ঢাকা ১ শ্রাবণ ১৪৩২, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
English

৪৪তম বিসিএস: স্বপ্নের লাইনে দীর্ঘ প্রতীক্ষা

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৪:৪৪ পিএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ০৫:৫৮ পিএম
৪৪তম বিসিএস: স্বপ্নের লাইনে দীর্ঘ প্রতীক্ষা
প্রতীকী ছবি

দেশের লাখো তরুণ–তরুণীর স্বপ্নের নাম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষা। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের এ প্রতিযোগিতা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, দেশের প্রশাসন এবং অগ্রযাত্রায় অংশ নেওয়ারও প্রতীক। কিন্তু ৪৪তম বিসিএসকে কেন্দ্র করে আজ স্বপ্ন আর শঙ্কা পাশাপাশি হাঁটছে অগণিত চাকরিপ্রত্যাশীর মনে।

৪৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় ১১ হাজার ৭৩২ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন, আর চূড়ান্তভাবে ক্যাডার পদ পাবেন মাত্র ১ হাজার ৭১০ জন। অর্থাৎ, প্রতি ছয়জনের মধ্যে কেবল একজন পাবেন তার স্বপ্নের পদটি। আগের বিসিএসগুলোর মতো চূড়ান্ত ফলাফলের আগমুহূর্তে পদসংখ্যা বাড়ানোর আশা করেছিলেন অনেকেই, কিন্তু তেমন কোনও ঘোষণা এখনও আসেনি।

এদিকে দেশের সরকারি দপ্তরগুলোর অর্ধলক্ষাধিক পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও সেগুলো পূরণে ধীরগতি এবং সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠছে দীর্ঘদিন ধরে।

২০২১ সালে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শুরু হওয়া এ বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলের প্রতীক্ষায় কেটে গেছে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময়, যা কেবল চাকরিপ্রত্যাশীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়নি, দেশের প্রশাসনের অগ্রযাত্রাকেও শ্লথ করে দিয়েছে।

শিক্ষা খাতের চিত্রও হতাশাজনক। সরকারি কলেজগুলোর ১০ হাজারের বেশি শিক্ষক পদ খালি থাকা সত্ত্বেও ৪৪তম বিসিএস–এ শিক্ষা ক্যাডারে অতি অল্প পদ রাখা হয়েছে। আর নন–ক্যাডারের পদ রাখা হয়েছে মাত্র ১,৪০০টি, যার বেশিরভাগই কারিগরি খাতের। সাধারণ বিষয়ের স্নাতকদের জন্য এটি আগের চেয়েও প্রতিযোগিতাপূর্ণ করে তুলেছে।

চিকিৎসা খাতের চাহিদা আরও তীব্র। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে পাঁচ হাজারের বেশি চিকিৎসক পদ খালি রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অভাবে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের কষ্ট প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। তবুও বিসিএসের মাধ্যমে চিকিৎসা খাতের শূন্য পদ পূরণে কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের।

চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জমছে কেবল পদসংখ্যা নয়, বরং ধীর এবং অস্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়েও। তাদের আশা, আগামী বিসিএস এবং বিদ্যমান শূন্যপদ পূরণে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। নিয়মিতভাবে শূন্যপদ পূরণ এবং চূড়ান্ত ফলাফলে পদসংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অগণিত মেধাবীর স্বপ্ন পূরণ করা যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

একটি কার্যকর এবং স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা শুধু ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণ নয়, দেশের প্রশাসন এবং সেবাখাতকে আরও শক্তিশালী করবে। তরুণদের আত্মবিশ্বাস এবং আগ্রহ ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজন দ্রুত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

দেশের মেধাবীরাই আগামীর চালিকাশক্তি, আর তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমই হলো সুষ্ঠু এবং নিয়মিত নিয়োগ। তবেই দেশের অগ্রযাত্রা হবে ত্বরান্বিত আর স্বপ্ন আর শঙ্কা নয়, কেবল আত্মপ্রত্যয় আর সাফল্যই প্রতিধ্বনিত হবে আগামীর বিসিএস প্রতিযোগিতায়।

লেখক: এস এম নোমান চৌধুরী- চাকরিপ্রত্যাশী (৪৪তম বিসিএস)

এত ক্যাডার লইয়া আমরা কী করিব!

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০৫:৩৯ পিএম
এত ক্যাডার লইয়া আমরা কী করিব!
হাসিবুল হাসান

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দুই শ্রেণির ক্যাডারের আধিপত্য, দাপট আর বিস্তৃতি চরমভাবে দৃশ্যমান। সমাজে এই দুই শ্রেণির বিস্তার যেভাবে ঘটেছে, অন্য কোনো খাত, শ্রেণি-পেশার গোষ্ঠীর আধিপত্য সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণায় প্রশাসনিক ক্যাডার আর রাজনৈতিক ক্যাডার রাষ্ট্র আর জনগণের জন্য আশীর্বাদ হলেও বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টোটা।

আজকের প্রসঙ্গ কোনো রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, ব্যাকবেঞ্চার নয়, আজকের প্রসঙ্গ ফার্স্ট বেঞ্চের বিসিএস ক্যাডার। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা বিরাট অংশ বিসিএসের মতো চাকরির নেশায় যেভাবে বুঁদ হয়ে থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকে না। তারা মনে করে এ সার্ভিসে যোগদান মানেই জীবনের চূড়ান্ত সফলতা। রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের আরও অনেক কিছু করার সক্ষমতা ছিল, তা না করে আমরা বিনিয়োগ বাড়িয়েছি কেবল ক্যাডার উৎপাদনের দিকে। অথচ মেধা পাচার রোধ করে সর্বোচ্চ মেধাবীদের দিয়ে আমরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতির মতো বড় খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারতাম। শিক্ষার পণ্যায়নের এ যুগে বহুধারায় বিভক্ত শিক্ষাপদ্ধতির মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে বিসিএস।

গত সপ্তাহে ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশের পর ফেসবুকের নিউজ ফিড গরম হয়ে আছে এসব তথাকথিত মেধাবীদের সফলতার খবরে। অসম সামাজিক বিকাশ, সম্মান, আর্থিক সুবিধা, ত্রুটিপূর্ণ সোসিও ইকোনকিম কালচারে এমন সমাজ মনস্কতা আমাদের মধ্যে এমন ন্যারেটিভ ঢুকিয়ে দিয়েছে। যেভাবেই হোক দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পর বিসিএসের চাকরিই হয়ে ওঠে এ দেশের তরুণদের প্রধান লক্ষ্য। অথচ একটা দেশের তরুণদের মেধা ও প্রাণশক্তি ব্যবহার করে আমরা দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য অনেক মহৎ কিছু করতে পারতাম। উন্নত দেশগুলো সেটাই করেছে আর আমরা করেছি মেধা পাচার। এখানে পৃষ্ঠপোশকতা করেছে খোদ সরকার নিজেই। সবাই প্রশাসন ক্যাডার প্রথম পছন্দ দিয়ে বাঙালিকে শাসন করতে চাই, নতুবা কাস্টমস, অথবা পররাষ্ট্র। সবার লক্ষ্য সীমাহীন ক্ষমতাচর্চা করে নিজের চৌদ্দগুষ্টিকে উদ্ধার করা নতুবা অর্থের দখল নেওয়া।

কবি জসীম উদ্‌দীনের বাঙালির হাসির গল্প সংকলনে একটা গল্প ছিল ‘তুমি কেন ঘষো আমি তাহা জানি’। তুমি কেন পররাষ্ট্র, প্রশাসন, কাস্টমসকে পছন্দ করো সেটা মনে হয় আমরা সবাই জানি। একসময় মারাঠা, মুঘল, ইংরেজ, মগ, পাকিস্তানিরা আমাদের শাসন ও শোষণ করেছে। আগে আমরা বিদেশিদের দ্বারা শাসিত হতাম, আর এখন আমরা শাসিত হই দেশের অভ্যন্তরের আমলা আর ভূইফোঁড় রাজনীতিবিদদের দ্বারা। এ তথাকথিতরা প্রজাতন্ত্রের শাসক ও শোষকদের সম্পর্ককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রামরাজত্ব কায়েম করে। অথচ শুধু বিসিএসের পেছনে না ছুটে আমরা আমাদের দেশের অভ্যন্তরে ভালো উৎপাদন ব্যবস্থাপক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী তৈরি করতে পারতাম। আমাদের ভালো বিজ্ঞানী নেই, ভালো গ্লোবাল করপোরেট লিজেন্ড নেই, নেই দক্ষ ম্যানেজার। দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান চলছে বিদেশি দক্ষ জনবল দ্বারা। আমাদের নেই নিজস্ব জ্ঞান, শক্তি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। ৫০ বছর দেশের আকাশসীমা থেকে রেভিনিউ লুট করেছে ভারত। নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে ইসরায়েল বিশ্বে স্বতন্ত্র ভাব তৈরি করে নিয়েছে। ছোট দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর আজ এশিয়ার বাণিজ্যকেন্দ্র, উত্তর কোরিয়া প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে বহির্বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়ে চমক সৃষ্টি করেছে। অথচ জনসংখ্যায় অষ্টম বৃহত্তম দেশ হওয়ার পরও আমাদের অর্জন শূন্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন শুধুই প্রশাসক’। আমলা উৎপাদন মানসিকতাই আমাদের জাতীয় মেধার এ শূন্যতা তৈরি করেছে। একটি সফল রাষ্ট্র গঠনে মেধাবী মানুষদের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। রাজনীতিতে চরিত্রহীনদের দৌরাত্ম্য, অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা, সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ, সব গোল্লায় যাক, শুধু বিসিএস টিকে থাক। আমলা দীর্ঘজীবী হোক।

রাষ্ট্রে একজন তথাকথিত আমলার চেয়ে প্রান্তিক কৃষকের অবদান অনেক বেশি। একদিকে আমলা যেমন রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিজের ক্ষমতা হিসেবে জাহির করে নামে-বেনামে আখের গোছাতে ব্যস্ত, নিজের চৌদ্দগুষ্টিকে উদ্ধার করতে তৎপর। সেখানে দেশের কৃষকরা দেশের উৎপাদনব্যবস্থাকে সচল রেখে বাঁচিয়ে রেখেছেন আমাদের দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা আনয়নে বিগত ৫৪ বছরে আমাদের রাজনীতি আর প্রশাসনের কতটুকু অবদান সেটা সময়সাপেক্ষ ও বিচার্য বটে। এজন্যই মনে হয় অনেকদিন আগে বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা বলে গেছেন- ‘এদেশে কৃষক না থাকলে রাজনীতিবিদ আর আমলা মিলে দেশের মাটি কেজি দরে বিক্রি করে দিত’। বিদেশি শাসকরা বাঙালিকে ভয় দেখিয়ে শক্তির জোরে শাসন করতে যে মজা পেতেন, আজকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই ক্ষমতা চর্চার প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেকে নিজেরা শাসন করি। সবার পছন্দ-প্রশাসন ক্যাডার। সবাই বাঙালিকে ভয় দেখাতে চাই, ক্ষমতা আর অর্থের দখল নিতে চাই।

দেশের বাস্তবতা হলো- বিসিএস নামে তথাকথিত চাকরির পেছনে ছুটে হাজার জনের চাকরি হলেও লাখ লাখ বেকার হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে ৪৪তম বিসিএসে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭১৬ জন অংশগ্রহণ করে এবং এ সংখ্যা বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বনিম্ন। করোনাকালে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রবণতার কারণে এ সংখ্যাটা কমেছে। প্রাথমিকভাবে প্রিলিমিনারিতে ১৫ হাজার ৭০৮ জন পাস করে লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ১১ হাজার ৭১২ জন এবং চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয় ১ হাজার ৬৯০ জন; যা মোট প্রতিযোগীর তুলনায় শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ আর অকৃতকার্য হয় ৯৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। অথচ তাদের অনেক ভালো সম্ভাবনা ছিল এ সমাজে অবদান রাখার। শুধু দৃষ্টিভঙ্গির কারণে একটি দেশ তার অভ্যন্তরে মানবসম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে চরমভাবে ব্যর্থ, ফলে মানসিক বিকারগ্রস্ততা নিয়ে শুধু সরকারের সিভিল সার্ভিসের এ ক্ষমতা আর সুযোগের অধিকারকে লক্ষ্য বানিয়ে আমরা এগিয়ে চলি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। অথচ দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের অন্যভাবে বিকল্প পন্থায় সুযোগ ছিল দেশের সেবা করার।

লেখক:  প্রাবন্ধিক ও শিক্ষা গবেষক
[email protected]

সবুজ অর্থায়নের কৌশলগত বিশ্লেষণ বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগ

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৪৫ এএম
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগ
সাকিফ শামীম

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজ প্রকল্পকে উৎসাহিত করতে নীতিমালা ও অর্থায়ন প্রকল্প চালু করেছে। তবে, নীতিগত অসামঞ্জস্যতা, আর্থিক প্রতিবন্ধকতা, দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা এই বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় বিপুল বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বর্তমান পরিবেশ যথেষ্ট সহায়ক নয়। এই সমস্যা সমাধানে নীতিগত সংহতি ও স্থিতিশীলতা আনা প্রয়োজন।

সবুজ অর্থায়ন বলতে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে এমন ঋণ বা বিনিয়োগকে বোঝায়, যার মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং সবুজ অবকাঠামো নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত। এটি কেবল পরিবেশ সুরক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা প্রদান করে। বৈশ্বিক সবুজ অর্থায়ন বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবুজ প্রকল্পের উপকরণগুলির মধ্যে রয়েছে সবুজ বন্ড, সবুজ ঋণ, সবুজ বন্ধকী, সবুজ ক্রেডিট কার্ড এবং টেকসই বিনিয়োগ তহবিল।

২০০৯ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিতে ২০২০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা পূরণ হয়নি। সম্প্রতি, ২০২৫ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, যা ২০৩১-২০৪০ সময়কালে বার্ষিক ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। এই বিপুল তহবিলের জন্য বৃহৎ আকারের বেসরকারি বিনিয়োগ অপরিহার্য। ভিয়েতনাম, চীন, ভারত এবং মরক্কোর মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সফল মডেলগুলি সুসংগত নীতিগত প্রণোদনা, ঝুঁকি লাঘব এবং শক্তিশালী পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের গুরুত্ব তুলে ধরে। এইসব দেশের মডেলসমূহ হতে ধারণা নিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে নিজস্ব স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজ অর্থায়নকে উৎসাহিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে, যেখানে ২০১৬ সাল থেকে ব্যাংকগুলিকে তাদের মোট ঋণের ন্যূনতম ৫ শতাংশ সবুজ অর্থায়নে বরাদ্দ করতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়াও জিটিএফ (Green Transformation Fund) এর মতো পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কম খরচে তহবিল সরবরাহ করা হয়। 

আইইইএফএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই তহবিল ব্যবহারের হার কমই রয়ে গেছে (যেমন, জিটিএফ-এর জন্য ১৯ দশমিক ০৫ শতাংশ)। এই প্রকল্পগুলির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সমন্বয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ।

বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত নীতিগত অসংগতি এবং নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কুইক এনহ্যান্সমেন্ট অব ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জি সাপ্লাই অ্যাক্ট (QEEESA) ২০১০ বাতিল এবং ৩০টিরও বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প স্থগিত করা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুন্ন করেছে। মাতারবাড়িতে নতুন কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরুজ্জীবিত করার বিবেচনা জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য প্রণোদনার অভাবও একটি বড় সমস্যা। নীতিগত সংহতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সৌরশক্তির সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ব্যবহার। বছরে ৩০০ দিনের বেশি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন থাকায় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ একটি আদর্শ স্থান। সবুজ অর্থায়নের আওতায় সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সোলার হোম সিস্টেম ও কৃষি সেচ ব্যবস্থায় সৌর পাম্প ব্যবহারের মতো সবুজ প্রকল্পগুলোয় (green project) বিনিয়োগে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। 

সবুজ ভবনের (green building) ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল অর্জন হলো ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের লিড গোল্ড সার্টিফিকেট অর্জন- যা আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য, শক্তি দক্ষতা এবং জল ব্যবস্থাপনার মানদণ্ডে একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি। হাসপাতালটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে এটি আমার জন্য এক বিশেষ অর্জন। এই হাসপাতালটি শুধু চিকিৎসাসেবাতেই নয়, পরিবেশ সংরক্ষণেও অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হাসপাতাল চত্বরজুড়ে ছায়াঘেরা সবুজ গাছপালা, উদ্ভিদ-বেষ্টিত গার্ডেন এবং আলো-বাতাস প্রবাহের স্বাভাবিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। 

বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন বাজার থেকে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করার সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু একটি স্পষ্ট জাতীয় নীতির অভাবে এই খাতের বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০৬ সাল থেকে উন্নত রান্নার চুলা এবং সৌর হোম সিস্টেমের মতো কার্বন-হ্রাসকারী উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তবে, দুর্বল নীতি কাঠামো এবং বেসরকারি খাতের সীমিত অংশগ্রহণের কারণে দেশটি তার সম্ভাবনার খুব সামান্যই কাজে লাগাতে পারছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানি সার্টিফিকেট (REC) প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত প্রতি মেগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিধিত্ব করবে। 

তবে, বর্তমানে কার্বন ট্রেডিং থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ ভারতীয় পরামর্শকদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা দেশীয় নিয়ন্ত্রণে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশমালাগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করবে।

লেখক: ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ

বিকল্পহীন হরমুজ প্রণালির অর্থনৈতিক গুরুত্ব

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৭:৩২ পিএম
বিকল্পহীন হরমুজ প্রণালির অর্থনৈতিক গুরুত্ব
রিয়াজুল হক

বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে এমন কিছু ভৌগোলিক স্থান আছে, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ মানেই পুরো বিশ্বের অর্থনীতির চাবিকাঠি হাতে রাখা। এরকমই এক স্থান হলো মধ্যপ্রাচ্যের হরমুজ প্রণালি। প্রায় ৩৯ কিলোমিটার প্রশস্ত এই জলপথটি একদিকে ওমানের সঙ্গে আরেকদিকে ইরানের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থান করছে। তবে এর কৌশলগত ও জ্বালানিভিত্তিক গুরুত্ব এতটাই প্রবল যে, একে ‘বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের গলা’ বলা হয়।

প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল (বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ) এই প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত হয়। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো যেমন- সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন তাদের তেল ও গ্যাস রপ্তানির জন্য কার্যত এই প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। ফলে এই প্রণালি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির জন্য এক অনিবার্য চালিকাশক্তি।

বিশ্বে অন্য কোনো তেল পরিবহন পথ এত বিপুল পরিমাণে জ্বালানি পরিবহনের ক্ষমতা রাখে না। আরব, কুয়েত, ইরাক, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো তেলনির্ভর রাষ্ট্রগুলোর জন্য হরমুজ প্রণালি বিকল্পহীন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ সবার জ্বালানি সরবরাহের শ্বাসতন্ত্র এই প্রণালির মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়। ফলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হওয়া মানেই বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি এবং চেইন রিঅ্যাকশনের মতো আর্থিক সংকট দেখা দেবে।

গত ২২ জুন ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় সরাসরি আঘাত হানে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ইরানের পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেয়, প্রয়োজনে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া হবে। 

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ইরান কি সত্যিই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে পারবে? এককথায় উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, পারবে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ইতোমধ্যে এই এলাকায় নৌবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। তবে একে পুরোপুরি বন্ধ করা হবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। 

বিশ্ববাজার এখনো ইরানের এই ঘোষণার অভিঘাত পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সংকেত ভয়ংকর। হরমুজ প্রণালিতে সামান্য জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হলেই ব্রেন্ট ক্রুডের দাম এক লাফে ১০ থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তেলের দাম যদি ব্যারেল প্রতি ১৫০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, তবে ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার মতো একটি নতুন অর্থনৈতিক সুনামি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশও বর্তমানে সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতার থেকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল এবং এলএনজি আমদানি করে। এই আমদানির পুরো রুটটাই হরমুজ প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। এই প্রণালি বন্ধ হলে জ্বালানি আমদানিতে দেরি ও ব্যয়বৃদ্ধি ঘটবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, পরিবহন খরচ ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার চাপে টাকার মান কমবে। 

পশ্চিমা শক্তি একদিকে যেমন ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, অন্যদিকে হরমুজ প্রণালিকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে মরিয়া। এই দ্বৈত উদ্দেশ্যই ভবিষ্যতে নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। চীন ও রাশিয়ার ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের আওতায় ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। রাশিয়াও ইরানকে পশ্চিমা ঘেরাটোপ থেকে বের করে আনতে চায়। এই অবস্থায় হরমুজ প্রণালি হয়ে উঠছে কেবল জ্বালানির রুট নয়, বরং বিশ্বমঞ্চে শক্তির ভারসাম্য রক্ষার এক অনিবার্য কেন্দ্রবিন্দু। এককথায় বলা যায়, হরমুজ প্রণালি কেবল একটি ভৌগোলিক পথ নয়, এটি আজকের বিশ্ব অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। 

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

জনসংযোগকর্মী মানেই মুখপাত্র নয়, মুখপাত্র হয়ে ওঠতে হয়

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৫, ১১:৫১ এএম
জনসংযোগকর্মী মানেই মুখপাত্র নয়, মুখপাত্র হয়ে ওঠতে হয়
মো. কামরুল ইসলাম

আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রতিদিন কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবেই। পরিচয় হবে টেলিযোগাযোগ কিংবা সরাসরি অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। জনসংযোগ পেশা কেমন জানি নতুন পরিচয়ের নেশায় বুদ হয়ে থাকা। একজন জনসংযোগকর্মী হিসোবে ৩০ বছরের সময়কাল যেন এক অভিজ্ঞতার পসরা সাজিয়ে সম্মুখপানে তাকিয়ে থাকা। নতুন পরিচয়, নতুন অভিজ্ঞতালব্ধ হওয়ার জন্য। 

অন্যসব ডিপার্টমেন্টের এক্সিকিউটিভদের মতো জনসংযোগ কর্মকর্তাদের সকাল-সন্ধ্যা অফিসের সময়, কালাকানুন সবই মেনে নিতে হয়। অতিরিক্ত হিসাবে ২৪ ঘণ্টাকেই কর্মঘণ্টা মেনে নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, দিনটি যদি ৩৬ ঘণ্টায় হতো তাহলে ভালোই হতো। 

আজকাল বনেদী খেলা ক্রিকেটে টি-টেন, টি-টুয়েন্টি, ওয়ানডে দিনদিন জনপ্রিয় উঠছে। কিন্তু টেস্ট ম্যাচের জৌলুস কিন্তু রয়ে গেছে আদি ও অকৃত্রিমতায়। জনসংযোগ পেশাটা ঠিক সেই রকমই একটা টেস্ট ম্যাচ। ধৈর্য্যের টেস্ট ম্যাচ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমহারে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। আর যদি কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ পেশা হয়ে থাকে তবে তো আপনাকে যেকোনো সময়ে যেকোনো বিষয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

জনসংযোগ পেশাটাই এমন আপনাকে প্রতিষ্ঠানের সব বিষয়ে কিংবা আপনার প্রতিষ্ঠান যে ধরণের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সেই ব্যবসা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হয়। উদাহরণ হিসেবে- অ্যাভিয়েশন সেক্টরের ব্যবসার কথাই উল্লেখ করা হলো- একজন সেলস্ কিংবা মার্কেটিং প্রতিনিধি সেলস অথবা মার্কেটিং বিষয়ক সম্যক জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট, অ্যাকাউন্টিং কিংবা  রেভিনিউ ডিপর্টেমেন্টের কাজের ধরণও হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত যেখানে কাজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পাইলট উভয়েরই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষায়িত হতে হয়। আবার অ্যাডমিন কিংবা এইচআর ডিপার্টমেন্টেরও কাজের সীমাবন্ধতা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বিভাগ যেমন পারচেজ, ক্যাটেরিং, ইন-ফ্লাইট সার্ভিস, কাস্টমার সার্ভিস, সিকিউরিটি, ক্লিনিং, ট্রান্সপোর্ট প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট কাজের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। 

জনসংযোগকর্মীকে যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতে হয়। খুব বেশি সচেতনতার সঙ্গে বক্তব্য রাখতে হয়। ভুল বক্তব্য প্রতিষ্ঠানকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। কঠিন সময়ে সাবলীলভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারাই একজন জনসংযোগবিদের কাজ। যা অন্যদের থেকে আলাদা, তাই প্রকাশ করা। 

একজন জনসংযোগকর্মীর প্রয়োজনীয়তা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সবসময়ই আছে। যেমন প্রয়োজন ভালো সময়ে তেমনি প্রয়োজন মন্দ সময়ে। তবে ভালো সময়ের চেয়ে মন্দ সময়ে জনসংযোগকর্মীকে খুব বেশি প্রয়োজন বলেই মনে হয়। প্রতিষ্ঠানের যেকোনো মন্দ সময়ে একজন জনসংযোগকর্মী তার সুসম্পর্ক দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ভালো সময়ের দিকে এগিয়ে নিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন জনসংযোগবিদ তার সাবলিল উপস্থাপনা দিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে সকল স্তরের নাগরিকদের নিকট সঠিক বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে তুলে ধরতে পারেন। যা অন্য কর্মকর্তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।

প্রয়োজন থাকলেই সংবাদকর্মীদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা আর প্রয়োজন শেষ হলেই সম্পর্ক শেষ এই নীতিতে যারা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য জনসংযোগ পেশা নয়। যারা নির্দিষ্ট সময় মেনে জনসংযোগ পেশায় কাজ করতে চান তাদের জন্যও এই পেশা খুব বেশী মানানসই হবে না। 

সরকারী কিংবা বেসরকারী উভয় সেক্টরেই জনসংযাগ কর্মীকে অফিস সময়ের বাহিরেও সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখতে হয় নিজেকে। আপনি হয়তো রাত ১১টা কিংবা ১২ টায় ও ফোন কল পেতে পারেন। আপনার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পরিচয়ের সূত্র ধরে কেউ জরুরী একটা সেবার জন্য আপনার দারস্থ হয়ে থাকলে প্রয়োজন বুঝে সহায়তা করা। এটাও জনসংযোগ কর্মীর সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। কারো সাথে পরিচয় হবে প্রফেশনালী কিন্তু সম্পর্ক তৈরী হবে পারসোনালী। যে সম্পর্কটা থাকবে আজীবন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারনে লাভবান হবে প্রতিষ্ঠান।

শুধুমাত্র এক্সটার্নাল রিলেশন ভালো রাখতে হবে ব্যাপারটা আসলে তা নয়, আপনার ইন্টারনাল রিলেশনও অনেক ভালো হতে হবে। ইন্টারনাল রিলেশন যতবেশী শক্তিশালী হবে আপনি জনসংযোগ কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠানে আপনার ভূমিকা ততবেশী গ্রহণযোগ্য হবে। আপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কোনো বার্তা খুব সহজেই মিডিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যা প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো কর্মীর পক্ষে সম্ভব নয়।         

ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে বড় মিডিয়া কিংবা ছোট মিডিয়া বলতে কিছু নেই। একজন জনসংযোগ কর্মী হিসেবে আপনাকে সব মিডিয়াই সমান ধারনা পোষণ করতে হবে। কোনো ঘটনা কিংবা দূর্ঘটনার সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে সত্য ঘটনা তুলে ধরাই কাম্য হবে নতুবা ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে নানাবিধ কল্পকাহিনীর সম্মুখীন হতে পারেন, যা ব্যবসার সুনাম ক্ষুন্ন হতে পারে, ভবিষ্যৎ ব্যবসার জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে। সত্য সংবাদ প্রকাশে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠান লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রত্যেকটি মিডিয়া হাউজের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এমনকি সংবাদকর্মীদের কমিউনিটি বেজড্ অনেক প্রতিষ্ঠান থাকে তাদের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে যেমন জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ক্রাইম রিপোটার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব), ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ইত্যাদি। একজন জনসংযোগ কর্মী হিসেবে সংবাদকর্মীদের মনোভাব অনুধাবন করা খুবই জরুরী।

জনসংযোগ কর্মীর কাজ এবং সময়ের কোনো রুটিন মাফিক সীমাবদ্ধতা নেই। সবসময়ই ফ্রি আবার আবার সবসময়ই ব্যস্ত। প্রতি মূহূর্তেই ব্যস্ততার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কঠিন সময়েও উপলব্ধি এমনই হওয়া উচিত- কথার মাধ্যমেই আপনি একজনকে কষ্ট দিতে পারেন আবার কথার মাধ্যমেই আপনি একজনকে সন্তুষ্টি দিতে পারেন। কথা বলবেন আপনি। আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কি কষ্ট দিবেন নাকি সন্তুষ্টি দিবেন।  

একজন জনসংযোগকর্মী আপাদমস্তক কোম্পানীর মুখপাত্র হয়ে উঠার জন্য আপনাকে সৎ, নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, অভিজ্ঞতালব্ধ হওয়া খুবই জরুরী।

লেখক: মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

রিজার্ভ গাড়িতে ঈদযাত্রা: চালকের ঘুমও জরুরি

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০২ পিএম
রিজার্ভ গাড়িতে ঈদযাত্রা: চালকের ঘুমও জরুরি
রিয়াজুল হক

ঈদ মানেই আনন্দ। দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার, গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন কাটানোর, কিংবা শহরের কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসার এক অবকাশ। এবারের কোরবানির ঈদে যেহেতু একটানা বড় ছুটি পাওয়া গেছে, অনেকেই কর্মস্থল ছেড়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হচ্ছেন। অনেকে বাস বা ট্রেনের ভিড় এড়িয়ে রিজার্ভ প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ভাড়া করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। সঠিক পরিকল্পনা, আরামদায়ক যাত্রা ঠিক আছে, তবে একটি বিষয়ে আমরা খুব কমই নজর দিই। সেটা হচ্ছে, গাড়ির চালকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা।

যে চালক আপনাকে ১৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে পৌঁছে দেবেন, তিনি হয়তো আগের দিনই এমন আরেকটি ভ্রমণ শেষ করেছেন। ঈদের এই মৌসুমে অতিরিক্ত আয়ের আশায় টানা তিন-চার দিন ধরে একটানা ট্রিপ দিয়ে চলেছেন। কখনও ঘুমোতে পারেননি ঠিকঠাক, কখনও খাওয়ার সময়ও পাননি। এভাবে অবসন্ন, ক্লান্ত, ঘুমে ঢুলে পড়া এক চালকের হাতে আপনার পরিবার, আপনার প্রাণ!

দীর্ঘ সময় ধরে একটানা গাড়ি চালানো চালকের জন্য যেমন শারীরিকভাবে কষ্টকর, তেমনি মানসিকভাবে বিপজ্জনকও। নিদ্রাহীনতা মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মনোযোগ বিঘ্নিত করে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। 

যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক নিরাপত্তা সংস্থার মতে, ঘুম ঘুম ভাব বা ক্লান্তি নিয়ে গাড়ি চালানো মদ্যপ অবস্থায় চালানোর মতোই বিপজ্জনক। বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা না থাকলেও ঈদের সময়ে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে ক্লান্ত চালকদের ভূমিকা যে থাকে, সেটা আমরা দেখতে পাই। চালক যদি ক্লান্ত বা নিদ্রাচ্ছন্ন থাকেন, তবে একটি মুহূর্তের ভুলেই ঘটে যেতে পারে কোনো জীবনের পরিসমাপ্তি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার করণীয় কী? 
আপনি যখন গাড়ি রিজার্ভ করছেন, তখন কেবল গাড়ির অবস্থা, এসি কাজ করছে কিনা কিংবা ভাড়া কত হবে, এসবই মাথায় রাখেন। কিন্তু চালকের অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ এটা আপনার প্রথম দায়িত্ব। কারণ, আপনার জীবনের নিরাপত্তা এরসঙ্গে জড়িত। গাড়ি রিজার্ভ করার সময়েই জানতে চান, ‘চালক গত কয়েক দিনে কতগুলো ট্রিপ দিয়েছেন? তিনি কোথা থেকে এসেছেন? ঘুমাতে পেরেছেন কিনা?’

অনেক ড্রাইভার ইচ্ছে করেই ক্লান্তি গোপন করেন। কারণ, তারা জানেন, যাত্রী জানলে ভয় পাবে এবং ভরসা হারাবে। অনেক চালক আবার গাড়ির মালিক বা ট্রাভেল অ্যাজেন্সির চাপে পড়ে একের পর এক যাত্রায় বাধ্য হন। সুতরাং, যদি আপনি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস না করেন, তবে কেউ আপনাকে আগে থেকে সতর্ক করবে না।

যেসব ট্রাভেল অ্যাজেন্সি বা গাড়ির মালিক গাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন, তাদেরও উচিত গাড়ির পাশাপাশি চালকদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া। একের পর এক ট্রিপে বাধ্য করার পরিবর্তে শিফট ভিত্তিক চালক রাখা। প্রতিটি ট্রিপের পরে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা এবং চালকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। কারণ, গাড়ির ব্র্যান্ড নতুন হলে কী হবে, যদি তার ক্লান্ত চালক স্টিয়ারিং-এর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন? এক ফোঁটা ঘুম, এক সেকেন্ডের অসতর্কতা, যার ফলাফল হতে পারে প্রাণঘাতী।

ঈদের মৌসুমে আমরা অনেক কিছু ভেবে ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। কোথায় খাব, কোথায় থাকব, কোন রাস্তায় যাব, সবই চিন্তা করি। কিন্তু চালকের সুস্থতার বিষয়টিই ভুলে যাই। অথচ আপনার ভ্রমণের সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করে চালকের উপর।

যারা আগে বিষয়টি আমলে নেননি, এবারের ঈদে সেই সচেতনতা শুরুতেই গ্রহণ করুন। যাত্রা শুরুর আগে একবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন, ‘শেষ কবে ঘুমিয়েছেন?’ 

আপনার এই প্রশ্নে হয়তো কিছুটা অস্বস্তি হবে, কিন্তু এই অস্বস্তিই বাঁচাতে পারে অনেক প্রাণ। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনাকে প্রায়ই দুর্ভাগ্য হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পেছনে বহু এড়িয়ে যাওয়া কারণ থাকে। নিজের প্রয়োজনেই সচেতন যাত্রী হিসেবে আপনার দায়িত্ব এই কারণগুলোকে আগে থেকেই চিহ্নিত করা, প্রতিরোধ করা। গাড়ি রিজার্ভ করা মানেই দায়িত্ব শেষ নয়, চালকের খোঁজ নেওয়াও যাত্রার অংশ। এবারের ঈদে সেই সচেতনতা নিয়েই শুরু হোক সবার গন্তব্যের পথে যাত্রা।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক