তথ্য জানার অধিকার”, “যাচাই বাছাই করে ন্যায্য মূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাবার অধিকার”, “কোন পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপুরণ পাওযার অধিকার”, “অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার”, “ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার”, “স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার” অন্যতম। তবে অধিকারের পাশাপাশি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও বলা হলেও এ বিষয়গুলি সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা একেবারেই কম নয়। বিষয়গুলো হলো; “পণ্য বা সেবার মান ও গুনাগুন সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হোন”, “দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করুন”, “আপনার আচরনে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হন সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন”, “পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন”, “ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার সংরক্ষনে সেচ্ছার ও সংগঠিত হোন”।

বিশ্বের সর্বাপেক্ষা অর্থনৈতিক গোষ্ঠি ভোক্তাদের স্বার্থ চিন্তা করে প্রতি বছর ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়ে আসছে। যদিও বাংলাদেশে সরকারিভাবে এই দিবসটি পালনের কোন কর্মসূচি নাই। ব্যবসায়ীসহ নানা গোষ্ঠির নানা দিবস সরকারি তালিকায় স্থান পেলেও ভোক্তাদের একটি মাত্র দিবস তালিকায় স্থান না পাওয়ায় ভোক্তা হিসাবে আবারও বৈষম্যের শিকার হলো বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। ক্যাবসহ অনেক সংগঠন নিজস্ব উদ্যোগে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা সুরক্ষার মূল বিষয়গুলি তুলে ধরে এবং শক্তিশালী ভোক্তা অধিকারের পক্ষে কথা বলে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি জীবনযাত্রায় নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। এবার ২০২৫ সালে, বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, "একটি ন্যায়সঙ্গত টেকসই জীবনযাত্রায় রূপান্তর," টেকসইজীবনযাত্রার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির আহ্বান জানায়, যা সকলের জন্য ন্যায্যতা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় অভিগম্যতা নিশ্চিত করে। 

যদিও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রার বিষয়টি প্রায়শই বড় অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত একটি বৈশ্বিক সমস্যা বলে মনে হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির অনন্য পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে যার স্থানীয় সমাধান প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর অর্থ একটি "ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর" নিশ্চিত করে যে টেকসই অর্থনৈতিক কষ্ট, বৈষম্য বা সামাজিক বর্জন খচরে তালিকায় আসে না। 

বাংলাদেশি ভোক্তাদের জন্য, এর অর্থ হল পরিবেশ-বান্ধব পছন্দগুলি শুধু ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয় বরং সকলের জন্য একটি সহজলভ্যতার সুযোগ তৈরী এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প হওয়া উচিত।

ইতিমধ্যে আমাদের সকলের কাছে পরিস্কার হয়েছে, টেকসই জীবনযাপনের দিকে বাংলাদেশের জন্য বড় প্রতিবন্ধক ও হুমকি হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্য নিরাপত্তা । 

তবে সবুজ জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে হলে অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। বাংলাদেশে অনেক গুলো পণ্য আমদানি হয়। যা আর্ন্তজাতিক বাজারের মূল্যের ওপর নির্ভর করে। তবে আমদানিকৃত পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে স্থানীয়ভাবে তৈরি, পরিবেশ-বান্ধব বিকল্পগুলিতে রূপান্তর অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হতে হবে।

টেকসই জীবনধারায় ভোক্তাদের যে সমস্ত মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ
অতিরিক্ত খরচের বোঝা এবং বাজার ব্যবস্থায় সকলশ্রেণী পেশার মানুষের সম-অভিগম্যতার সুযোগ, জৈব খাদ্য, বায়োডেগ্রেডেবল প্যাকেজিং এবং নবায়নযোগ্য সৌর শক্তি সমাধানগুলির মতো টেকসই পণ্যগুলি প্রায়শই প্রচলিত বিকল্পগুলির চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। অনেক ভোক্তা তাদের দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা সত্ত্বেও সামর্থের অভাবে এই বিকল্পগুলি ক্রয় করতে পারে না। একইভাবে, টেকসই চাষের কৌশলগুলি খাদ্য নিরাপত্তা বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাধারন মানুষের মাঝে এ বিষয়ে তবে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। ক্রয়ক্ষমতার দিকে নজর না দেওয়া হলে টেকসই বিকল্পগুলি বেশিরভাগ সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে না। 

ভুল তথ্য এবং পরিবেশবান্ধব
অনেক ভোক্তা সত্যিকারের টেকসই পণ্য এবং সত্যিকারের পরিবেশবান্ধব সুবিধা ছাড়াই "সবুজ" হিসাবে বিপণনকারীদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। পরিবেশ বান্ধব নয় এমন সব ব্যবসাগুলিকে যখন মিথ্যাভাবে পরিবেশগত দায়বদ্ধতা দাবি করে তখন ভোক্তাদের পক্ষে সত্যিকারের পরিবেশ বান্ধব পণ্যগুলো পছন্দগুলি করা আরও কঠিন হয়ে যায়। টেকসই দাবিগুলি বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য স্পষ্ট লেবেলিং, জনসচেতনতা প্রচার ও শক্তিশালী আইনগত বিধিবিধান প্রয়োজন।

অবকাঠামো ও নীতিগত ফাঁকফোকর
পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুবিধার অভাব, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা এবং পরিবেশগত নীতিগুলির দুর্বল প্রয়োগের কারনে টেকসই ব্যবহারের রূপান্তরকে বাধা দিচ্ছে। যদিও প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ এবং সংরক্ষণের প্রচেষ্টা গতি অর্জন করেছে, বর্জ্য নিষ্পত্তি এবং টেকসই পণ্যের প্রাপ্যতায় চ্যালেঞ্জগুলি এখনও বিদ্যামান। উন্নত অবকাঠামো, যেমন উন্নত পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রোগ্রাম এবং ব্যবসায়ের জন্য পরিবেশ-বান্ধব প্যাকেজিং গ্রহণের জন্য প্রণোদনা, এই ব্যবধানটি পূরণ করতে সহায়তা করতে পারে।

ভোক্তাদের জন্য ন্যায্য রূপান্তরকে সমর্থন করতে পারে
ভোক্তা, ব্যবসা এবং নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা টেকসই উন্নয়নের দিকে এমনভাবে স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারে যা সকল ভোক্তাদের উপকারে আসতে পারে।

ভোক্তা অধিকার ও সচেতনতা জোরদার করা
আমাদের দেশের ভোক্তারা এখনও স্বাধীনভাবে পণ্য পছন্দ করা ও ক্রয় করতে পারে না। তারা বিক্রয় প্রতিনিধি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পণ্য লেবেলিংয়ে স্বচ্ছতার পক্ষে এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দাবির জন্য ব্যবসায়ীকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যার কারণে একটি পরিপূর্ণ লেবেলিং আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও কমিউনিটি গ্রুপ ভিত্তিক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন পেশাজীবি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠানগুলোতে ভোক্তা শিক্ষার সম্প্রসারণ করে সাধারন ভোক্তাদেরকে এ বিষয়ে আরও বেশি অবহিত করা, নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে পারে কিনা সে বিষয়ে আরও ক্ষমতায়িত করতে হবে।

টেকসই পণ্যগুলিকে আরও সাশ্রয়ী মূল্যের করা
টেকসই ও পরিবশে বান্ধব পণ্যের দাম কমাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। সম্ভাব্য ব্যবস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে:
•    প্রচলিত বিকল্পগুলির সাথে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য পরিবেশ-বান্ধব পণ্যগুলিকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
•    টেকসই অনুশীলন গ্রহণকারী ব্যবসায়ের জন্য কর প্রণোদনা, সবুজ পণ্যগুলির বিস্তৃত গ্রহণকে উত্সাহিত করা।
•    টেকসই পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনে বিনিয়োগ, ব্যয়বহুল আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করা।
এই কৌশলগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, টেকসই বিকল্পগুলি পণ্যগুলোর সাধারণ মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হয়ে উঠতে পারে।

স্থানীয় উদ্যোগে টেকসই উদ্যোগকে উৎসাহিত করা
পরিবর্তনের জন্য যে কোন স্থানীয় উদ্যোগের টেকসই কার্যকর পরিবর্তন চালানো সম্ভাব। সমবায়ী ভিত্তিক স্থানীয় কৃষি ও সবজি বাগান, শেয়ারে চলা সাশ্রয়ী গণপরিবহন পরিষেবা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ইলেক্ট্রনিক উপকরণ ও  ড্রাইভের মতো প্রোগ্রামগুলি স্থায়িত্বকে আরও ব্যবহারিক এবং সাশ্রয়ী মূল্যে করতে করতে পারে। পরিবেশসম্মত ও টেকসই জীবনযাত্রাকে উৎসাহিত করে এমন ছোট ব্যবসায়গুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। যেখানে স্থানীয়ভাবে তৈরী বায়োডেগ্রেডেবল পণ্য যা পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করার সময় স্থানীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করতে পারে।

সরকারি বিধিবিধান ও কর্পোরেট জবাবদিহিতা জোরদার করা
সরকারকে অবশ্যই কঠোর পরিবেশগত বিধিবিধান প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে, যেমন:
•    বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং প্লাস্টিক হ্রাসের জন্য ব্যবসাগুলিকে জবাবদিহি করা।
•    সংস্থাগুলির জন্য টেকসই প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করা, তাদের পরিবেশগত প্রভাবের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
•    সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎকে গৃহস্থালি ও ব্যবসার জন্য আরও সহজলভ্য করার জন্য পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রণোদনা প্রসারিত করা।
•    সরকার-সমর্থিত প্রোগ্রামগুলিও টেকসই পাবলিক ট্রান বিকাশের দিকে কাজ করা উচিত

ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরে ব্যবসায়ীদের ভূমিকা
ব্যবসাগুলি সবুজ অনুশীলন গ্রহণ করে, সাশ্রয়ী মূল্যের পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প সরবরাহ করে এবং কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) উদ্যোগে জড়িত হয়ে স্থায়িত্ব প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্জ্য সংগ্রহ অভিযান, পরিবেশগত শিক্ষা প্রচার এবং বৃক্ষরোপণ প্রচেষ্টার মতো টেকসই প্রোগ্রামগুলি চালানোর জন্য বড় বড় করপোরেট গ্রুপ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন(এনজিও)গুলির সাথে অংশীদারিত্ব বাড়ানো যেতে পারে। তাদের ব্যবসায়িক প্রচলিত পদ্ধতিতে স্থায়িত্ব জোরদার করে সবুজ অর্থনীতির দিকে রূপান্তরে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।

সম্মিলিত কর্মের শক্তি
যেহেতু পুরো বিশ্ব এখন একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরের পথে অগ্রসর হচ্ছে, ব্যবসা বানিজ্যসহ প্রত্যেক অংশীজন-ভোক্তা, ব্যবসায়ী, নীতিনির্ধারক এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই তাদের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। টেকসই জীবনযাত্রার দিকে যাত্রা অবশ্যই যাদের আয় ও সম্পদ কম তাদেরকে এপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে বাধা প্রদান করা হলে পুরো সমাজ কোন ভা্বেই এগিয়ে যেতে পারবে না। কারণ কাউকে পিছিয়ে রেখে সমাজ কোনভাবেই এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই সমাধানগুলি অবশ্যই অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫ আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, স্থীয়ত্বশীল জীবনধারায় একজন নাগরিক, একজন ভোক্তা হিসাবে সত্যিকারের পরিবেশগত দায়বদ্ধতার বিষয়টি। যাতে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি, পেশাজীবি যে যে আয়ের হোক না কেন, কেউ যেন স্থায়ীত্বশীল জীবনযাত্রার রূপান্তরে যেন পিছিয়ে না পড়ে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরে টেকসই জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে একসাথে চলে পুরো বিশ্বের জন্য অনুকরনীয় মডেল হয়ে উঠতে বাংলাদেশ যেন নেতৃত্ব দিতে পারে, সে প্রত্যাশা সকলের।

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
[email protected]

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন ও সম্ভাবনা

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ০৯:০৪ এএম
নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন ও সম্ভাবনা
ডা. রুবাইয়াৎ ফেরদৌস

বেগম রোকেয়া বলেছেন- ‘যে জাতি নারীকে অবজ্ঞা করে সে জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না।’ বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন, ‘আমরা সবাই সফল হতে পারব না, যদি আমাদের অর্ধেককে পিছিয়ে রাখা হয়।’

এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন- নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এ দিনটি শুধু উদযাপনের জন্য নয়, বরং নারীদের জীবনমান উন্নত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও সময়।

নারী দিবসের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট:
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা ১৯০৮ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পনেরো হাজার নারী শ্রমিক তাদের কর্মস্থলে ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা কমানো এবং ভোটাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এরপর ১৯০৯ সালে আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় নারী দিবস’ পালন করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, যেখানে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিন নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯১১ সালে প্রথমবার অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ (ইউএনও) এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৭ সালে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারী অধিকার ও সমতার লক্ষ্যে এই দিনটি পালনের আহ্বান জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি শুধু নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দিন নয়, বরং নারীদের অধিকার রক্ষা, সমান সুযোগ তৈরি, লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ফিরে আসি। এবারের প্রতিপাদ্য হলো- ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন- সব নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এনিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে পুরো সমাজের কাছে ছোট ছোট কয়েকটা অর্থপূর্ণ প্রশ্ন আমি ছুড়ে দিতে চাই। আমাদের গুরুজনরা, মনীষী-মহীয়সীরা সত্যিই অনেক সুন্দর কথা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন যদিও-

# তবুও আমরা এখনো কেন লড়াই করেই যাচ্ছি?
# এখনো শত শত মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে যৌতুকের জন্য নির্যাতিত। কেন?
# এখনো কেন তাদের পাতে মাছের লেজটাই নিয়ম করে জোটে?
# এখনো কেন পাবলিক প্লেসে হেনস্থার শিকার হতে হয়?
# এখনো মার্জিতভাবে চললেও নোংরা দৃষ্টির ছোবলে সর্বদা কুঁচকে থাকতে হয়। কেন?
# নারী প্রতিষ্ঠিত হলেও শুনতে হয়- ‘ও নিশ্চয়ই কুপথে রোজগার করে’। কেন?
# এখনো নারী কেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে?
# এখনো নারী সমাজের বেশির ভাগই বিষণ্ণতার রোগী। কেন?
# এখনো নারী ‘কোনটা তোমার আসল বাড়ি’- এই প্রশ্নে ঘুরপাক খায়?
# এখনো নারী মানেই রান্নাঘর। কেন?
# এখনো নারী ‘কে আমার আপন’ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান?
# এখনো কেন পরিবারের কোনো সিদ্ধান্তের বৈঠকে ঠাঁয় হয় না? সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে কণ্ঠ দিতে পারে না? অধিকার তার নেই। কেন?
# এখনো নারী টক্সিক ম্যারাইটাল লাইফেও আতঙ্কগ্রস্ত, আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্কগ্রস্ত? বিয়ের পর আতঙ্ক, স্বামী যদি ডিভোর্স দিয়ে দেয়! আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্ক, সমাজ যদি আমাকেই দোষারোপ করে যে, আমিই খারাপ তাই সংসার টেকাতে পারিনি?
# সব ক্ষেত্রেই এখনো কেন নারীর দোষ?
# শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের পদে পদে বাধা। কেন?
# কেন বেতনবৈষম্য?
# কেন চাকরির সুযোগের অভাব?
# পারিবারিক ও সামাজিক গোঁড়ামি- কেন?
# মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। কেন?

এ প্রশ্নগুলোর বাইরেও হাজার হাজার প্রশ্ন নিয়ে আজও আমাদের নারীসমাজ যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধের অবসান এখন সময়ের দাবি। অথচ দ্য ফ্যাক্ট ইজ, নারী কোনো একক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি একাধারে মা, মেয়ে, স্ত্রী, বোন, কর্মী, নেতা, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড়, স্বপ্নদ্রষ্টা ও সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত। শিক্ষা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, রাজনীতি, ব্যবসা, ক্রীড়া সব ক্ষেত্রে নারীরা সফলতার গল্প লিখছেন। বেগম রোকেয়া থেকে মালালা ইউসুফজাই, মেরি কুরি থেকে কাল্পনা চাওলা। তারা প্রমাণ করেছেন যে, নারী এগিয়ে গেলে সমাজও এগিয়ে যায়।

বিশ্বখ্যাত লেখিকা মায়া এঞ্জেলু বলেছেন- ‘প্রতিবার একজন নারী যখন নিজের জন্য দাঁড়ান, তখন তিনি সব নারীর জন্যও দাঁড়ান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ কবি সুফিয়া কামাল তার ‘আমি নারী’ কবিতায় বলেছেন-
‘আমি সেই নারী-
যে জগতের আলো আঁধারে আপন শক্তিতে জ্বলে,
আমি সেই নারী-
যে প্রেম, সাহস, শক্তি, ভালোবাসায় অনড় ও অমলিন।’

নারী সমাজের ব্যাপারে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ (র.), যিনি ছিলেন একজন সুবিবেচক এবং বিচক্ষণ মানুষ। তার দৃষ্টি এবং চিন্তাশক্তি খুবই প্রখর ও সুনিপুণ ছিল সেই আমলেও। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম মহিলাগণ কখনো জ্ঞানে ও পাণ্ডিত্যে পুরুষ দিগের পশ্চাতে ছিলেন না। এমনকি বহুবিধ শাস্ত্রে তাঁহারা অধিকতর পারদর্শী ও অগ্রণী ছিলেন। কি অস্ত্রবিদ্যায়, কি রাজনীতি, কি রাজ্য শাসন সর্বত্রই তাঁহাদের প্রতিভা প্রকাশ লাভ করিয়াছিল।’ (রচনাবলি; তৃতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৯৫-৯৯)।

দুঃখের বিষয় এখনো অনেক নারী নির্যাতন, বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। আজকের এই দিবসে আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি- নারীর কণ্ঠকে গুরুত্ব দেব, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করব, নারী স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে সম্মান করব। সব নারীকে বলতে চাই- আসুন আমরা কোনো বাধার দেয়ালে থেমে না যাই, বরং সেই দেয়াল ভেঙে নতুন পথ তৈরি করি। কারণ নারী হলো শক্তি, নারী হলো সাহস, নারী হলো আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টা। নারী যখন নিজের শক্তি বুঝতে পারে, তখন সে পুরো বিশ্ব বদলে দিতে পারে। ওইদিন খুব তাড়াতাড়িই আসবে, যেদিন সমতা, ক্ষমতা আর অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে না। ওই নতুন পথে আলোকিত হয়ে নারী-পুরুষ সবাই হাঁটব। দেশ ও জাতিকে উন্নত করব। পরিশেষে, কবি জীবনানন্দ দাসের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
‘আমার ভিতরে রক্তের স্রোত আছে,
আমার চোখে অগ্নিশিখা
আমি থামবো না
আমি হারবো না।’

লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ‍ও সহকারী অধ্যাপক
সাইকিয়াট্রি বিভাগ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল

মহাবিশ্বে গ্রহাণুর বিচরণ ও পৃথিবীর উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৭ এএম
মহাবিশ্বে গ্রহাণুর বিচরণ ও পৃথিবীর উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব
মো. জাহিদুল ইসলাম

যেসব গ্রহ-উপগ্রহ দিয়ে সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছে সেসব গ্রহ-উপগ্রহের অবশিষ্ট টুকরোগুলোই হচ্ছে গ্রহাণু। যা সূর্যকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। এদের মধ্যে মাঝেমধ্যে কয়েকটা ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। গ্রহানু হলো সৌরজগতের অংশ, ছোট গ্রহ, পাথুরে বস্তু যা সাধারনত মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে অবস্থান। আনুমান করা হয় প্রায় ১৩ লক্ষ গ্রহানু রয়েছে।

মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যের এই অঞ্চলকে  গ্রহানু বলয় বলে। এই বলয়ের মধ্যে গ্রহের তুলনায় অনেক ছোট পাথরখণ্ড এবং ধাতু রয়েছে। এই পাথরখণ্ডগুলিকে গ্রহাণুপুঞ্জ বা ছোট গ্রহ বলা হয়। এগুলি পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনেকগুলিকে দূরবীন বা ছোট দূরবীক্ষণ যন্ত্রের (টেলিস্কোপ) মাধ্যমে দেখা যেতে পারে।

সৌরজগতে সম্ভবত কয়েক লক্ষ গ্রহাণু রয়েছে। ৯৬,০০০ এরও বেশি গ্রহাণুকে সংখ্যা দিয়ে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১২,০০০ এর নাম রয়েছে। কিন্তু যদিও অনেক গ্রহাণু আছে, গ্রহাণুপুঞ্জ বলয়ের বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা।  সৌরজগতের প্রথম ১০ কোটি বছরে গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় তার ভরের ৯৯.৯৯% হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করছে। মহাকাশ থেকে রোজ শত শত টন ধুলোবালি নিক্ষিপ্ত হয় পৃথিবীর দিকে।

কোন কোন সময় বছরে প্রায় একবার একটা  ছোট আকৃতির (উদাহরণ স্বরূপ গাড়ির আকারের) গ্রহাণু আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারলেও মেসোস্ফিয়ার স্তরে এসে পুড়ে যায়। কখনো পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না। এদিকে আশার কথা হচ্ছে যে অধিকাংশ গ্রহাণু আকারে খুব ছোট হয়। পৃথিবীর জন্যে পর্যাপ্ত ক্ষতিকর গ্রহাণুর সংখ্যা অবশ্য কম। তাই পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনাও কম।

তবে পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাত হানা একেবারেই অসম্ভব নয়। কিছু কিছু গ্রহাণু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে এক কিলোমিটারেরও কম। অনানুষ্ঠানিকভাবে ৫০ মিটার পর্যন্ত গ্রহাণুর পরিধির   সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চেয়ে ছোট যে কোন কিছু উল্কা নামে পরিচিত। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অগ্রগতির ফলে এবং বিশেষ করে পৃথিবীর কাছাকাছি ঘুরে বেড়ানো বস্তুগুলির ক্ষেত্রে, ৫০ মিটারের চেয়ে ছোট কিছু বস্তু  মাঝে মাঝে পৃথিবীর কাছ দিয়ে যেতে দেখা যায়। তবে ডাইনোসর বিলুপ্তির জন্যে দায়ী ১০-১২ কিলোমিটার পরিধির একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানলে সেটা হবে ভিন্ন এক বিষয়। এমন গ্রহাণুর সংখ্যা খুব কম এবং তা কয়েক মিলিয়ন বছরে একবার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে পারে।

এদিকে গ্রহাণু থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বায়ুমণ্ডল রয়েছে। এর পাশাপাশি পৃথিবীর চারপাশে সমস্ত মহাকাশের শিলাগুলোর ওপর নজর রাখার জন্য নাসাসহ আরও অনেক স্যাটেলাইট রয়েছে। তবে গ্রহাণুর বিশেষ পর্যবেক্ষণ এবং গতিবিধি লক্ষ্য পর্যবেক্ষণ ব্যতীত পৃথিবীর দিকে আগত গ্রহাণু শনাক্ত করা খুব কঠিন। এ ছাড়া, বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ডার্ট নামে নাসা একটি যান মহাকাশে পাঠায়। যা মূলত পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো গ্রহাণুকে তার গতিপথ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

গ্রহাণু সাধারণত অনিয়মিত আকারের হয়। তবে কিছু কিছু  প্রায় গোলাকার গ্রহাণুর দেখা যায়। গ্রহাণুর কোন বায়ুমণ্ডল নেই। গঠনগত দিক থেকে গ্রাহানু ৩ শ্রেণীর হয়ে থাকে। যেমনঃ-  প্রথমটি হচ্ছে C- Type: (Chondrite)। এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই C- Type: (Chondrite) গ্রহাণু সাধারণত কাদা ও সিলিকেট শিলা দ্বারা তৈরি । এরা মূলত সৌরজগতের অন্যতম আদি বস্তু। দ্বিতীয়টি হচ্ছে  S- Type। এই  S- Type ধরনের গ্রহাণু সিলিকেট ও নিকেল-আয়রন দিয়ে গঠিত। তৃতীয় এবং সর্বশেষ  M- Type ধাতব গ্রহাণু ও নিকেল-আয়রন দিয়ে গঠিত।

বিভিন্ন আকারের গ্রহানু রয়েছে, ছোট যেমন মাত্র ১০ মিটার ব্যাসার্ধের আবার বড় আকারেরও গ্রহানু আছে যেমন ভেস্তা যার ব্যাসার্ধ প্রায় ৫৩০ কিমি। গ্রহানু সৌরজগতের সমসাময়িক, বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। তবে গ্রহানু পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে যদি পৃথিবীতে আঘাত হানে ঠিক যেমন ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে ১০ থেকে ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের একটি গ্রহানু পৃথিবীকে আঘাত হেনেছিল। যার ফলাফল হিসেবে আস্তে আস্তে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের মতে গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেটি হবে পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। কোনো একটি শহরে গ্রহাণু এসে পড়লে ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ওই শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। পুরো গ্রহেই তার মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। আর যদি একটা জায়গায় প্রভাব পড়তো তাহলে তো ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর যে স্থানে গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল শুধু সেই স্থানের ডাইনোসরগুলো মারা যেত। ডাইনোসরগুলো পুরো পৃথিবী থেকে  বিলুপ্ত হতো না। অন্য জায়গার ডাইনোসরগুলো বেঁচে থাকতো।

এদিকে পৃথিবীর সাথে গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে যদি কোথাও বড় ধরনের আগুন লেগে যায়, কিম্বা একটা বিশাল গর্ত তৈরি হয় এবং সেখান থেকে যদি সব ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে চলে যায়, তাহলে সারা গ্রহেই ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরকম হলে পৃথিবীর প্রাণীরা হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে না। এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না।

নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে। এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না। নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে। গ্রহানুর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে গ্রহানুকে তিনটি ভাগে বিভিক্ত করা হয়। এদের মধ্যে  প্রধান গ্রহানু বলয় (Main Asteroid Belt) বলয়টি রয়েছে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে। আনুমান করা হয় ১১ লক্ষ থেকে ১৯ লক্ষ গ্রহানু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই বলয়ে। আরেকটি ট্রোজান (Trojans) এটি একটি বিশেষ এলাকা, প্রতি গ্রহের কক্ষপথের দুইটি অংশে সেই গ্রহের মহাকর্ষ বল ও সূর্যের মহাকর্ষ বল সমান, ঠিক এই কারনে ওই অংশে মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে, সেই অংশ ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট নামে পরিচিত।

সর্বশেষটি হলো পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু (Near-Earth Asteroids) যা পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করে। নাসা এই ধরনের গ্রহানুর উপর নজরদারি করে থাকে। সম্প্রতি একটি গ্রহাণুর গতিবিধির নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে ‘২০২৪ ওয়াইআর-৪’ নামের একটি গ্রহাণু। এটি ২০৩২ সালে পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। দিন দিন এ নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। শুরুতে ২০৩২ সালে গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে ১ শতাংশ আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়িয়ে ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে উন্নীত করেন।

গ্রহাণুটির যাত্রাপথ সম্পর্কে নতুন তথ্য পাওয়ার পর এমনটিই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইএসএ)। বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির গতি এবং আকারের আরও নির্ভুলভাবে পরিমাপের জন্য জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহাণুটি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে কোনো সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয় কিনা এই বিষয়টির পাশাপাশি গ্রহাণুটির ছোট ছোট ঝুঁকির দিকটিও ভালোভাবে খতিয়ে দেখতেই টেলিস্কোপটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ‘২০২৪ ওয়াইআর-৪’ গ্রহাণু শনাক্ত করা হয়। এর পর থেকে এটি পৃথিবীর কাছাকাছি আছড়ে পড়তে পারে এমন গ্রহাণুদের ঝুঁকি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে এই গ্রহাণুর ব্যাস ৪০ থেকে ৯০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এটি ২০১৩ সালে রাশিয়ায় আঘাত হানা গ্রহাণুর আকারের মতো হতে পারে। যেই গ্রহাণুটি বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়ে চেলিয়াবিনস্ক শহরে হাজার হাজার জানালার কাচ ভেঙে ফেলেছিল এবং এ ঘটনায় কয়েক শ মানুষ সামান্য আঘাত পেয়েছিল। একটি বরফাচ্ছন্ন হ্রদে আছড়ে পড়ে এই গ্রহাণু। আছড়ে পড়ার পর এর মাত্র ১ মিটার অবশিষ্ট ছিল। তবে যদি ৯০ মিটার আকারের গ্রহাণু আঘাত হানে তাহলে তার প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে।

১৯০৮ সালের সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কা ঘটনাটির মতো প্রভাব ফেলতে পারে। এটি লাখ লাখ গাছকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এবং প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, কয়েকজন মানুষ মারাও যান। যদি এমন আঘাত কোনো বড় শহরের ওপর হয় তবে তার ফলাফল মহাবিপর্যয়ের মতো হতে পারে।

লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
[email protected]

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে লোকসংস্কৃতির ভূমিকা

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:১৬ এএম
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে লোকসংস্কৃতির ভূমিকা
মো. ফয়সাল হোসেন

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) বর্তমান বিশ্বের একটি আলোচিত ও অত্যাবশ্যকীয় নীতি, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বর্তমান উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আধুনিক বিশ্বে উন্নয়ন মানেই শুধু নগরায়ণের দিকে ধাবিত হওয়া নয়; বরং নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে অগ্রসর হওয়াই প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন। পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত এ সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনায় লোকসংস্কৃতির ভূমিকা অপরিসীম। লোকসংস্কৃতি পুরুষানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত জ্ঞান, প্রযুক্তি, বিশ্বাস, রীতি-নীতি, কাহিনী, শিল্প, গান ও ঐতিহ্যলব্ধ জীবনধারার প্রতিফলন। এটি শুধুমাত্র বিনোদন কিংবা অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, বরং একটি দেশের টেকসই উন্নয়নে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। উন্নয়নকে যদি বটবৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে লোকসংস্কৃতি হলো তার শেকড় যা শক্ত ও বিস্তৃত না হলে প্রকৃত উন্নয়ন কাঠামোও টেকসই হয় না। জাতিসংঘ নির্ধারিত ১৭ টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেকগুলোতে লোকসংস্কৃতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে। লোকসংস্কৃতির বস্তগত উপাদান যেমন পরিবেশ বান্ধব ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় নিয়ামিক তেমনি এর অবস্তুগত উপাদান সামাজিক ঐক্য, সচেতনতা বৃদ্ধি ও জ্ঞান প্রসারের অন্যতম পন্থা। 

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)অর্জনে বাঙালি সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা লোকজ জ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত, শিল্প আমাদের আত্মপরিচয় উন্মোচনের করে শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ-জীবনধারায় অগ্রগতির চালিকা শক্তি হিসেবে গুরুত্ব বহন করছে। বাঙালির পাশাপাশি এ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আদিবাসীদের পরিবেশবান্ধব জীবনব্যবস্থা ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান এ উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে আরও সমৃদ্ধ করছে।

টেকসই উন্নয়নের পথে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রকৃতি আমাদের প্রতি দিন দিন বিধ্বংসী হয়ে উঠছে । ফলস্রুতিতে বন্যা, খরা, নদী ভাঙন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো সমস্যার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। লোকসংস্কৃতির বড় প্রাপ্তি এখানেই; এ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে লোকসংস্কৃতি বিভিন্নভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখছে। সুন্দরবনের লোকগাথায় বনদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, যা মানুষকে বন সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে। কৃষিতে  ক্ষতিকারক কীটনাশকের পরিবর্তে ঐতিহ্যগতভাবে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি জৈব সার, ছাই, পুকুরের তলানিতে থাকা কাদা, হাঁস-মুরগির বিষ্টা,  ফসল বিনষ্টকারী পোকা দমনে মেহগুনি ও নিম গাছের ফল ব্যবহারে মাটি, বায়ু ও  পানি  দূষণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে লোকজ্ঞান সমৃদ্ধ খনার বচন শুধু প্রাচীন লোকজ্ঞানই নয় ,বরং এটি এ দেশেরে কৃষিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির অংশ। বচনগুলো আবহাওয়া, সেচ ব্যবস্থা, জমির উর্বরতা ও চাষাবাদ, কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেনো, ঐতিহ্যনির্ভর খনার জ্ঞানগর্ভ বচনে কৃষির মৌলিক কিছু জ্ঞানকে ধারণ করে যা এ দেশের টেকসই অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করে। চাষাবাদ সম্পর্কে খনা বলে- এক অঘ্রাণে ধান, তিন শ্রাবণে পান, ডেকে ডেকে খনা গান, রোদে ধান, ছায়ায় পান। অর্থাৎ, ধান বর্ষায় রোয়া হলে হেমন্তে ফসল পাওয়া যায় এবং পান বর্ষায় চাষ করলে তিন বছরে তা পরিণত হয়। আর রোদে ধানের ফলন ভালো হয় সেই সাথে রোদে ধান শুকালে সেটি অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।অন্যদিকে অতিরিক্ত রোদ পান পাতার সজীবতা নষ্ট করে তাই ছায়াযুক্ত পরিবেশ পান চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষিকেন্দ্রিক এ দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষাবাদ মূলত ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মা ও যমুনা নদীর পানির প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকার চাষাবাদ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, ভূগর্ভস্ত পানি অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ঢাকার ভূগর্ভস্ত পানির স্তর প্রতিবছর ২ মিটার (প্রায় ৭ ফুট) করে নেমে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের উপায় আমরা লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ লোকজীবন নির্ভর গ্রামীণ সংস্কৃতিতে দেখতে পাই। প্রাকৃতিক জলাধারা সংরক্ষণ, কূপ খনন, পুকুর সংরক্ষণ এবং পানি ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধনের ঐতিহ্য পরিলক্ষিত, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব পূরণের পাশাপাশি মানুষকে পানির অপচয় রোধে সচেতনের করে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম অংশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় স্তম্ভ। গ্রাম বাংলার নারী-পুরুষরা বিনা পুঁজিতে ব্যবসা করে সাবলম্বী হচ্ছে। এ শিল্পের তৈরি নকশি কাঁথা, মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্য, তাঁত শিল্প, পাটজাত পণ্য দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিশ্ব বাজারের নজর কাড়ছে। এ শিল্প দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে।

প্রাচীন চর্যাপদের গুহ্য বোধ থেকে শুরু করে কবিগান, পালাগান, গম্ভীরা, আলকাপ গান, বাউল, জারি-সারি, ভাটিয়ালি লোকগানের ইতিহাস আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির শেকড়ে সঞ্চিত। যুগ যুগ ধরে হাসন, লালন, পাগলা কানাই, শাহ আব্দুল করিমের মত সাধকগণ তাদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে মানবতার সুর তুলে ধরেছেন। লালন তার গানে বার্তা দিয়েছেন, ‘‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’’-আমরা সত্যিই যদি সুন্দর একটা পৃথিবী চাই তাহলে প্রথমেই আমাদের মানুষকে ভালোবাসতে হবে, ভ্রাতৃত্ববোধে জাগ্রত হতে হবে। লোকগান এখন শুধু অতীতের স্মৃতিচিহ্ন বা নিছক আনন্দ উল্লাসের মাধ্যম নয়, বরং এটি আধুনিকতার ছোঁয়ায় চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন রূপে ফিরে আসছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী, গানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মেলা ও উৎসবের আয়োজক, কারুশিল্পী ও ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতাদের কর্মসসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তারা দেশ পেরিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জ্ঞান প্রসারের অন্যতম হাতিয়ার লোকসংস্কৃতির এই উপাদান। পরিবেশ, জলবায়ু, সমসমায়িক নানা সংকট, দুর্নীতি, বাল্যবিবাহ, সামাজিক মূল্যবোধ, নারী অধিকারসহ নানা বিষয়ে জনগণের মধ্যে প্রতিনিয়ত সচেতনতা তৈরি করছে। এ দেশের উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও চাঁপানবাবগঞ্জে প্রচলিত গম্ভীরা গান বাল্য বিবাহ সম্পর্কে তারই জানান দেয়; পাকা বাঁশ শক্ত বেশি কাঁচা বাঁশে লাগে ঘুন, অল্প বয়সে বিহ্যা দিলে সংসারে লাগে আগুন, আর ঝগড়া ঝাঁটি মারাপিটা সংসারে রোজ হয় ডেহাটা, সচেতন হইয়ো পিতা-মাতা হইয়ো নাকো নাজেহাল, নানা হে.. লোকসংস্কৃতির ভান্ডার গৃহস্থের গোলা ভরা ধানের মতো; লোক কাহিনী, ধাঁধা, প্রবাদ, ছড়া আমাদের সংস্কৃতির শক্তিশালী অংশ। পুরুষানুক্রমিকভাবে চলে আসা এ সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো মানুষের চিন্তা শক্তির বিকাশ, মূল্যবোধ জাগ্রত করা ও মাতৃভাষার ঐশ্বর্যকে সমৃদ্ধ করে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক  শিক্ষাস্তরে পাঠদানকে আরও সুন্দর, বোধগম্য ও আনন্দদায়ক করার জন্য এর প্রয়োগ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। আগামী বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য লোকসংস্কৃতি পাঠ একজন শিশুকে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলে। 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এ দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান মেমন- পাহাড়পুর, শালবন বিহার, লালবাগ কেল্লা, সুন্দরবন, মহেশখালি, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, মহাস্থানগড়, উয়ারি বটেশ্বরসহ অন্যান্য স্থান দেশের মানুষের পাশিাপাশি বিদেশী দর্শনার্থীর নজর কাড়ছে।পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাজার ও  রাস্তাঘাটের উন্নয়ন সাধন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশীয় পণ্যকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে পর্যটন শিল্প লিঙ্গ সমতায়ও বিশেষ ভূমিকা রাখছে, জাতিকে দক্ষ করে গড়ে তুলছে।

সবমিলিয়ে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের মতো সাংস্কৃতিকভাবে ঐশ্বর্যশীল দেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য লোকসংস্কৃতির যথাযথ ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।  আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পাই, বিশ্বায়নের এই যুগে নিত্য নতুন আধুনিক কলাকৌশল যেমন প্রকৃতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দিন দিন আগ্রাসী করে তুলছে। টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন আমরা এ পৃথিবীকে প্রকৃতভাবে বাসযোগ্য গড়ে তুলতে পারবো। লোকসংস্কৃতি সেই শক্তি যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে মানুষের ঐতিহ্যগত জীবনধারায় রূপ নিয়েছে এবং তার মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও পরিবেশগত জ্ঞান টেকসই জীবনযাত্রার সূচনা করেছে। আমাদের লোকসংস্কৃতি ভান্ডারের গভীরতা ও আধুনিক প্রযুক্তির গতির সাথে সেতু বন্ধন তৈরি করতে পারলে টেকসই উন্নয়ন হবে মানবিক ও পরিবেশ বান্ধব। 

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী,  ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগ,  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]

‘নদী থেকে সমুদ্রতক’- ফিলিস্তিন আদৌ স্বাধীন?

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:১৪ পিএম
আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ পিএম
‘নদী থেকে সমুদ্রতক’- ফিলিস্তিন আদৌ স্বাধীন?
নাইমুর রহমান

‘কোটি বাঙালি স্বপ্ন দেখে আসবে যে সে দিন
নদী থেকে সমুদ্রতক স্বাধীন ফিলিস্তিন।’

এই স্বপ্ন হয়তো বিশ্বের প্রত্যেক শান্তিকামী নাগরিক দেখেন। একদিন ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে। শেষ হবে পশ্চিমা আগ্রাসন। ইসরায়েলি আয়রন ডোমের কেন্দ্রবিন্দু, গণহত্যার মুণ্ডুহীন মেশিনগান থেমে যাবে।

১৯৬৭ সালের ২১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের সামনে ভিয়েতনামে মার্কিনি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এক কিশোরি তার দিকে তাক করা রাইফেলের ব্যারেলে গুজে দিয়েছিলেন ডেইজি ফুল। কয়েক দশকজুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তার অবিস্মরণীয় প্রতীক হয়ে আছে ফরাসি আলোকচিত্রী মার্ক রিবোদের তোলা ছবিটি।

সেই থেকে এই কাল- যুদ্ধের বিপরীতে একটি নরম ডেইজি ফুলের ক্ষমতা নিয়ে কবিতা, গদ্য ফুটেছে থরে থরে।

একবিংশ শতাব্দীর শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের মুখে একটি ডেইজি ফুল আঁটবে কি না, তা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন নব্যসাম্রাজ্যবাদী বিশ্বনেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে চাঞ্চল্যকর প্রস্তাব দেন ট্রাম্প।

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকাকে ‘উন্নয়নের সারথি’ হিসেবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করতে চান তিনি।

কীভাবে? গাজার পুরো জনগোষ্ঠীকে ‘অন্যত্র সরিয়ে’।

ভূরাজনীতি নিয়ে অল্পবিস্তর জানাশোনা থাকলেই পাঠকের মনে পড়বে ১৯৪৮ সালে সংঘটিত আল-নাকবাহর (ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ফিলিস্তিনে গণহত্যার মাধ্যমে ইসরায়েলি আধিপত্য কায়েম) কথা। 

ঠিক এভাবেই লাখ লাখ ফিলিস্তিনির বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিশ্বনেতারা।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধুনিক যুগে এসেও গায়ের জোরে জমি দখলের সামন্তবাদী আগ্রাসন ঢাকার কোনো চেষ্টাই করেননি ট্রাম্প। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘জেনোসাইড জো’ অবশ্য কোনো অংশে কম ছিলেন না। তবে বাইডেনের আগ্রাসী নীতিগুলো ‘ভদ্র কূটনীতির চাদরে’ মোড়া থাকত।

ট্রাম্প বলছেন, ‘গাজা উপত্যকা দখলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র; আমরা হব গাজার মালিক।’

শুনসান সংবাদ সম্মেলনের নীরবতা ভেঙে এনবিসির সাংবাদিক কেলি ও’ডনেল প্রশ্ন ছোড়েন- ‘গাজার ওপর আধিপত্য বিস্তারের অধিকার কোথায় পেলেন?’ 

জবাবে ট্রাম্পের মন্তব্য ঢেকে দেয় স্বাভাবিক বিবেকসম্পন্ন সোজাসাপ্টা এই প্রশ্নের বৈধতা।

‘যাদের সঙ্গেই এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে- প্রায় সবাই গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানার বিষয়ে সম্মত।’

যাদের সঙ্গে ট্রাম্প আলোচনা করেছেন তারা আর যাই হোক- ফিলিস্তিনের বাসিন্দা নন- এ বিষয়টি নিশ্চিত। ফিলিস্তিনি কোনো বাসিন্দাই দেশের সার্বভৌমত্ব পশ্চিমাদের হাতে দিতে চাইবেন না। যেভাবে চাইবেন না ইসরায়েলি গণহত্যার শিকার হতে।

এ সময় ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল নেতানিয়াহুকে দেখেই বোঝা যায়, হোয়াইট হাউসে এসে ঠকেননি। বন্ধু ট্রাম্পের ‘পরামর্শে’ হত্যাযজ্ঞ থামিয়েছিলেন। এখন আরও বড় গণহত্যার নীলনকশা আঁকবেন- চকচকে হাসিটা যেন এটাই স্পষ্ট করে। 

ফিলিস্তিনের বাসিন্দারা কোথায় যাবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘জর্ডান বা মিসরে যেতে পারেন। দেশ দুটি অভিবাসী নিতে চায় না। কিন্তু আমি বলেছি, নিতে হবে।’

বিখ্যাত আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস কবিতা ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’-এ বলেছেন, ‘সৎরা সকলে মূক-বধির, তাণ্ডব চালাচ্ছে শকুনেরা।’

এক শতাব্দী পার হলেও ইয়েটসের কথা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। তফাৎ শুধু এই- আধুনিক শকুন খোদ বলছেন, ‘আমি নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার। কিন্তু জানি আমাকে সম্মানিত করা হবে না।’

তবে কি নদী থেকে সমুদ্রতক ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বাণী পৌঁছে যাবে না? গাজা উপত্যকায় সাধারণের পদচারণা, মাছের বাজারে হাঁক শোনা যাবে না?- যাবে হয়তো। কিন্তু সেখানে ফিলিস্তিনিদের পায়ের ছাপ ফসিল হয়েই থেকে যাবে।

পারমাণবিক বোমার মুখে ছোট ডেইজি ফুল খুঁজতে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। 

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়