ঢাকা ২৪ মাঘ ১৪৩১, শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

বড় গামলা রহস্য এবং ভোক্তা ঠকানো তত্ত্ব!

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:১৩ পিএম
বড় গামলা রহস্য এবং ভোক্তা ঠকানো তত্ত্ব!
রিয়াজুল হক

আপনারা যারা গরুর মাংস কেনেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখবেন ডিজিটাল ওজন মাপার মেশিনটা দোকানের ভেতরে থাকে এবং সেটার উপর অনেক বড় গামলা বসানো থাকে। গামলার গলা এতো উঁচু থাকে যে, গামলার ভেতরের কোনায় আগে থেকে কিছু আছে কিনা, সেটা দোকানের বাইরে থেকে বোঝাও যায় না।

এখানে একটা প্রশ্ন থাকে, এক কেজি বা দুই কেজি বা পাঁচ কেজি মাংস কেনার জন্য এত বড় গামলার কী আদৌ প্রয়োজন আছে? না, নেই। সাধারণত ক্রেতারা তো একসঙ্গে এক কেজি বা দুই কেজি মাংসই কিনে থাকেন।

অথচ ডিজিটাল ওজন মাপার মেশিনের উপর যে গামলা রাখা হয়, সেটা ২০ কেজির উপরে মাংস কিনলে হয়তো প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু ২০ কেজি মাংস দোকান থেকে কয়জন কেনে? যদি ২০ কেজি, ৩০ কেজি বা বেশি মাংসের দরকার হয়, সেক্ষেত্রে তো তিনি গরু কিনে জবাই দেবেন। আবার মাংস পরিমাপ করার জন্য যে ডিজিটাল মেশিন ব্যবহার রাখা হয়, সেই মেশিনের ধারণক্ষমতা একবারে ২০ কেজি আছে কিনা, সেটাও কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। এখানে নিচু গামলা ব্যবহার করা যেতো।

এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এত বড় গামলা ব্যবহার করা হচ্ছে, এর কারণ কী হতে পারে? অনেক জায়গায় দেখা গেছে, গামলার ভেতরে আগে থেকেই খাবার অনুপযোগী চর্বি/ হাড্ডি/ লেজ রাখা হয়। আর আপনার সামনে যে মাংস কাটা হচ্ছে, সেটা সেই আগে থেকে রেখে দেওয়া খাবারের চর্বি /হাড্ডির সঙ্গে মিশিয়ে মাপ দেওয়া হচ্ছে। এই খাবার উপযোগী এবং অনুপোযোগী মাংস মিশিয়ে বিক্রি করার আরেকটি তরিকা আছে। সেটা নিচে দুই নম্বর পরামর্শে উল্লেখ করা হয়েছে।

এবার একটু হিসাব করুন, এক কেজি মাংসের দাম ৭০০ টাকা। আপনাকে যদি এখন ২৫০ গ্রাম খাবার অনুপযোগী চর্বি/ফেলানো হাড্ডি দেওয়া হয়, তাহলে তার দাম দাঁড়ায় কত? আর আপনার সামনে যে মাংস কাটা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে তো চর্বি, হাড্ডি থাকছেই।

যারা বাজারে মাংস কিনতে যান, তাদের প্রতি আমার দুইটি পরামর্শ।

এক) মাংস কেনার সময় যেভাবেই হোক ডিজিটাল মেশিনের উপর রাখা গামলাটি ভালো করে দেখুন, ভেতরে আগে থেকেই চর্বি/হাড্ডি রাখা আছে কিনা? 

আর যদি সম্ভব হয়, ডিজিটাল মেশিন দোকানের ভেতর থেকে বাইরে এনে দোকানের সামনে এনে রাখতে বলুন।

দুই) মাংস বিক্রেতা যে খাটিয়ায় মাংস কাটে, সেই খাটিয়ার কোনায় আগে থেকে যদি অপ্রয়োজনীয় চর্বি/হাড্ডি/লেজ ইত্যাদি থাকে, সেগুলো সরিয়ে ফেলতে বলুন। কারণ মাংস গামলায় রেখে মাপার সময় আপনার অজান্তেই এগুলো অর্থাৎ অখাদ্য চর্বি, হাড্ডি মিশিয়ে দেবে। টেরও পাবেন না।

আর যারা ভোক্তা অধিকারে আছেন, তারা যদি ক্রেতা সেজে এসব দোকান তদারকি করেন এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানার আওতায় নিয়ে আসেন, তাহলে অনেকাংশেই এই ধরণের প্রতারণা কমে যাবে।

সবাই সাবধান হোন। কারণ, সতর্ক না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

‘নদী থেকে সমুদ্রতক’- ফিলিস্তিন আদৌ স্বাধীন?

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:১৪ পিএম
আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ পিএম
‘নদী থেকে সমুদ্রতক’- ফিলিস্তিন আদৌ স্বাধীন?
নাইমুর রহমান

‘কোটি বাঙালি স্বপ্ন দেখে আসবে যে সে দিন
নদী থেকে সমুদ্রতক স্বাধীন ফিলিস্তিন।’

এই স্বপ্ন হয়তো বিশ্বের প্রত্যেক শান্তিকামী নাগরিক দেখেন। একদিন ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে। শেষ হবে পশ্চিমা আগ্রাসন। ইসরায়েলি আয়রন ডোমের কেন্দ্রবিন্দু, গণহত্যার মুণ্ডুহীন মেশিনগান থেমে যাবে।

১৯৬৭ সালের ২১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের সামনে ভিয়েতনামে মার্কিনি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এক কিশোরি তার দিকে তাক করা রাইফেলের ব্যারেলে গুজে দিয়েছিলেন ডেইজি ফুল। কয়েক দশকজুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তার অবিস্মরণীয় প্রতীক হয়ে আছে ফরাসি আলোকচিত্রী মার্ক রিবোদের তোলা ছবিটি।

সেই থেকে এই কাল- যুদ্ধের বিপরীতে একটি নরম ডেইজি ফুলের ক্ষমতা নিয়ে কবিতা, গদ্য ফুটেছে থরে থরে।

একবিংশ শতাব্দীর শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের মুখে একটি ডেইজি ফুল আঁটবে কি না, তা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন নব্যসাম্রাজ্যবাদী বিশ্বনেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে চাঞ্চল্যকর প্রস্তাব দেন ট্রাম্প।

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকাকে ‘উন্নয়নের সারথি’ হিসেবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করতে চান তিনি।

কীভাবে? গাজার পুরো জনগোষ্ঠীকে ‘অন্যত্র সরিয়ে’।

ভূরাজনীতি নিয়ে অল্পবিস্তর জানাশোনা থাকলেই পাঠকের মনে পড়বে ১৯৪৮ সালে সংঘটিত আল-নাকবাহর (ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ফিলিস্তিনে গণহত্যার মাধ্যমে ইসরায়েলি আধিপত্য কায়েম) কথা। 

ঠিক এভাবেই লাখ লাখ ফিলিস্তিনির বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিশ্বনেতারা।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধুনিক যুগে এসেও গায়ের জোরে জমি দখলের সামন্তবাদী আগ্রাসন ঢাকার কোনো চেষ্টাই করেননি ট্রাম্প। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘জেনোসাইড জো’ অবশ্য কোনো অংশে কম ছিলেন না। তবে বাইডেনের আগ্রাসী নীতিগুলো ‘ভদ্র কূটনীতির চাদরে’ মোড়া থাকত।

ট্রাম্প বলছেন, ‘গাজা উপত্যকা দখলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র; আমরা হব গাজার মালিক।’

শুনসান সংবাদ সম্মেলনের নীরবতা ভেঙে এনবিসির সাংবাদিক কেলি ও’ডনেল প্রশ্ন ছোড়েন- ‘গাজার ওপর আধিপত্য বিস্তারের অধিকার কোথায় পেলেন?’ 

জবাবে ট্রাম্পের মন্তব্য ঢেকে দেয় স্বাভাবিক বিবেকসম্পন্ন সোজাসাপ্টা এই প্রশ্নের বৈধতা।

‘যাদের সঙ্গেই এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে- প্রায় সবাই গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানার বিষয়ে সম্মত।’

যাদের সঙ্গে ট্রাম্প আলোচনা করেছেন তারা আর যাই হোক- ফিলিস্তিনের বাসিন্দা নন- এ বিষয়টি নিশ্চিত। ফিলিস্তিনি কোনো বাসিন্দাই দেশের সার্বভৌমত্ব পশ্চিমাদের হাতে দিতে চাইবেন না। যেভাবে চাইবেন না ইসরায়েলি গণহত্যার শিকার হতে।

এ সময় ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল নেতানিয়াহুকে দেখেই বোঝা যায়, হোয়াইট হাউসে এসে ঠকেননি। বন্ধু ট্রাম্পের ‘পরামর্শে’ হত্যাযজ্ঞ থামিয়েছিলেন। এখন আরও বড় গণহত্যার নীলনকশা আঁকবেন- চকচকে হাসিটা যেন এটাই স্পষ্ট করে। 

ফিলিস্তিনের বাসিন্দারা কোথায় যাবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘জর্ডান বা মিসরে যেতে পারেন। দেশ দুটি অভিবাসী নিতে চায় না। কিন্তু আমি বলেছি, নিতে হবে।’

বিখ্যাত আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস কবিতা ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’-এ বলেছেন, ‘সৎরা সকলে মূক-বধির, তাণ্ডব চালাচ্ছে শকুনেরা।’

এক শতাব্দী পার হলেও ইয়েটসের কথা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। তফাৎ শুধু এই- আধুনিক শকুন খোদ বলছেন, ‘আমি নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার। কিন্তু জানি আমাকে সম্মানিত করা হবে না।’

তবে কি নদী থেকে সমুদ্রতক ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বাণী পৌঁছে যাবে না? গাজা উপত্যকায় সাধারণের পদচারণা, মাছের বাজারে হাঁক শোনা যাবে না?- যাবে হয়তো। কিন্তু সেখানে ফিলিস্তিনিদের পায়ের ছাপ ফসিল হয়েই থেকে যাবে।

পারমাণবিক বোমার মুখে ছোট ডেইজি ফুল খুঁজতে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। 

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠাগারের গল্পটি হতে হবে বড়

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:১১ পিএম
পাঠাগারের গল্পটি হতে হবে বড়
আনিছুল হোসেন তারেক

‘গ্রন্থটির কোনো কপি কোথাও না পেয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি স্থির করলাম যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-স্থিত লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে একবার খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে এবং কিমাশ্চর্যম অতঃপরম ‘সমুদ্রের স্বাদ’ সেখানে ঠিকই পাওয়া গেল। যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী আমার ভগিনেয় কিছুকাল আগে বইটি ফটোকপি করে আমাকে পাঠিয়ে দেয়। ‘সমুদ্রের স্বাদ’ উপন্যাসটি ১৯৭০ সালে জ্যাক লন্ডনের ‘দ্য সি উলফ’-এর অনুবাদ করেছিলেন কবীর চৌধুরী। তার পর ২০০৫ সালে নতুন করে পুনর্মুদ্রণ প্রকাশ করতে গিয়ে বইটির মুখবন্ধ লিখেছিলেন।

অবাক করা বিষয় নিশ্চয়ই। এ দেশে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় লিখিত একটি বই কীভাবে আমেরিকার একটি পাঠাগারে? 

সম্প্রতি বিবিসির একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে- এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আমেরিকার ‘পিএল-৪৮০’ কর্মসূচির মধ্যে। ‘পাবলিক ল ৪৮০’ বা ‘পিএল-৪৮০’; এমন একটা মার্কিন উদ্যোগ যা চালু হয়েছিল ১৯৫৪ সালে।

‘ফুড ফর পিস’ নামেও পরিচিত এই উদ্যোগ ছিল শীতল যুদ্ধের সময়কার এক কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্য।

প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের স্বাক্ষরিত এই আইনের আওতায় ভারতের মতো দেশ স্থানীয় মুদ্রায় মার্কিন শস্য কেনার অনুমতি পায়।

এর ফলে একদিকে যেমন দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার বোঝা হ্রাস পায়, তেমনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাদের উদ্বৃত্ত শস্যসংক্রান্ত সমস্যার সমাধানও খুঁজে পায়।

এই খাদ্যসহায়তার অন্যতম বৃহত্তম গ্রহীতা ছিল ভারত। বিশেষত, ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে যখন সে দেশে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা গিয়েছিল।

‘পিএল-৪৮০’-এর আওতায় অংশগ্রহণকারী মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ন্যূনতম ব্যয়ে স্থানীয় মুদ্রা তহবিল সরবরাহ করা হতো।

এই তহবিল ভারতের একাধিক আঞ্চলিক ভাষায় লেখা বই, সাময়িকী, ফোনোগ্রাফ রেকর্ড এবং অন্যান্য মাধ্যম কেনার জন্য ব্যবহার করা হতো।

ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো ১৩২ বছরের পুরানো। সেখানে দক্ষিণ এশিয়াসম্পর্কিত ৮ লাখেরও বেশি বইয়ের খণ্ড রয়েছে, যা এই প্রতিষ্ঠানকে ওই অঞ্চলের (দক্ষিণ এশিয়ার) গবেষণার জন্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশের গ্রন্থাগারের ইতিহাস খুব পুরানো নয়। উপনিবেশিক শাসনামলে ইংরেজদের এবং এলিট-শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি পাঠাগার গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে ৭১টি গণগ্রন্থাগার এবং সরকারি হিসাব মতে, ৯০০-এর মতো বেসরকারি গ্রন্থাগার রয়েছে। এর মধ্যে শতবর্ষী পাঠাগারের সংখ্যা ৩৯টি এবং পঞ্চাশোর্ধ পাঠাগারের সংখ্যা ১৪০টি। বইবান্ধব সমাজ বিনির্মাণে বেসরকারি পাঠাগারগুলোর বিনিয়োগ সরকারি বিনিয়োগের সমপর্যায়ে না হলেও একেবারে কম নয়। প্রান্তিক পর্যায়ের পাঠকদের চাহিদা পূরণে এই বেসরকারি পাঠাগারগুলো কিছুটা হলেও সরকারের সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। 

আমাদের মূল সমস্যা হলো এই পাঠাগারগুলোয়ও পাঠক নেই। এর অন্যতম একটি কারণ হলো মানসম্মত বইয়ের ঘাটতি। সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোয় অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে নিম্নমানের বই কেনা হয়। এই গণগ্রন্থাগারগুলো তাই পাঠকদের তীর্থস্থান না হয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের গাইড বই চর্চার কেন্দ্র হয়ে গেছে। এখানে তথ্য এবং গবেষণামূলক বই তেমন একটা নেই। অন্যদিকে বেসরকারি পাঠাগারগুলো পাঠক চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে যেহেতু বই সংগ্রহ করে, তাই কিছু মানসম্মত বই পাঠক পড়তে পারে। কিন্তু একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারে শুধু গল্প বা উপন্যাস থাকলেই হয় না। সেখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষার তথ্য ও গবেষণামূলক বই, উন্নতমানের রেফারেন্স সেকশন থাকতে হয়। যেখানে গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা একাডেমিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় দেশি-বিদেশি বই পাবে। 

একজন পাঠাগারকর্মী হিসেবে পাঠাগারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি স্কুল, কলেজ পর্যায়ের বইয়ের পাঠকদের একটা বড় অংশই একটা সময়ে আর পাঠাগারমুখী হয় না। এর একটি প্রধান কারণ হলো- তাদের অভিভাবকরা মনে করেন পাঠাগার হচ্ছে গল্পের বই পড়ার জন্য, যা তাদের সন্তানের একাডেমিক পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটায়। আমাদের পড়াশোনা যেহেতু গাইড বইকেন্দ্রিক, তাই তারা একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে পাঠাগার চর্চাকে গুরুত্ব দেন না। 

বলা হয়ে থাকে, একটি সমৃদ্ধ জাতি তৈরি করে সে দেশের সমৃদ্ধ পাঠাগার। অনেকটা পাদপ্রদীপের আড়ালেই বইবান্ধব সমাজ বিনির্মাণে আমাদের দেশে শত শত বেসরকারি পাঠাগার এবং এই পাঠাগারের কর্মীরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সারা বিশ্বে এটি কিন্তু বিরল। এই কাজটি সরকারের করার কথা। সরকার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে এই পাঠাগারগুলোকে অনুদান দিয়ে থাকে। কিন্তু এখানে মূল সমস্যা হলো আস্থাহীনতা। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের কারণে এই অনুদানকে কেন্দ্র করে সাইনবোর্ডসর্বস্ব পাঠাগারের নামে অনুদান নিয়ে যায়। ফলে দেশের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারগুলো আর্থিকসংকটে অচল হয়ে পড়ছে। আমাদের সমাজে যেহেতু পাঠাগারের গুরুত্ব তেমন নেই, তাই সামাজিক অনুদানও তেমন একটা নেই। অথচ এই পাঠাগারগুলোর অধিকাংশই সমাজের মধ্য থেকেই একসময় গড়ে উঠেছিল। শতবর্ষী এবং পঞ্চাশোর্ধ এই পাঠাগারগুলোর স্থায়ী কাঠামো রয়েছে। এই পাঠাগারগুলোকে সচল এবং সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে খুব সহজেই আঞ্চলিক পর্যায় পর্যন্ত পাঠকের বইয়ের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এতে খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এগুলো সরকারি গণগ্রন্থাগার থেকে বেশি কার্যকর হবে। কারণ, এই পাঠাগারগুলো সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুয়তেও খোলা রাখা সম্ভব। এতে করে চাকরিজীবীরা অথবা শিক্ষার্থীরা ছুটির দিনগুলোয় পাঠাগারচর্চা করতে পারবে। 

বিগত সময়ে আমরা পাঠাগারের অনেক রূপ দেখেছি। সেলুন পাঠাগার, স্টেশন পাঠাগার অথবা গ্রামে গ্রামে পাঠাগার, ঘরে ঘরে পাঠাগারসহ অনেক স্লোগান। বইয়ের ফেরিওয়ালা, পাঠাগার উদ্যোক্তাদের নিয়ে হইচই, বিশেষ অনুদান বরাদ্দ, বেশ জাঁকজমকপূর্ণ বইমেলা- সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়েছে সরকার বইবান্ধব সমাজ গঠনে বেশ সিরিয়াস। বই খাতে সরকারের সীমিত বাজেট থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাদের উৎসাহিত করার জন্য। যেখানে দেশের বড় এবং স্থায়ী প্রাচীনতম পাঠাগারগুলো আর্থিকসংকটে প্রায় বন্ধ অথবা জীর্ণ, সেখানে ওই বরাদ্দ, বইমেলা নিয়ে আড়ম্বর আর যাই হোক বইবান্ধব সমাজ গঠিত হবে না। 

পাঠাগারের গল্পটি হতে হবে বড়। এর বিশালতাই পাঠক তৈরি করবে। 

লেখক: পাঠাগারকর্মী
সম্পাদক, শহিদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার
[email protected]

ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের দিন আজ

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম
আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:৩৮ পিএম
ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের দিন আজ
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

আজ ২৯ জানুয়ারি। ১৭৮০ সালের এই দিনে ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্র নামক জ্ঞানভান্ডারের যিনি শুভ সূচনা করেছিলেন, তিনি হলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ভারতের কলকাতা হতে প্রকাশিত ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর সম্পাদক, প্রকাশক তথা ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসের শুভ সূচনাকারী হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। 

সাংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন, নির্ভিক, নিরপেক্ষ, সাহসী ও সংগ্রামী এক পুরুষ। হিকি ছিলেন জাতিতে ইংরেজ। ১৭৭৪ সনে তিনি ভাগ্য অন্বেষণে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম হতে ভারতের হিজলিতে আসেন। কর্মজীবনের প্রথমে তিনি জাহাজের ব্যবসা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত এ ব্যবসাতে বড় ধরণের মার খেয়ে খবরের কাগজ বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই সিদ্ধান্তের ফসল হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’। 

ট্যাবলয়েড সাইজের দুইপাতা বিশিষ্ট ইংরেজি ভাষার প্রকাশনা সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি হিকি কর্তৃক প্রকাশিত ও সম্পাদিত হতো বলে জনসাধারণের কাছে তা ‘হিকির গেজেট’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিল। হিকির গেজেটের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকতো বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন ছাড়াও প্রথম সংখ্যাতে সবার নজর কাড়ে ‘পোয়েটস কর্ণার’ বা কবিদের জন্য বিভাগটি। প্রেম-ভালবাসা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও এ জাতীয় বিমূর্ত বিষয়সহ সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে এখানে কবিতা লিখতেন স্বয়ং হিকি এবং আরও কেউ কেউ। 

হিকির গেজেটের পাঠক শ্রেণির অধিকাংশই ছিল বেসরকারি বণিক এবং ভারতবর্ষে বসবাসরত ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা। হিকির গেজেটে পাঠকদের নিয়মিত চিঠি প্রকাশিত হতো। আর এসব চিঠিতে যেমন থাকত কলকতা বা অন্যান্য জায়গায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের নানা প্রকার অভাব-অভিযোগ ও অসুবিধার কথা, তেমনি থাকত প্রশাসনের দুর্নীতি এবং অন্যায় আচরণের খবর। এমনিভাবে রোহিলা যুদ্ধ, মারাঠা যুদ্ধ এবং তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের ভুল নীতির কঠোর সমালোচনা করে চিঠিও খবর প্রকাশিত হতে থাকে হিকির বেঙ্গল গেজেটে। 

তাছাড়া সেনারা কীভাবে প্রবঞ্চিত হচ্ছে, সরকারি সিক্কা মুদ্রা বাতিলের ফলে লেনদেনে যে অসুবিধার সৃষ্টি হলো, আদালতে কি ধরণের বেআইনি কাজকর্ম চলছে এবং ঘুষ না দিলে যে কিছুই হয় না, সেসব বিষয়ও প্রকাশিত হতো হিকির গেজেটে। 

হিকির গেজেটে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সাহসী সংবাদ প্রকাশের ফলে হিকির গুণাগ্রহীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার শত্রুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সরকারের অপকার্যের কঠোর সমালোচনা করার জন্য হিকিকে জব্দ করার জাল যতই বিস্তৃত হতে থাকল, হিকিও ততই মরিয়া ও বেপরোয়া হয়ে ওঠলেন। বিশেষ করে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস আর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইলিজা ইম্পে প্রচণ্ডভাবে ক্ষেপে যান হিকির ওপর এবং তাকে জব্দ করার উপযুক্ত সময়টুকুর জন্য তারা অপেক্ষা করতে থাকেন। 

কলকতার প্রথম কমিশনার রবার্ট চেম্বারস ও সার্ভেয়ার এডওয়ার্ডটিবেট্রা (যার নামে আজকের টেরিটি বাজার) প্রণীত নগর উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত কর ধার্য প্রস্তাবের বিপক্ষে হিকি তার পত্রিকার মাধ্যমে জনমত ও আন্দোলন সংস্থা গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয়, হিকি তার গেজেটের ৪৩তম সংখ্যাতে লিখলেন ‘কলকতার ইংরেজরা দেশের মঙ্গলের জন্য এ ধরণের সংস্থা গড়ে তোলায় হেস্টিংস ভয় পেয়েছেন। তার আশঙ্কা, এতে তার (হেস্টিংসের) নাম কলংকিত হবে’।

এ খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরই হেস্টিংস ভারতবর্ষের প্রথম খবরের কাগজটির ওপর সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের কাছ থেকে পত্রিকাটি যেসব সুযোগ-সুবিধা পেতেন তা তিনি প্রত্যাহার করে নিলেন। ‘কাউনিসল অব বেঙ্গল’-কে দিয়ে ১৭৮০ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি পাস করে নিলেন জেনারেল পোস্ট অফিসের মাধ্যমে হিকি আর তার কাগজ পাঠাতে পারবেন না গ্রাহকদের কাছে। 

এ ঘটনার পর হিকি তার গেজেটে ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তাকে হোমারের মতো ছোট ছোট গাঁথা রচনা করে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করে বেড়াতে হয়, তবুও তিনি সরকারের অন্যায় কাজের বিরোধিতা করা বন্ধ করবেন না’।

এরপর শুধু হেস্টিংস নয়, হেস্টিংস পত্নীর বিরুদ্ধেও হিকি তার গেজেটে তুলেন সমালোচনারা ঝড়। হেস্টিংস পত্নী সম্পর্কে হিকি লেখেন, ‘সেই সহৃদয়া মহিলার কথা যা শুনেছি, তাতে তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি, তার উদার স্বভাবের সুযোগ নিয়ে যদি তার স্বামীকে প্রভাবিত করে আমাকে কোনো সুযোগ দিতে বলি এবং তার স্বামীও স্ত্রীর প্রতি অসন্দিগ্ধ ভালবাসায় অভিভূত হয়ে তার অন্যায় অনুরোধ মেনে নেন-তবে সেটা খুব সুখের হবে না’।

কলকতার মানুষ ১৭৮০ সালের অক্টোবর সংখ্যায় হিকির গেজেটে খবরের এ অংশটা দেখে টানটান হয়ে বসল। স্ত্রীর প্রতি এই আক্রমণে হেস্টিংস যখন আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ, হিকি তখন নাটকীয়ভাবে তার গেজেটের প্রথম বছরের ৪৩তম সংখ্যায় লিখলেন, ‘কাগজের জন্য তার এখন তিনটি জিনিস হারাবার আছে। সে তিনটি জিনিস হলো তার সম্মান, তার স্বাধীনতা এবং তার জীবন। প্রথমটির জন্য তিনি পরের দুটি হারাতে রাজি আছেন। তাকে অন্যায়ভাবে আটক রেখেও তার ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে, সন্ত্রাস, অত্যাচার চালিয়েও তাকে নিরস্ত করা যাবে না। তার যে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষমতা আছে, তা কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা তার প্রভু সম্রাটও তার হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। কোম্পানি বা তার কর্মচারীদের এমন ক্ষমতা দেওয়াটা বৃটিশ সম্রাটের অভিপ্রেতও নয়”।

হিকি তার গেজেটে এরপর থেকেই হেস্টিংস, কর্ণেল পিয়ার্স, সিমন ড্রোজ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সরাসরি লিখতে থাকলেন। তার আক্রমণের আঘাতটা বেশি করে পড়তে থাকল হেস্টিংস পত্নীর ওপর। আর তাতেই কিছুটা পত্নীপ্রেমেবশংবদ হেস্টিংস মামলা দায়ের করলেন হিকির বিরুদ্ধে। মামলায় দু’দফা অভিযোগের জন্য ৪০ হাজার করে মোট ৮০ হাজার টাকার জামিন দেওয়া হলো তাকে। টাকা দিতে না পারায় তাকে জেলেই থাকতে হলো গভর্নর হেস্টিংসের দায়ের করা মামলায়। জেল থেকেই হিকি চালাতে থাকলেন তার কাগজ। 

আক্রমণের ধার তাতে হলো আরো তীক্ষ্ণ। জেল থেকে এক সময় হিকি ছাড়া পেলেও হেস্টিংস তার এই পরম সমালোচকটির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এবার তিনি হিকির বিরুদ্ধে দায়ের করলেন ক্ষতিপূরণের মামলা। আর বিচারপতি ইম্পেকে দিয়ে (যে ইম্পেকে দিয়ে হেস্টিংস একদিন নন্দকুমারকে জালিয়াত প্রমাণিত করে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ জারি করেছিলেন) হেস্টিংস কৌশল খাটিয়ে বিচার করালেন হিকির বিরুদ্ধে। শত্রুর মুখ বন্ধ করার জন্য হেস্টিংসের ইংগিতেই ১৭৮২ সালের মার্চ মাসে প্রধান বিচারপতি ইম্পে বাজেয়াপ্ত করালেন হিকির প্রেস, ছাপার কাগজ, যন্ত্রপাতি সবকিছু। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হিকিকে তারা করে দিলেন একেবারে নিঃস্ব। 

পরবর্তীতে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও হিকি তার সংবাদপত্রকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু টাকার অভাবে তা আর হিকির পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর এভাবেই অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের রক্তিম সূর্য। এক সময় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিজ মাতৃভূমি ব্রিটেনে যাওয়ার অর্থ সংগ্রহের জন্য চীনের উদ্দেশ্যে জাহাজে যাত্রা করেন জাতির জাগ্রত বিবেক জেমস অগাস্টাস হিকি। কিন্তু তার আর চীনে যাওয়া হলো না। তার আগেই সারা জাগানো বহু খবরের সাংবাদিক হিকি নিজেই হয়ে গেলেন সংবাদ।

১৮০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ প্রকাশিত হলো ছোট্ট একটি খবর-‘চীনে যাবার পথে সমুদ্রে জাহাজের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন জেমস অগাস্টাস হিকি’। ভারবর্ষের সর্বপ্রথম এ সংবাদপত্রটির অতিমাত্রায় স্পষ্টবাদিতা, বস্তুনিষ্ঠতা আর রাষ্ট্রীয় বিরুদ্ধ কেন্দ্রিকতা একে বেশিদিন টিকতে দেয়নি এ কথা সত্যি; তবে এর চেয়ে আরও বেশি সত্যি এই যে, হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ ভারতীয় উপমহাদেশে এমন কোনো এক সংবাদ বিপ্লবরে শুভ সূচনা করে দিয়েছিল, যার ঢেউ ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করে ভারতীয় উপমহাদেশের (বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) সংবাদপত্রগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে-কোনো না কোনো ভাবেই। 

বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী সংবাদ পরিবেশন ও ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবিদকতার পৃথিকৃৎ জেমস অগাস্টাস হিকি আজ আর কেবলমাত্র একটি নাম নয়, একটি ইতিহাসও বটে। আজ ২৯ জানুয়ারি হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রকাশের ২৪৫ বছর পূর্তিতে তাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে।  

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ এবং সহযোগী ডিন, মানবিক ও সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, চণ্ডিগড় ইউনিভার্সিটি, পাঞ্জাব, ইন্ডিয়া। 
[email protected]

কালীপূজা ও খোকসার কালী

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:৩১ পিএম
কালীপূজা ও খোকসার কালী
ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

ভক্তি ধর্মের বাহন! ধর্মের মধ্যে তাই ভক্তিকে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়। পৃথিবীর সব ধর্মের কমবেশি ভক্তি আছে।তবে সব ধর্মে ভক্তি নিবেদনের মাধ্যম এক নয়। সনাতন ধর্ম ভক্তি নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে নির্মল সৌন্দর্যের প্রতীক, পুষ্পকে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই পূজা পুষ্পের ভেতর দিয়েই সম্পন্ন হয়। পূজা অর্থাৎ পুষ্পকর্ম, ফুল দিয়ে অর্চনা। আসলে বনফুলে পূজা হয় না, ‘মনফুল’ দিয়েই পূজা করতে হয়। ‘মনফুল’কে প্রত্যক্ষভাবে দেবতার পায়ে অর্পণ করতে না পেরে আমরা বনফুল দিয়ে থাকি। কিন্ত বনফুলের সঙ্গে ‘মনফুল’ অঞ্জলি হয়ে থাকে। মনকে দেবতার পায়ে নিবেদন করবার উপযুক্ত সুন্দর শুভ্র মাধ্যম পুষ্প। তাই বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন - পুষ্প আপনার জন্যে ফোটে না, তোমার হৃদয় কুসুমকে পরের জন্যে প্রস্ফুটিত করিও।

প্রাচীনকালে সনাতন ধর্মে ফুল দিয়ে অর্চনা অর্থাৎ পূজা ছিল না। উপনিষদের ঋষিগণ নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। কিন্ত কালক্রমে ফুল দিয়ে অর্চনা আরম্ভ হয়। পুরাণের উপাসনার নামও পূজা কেবল পরিবার পরিজনের মঙ্গলের জন্যে নয়, বিশ্বের কল্যাণের জন্যেই অনুষ্ঠিত হয়।

সনাতন ধর্মে বিভিন্ন প্রকার পূজা হয়ে থাকে। কেউ ফুলে-জলে করেন, আবার কেউ ষোড়শোপচারে করেন। তারা গরমের দিনে পাখার বাতাস আর শীতের দিনে পশমি কাপড়ে মূর্তিকে অবরিত করতে দ্বিধা করেন না। যিনি শীত ও গ্রীষ্মের জন্মদাতা, যার শাসনে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তাঁরা, আকাশ, বাতাস সর্বদা নিজ নিজ কাজে নিযুক্ত রয়েছেন, তিনি যে শীত ও গ্রীষ্মে কষ্ট পান- এটা কল্পনা। ভাবগ্রাহী জনার্দন ভাবের ভিখারি, ভক্তির কাঙ্গাল, দ্রব্যের নয়। ভক্তি ভাবটুকুই তিনি গ্রহণ করেন। 

সাকারকে অবলম্বন করেই মূখ্যত পূজা হয়ে থাকে। সাকার পূজা করতে করতে মন নির্মল হয়।বুদ্ধি উন্নত হয় আর নিরাকার নির্গুণ স্বরূপের ধারণাশক্তি জন্মে। মনের ভাবধারার বিকাশ সাধন করাই হচ্ছে পূজার আসল উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যেই ভগবানকে রক্ষকত্বে বরণ করতে হবে, তাঁকে একান্তভাবে আত্নসমর্পণ করতে হবে।

এতক্ষণ গেল পূজার কথা। এবার আসা যাক কালীর কথায়। কালীর কথা বলতে গেলেই শক্তি উপাসনার কথায় আসতে হয়। সমগ্র বিশ্ববিধানের অন্তরালে একটি সর্বশক্তিময়ী মাতৃকাবোধের প্রভাব অতি সর্বশক্তিময়ী মাতৃকাবোধের প্রভাব অতি প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতায় স্বকৃতিলাভ করে আসছে। ঋগ্বেদেও এই আদ্যাশক্তি উল্লেখ আছে।মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, কালিকা পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে এই দেবীর আখ্যান নানাভাবে উল্লেখিত হয়েছে। পাঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুর মহেঞ্জোদারো নগরে শক্তিপূজা প্রচলিত ছিল। এই দুই নগরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অসংখ্য মৃঁন্ময়ী দেবীর মূর্তি আবিষ্কার হয়েছে।

নারীশক্তির পূজা মূখ্যত প্রাচীনকালের মাতৃতান্ত্রিক পরিবার থেকেই শুরু হয়। তখন নারীরাই ছিল পরিবারের প্রধান। আজ থেকে আট হাজার বছর পূর্বে ভোলগা নদীর তীরে প্রথম একটি মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের পরিচয় পাওয়া যায়। যে পরিবারের কর্ত্রী ছিলেন ‘নিশা’। আবার সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের কর্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায় - এমন একটি পরিবারের প্রধানের নাম ‘দিবা’। এই নারীর জন্যেই জনের (প্রজাতন্ত্র) সব প্রকার প্রতিষ্ঠা আসতো বলে সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করতেন। নারীরশক্তি ও মাতৃত্ব এমনিভাবে বহুকাল পূর্ব থেকেই পূজা পেয়ে আসছিল।

বাঙালির শিরায় শিরায় শক্তি - ভাবধারা দীর্ঘকাল থেকে প্রছন্নভাবে বয়ে আসছে। বহুকাল থেকেই এদেশ তন্ত্রধ্যান মাতৃকাপূজার পীঠস্থান, উপরন্তু প্রাচীর বৈদিক যুগ থেকে পৌরাণিক যুগের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগ পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষেই আদ্যাশক্তি কোনো না কোনো প্রকার পূজা উপাসনা চলে আসছে। নারীশক্তির পূজার একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে দুর্গা। দুর্গা চণ্ডীরই নামবিশেষ। ঋগ্বেদে দুর্গা অরুযী (অরুণ বর্ণ) নামে পরিচিত। ঋগ্বেদে এই দেবীর পূজার ব্যবস্থা নেই, তবে স্তব আছে। একথা মনে করার যথেষ্ট হেতু আছে যে, এই দেবীর পূজা লোকসমাজে প্রচলিত ছিল।

ঋগ্বেদে উষার উপাসনা থেকে পরবর্তীকালে পার্বতী বা দুর্গাপূজার উৎপত্তি হয়েছিল।

পার্বতী বা দুর্গা গুহার মধ্যে থাকলে তিনি কালী, গুহামুখে অর্থাৎ গুহার বাইরে থাকলে তিনি গৌরী। লোকসমাজে পূজা পাওয়ার জন্যে দেবী গুহামুখেই থাকেন গৌরী রূপে। তাই তাঁর আরেক এক নাম দ্বারবাসিনী। দুর্গার এই দ্বারবাসিনী গৌরী রূপেই আমরা পূজা করি। দেবীর এই ভিতরে কালো আর বাইরে সাদা রূপের উল্লেখ মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবীর কাহিনীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধের আগে দেবী পার্বতী দেবতাদের প্রবুদ্ধা হয়ে তাঁর ‘অম্বিকা স্বরূপ’ (গৌরী রূপ) প্রকট করলেন - তখন দেবতাদের মনে হয়েছিল তার দেহ থেকে অম্বিকা বেরিয়ে আসবার পর যে খোলস রইল তা কালী হয়ে গেল (৮৫ অধ্যায়, মার্কণ্ডেয় পুরাণ)। পার্বতী হলেন পর্বতবাসিনী দেবী যাকে কঠোপনিষদে বলা হয়েছে হৈমবতী ঊমা, আর পুরাণে বলা হয়েছে দেবী শারদা। ঋগ্বেদের বর্ণনায় দেবী হলেন আসলে গুহাবাসিনী আশ্রয়দাত্রী অন্ধকারের রাত্রির দেবী। তিনি প্রকাশ হন ঊষা রূপে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের কাহিনীতেও তাই। এই দেবী আরাধনার বিশেষ তাৎপর্য আছে। দশম দলে কুলকুণ্ডলিনীতে হাদিনী শক্তির অবস্থান। এই হাদিনীকে জাগ্রত করেই সাধনা করতে হয়।

শক্তি ঊর্দ্ধদেশে গিয়ে পরম শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাধককে সিদ্ধপদবাচ্য করে। শক্তির প্রতীক অসুরকে বা অশুভকে বিনাশ করতে হলে শক্তির প্রয়োজন।

কালী নারীরুপিনী কেন?
নারী যদি অসুর বা অশুভকে আশ্রয় দেয় তাহলে আর কেউ তাকে বধ করতে পারে না। তাই নারীরই কর্তব্য জীবন ও জগৎকে সুস্থ ও স্ফুর্ত করে তুলতে অসুর ও অশুভকে নাশ করা। শুধু কালীপূজাতেই এই সত্য সীমাবদ্ধ নয়। আজও যদি বিশ্বে কেউ শান্তি আনতে পারেন তাহলে তিনি নারী। নারীই পারে আসন্ন পারমানবিক যুদ্ধ বন্ধ করতে। তাই আজকের বারুদাগার বিশ্বে শান্তির জন্য প্রয়োজন কল্যাণী নারীর চির কল্যাণময়ী হস্ত। ধ্বংসন্মুখ পৃথিবী তাই চেয়ে আছে কল্যাণী নারীর দিকে। ব্রক্ষ্মশক্তি, ব্রক্ষ্ম এবং শক্তি অভিন্ন। তাই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন- ‘যেমন জল ও তাহার তরলতা, দুগ্ধ ও তাহার ধবলত্ব মণি ও তাহার জ্যোতি, সমুদ্র ও তাহার তরঙ্গ অভিন্ন। ব্রক্ষ্ম ও শক্তিও তেমনি অভেদ। যিনি কালী, তিনিই ব্রক্ষ্ম’। তাইতো সাধক রামপ্রসাদের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে - ‘কালী ব্রক্ষ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি’।

একসময় আর্য সমাজে সাকার উপাসনা ছিল না। কালক্রমে সাকার উপাসনা প্রবেশ করে। জীবন যখন জটিলতার পথে অনেকখানি এগিয়ে গেল - তখন মানুষ নিরাকারে আর মনস্থির করে রাখতে পারল না। ফলে চিন্ময়ীর ধ্যান থেকে মৃণ্ময়ীর উৎপত্তি হলো।

শুধু কালীপূজা নয় - সনাতন ধর্মে এমন অনেক সাকার উপাসনার পদ্ধতি বিরাজমান। তাই বলে সনাতন ধর্মে সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্ব নেই। বরং এক উদার দার্শনিক আধ্যাত্মিক আর্দশ এই ধর্মের সকল মত ও পথকে এক মিলন মহাসাগরে লীন করেছে। সনাতন ধর্ম সাকার নিরকার, লৌকিক, বৈদিক, যুক্তিমার্গ, স্বধর্ম, পরধর্ম, স্বদেশ, বিদেশ সবাইকে শ্রদ্ধার উদার আসনে বসিয়ে চিরকাল ধরে অখণ্ড মানব মিলনমেলার রাগিনিই বাজিয়ে চলেছে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক তিলোত্তমা

শয়তানের নিঃশ্বাস এবং মাস্ক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৩ পিএম
শয়তানের নিঃশ্বাস এবং মাস্ক
রিয়াজুল হক

করোনাকালীন সময়ের মতো, সবার মাস্ক ব্যবহার শুরু করা উচিত। কারণ এখন দেখা যাচ্ছে, কিছু ছিনতাইকারী নিরীহ আগন্তুক বেশে কাগজে পাউডার মিশিয়ে সেই কাগজ আপনার কাছে দেবে। হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, কাগজে লেখা ঠিকানা আপনি চেনেন কি-না? কাগজটি পড়ার জন্য নাক মুখের কাছে নিবেন, কোনোভাবে কাগজের পাউডার আপনার নাকে গেলেই, আপনার কাজ শেষ। আপনার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে সেই আগন্তুক বাটপারের কাছে। আপনি ঘোরের মধ্যে থাকবেন এবং আপনার নিজের কাছে আপনার নিয়ন্ত্রণ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আর থাকবে না। অনেকেই একে শয়তানের নিঃশ্বাস বলে থাকেন। এরপর ছিনতাইকারীর নির্দেশ মতো আপনি চলতে থাকবেন। আপনার কাছে থাকা মোবাইল, টাকা, গলার চেইনসহ দামি সবকিছু নিজেই তাকে কাছে দিয়ে দিবেন। কোনো ধরনের জোর জবরদস্তি করা লাগবে না। 

একইভাবে, টাকায় পাউডার মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, টাকাটা একটু দেখেন তো, জাল টাকা কি-না? চোখের কাছে নিয়ে পরীক্ষা করতে যাবেন। টাকার সঙ্গে মেশানো পাউডার আপনার নাকে যাবে, একইভাবে আপনার নিয়ন্ত্রণ ছিনতাইকারীদের কাছে চলে যাবে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনটাই ঘটছে।

এখন ছিনতাইয়ের অন্যতম একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই শয়তানের নিঃশ্বাস। এর ঝুঁকি কমানোর একটা অন্যতম উপায় হচ্ছে মাস্ক ব্যবহার করা। এতে করে আপনার নাক-মুখ সংরক্ষিত থাকবে। 

করোনা চলে গেছে কিন্তু প্রতারক তো আছে। আপনি মাস্ক ব্যবহার করলে ছিনতাইকারী প্রতারক হয়তো আপনার কাছেই আসবে না, ঠিকানা জিজ্ঞেস করার জন্য কিংবা নোট পরীক্ষা করানোর জন্য। সুতরাং সতর্ক থাকুন সবাই, মাস্ক ব্যবহার করুন এবং নিরাপদ হোক সবার জীবন।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সালমান/