
আমরা এক অস্বাভাবিক গরমের সময় পার করছি। প্রতিদিনের আবহাওয়ার খবরেই সেই প্রমাণ মেলে। দেশের সব অঞ্চলেই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। কোথাও কােথাও ৪০ ছাড়িয়ে গেছে। বাতাসে আর্দ্রতা কম, ঘাম শুকায় না, ঘর ঠান্ডা হয় না। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, আমরা কী কিছুই করতে পারি না? বিজ্ঞান ও প্রকৃতির উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, পারি। আর সেই উপায়ের নাম হলো, গাছ। বিশেষত দেশীয় গাছ। আর তার মধ্যেও যেটি সবচেয়ে কার্যকর ও উপকারী, তা হলো নিম গাছ।
সম্প্রতি ভারতের আহমেদাবাদ শহরের সিইপিটি ইউনিভার্সিটি একটি গবেষণা করেছে, যেখানে দেশীয় প্রজাতির গাছের মধ্যে বিশেষভাবে নিম গাছ শহুরে উষ্ণতা প্রশমনে কতটা কার্যকর, তা পরিমাপ করা হয়। এই গবেষণায় তারা তাপমাত্রা, বিকিরণ এবং মানবদেহ কতটা গরম অনুভব করে - এই তিনটি দিক পরিমাপ করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিম গাছের কারণে বাতাসের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যায়। মোট বিকিরণ তাপমাত্রা কমে ২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। মানবদেহে তাপমাত্রা ২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম অনুভূত হয়।
এই গবেষণা নগর পরিকল্পনা ও জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোর পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের শহরগুলোতে, যেখানে ঘনবসতি, কংক্রিট এবং গাছপালা কম- সেখানে এ ধরণের দেশীয় ছায়াদানকারী গাছ লাগানো বাস্তবিক অর্থেই তাপমাত্রা কমাতে পারে।
সিইপিটি ইউনিভার্সিটির গবেষণার ফলাফল আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গেও মিলে যায়। আপনি যদি একটি বড় নিম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান, শরীর স্বস্তি পায়, যেন বাতাসও শীতল। কারণ, নিম গাছ ঘন ছায়া দেয়, ট্রান্সপিরেশন প্রক্রিয়ায় পরিবেশে আর্দ্রতা ছাড়ে এবং বিকিরণ তাপ শোষণ করে।
আমাদের দেশে নিম গাছ পরিচিত ও সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও আজ শহরাঞ্চলে এর দেখা মেলে না বললেই চলে। অথচ ঢাকার মতো শহরগুলোতে যেখানে কংক্রিট আর পিচঢালা রাস্তায় ঘেরা, সেখানে যদি প্রতি ব্লকে, প্রতি স্কুল বা হাসপাতালের পাশে অন্তত কয়েকটি নিম গাছ থাকত, তাহলে শহরের গড় তাপমাত্রা অনেকটাই কমে আসত।
নিম গাছের আরও কিছু দারুণ বৈশিষ্ট্য আছে। এটি খুব কম যত্নে বড় হয়, শুষ্ক ও অনুর্বর মাটিতেও জন্মাতে পারে। এতে পানির চাহিদা কম এবং কোনো রাসায়নিক সার না দিলেও চলে। পাশাপাশি এটি বায়ু বিশুদ্ধ করে, রোগজীবাণু দমন করে এবং কৃষিকাজে প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
আজকের প্রেক্ষাপটে নিম গাছ যেন একযোগে পরিবেশ রক্ষাকারী, স্বাস্থ্যরক্ষাকারী এবং জলবায়ু-যোদ্ধা। শহরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য যে সবুজ অবকাঠামো দরকার, নিম গাছ তারমধ্যে অন্যতম।
আমাদের নাগরিক জীবনে এখনই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে যদি প্রতিটি খোলা জায়গায় তিন থেকে পাঁচটি নিম গাছ রোপণ করা যায়, তবে কয়েক বছরের মধ্যে আমরা স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পাব। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, হাসপাতাল ও সরকারি অফিসে পরিকল্পিতভাবে নিম গাছ রোপণের কাজ চালানো যেতে পারে।
একইসঙ্গে দরকার গাছ বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ। অনেক সময় দেখা যায়, গাছ লাগানো হলেও তা ঠিকমতো বড় হয় না, অথবা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শুকিয়ে যায়। তাই রোপণ থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা থাকা দরকার।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দিনে গরমের মাত্রা আরও বাড়বে। এই আগাম সংকেতের মোকাবিলা করতে হলে আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আর সেই প্রস্তুতির অন্যতম অংশ হলো, প্রতিটি অঞ্চলে দেশীয় গাছ লাগানো। আর যদি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, স্বল্প রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও দীর্ঘস্থায়ী উপকার বিবেচনায় আনা হয়, তখন নিম গাছ হয়ে ওঠে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। নিজের শহর, গ্রাম, পাড়া কিংবা স্কুলের প্রাঙ্গণে অন্তত একটি করে নিম গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এই ছোট উদ্যোগই হতে পারে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক