
বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে এমন কিছু ভৌগোলিক স্থান আছে, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ মানেই পুরো বিশ্বের অর্থনীতির চাবিকাঠি হাতে রাখা। এরকমই এক স্থান হলো মধ্যপ্রাচ্যের হরমুজ প্রণালি। প্রায় ৩৯ কিলোমিটার প্রশস্ত এই জলপথটি একদিকে ওমানের সঙ্গে আরেকদিকে ইরানের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থান করছে। তবে এর কৌশলগত ও জ্বালানিভিত্তিক গুরুত্ব এতটাই প্রবল যে, একে ‘বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের গলা’ বলা হয়।
প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল (বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ) এই প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত হয়। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো যেমন- সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন তাদের তেল ও গ্যাস রপ্তানির জন্য কার্যত এই প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। ফলে এই প্রণালি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির জন্য এক অনিবার্য চালিকাশক্তি।
বিশ্বে অন্য কোনো তেল পরিবহন পথ এত বিপুল পরিমাণে জ্বালানি পরিবহনের ক্ষমতা রাখে না। আরব, কুয়েত, ইরাক, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো তেলনির্ভর রাষ্ট্রগুলোর জন্য হরমুজ প্রণালি বিকল্পহীন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ সবার জ্বালানি সরবরাহের শ্বাসতন্ত্র এই প্রণালির মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়। ফলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হওয়া মানেই বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি এবং চেইন রিঅ্যাকশনের মতো আর্থিক সংকট দেখা দেবে।
গত ২২ জুন ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় সরাসরি আঘাত হানে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ইরানের পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেয়, প্রয়োজনে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ইরান কি সত্যিই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে পারবে? এককথায় উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, পারবে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ইতোমধ্যে এই এলাকায় নৌবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। তবে একে পুরোপুরি বন্ধ করা হবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।
বিশ্ববাজার এখনো ইরানের এই ঘোষণার অভিঘাত পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সংকেত ভয়ংকর। হরমুজ প্রণালিতে সামান্য জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হলেই ব্রেন্ট ক্রুডের দাম এক লাফে ১০ থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তেলের দাম যদি ব্যারেল প্রতি ১৫০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, তবে ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার মতো একটি নতুন অর্থনৈতিক সুনামি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশও বর্তমানে সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতার থেকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল এবং এলএনজি আমদানি করে। এই আমদানির পুরো রুটটাই হরমুজ প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। এই প্রণালি বন্ধ হলে জ্বালানি আমদানিতে দেরি ও ব্যয়বৃদ্ধি ঘটবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, পরিবহন খরচ ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার চাপে টাকার মান কমবে।
পশ্চিমা শক্তি একদিকে যেমন ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, অন্যদিকে হরমুজ প্রণালিকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে মরিয়া। এই দ্বৈত উদ্দেশ্যই ভবিষ্যতে নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। চীন ও রাশিয়ার ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের আওতায় ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। রাশিয়াও ইরানকে পশ্চিমা ঘেরাটোপ থেকে বের করে আনতে চায়। এই অবস্থায় হরমুজ প্রণালি হয়ে উঠছে কেবল জ্বালানির রুট নয়, বরং বিশ্বমঞ্চে শক্তির ভারসাম্য রক্ষার এক অনিবার্য কেন্দ্রবিন্দু। এককথায় বলা যায়, হরমুজ প্রণালি কেবল একটি ভৌগোলিক পথ নয়, এটি আজকের বিশ্ব অর্থনীতির হৃদস্পন্দন।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক