
ঈদ মানেই আনন্দ। দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার, গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন কাটানোর, কিংবা শহরের কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসার এক অবকাশ। এবারের কোরবানির ঈদে যেহেতু একটানা বড় ছুটি পাওয়া গেছে, অনেকেই কর্মস্থল ছেড়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হচ্ছেন। অনেকে বাস বা ট্রেনের ভিড় এড়িয়ে রিজার্ভ প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ভাড়া করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। সঠিক পরিকল্পনা, আরামদায়ক যাত্রা ঠিক আছে, তবে একটি বিষয়ে আমরা খুব কমই নজর দিই। সেটা হচ্ছে, গাড়ির চালকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা।
যে চালক আপনাকে ১৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে পৌঁছে দেবেন, তিনি হয়তো আগের দিনই এমন আরেকটি ভ্রমণ শেষ করেছেন। ঈদের এই মৌসুমে অতিরিক্ত আয়ের আশায় টানা তিন-চার দিন ধরে একটানা ট্রিপ দিয়ে চলেছেন। কখনও ঘুমোতে পারেননি ঠিকঠাক, কখনও খাওয়ার সময়ও পাননি। এভাবে অবসন্ন, ক্লান্ত, ঘুমে ঢুলে পড়া এক চালকের হাতে আপনার পরিবার, আপনার প্রাণ!
দীর্ঘ সময় ধরে একটানা গাড়ি চালানো চালকের জন্য যেমন শারীরিকভাবে কষ্টকর, তেমনি মানসিকভাবে বিপজ্জনকও। নিদ্রাহীনতা মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মনোযোগ বিঘ্নিত করে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক নিরাপত্তা সংস্থার মতে, ঘুম ঘুম ভাব বা ক্লান্তি নিয়ে গাড়ি চালানো মদ্যপ অবস্থায় চালানোর মতোই বিপজ্জনক। বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা না থাকলেও ঈদের সময়ে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে ক্লান্ত চালকদের ভূমিকা যে থাকে, সেটা আমরা দেখতে পাই। চালক যদি ক্লান্ত বা নিদ্রাচ্ছন্ন থাকেন, তবে একটি মুহূর্তের ভুলেই ঘটে যেতে পারে কোনো জীবনের পরিসমাপ্তি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার করণীয় কী?
আপনি যখন গাড়ি রিজার্ভ করছেন, তখন কেবল গাড়ির অবস্থা, এসি কাজ করছে কিনা কিংবা ভাড়া কত হবে, এসবই মাথায় রাখেন। কিন্তু চালকের অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ এটা আপনার প্রথম দায়িত্ব। কারণ, আপনার জীবনের নিরাপত্তা এরসঙ্গে জড়িত। গাড়ি রিজার্ভ করার সময়েই জানতে চান, ‘চালক গত কয়েক দিনে কতগুলো ট্রিপ দিয়েছেন? তিনি কোথা থেকে এসেছেন? ঘুমাতে পেরেছেন কিনা?’
অনেক ড্রাইভার ইচ্ছে করেই ক্লান্তি গোপন করেন। কারণ, তারা জানেন, যাত্রী জানলে ভয় পাবে এবং ভরসা হারাবে। অনেক চালক আবার গাড়ির মালিক বা ট্রাভেল অ্যাজেন্সির চাপে পড়ে একের পর এক যাত্রায় বাধ্য হন। সুতরাং, যদি আপনি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস না করেন, তবে কেউ আপনাকে আগে থেকে সতর্ক করবে না।
যেসব ট্রাভেল অ্যাজেন্সি বা গাড়ির মালিক গাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন, তাদেরও উচিত গাড়ির পাশাপাশি চালকদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া। একের পর এক ট্রিপে বাধ্য করার পরিবর্তে শিফট ভিত্তিক চালক রাখা। প্রতিটি ট্রিপের পরে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা এবং চালকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। কারণ, গাড়ির ব্র্যান্ড নতুন হলে কী হবে, যদি তার ক্লান্ত চালক স্টিয়ারিং-এর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন? এক ফোঁটা ঘুম, এক সেকেন্ডের অসতর্কতা, যার ফলাফল হতে পারে প্রাণঘাতী।
ঈদের মৌসুমে আমরা অনেক কিছু ভেবে ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। কোথায় খাব, কোথায় থাকব, কোন রাস্তায় যাব, সবই চিন্তা করি। কিন্তু চালকের সুস্থতার বিষয়টিই ভুলে যাই। অথচ আপনার ভ্রমণের সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করে চালকের উপর।
যারা আগে বিষয়টি আমলে নেননি, এবারের ঈদে সেই সচেতনতা শুরুতেই গ্রহণ করুন। যাত্রা শুরুর আগে একবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন, ‘শেষ কবে ঘুমিয়েছেন?’
আপনার এই প্রশ্নে হয়তো কিছুটা অস্বস্তি হবে, কিন্তু এই অস্বস্তিই বাঁচাতে পারে অনেক প্রাণ। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনাকে প্রায়ই দুর্ভাগ্য হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পেছনে বহু এড়িয়ে যাওয়া কারণ থাকে। নিজের প্রয়োজনেই সচেতন যাত্রী হিসেবে আপনার দায়িত্ব এই কারণগুলোকে আগে থেকেই চিহ্নিত করা, প্রতিরোধ করা। গাড়ি রিজার্ভ করা মানেই দায়িত্ব শেষ নয়, চালকের খোঁজ নেওয়াও যাত্রার অংশ। এবারের ঈদে সেই সচেতনতা নিয়েই শুরু হোক সবার গন্তব্যের পথে যাত্রা।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক