ঢাকা ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
English

বৈষম্য নিরসনের যুগে বড় বৈষম্যের শিকার শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পীরা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৬ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৮ পিএম
বৈষম্য নিরসনের যুগে বড় বৈষম্যের শিকার শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পীরা

বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের দেশীয় সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে একাডেমির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যারা কাজ করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তাদের মধ্যে দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী মো. খুরশিদ আলম, শাকিলা জাফর, আবিদা সুলতানা, শহীদুজ্জামান স্বপন সম্পৃক্ত ছিলেন। নৃত্যশিল্পী হিসেবে একুশে পদকপ্রাপ্ত শামীম আরা নিপা, শিবলী মোহম্মদ, দীপা খন্দকার। যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে  ছিলেন বাঁশিতে শিল্পকলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত মো. মনিরুজ্জামান, বেহালায় সুনীল কর্মকার, বাদশা মিয়া, সরোদে ইউসুফ খান, তবলায় স্বপন নাগ, চন্দন দত্ত ও ওস্তাদ মেহের হোসেন, কিবোর্ডে জাহিদ হোসেন। 

সংগীত, নৃত্য ও যন্ত্রশিল্পে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব শিল্পীরা অসামান্য অবদান রাখলেও তাদের প্রায় সাবাইকে চরম হতাশা ও অতৃপ্তি নিয়ে চাকরি করে কেউ কেউ চাকরি শেষ করেছেন আবার অনেকে বৈষম্যের কারণে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিযুক্ত করছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলেন, শিল্পীদের জন্য সৃষ্ট দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানেই যদি চাকরি করার সব যোগ্যতা, দক্ষতা ও জাতীয় পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করার অবদান রাখা সত্ত্বেও  যে গ্রেডে চাকরির শুরু সেই গ্রেডেই চাকরি শেষ করতে হয় এটা শিল্পীদের জন্য চরম আপমানের ও হতাশার।

 শিল্পীরা ঈশ্বর প্রদত্ত সৃজনশীল মানসিকতা নিয়ে জন্মায় বিধায় তার এই উদ্ভাবনী চিন্তা যখন ব্যক্তি বা জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে পারে তখন দেশ ও জাতির কাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বসংস্কৃতিতে বাংলাদেশের মান বৃদ্ধি ও প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে শিল্পী বা চিন্তকদের ভাবনার পরিবর্তে টাকাওয়ালা ও ক্ষমতাবানদের অসংলগ্ন ও অপসংস্কৃতি চর্চার জয়-জয়কার শুরু হয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে, যার ফলে আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটলেও মানবিক ও সাংস্কৃতিক কোনো উন্নয়ন ঘটেনি বললেই চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির একজন শিল্পী বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিল্পীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরিরত কণ্ঠশিল্পীরা সব থেকে বড় বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন সেই ১৯৮৯ সাল থেকে। কীভাবে একই যোগ্যতা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পীদের জাতীয় বেতন স্কেল দশম গ্রেড আর যন্ত্রশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের বেতন স্কেল নবম গ্রেড হয়- সেই প্রশ্ন আমি জাতির কাছে রাখতে চাই।

সংগীত-নৃত্য-যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে এই বৈষম্য হওয়ায় কণ্ঠশিল্পীরা সার্বক্ষণিক হীনম্মন্যতায় ভোগেন, যা তার সৃষ্টিশীলতা ও পরিবেশনায় চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৮৯ সাল থেকে এই বৈষম্য নিরসনের চেষ্টা চলছে বলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বলে আসছেন। এই বৈষম্য দ্রুততার সঙ্গে দূর করে শিল্পীদের জন্য একমাত্র বিশেষায়িত জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের প্রাধান্য ও যৌক্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা রেখে  আইন ও প্রবিধানমালা প্রণয়ন করার সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের চিন্তার প্রতিফল ঘটাতে হবে দেশের এই একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে।

লেখক: কবি ও গবেষক

আমাদের নির্বাসিত মানবাধিকার ও আগামীর জনপ্রত্যাশা

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৯ এএম
আমাদের নির্বাসিত মানবাধিকার ও আগামীর জনপ্রত্যাশা
অধ্যক্ষ আবদুল খালেক

সহজ ভাষায় মানবাধিকার বলতে আমরা বুঝি, মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার লাভ করে। মানুষের জীবন, অধিকার, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ-সুবিধাগুলোই মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। অধিকারগুলো কেউ কখনো কারও কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না। মানবাধিকারের অধিকতর সুরক্ষা ও নিশ্চয়তার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। সেখানে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কারণে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আমাদের দেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী, মানবাধিকারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার অর্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত কোনো ব্যক্তির জীবন, অধিকার, সমতা ও মর্যাদা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার।’

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানে নিম্নোক্তভাবে মানবাধিকারের চমৎকার চিত্রায়ন লক্ষ করা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মানবাধিকারের মূলনীতিগুলোকে বাংলাদেশ সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং নাগরিকের মানবাধিকার সুরক্ষায় বিভিন্ন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে।’ সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিশ্রাম ও চিত্ত বিনোদন এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানবাধিকারগুলো এবং নাগরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

মানবাধিকার রক্ষা, তার উন্নয়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র প্রশাসন, বিচার ও আইন বিভাগের মাধ্যমে জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও সহায়তার জন্য জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গঠন করে। রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত হলেও জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে। তারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সরকারকে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়। দেশে দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী, ২০১০ সালের ২২ জুন একজন চেয়ারম্যান, একজন সার্বক্ষণিক সদস্য এবং পাঁচজন অবৈতনিক সদস্য সমন্বয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছিল।

কিন্তু জাতীর জন্য বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়, আওয়ামী দুঃশাসনের ১৫ বছরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিশ্ব বিবেককে স্তম্ভিত করেছে। এই সময়ের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে বেআইনি হত্যা, গুম, আয়নাঘর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজত ও রিমান্ডে পরিকল্পিত নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার-আটক, অমানবিক ও অসম্মানজনক আচরণ উল্লেখযোগ্য। এমনকি কারাগারেও কঠিন ও জীবনের জন্য হুমকির মুখোমুখি পরিবেশ তৈরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। গুমের শিকার হওয়া বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী ও ধর্মীয় নেতারা। এসব ঘটনা প্রতিরোধ, তদন্ত বা প্রতিকারের পরিবর্তে দোষীদের উৎসাহ, পদোন্নতি ও পুরস্কৃত করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। একজন অপরাধের অভিযোগে তার স্বজনদের শাস্তি দেওয়ার ঘটনা বিরল কিছু নয়। 

গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, অহেতুক গ্রেপ্তার ও বিচারের সম্মুখীন, সেন্সরশিপ এবং যখন-তখন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুতর বিধিনিষেধ আরোপ অব্যাহত ছিল। বিশ্ববাসী বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ, সংগঠন ও রাজনীতি এমনকি চলাফেরার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিভৎস রূপ অবলোকন করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য সোনার হরিণ বৈকি! সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হলে তাদের সাজা দেওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের আইনে রয়েছে। কিন্তু সরকার সেই আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

লিঙ্গভিত্তিক যৌন নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, জোরপূর্বক বিয়ে, জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা, স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন, মুসলমানদের ধর্মীয় মাহফিলে সুকৌশলে বাধা দেওয়া বিশ্ববাসীকে রীতিমতো হতবাক করেছে। ব্যাংকলুট, অর্থ পাচার, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, বহুমাত্রিক রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ আমাদের লজ্জিত করেছে চরমভাবে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ বলেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে বাংলাদেশে ২ হাজার ৬৯৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন, একই সময়ে ৬৭৭ জন গুমের শিকার হন এবং ১ হাজার ৪৮ জন হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছে। এ ছাড়া ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাসহ ২০২৪ সালের ঘটনা যুক্ত করলে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

যেকোনো দেশের মানবাধিকার রক্ষা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ জন্য দেশের সংবিধানে মানবাধিকার রক্ষার বলিষ্ঠ আইন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ইসলাম ধর্মে সর্বজনীন মানবাধিকারের গ্যারান্টি ও নীতিমালা সংবিধানে সংযোজন অত্যাবশ্যক। মানবাধিকারবিষয়ক অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন যেমন, সব ধরনের জাতিগত বৈষম্য বিলোপ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনভেনশন ১৯৬৫, জাতিগত বিভেদ দমন ও শাস্তিবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন ১৯৭৩, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন ১৯৭৯, মানব পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশন ১৯৪৯, শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯, নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক, অবমাননাকর আচরণ এবং শান্তিবিরোধী কনভেনশন ১৯৮৪-সহ রাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে মানবাধিকারের যেসব ধারা বা আইনের সাদৃশ্য রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আলোকে রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানের মধ্যে প্রয়োজনীয় ধারাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা। সঙ্গে সঙ্গে যেসব আইন মানবাধিকারের প্রতি সংঘাতপূর্ণ সেসব আইনের সংস্কার ও সংশোধন করা। স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। কেননা মানবাধিকার সুরক্ষায় যেকোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিবেশে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানবাধিকার রক্ষায় কতিপয় সংস্কার ও কঠোর বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। আইনের ফাঁকফোকরে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা আর্থিক লাভের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটাতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বাগ্রে মনোনিবেশ করতে হবে। সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরণ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নির্মূলে কঠোর আইন প্রণয়ন সময়ের দাবি। ১৪৪ ধারার অপপ্রয়োগ, ওয়ারেন্টবিহীন আসামি গ্রেপ্তার, আসামি গ্রেপ্তারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে থানায় হস্তান্তর, রিমান্ডে অনাকাঙ্ক্ষিত ও নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে কার্যকর আইন প্রণয়ন মানবাধিকার রক্ষার অন্যতম উপাদান। একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি মানবাধিকারকে সুসংহত করবে নিঃসন্দেহে। শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমন মানবাধিকারের অন্যতম মাপকাঠি।

অন্যের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও লুণ্ঠনের বিষয়ে কঠোর থেকে কঠোরতর পদক্ষেপ আওয়ামী স্বৈরশাসক কর্তৃক ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকারকে পুনরুদ্ধার করতে পারবে। নারী ও শিশু নির্যাতন, গুম, খুন, মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধগুলো নির্মূলে সুপরিকল্পিত ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়নে ব্যর্থ হলে মানবাধিকার চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুরোপুরি নিশ্চিত করা, অবাধ তথ্য প্রবাহ সহজীকরণ ও গণমাধ্যমকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের নিকটজন প্রত্যাশাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাপটকে জিরো টলারেন্স সীমাবদ্ধ রাখা। সর্বোপরি জনগনের অবাধ ও স্বাধীন মত প্রকাশ ও ধর্ম পালনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম প্রত্যাশাকে মূল্যায়ন করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয় আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ ও কঠোরভাবে বাস্তবায়নের স্পষ্ট নির্দেশনা সমুন্নত রাখবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, হাজিগাঁও বরুমচডা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম

শামস তাবরিজির সুফিবাদী দর্শন: আধ্যাত্মিক প্রেম, একত্ববাদ ও ইসলামি আকিদার সঙ্গতিবিচার

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ পিএম
শামস তাবরিজির সুফিবাদী দর্শন: আধ্যাত্মিক প্রেম, একত্ববাদ ও ইসলামি আকিদার সঙ্গতিবিচার
মো. রেজাউল করিম

শামস আল-দিন তাবরিজি ছিলেন পারস্যের (বর্তমান ইরান) এক বিখ্যাত সুফি সাধক। তাবরিজির নামের অর্থ ‘সূর্য,’ যা তার জ্ঞানের আলোকময়তা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। তাবরিজির সাথে জালালুদ্দিন রুমির সাক্ষাৎ রুমির জীবন ও দর্শনের গতিপথে আমূল পরিবর্তন করে দেয়, যা পরবর্তী সময়ে রুমির বিখ্যাত রচনা ‘Diwan-e Shams-e Tabrizi’-তে ফুটে ওঠে। তাবরিজির জীবন এবং তার অনুসৃত সুফিবাদী দর্শন মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে গভীর সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে। 

তাবরিজির জীবন ও সুফিবাদী দর্শনের সম্পর্ক: ইতিহাসে তাবরিজির জীবন বেশ ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং রহস্যে আবৃত। তাকে বলা হতো ‘পারিন্দা’ বা ‘পাখি’। কারণ তিনি কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থির হয়ে থাকতেন না। বরং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতেন, যেন সৃষ্টিকর্তার খোঁজে তার পথযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন এবং নিজের আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, সত্যিকারের সাধকের জীবন নির্ভর করে অন্তরের শুদ্ধতার ওপরে, বাহ্যিক ধ্যান-ধারণার ওপরে নয়। সুফিবাদ এমন একটি দর্শন, যেখানে একজন সাধক স্রষ্টার সাথে একাত্মতা লাভের জন্য নিজের আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে স্বীয় জ্ঞান ও প্রেমে অনুরক্ত হন। তাবরিজি সুফিবাদের এই গূঢ় এবং অন্তর্দৃষ্টিমূলক দিকটির অনুসারী ছিলেন, যা শুধুমাত্র তত্ত্বকথায় সীমাবদ্ধ না থেকে বরং জীবনের প্রতিটি কাজে এবং ভাবনায় তাঁর স্বীয় দর্শন প্রয়োগের ওপরে গুরুত্ব দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম ও আত্মনিবেদন ছাড়া একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পেতে পারে না। শামস আল-দিন তাবরিজি ছিলেন এক বিস্ময়কর ও বিরল প্রতিভা; যার কাছে মানবপ্রেমের চূড়ান্ত অর্থ ছিল স্রষ্টার প্রতি অবিচল ভালোবাসা ও আত্মসমর্পণ। তিনি এই প্রজ্ঞা অর্জন করেছিলেন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। তিনি বহু দেশ ও জনপদ ভ্রমণ করেন এবং বিভিন্ন ধর্মের দর্শন অধ্যয়ন করেছেন।

তাবরিজির প্রজ্ঞা ও জালালুদ্দিন রুমির ওপরে তাঁর প্রভাব: তাবরিজি আর এক সুফি-সাধক জালালউদ্দিন রুমির জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। রুমির সাথে তাঁর যোগাযোগের ঘটনাটি এক আধ্যাত্মিক গল্প হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। বলা হয়, রুমির সাথে দেখা হওয়ার আগে তাবরিজি স্রষ্টার প্রেম ও উপলব্ধি খুঁজে পেতে নানা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। রুমির জীবনে তাবরিজির আবির্ভাব রুমিকে জীবনের নতুন বোধ ও আত্মশুদ্ধির পথে নিয়ে যায়। তাবরিজি তাঁকে জীবন ও দর্শন প্রশ্নে গভীর চিন্তার মুখোমুখি করেন, যা রুমির চিন্তাকে উদ্দীপ্ত করে এবং তাঁকে আত্মসংশোধনের পথে পরিচালিত করে। তাঁদের দুইজনের মধ্যকার চল্লিশ দিনের আলাপচারিতা রুমির মনে গভীর ছাপ ফেলে এবং তা রুমির জীবন-দর্শন ও সাহিত্যকর্মে আমূল পরিবর্তন আনে।

তাবরিজির প্রজ্ঞা এবং তাঁকে ঘিরে থাকা রহস্যের মূলে ছিল তার সুফিবাদী দর্শনের শক্তি, যা প্রেমের গভীরতার প্রকাশ এবং মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কের আধ্যাত্মিক মেলবন্ধনের ওপরে গুরুত্ব। তাঁর দর্শনে প্রকাশ পায় প্রেম, আত্মত্যাগ এবং একাত্মতার শক্তি। জালালুদ্দিন রুমির কাছে তাবরিজি কেবল একজন বন্ধুই ছিলেন না, বরং ছিলেন ঐশী পথপ্রদর্শক, যাঁর মাধ্যমে রুমি আত্মসংশোধন এবং পরিপূর্ণতার সন্ধান পান। তাবরিজির শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে জালালুদ্দিন রুমি নিজের জীবনে সেই উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং প্রেমের চর্চা করতে শুরু করেন। এই চর্চা রুমির সাহিত্য ও দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে। তাবরিজির নির্দেশনায় রুমি নিজের ভেতরের গভীরতাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং তাঁর কবিতায় স্রষ্টার প্রতি প্রেমের উদাহরণ সৃষ্টি করেন। রুমির ‘Diwan-e Shams-e Tabrizi’ রচনা তাবরিজির প্রজ্ঞার চিরন্তন প্রতীক হিসেবে অমর হয়ে রয়েছে, যেখানে রুমির জন্য তাবরিজি ছিলেন এক বিরল প্রজ্ঞার উৎস।

সর্বোপরি, শামস আল-দিন তাবরিজি সুফিবাদী দর্শনের এক শক্তিশালী প্রতীক, যিনি সত্যিকারের আধ্যাত্মিক প্রেম এবং পরিপূর্ণতায় সন্ধানী ছিলেন। তার শিক্ষার মূল ভিত্তি ছিল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্রষ্টার প্রতি নিবিড় প্রেমের চর্চা, যা শুধু রুমির ওপরই নয় বরং পরবর্তী সব সুফি সাধকের জীবন ও দর্শনেও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।

তাবরিজির ‘ভালোবাসার চল্লিশ নিয়ম’ এবং সুফিবাদী দর্শন: তাবরিজির প্রেমের দর্শন ‘ভালোবাসার চল্লিশটি নিয়ম’-এ প্রকাশ পেয়েছে, যা মানবজীবনের গভীর বোধ ও অন্তর্দর্শনের প্রতিফলন। এই নিয়মগুলো শুধু ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। এই নিয়মগুলোতে তাবরিজি দেখিয়েছেন কেন ও কিভাবে মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত- জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত শুধুই স্রষ্টার প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেম এবং মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ। এই নিয়মগুলোতে তাবরিজি প্রেমের বিভিন্ন স্তর ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, যেখানে বাহ্যিক প্রেমের চেয়ে আত্মিক প্রেম এবং স্রষ্টার প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ নিয়মগুলোতে তিনি বলেন, প্রকৃত প্রেমের জন্য কোনো শর্ত নেই; এটি মানুষের হৃদয়ের গভীরতা থেকে উদ্ভূত হয়। অন্যান্য সুফি-সাধকের মতো তাবরিজিও মনে করতেন, সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা মানেই মানুষের ভেতরের দুঃখ-বেদনাকে উপলব্ধি করে জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে সাধনায় পরিণত করা।

তাবরিজির দর্শনের সাথে সুফিবাদের মিল এবং দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা: তাবরিজির সুফিবাদী দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো- এক ধরনের উচ্চতর আধ্যাত্মিক জীবনযাপন, যা প্রেমের গূঢ় অর্থের ওপরে ভিত্তি করে উৎসারিত। সাধারণত সুফিবাদ মানুষকে বাহ্যিক জীবনের চেয়ে অভ্যন্তরীণ জীবনে মনোযোগ নিবিষ্ট করার শিক্ষা দেয় এবং তাবরিজি এই দর্শনেরই এক অনন্য মূর্ত প্রতীক। তবে তাবরিজির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কিছুটা ব্যতিক্রমী; তিনি নিজের জ্ঞান প্রদর্শনে আগ্রহী ছিলেন না এবং নিজের পরিচিতির চাইতে স্রষ্টার প্রেমে আত্মনিমগ্ন থেকে জীবন অতিবাহিত করতে আগ্রহী ছিলেন। তাবরিজি বিশ্বাস করতেন যে প্রেম এবং স্রষ্টার সঙ্গে মিলনের মাধ্যমে জীবনের চূড়ান্ত পরিপূর্ণতা লাভ সম্ভব। তার জীবনব্যাপী সাধনা ও বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় দর্শনের গবেষণার মধ্যে তিনি অনুধাবন করেন যে স্রষ্টার প্রেমে ডুবে যাওয়ার মাধ্যমেই আত্মার মুক্তি পাওয়া সম্ভব। 

শরিয়ত ও সুফিবাদী দর্শনের দ্বন্দ্ব: ইসলামের মৌলিক আকিদার মূল ভিত্তি হলো একত্ববাদ (তাওহিদ) এবং আল্লাহকে উপাসনার একমাত্র উপযুক্ত সত্তা হিসেবে স্বীকার করা। ইসলাম মানুষকে আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণে এবং শরিয়ত মানার মাধ্যমে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে নির্দেশ করে। অন্যদিকে, সুফিবাদে ইসলামের আধ্যাত্মিক ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক অংশে আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেম নিবেদনের চর্চা করা হয়, যা কখনো কখনো ইসলামের বাহ্যিক শৃঙ্খলার তুলনায় অন্তর্মুখী ভাবনার প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়। যদিও মুসলিম-বিশ্বে খ্যাতিমান সুফিসাধক আব্দুল কাদের জিলানী (র.), খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (র.), মুজাদ্দেদে-আল-ফেসানি (র), বাহাউদ্দিন নকশবন্দিয়া (র.) প্রমুখ কোরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত শরিয়তকে কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন।

ইসলামে শরিয়ত তথা ইসলামের আইন মানা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে ইসলামের মূল নির্দেশনা হচ্ছে- আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা এবং তার প্রয়োজনীয় চর্চা করা। কিন্তু কিছু সুফি-সাধক ইসলামের বাহ্যিক আচার অনুশীলনের বাইরে গিয়ে আধ্যাত্মিক পথে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছেন, যা ইসলামি শরিয়তের মৌলিক আকিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং সম্পূর্ণ বিরোধাত্মক। বহু সুফিসাধক, বিশেষ করে প্রাচীন সুফিবাদী চিন্তাবিদগণ, শরিয়তের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কিছু সুফিসাধক ‘প্রেমের উচ্চতর স্তরে’ পৌঁছাতে শরিয়তের বাহ্যিক নিয়ম থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাকে অনুপ্রাণিত করেন। এটি ইসলামি চিন্তাবিদদের চোখে বিপথগামী এবং ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। কেননা, আল-কোরআনে সালাত, সিয়াম, জাকাত ও হজ (যাদের সামর্থ্য আছে) ইসলামের মূল আকিদা ও অবশ্য করণীয় হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহ একক এবং অতুলনীয়, যা তাওহিদের (একত্ববাদ) মূল ভিত্তি। কিছু সুফিসাধক ‘ওয়াহদাত-উল-ওয়ুজুদ’ বা অস্তিত্বের একত্ববাদে বিশ্বাস করেন, যা আল্লাহর সাথে মানব আত্মার এক ধরনের মিলনের ধারণা। এই বিশ্বাস ইসলামের মূল আকিদা থেকে একেবারেই আলাদা। কারণ ইসলামে বলা হয়েছে আল্লাহ নিরাকার এবং তাঁর সাথে মানুষের আত্মার কোনো রকম মেলবন্ধনের ধারণা কোরআন কিংবা হাদিসে বর্ণিত নেই। 

মুরশিদ বা পথপ্রদর্শক প্রশ্নে বিরোধ: এ ছাড়া সুফিবাদীরা পির বা গুরুকে মুরশিদ বা প্রথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু এই ধারণাও ইসলাম ধর্মের মৌলিকত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, ইসলাম ধর্মের ঐশী গ্রন্থ আল-কোরআনে হযরত মোহম্মদ (স.)কেই একমাত্র পথপ্রদর্শক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। 

সুফিবাদ ও ইসলামি আকিদার দ্বন্দ্ব একটি ভারসাম্যের প্রশ্ন: যদিও আল্লাহর প্রতি প্রেমকে এমন একটি উচ্চতর স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন, যা অনেকেই ইসলামের মৌলিক আকিদা থেকে বিচ্যুতি বলে মনে করেন; তবে অনেক সুফিবাদী চিন্তাবিদগণ (ওপরে উল্লিখিত খ্যাতনামা সুফি পিরগণ) এটা বিশ্বাস করেন যে, শরিয়ত মানা এবং আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেম একে অপরের পরিপূরক। তাঁদের মতে, আল্লাহর প্রতি প্রেমের গভীরতার কারণে একজন মানুষ আল্লাহর আদেশ মানতে আরও আগ্রহী হন এবং তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করেন। তবে, ইসলামি প্রধান ধারার আকিদায় শরিয়তের বাহ্যিক চর্চা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আল-কোরআন ও ছহি হাদিস অনুযায়ী শরিয়তকেই আল্লাহর নিকটে পৌঁছানোর একমাত্র পথ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। নবী মোহাম্মদ (স.) এবং সাহাবিগণ কোরআনে বর্ণিত শরিয়তকেই অনুসরণ করেছেন, মারেফতকে নয়। কিন্তু সুফিবাদীগণ ধর্মের বাহ্যিক চর্চা অপেক্ষা আধ্যাত্মিকতার প্রতি গুরুত্ব দেন বেশি। কিন্তু ইসলামের মৌলিক আকিদায় শরিয়ত এবং আল্লাহর প্রতি প্রেম নয়, বরং তাঁর হুকুমের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তা মান্যতাই স্রষ্টা বা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ। 

সুফিবাদে আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব ও ইসলামি আকিদার সাথে সম্পর্ক: কিছ ইসলামি তাত্ত্বিক এবং সুফিবাদী চিন্তাবিদরা বলেন, সুফিবাদে আধ্যাত্মিকতার ওপরে যে জোর দেওয়া হয় তা আসলে ইসলামেরই এক গভীরতম অংশ এবং এর মাধ্যমে মানুষের আত্মিক উন্নতির মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যে আসা সম্ভব। এভাবে সুফিবাদীদের কাছে ধর্ম শুধু বাহ্যিক আচার নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া যা আল্লাহর প্রতি প্রেমের মাধ্যমে তার নৈকট্যে পৌঁছানো সম্ভব বলে তাঁরা মনে করেন। তবে শরিয়তের চর্চা এবং ইসলামিক আকিদার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য ছাড়া কেবল আধ্যাত্মিক চর্চা আল্লাহর প্রতি প্রেমের একটি সঠিক ও শুদ্ধ পথ হতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলমান, বরং এই দর্শন থেকেই ভণ্ড পিরবাদের উৎপত্তি হয়েছে বলা হয়। 

লেখক: বহুমাত্রিক লেখক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

সংবাদমাধ্যমের ওপর এ কীসের আলামত

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫১ পিএম
সংবাদমাধ্যমের ওপর এ কীসের আলামত
মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী

দেশে একের পর এক সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকি বা আক্রমণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইতোমধ্যে ঢালাওভাবে প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া এবং হুমকি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতের অন্তরায় বলে সম্পাদক পরিষদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও অপরাধের প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের ঢালাও পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঠিক নয়। এটি সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ওপর এক ধরনের আক্রমণ যা, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার শামিল। আবার অন্য দিকে তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কোনো চাপ নেই, তবে স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে গণমাধ্যমকে সাহসের সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। তিনি গুজব ও অপতথ্য প্রতিরোধ গণমাধ্যমকেই অগ্রণী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। তিনি এও বলেন, গত ১৬ বছর গণমাধ্যম যদি সঠিক ভূমিকা পালন করত তাহলে দেশে এ ধরনের ফ্যাসিবাদের উত্থান হতো না। তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন যে, গণমাধ্যমের ফলাও প্রচার এবং নিউজ কভারেজের কারণে ফ্যাসিস্ট সরকারের দ্রুত পতন হতে সক্ষম হয়েছে। মনে রাখা উচিত এখন যেন আবার ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো নতুন করে আচরণ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা দেখতে চায় না। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। তারা সরকারের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরে দিয়ে থাকে।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি যেন যথাযথ সম্মান দেখানো হয় তা নিশ্চিতকরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। উল্লেখ্য, তিন দফায় তথ্য মন্ত্রণালয় দেশের ১৬৭ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। আরও বাতিল করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো পরিস্থিতি অবশ্যই বাংলাদেশ সম্পর্কিত পরিস্থিতির জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন বা মুক্তভাবে কাজ করতে পারাটাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো রাজনৈতিক দলগুলোর মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং ভিন্নমত ও বিরোধী মতামতসহ সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করার অধিকারকে সমর্থন করেন। সত্যি কথা বলতে অধিকাংশ দেশে আইনগতভাবে মুক্ত-স্বাধীন গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংবাদপত্র পরিষদের ঘন ঘন বিবৃতি প্রমাণ করে যে, সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আক্রান্ত কি না। ভারতের এক সিনিয়র সাংবাদিক বলেছেন প্রত্যেক দেশের সংবিধানে, আইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা যখনই বাস্তবায়নের সময় আসে তখন ক্ষমতাসীনরা বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর এটাই বাস্তব। গণতন্ত্রের একটি প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তাহার অন্যতম সূচক। গত ১৬ বছরে অনেক সাংবাদিক খুন হয়েছে বাংলাদেশে। 

সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মীরা সাধারণত খুন বা মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক শ্রেণির অতি উৎসাহীদের কথায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে একের পর এক হত্যা বা খুনের মামলা দিয়ে শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। তারা যেকোনো অন্যায়-অপরাধ করবে না তা কিন্তু নয়। এরপরও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতির কাছে ভুল-ত্রুটি তুলে ধরে। তবে কোনো গণমাধ্যমকর্মী অপরাধ করলে তাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ ধারা অনুসরণ করে আইনি ব্যবস্থা বা প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ বা নালিশ করা যেতে পারে। বলে রাখা ভালো, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে জনগণের রাজত্বের পরিবর্তে দুর্বৃত্তদের রাজত্ব কায়েম হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করার সুযোগ না পায় তাহলে সে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পরবে। কারণ সংবাদপত্র হচ্ছে গণদেবতার বিচারালয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য তিন ধরনের নিরাপত্তা দরকার- আইনি, অর্থনৈতিক ও দৈহিক। আজকাল কর্মক্ষেত্রে সাংবাদিকরা কোনোভবেই নিরাপদ নয়। রাষ্ট্রও সাংবাদিকদের সঠিকভাবে রক্ষাকবচ করতে অবহেলা করে থাকে। মুক্ত সাংবাদিকতা ও টেকসই উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের যেকোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তা সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মীরা দেশের স্বার্থে তুলে ধরা মানে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা নয় বরং সরকারকে সহায়তাই করা। গুজব, মিথ্যা অপপ্রচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে কার্যকর বস্তুই হচ্ছে মুক্ত গণমাধ্যম।

১৮৬০ সালে সংবাদ প্রভাকর লিখেছেন জনগণের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার নিবারণ এবং রাজ নিয়মের শৃঙ্খলাবন্ধন করাই সংবাদপত্র প্রকাশের প্রধান উদ্দেশ্য। সে কালের কাগজেরও কুৎসিত কাদা ছোড়াছুড়ি থাকলেও এখন তেমন আর দেখা যায় না। তবে সরকারের তাবেদারি সবসময় রয়েছে। তবু জনগণের অধিকার, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়, মানুষের মর্যাদা, গণতন্ত্র প্রতিটি ধারণাকে সবকিছুকে টেনে এনেছে সংবাদপত্রগুলো। 

বর্তমান সরকারকে অনুরোধ করব অযথা সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি না করে বরং সাংবাদিক সমাজের কাছ থেকে দেশ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে সুপরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
[email protected]

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক: কৌশল, সংকট ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ পিএম
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক: কৌশল, সংকট ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
রুকাইয়া জামান তানিয়া

পূর্বে রাশিয়া-ইউক্রেন, পশ্চিমে যুদ্ধনীতিতে অকুণ্ঠ সমর্থন আর মধ্যপ্রাচ্যের ভয়াবহ সংকট বিশ্বকে এক চরম অস্থিতিশীলতায় ফেলেছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসের প্রেসিডেন্ট পদে নিরঙ্কুশভাবে নির্বাচিত হয়েছেন রিপাকলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ট্রাম্পের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু না হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের আওতায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে এক ধরনের চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক। সুতরাং ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্বগ্রহণের পর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সীমা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেবে- এমনটাও আশা করা যায় না। তবে এই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক কী ধরনের পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়ে যেতে পারে বা  বাংলাদেশের সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বা জটিলতাগুলো কী হতে পারে এবং বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে ওয়াশিংটন, বেইজিং, নয়াদিল্লির মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য তৈরি হবে সে বিষয়গুলোই আজকের আলোচনা।

বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যক্তি না কি বৈদেশিক নীতি?
বিশ্ব রাজনীতে ব্যক্তি না কি বৈদেশিক নীতি ট্রাম্পের কাছে প্রাধান্য পাবে? অধ্যাপক মেহনাজ মোমেনের মতে, ট্রাম্প ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পর্ক তৈরি করতে ভালোবাসেন, কিন্তু তার বৈদেশিক নীতি ভিন্ন। যেমন ট্রাম্পের নরেন্দ্র মোদি বা ভ্লাদিমির পুতিনকে পছন্দ। কিন্তু বৈদেশিক নীতি ভিন্ন। ২০১৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে ড. ইউনূস ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণকে ‘A SOLAR ECLIPSE’ বলে আখ্যায়িত করেন। অর্থাৎ একটি সূর্যগ্রহণ বা অন্ধকার সময়ের সাথে তুলনা করেছিলেন। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস বা জো বাইডেন অর্থাৎ ডেমোক্র্যাট দলের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মতো। এ থেকে কিছুটা সন্দেহ তৈরি হয় পরিবর্তিত প্রশাসন বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করবে কি না? এ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে পূর্বের ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্যতায় কিছুটা ভাটা পড়তে পারে। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মতে, উভয় দলের সাথে ড. ইউনূসের ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে। যেহেতু ট্রাম্পের কাছে বৈদেশিক নীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পর্কের ভিত্তি থেকে আলাদা, সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের আওতায় খুব বড় রকম পরিবর্তন আসবে এমন আশা করা যায় না। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য রোধে বা সংকুচিত করতে, স্বল্পমূল্যে মানসম্মত পণ্য ও সেবা নিশ্চিত করতে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজের অবস্থান শক্ত করতে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা সমমুখী সম্পর্ক থাকবে বলে অনুমান করা যায়।

বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স
ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারের সময় বলেন, অভিধানে তার সবচেয়ে প্রিয় শব্দ ‘শুল্ক’ এবং তিনি একাধিকবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার আমদানি পণ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে এবং চীনা পণ্যের ক্ষেত্রে যা ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রপ্তানির ২০ থেকে ২২ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৬ শতাংশ শুল্ক প্রদান করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক বাড়ার আশঙ্কা নেই। বরং পণ্যের মান ভালো রাখতে পারলে বাংলাদেশের জন্য আরও সম্ভাবনা বাড়বে। অন্যদিকে চীনা পণ্যের ওপর মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক চীনের পণ্য রপ্তানিকে সংকুচিত করতে পারে। যদি এমন হয় তা হলে বাংলাদেশ তার বাণিজ্যকে আরও বেশি সম্প্রসারিত করতে পারবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের বেক্সিমকো, এসকেএফ, অপসোনিন, স্কয়ার প্রভৃতি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি থেকে স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ওষুধ রপ্তানি হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই খাতে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত রপ্তানি আয় প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। জুলাই থেকে অক্টোবর এই চার মাসে রেমিট্যান্স থেকে বাংলাদেশের আয় প্রায় ১৪১ কোটি ৮২ লাখ ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৬ শতাংশ।

ত্রিকোণোমিক বাণিজ্য ভারসাম্য
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে সবচেয়ে বড় আমদানি অংশীদার চীন। তা হলে ঢাকা কীভাবে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলবে? বিশ্ব রাজনীতিতে প্রতিটি দেশ তার নিজের জাতীয় স্বার্থকে আগে মূল্যায়ন করে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম না। অতএব এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম যা করণীয় তা হলো, দুর্বলতাগুলো অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও নীতি গ্রহণপূর্বক সেগুলোকে শক্তিতে পরিণত করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তিনটি পন্থা অবলম্বন করতে পারে। 

প্রথমত, বাংলাদেশ চীনের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে (অবকাঠামো, ইন্টারনেট, মেশিনারি, রোবটিক্স, ড্রোন ইত্যাদি) বিনিয়োগ বাড়াতে পারে, যা পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের উন্নয়ন সাধন করবে। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ কর্মক্ষেত্রের সুযোগ তৈরি করবে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দূরত্বকে কমিয়ে আনবে এবং কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াবে। 

দ্বিতীয়ত, কৃষি, খাদ্য ও জল ব্যবস্থাপনায় চীনকে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা। বিশেষ করে ভারতের সাথে বরাবরই বাংলাদেশের পানি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সমস্যাটি পুরাতন হলেও তার কোনো কার্যকরী স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হয়নি। দেশের এই পানিসম্পদ রক্ষা, প্রয়োজনে কাজে লাগানো ও অপ্রয়োজনে নিষ্কাশনের মতো ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে তা প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে। 

তৃতীয়ত, আমেরিকার জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশ ঘটানো। কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোচ্চ উপযোগিতায় সর্বোচ্চ রপ্তানি বৃদ্ধি করে দেশীয় উন্নয়নসহ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ তার সৃজনশীলতাকে তুলে ধরতে পারবে।

রোহিঙ্গা সংকটে স্থিতিশীলতা ও অভিবাসী নীতি
রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক সংকট মোকাবিলায় বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও ট্রাম্প প্রশাসন আমাদের প্রতি উদারতা/মানবিকতা দেখাবেন বলে মনে হয় না। আবার ট্রাম্প এটাও চাইবেন না যে, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে কোনো অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্ট হোক। কারণ এই অস্থিতিশীলতা ওয়াশিংটনের প্রভাব কমিয়ে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকবে এবং ট্রাম্প-মোদির বন্ধুত্ব মূলত এই অঞ্চলে বন্ধুর শত্রু-শত্রুকে দমানোর কৌশল। তা হলে এই সংকট নিরসনের উপায় কী? আমরা দেখেছি, ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় রোহিঙ্গাদের অন্য দেশে স্থানান্তরের চিন্তাভাবনা করছেন। কিন্তু ট্রাম্প নিজেই অভিবাসী নীতিতে কঠোর হবেন বলে মনোভাব প্রকাশ করেছেন। সুতরাং ড. ইউনূসের জন্য এটিও খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। সুতরাং যদি বাংলাদেশ বৃহত্তর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিষয়টি রোহিঙ্গাকে ঘিরে ফুটিয়ে তুলতে পারে তা হলে এটি মার্কিন দৃষ্টিগোচর হতে পারে। অন্যথায় যতদিন পর্যন্ত মার্কিন দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভবপর না হয়, ততদিন পর্যন্ত ভিন্ন নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আরাকানে লাখ লাখ রোহিঙ্গার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি বৃহৎ বাজার সৃষ্টির কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে রোহিঙ্গারা একদিকে কর্মসংস্থান পাবে, অন্যদিকে নিজেদের চাহিদার জোগান নিজেরাই করতে পারবে। যা আরাকান সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের জন্য একটা সাময়িক সচ্ছলতার পথ তৈরি করবে। আমেরিকান অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর কথা বললে ট্রাম্প তার দেশে অভিবাসননীতিতে অনেক বেশি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশি ডকুমেন্টেড অভিবাসীদের জন্য এটা তেমন কোনো সমস্যা বয়ে আনবে না। তবে ১৩ মিলিয়ন আনডকুমেন্টেড অভিবাসী এবং যারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করছে বা অবস্থান করছেন, তারা সমস্যার সম্মুখীন হবে। সেক্ষেত্রে অরেকটি প্রশ্ন থেকে যায় তা হলো, অভিবাসী সন্তানদের স্বয়ংক্রিয় নাগরিত্ব বাতিল হলে কী হবে? ট্রাম্প প্রশাসন আগামী জানুয়ারি মাসে কার্যক্রম হাতে নিলে ধীরে ধীরে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

লেখক:
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সমাজসেবার অগ্রদূত রণদা প্রসাদ সাহা

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
সমাজসেবার অগ্রদূত রণদা প্রসাদ সাহা
রণদা প্রসাদ সাহা

কার্তিকের মৃদু ঠান্ডা বাতাস উড়ে আসছে গারো পাহাড় থেকে। আর শালবন থেকে ভেসে আসছে, সাঁঝের নিঃশব্দতায় শিয়াল, প্যাঁচার ডাক। সন্ধ্যার ম্লান আলো ঢেকে গিয়েছে উত্থান একাদশীর শুক্লাপক্ষের দুকূল ভাসানো জ্যোৎস্নায়, সাভারের নিস্তব্ধ এক গ্রাম, কাছৈড়। জীর্ণ আঁতুড়ঘরে রাতের আঁধার বিদীর্ণ করে, কাক ডাকা জ্যোৎস্নায়, জন্ম নেন একজন রণদা প্রসাদ সাহা। কাছৈড় গ্রাম ছিল তার নানার বাড়ি। সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী, মেয়েদের সন্তান জন্মের সময় বাপের বাড়িতে পাঠানো হতো।যদিও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা দেবেন্দ্র নাথের সামর্থ্য ছিল না স্ত্রীকে নিজের কাছে রাখার। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে রণদা ছিলেন মেজো। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও সেই মায়ের সঙ্গটুকুও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি। তার মা অনাদরে, অবহেলায়, আতুড়ঘরের অশুচি পরিবেশে, বিনাচিকিৎসায়, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনি মারা যান। তার মায়ের মৃত্যু ছিল হৃদয়বিদারক, যদিও তৎকালীন সমাজের রীতিতে এমন মৃত্যু এরকম অগ্রাহ্যই করা হতো।

এ শোক যেন তার জীবনজুড়ে এক বিস্তীর্ণ বনস্পতির পতনের মতো ছিল, যার শূন্যতা কোনোদিনও মেটেনি। মায়ের মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে সেই শূন্যতা তার হৃদয়ে গেঁথে যায়। 

মায়ের অকালমৃত্যুর আঘাতই সম্ভবত তাকে পরিণত করেছে এক নিঃস্বার্থ প্রেমিক সমাজসেবীতে। তার সেবা ও মানবকল্যাণের মূল চালিকাশক্তি ছিল মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। 

তৃতীয় শ্রেণির পর রণদার পড়াশোনা আর হয়ে ওঠেনি। বাড়িতে মন টিকেনি। কিশোর বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়েছেন বারংবার। কুলি, শ্রমিক, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা- এমন হেন কোনো কাজ নেই যা তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ছিল না। তার অভিজ্ঞতার বর্ণিলতা রূপালি পর্দার রোমাঞ্চকর মুহূর্তকে হার মানিয়েছে; হয়ে উঠেছেন আমাদের বাস্তবের নায়ক। 

ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের বাইরে তার মধ্যে স্বদেশ ভাবনা উপলব্ধ ছিল। উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে, যা তার সাহসী মনোভাব এবং সংগ্রামী চেতনাকে আরও দৃঢ় করে তোলে। নিঃসংকোচে কারাবরণ করেন। জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, স্বদেশপ্রেমী, স্বশিক্ষিত এই মানুষটি ছিলেন সত্যিকারের মানবতার ফেরিওয়ালা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাগত, ব্রিটিশ ভারত থেকে যোগদান দেন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে। ইরাকের মেসোপটেমিয়া ফ্রন্টে অসুস্থ ও আহত সৈনিকদের সেবা করেন আরও সবার সঙ্গে। উনি যে তার কাজে আরো সবার থেকে আলাদা, ব্যতিক্রমী তা আবারও প্রকাশ পায়। একদিনের কথা। রোগীর তাঁবুতে আগুন লাগে গোলার আঘাতে। সে ভয়াবহ আগুন ছিল অগম্য। আগুনের ভয়ে সবাই জীবন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন রণদা প্রসাদ দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে রোগীদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। শেষ রোগীটিকে বের করে এনে অজ্ঞান হয়ে গেলেন রণদা। বীরত্বগাথা ভূমিকার জন্য বিভিন্ন মহলে প্রশংসা অর্জন করেন। স্বীকৃতি লাভ করেন বৃটিশরাজ থেকে। তাঁর  সুস্থ্য হয়ে দেশে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রণদাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। 

রণদা যখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে ইরাক যান তখন তার সঙ্গে দেখা হয় লম্বা চুল, বড় চোখের প্রাণবন্ত এক যুবক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। রণদা তাকে সংগীত বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যা নজরুলের বেশ পছন্দ হয়।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে বাঙালি পল্টনে যোগ দেন এবং সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিজের অসাধারণ দক্ষতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ করেন এবং পরবর্তীতে স্বদেশী তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দেশে ফিরে আসেন। 

যুদ্ধ শেষে রেলওয়ের টিকিট কালেক্টরের চাকরি শুরু করেন। এই ক্ষুদ্র চাকরি ও মাপা জীবন, তোলা জলে তৃষ্ণা মেটানোর মানুষ তিনি ছিলেন না। যদিও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও বৃহৎ ও আরও প্রসারিত।

তিনি কলকাতায় কয়লা ও লবণের ব্যবসা শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কয়লার একজন বড় ঠিকাদার এবং ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এই সময়ে নদী পথে কয়লাচালিত লঞ্চের মালিক হওয়ার মাধ্যমে তার আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। তার প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের মাধ্যমে তিনি দেশের নৌপথে মালামাল পরিবহণের একটি নতুন যুগের সূচনা করেন। এই বিপুল বিত্ত-বৈভব তাকে বিলাসী করে তুলেনি। বিশাল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি যথেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেননি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাকে আর সবার মতো রূঢ় হতে শেখায়নি। বরং সংসার সন্ন্যাসী মানুষটির মনে ছিল চির বৈরাগ্য। জীবন তাঁকে নিতে নয়, ভালোবেসে বিলিয়ে দিতে শিখিয়েছে, আর তিনি বিলিয়েও দিয়েছেন। এর সাক্ষ্য বহন করে কুমুদিনী ট্রাস্ট। সমাজকল্যাণের এই মহৎ প্রয়াসে রণদা প্রসাদ সাহা দেশের বিভিন্ন দুর্যোগময় মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশাল হৃদয়ের মানুষটি, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট গঠন করে তার সমগ্র সম্পত্তি দাতব্য কাজে বিলেয়ে দিয়েছেন। 

সমাজসেবা এবং মানবকল্যাণে তার অবদান অবর্ণনীয় ও চিন্তার অতীত। ১৯৩৮ সালে, অজপাড়াগাঁয়ে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাসপাতাল গ্রামের দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করে আসছে। তিনি শুধু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাই করেননি, কুমুদিনী হাসপাতালের সঙ্গে নার্স প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহিলাদের জন্য মেডিক্যাল কলেজ, এবং অসহায় নারীদের জন্য ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠা করে তাদের শিক্ষা ও সেবা দানে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার এইসব প্রচেষ্টা ও প্রতিষ্ঠা, তার শৈশবের তাড়িত স্মৃতির স্মারক।

রণদা প্রসাদ সাহা শুধুমাত্র একজন সফল ব্যবসায়ী বা সমাজসেবক ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানবতার অমলিন প্রতীক। সমাজের প্রতি তার অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে, এবং পাকিস্তান সরকার তাকে ‘হেলাল-এ-পাকিস্তান’ সম্মান প্রদান করে। তার মহৎ কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ৭ মে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা তাকে ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে মির্জাপুর থেকে ধরে নিয়ে যায়, যার পর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

ব্যবসায়ী, বিদ্যুৎসাহী ও সমাজসেবার পাশাপাশি রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন সংস্কৃতিপ্রাণ একজন মানুষ। অন্যের মধ্যে শিল্প ও সংস্কৃতির গুণ দেখলে তিনি যেমন তা উস্কে দিতেন, তেমনি নিজেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুরু থেকেই ভারতেশ্বরী হোমসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মির্জাপুরে বিপুল উৎসাহ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সৌখিন নাট্যসংঘ ও মঞ্চ। এমন আধুনিক মঞ্চ তখন পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায়ও ছিল না। ১৯৬৯ সালের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর দুই দিন আনন্দ নিকেতন মঞ্চে ক্ষীরদাপ্রসাদ রচিত ‘আলমগীর’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে বাদশাহ আলমগীরের ভূমিকায় রণদাপ্রসাদের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।

এমন মহান ব্যক্তিত্ব রণদা প্রসাদ সাহা। যিনি নিজের জীবনের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যকে অগ্রাহ্য করেছেন। মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। তার এমন দানের গল্প রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছেন আমাদের অনুপ্রাণ, আমাদের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। তার জীবনালেখ্য আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য জাজ্বল্যমান অনুপ্রেরণার উদাহরণ। 

১৫ নভেম্বর এই নির্মোহ মানুষটির জন্মদিন। নাম-খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত কোনোকিছুরই মোহ তার ছিলনা। নিজের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানও করেননি। তার উত্তরাধিকাররা তার নামে নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন আর. পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়। তার জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ 
আর. পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়

'), descriptionParas[2].nextSibling); } if (descriptionParas.length > 6 && bannerData[arrayKeyTwo] != null) { if (bannerData[arrayKeyTwo].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyTwo].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyTwo].file)), descriptionParas[5].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyTwo].custom_code), descriptionParas[5].nextSibling); } } if (descriptionParas.length > 9 && bannerData[arrayKeyThree] != null) { if (bannerData[arrayKeyThree].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyThree].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyThree].file)), descriptionParas[8].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyThree].custom_code), descriptionParas[8].nextSibling); } } });