বছরে ২২ লাখ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় যেকোনো জটসহ যানজট নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। সড়ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তথা যানবাহনের সংখ্যা কমাতে হবে। ঈদের সময় এ মহানগরীতে বিপুল সংখ্যায় জনসংখ্যা কমে যায় বলেই যানজট শূন্য হয়। পরে তা ফেরার ফলেই যানজটও ফেরে উপচে পড়া ঘনত্বে। যানজটের প্রধান কারণ এটিই।...
ঈদুল আজহার ছুটি শেষে রাজধানীতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কারণ ২ কোটি ৬৫ লাখ শহরবাসীর মধ্যে যারা ঈদে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন তারা সবাই কর্মস্থলে ফিরেছেন। ব্যবহার শুরু করছেন সব ধরনের যানবাহন, ফুটপাত, বিপণিবিতান, অলি-গলি। ফলে যানজট ফিরে এসেছে ঈদের পাঁচ দিন আগে যে স্তরে ছিল সেই স্তরে এবং ঘনত্বে। এ প্রসঙ্গে সরকারের নেওয়া বড় কয়েকটি ব্যয়বহুল প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে বলতে হয়- ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে সিগন্যাল সিস্টেম আধনিুকায়ন করার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল তা আগেই ব্যর্থ হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গণপরিবহনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকায় সিগন্যাল সিস্টেম আধুনিকায়নের যেকোনো প্রকল্প মুখথুবড়ে পড়বে। এর আগে ২০০১ সালে ঢাকা নগর অঞ্চল পরিবহন পরিকল্পনার অধীনে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন শুরু হয়। ঢাকাসহ ৬০টি স্থানের সিগন্যাল স্থাপনে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে ২৫ কোটি টাকা অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। বলা হয়েছে, রক্ষাবেক্ষণের অভাবে এ সিগন্যালব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ সিগন্যালব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ার পেছনে যে কারণের কথা বলা হয়েছে তা আসলে অসার। রোগের কারণ নির্ণয় না করে উপসর্গগুলোকে বলপ্রয়োগ কিংবা নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে দমন ও দূরীভূত করতে গেলে এমনটাই হবে। অতীতেও তাই হয়েছে।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বছরে ২২ লাখ। বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ২৭০টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনাক্রমে এ যানবাহন বৃদ্ধির হার একান্তই সামান্য। কারণ মানুষের গাড়ি কেনার সামর্থ্য এখনো খুবই নিচু পর্যায়ে। অন্যদিকে রাস্তা কমে যাচ্ছে। কারণ বর্ধিত যানবাহনের চলাচল, রাস্তার ওপর দোকানপাট, ফেরিওয়ালা, ফুটপাতে নানাবিধ ব্যবসায়ীর উপচে পড়া ভিড়ের কারণে পথচারীদের রাস্তার ওপর এসে পড়া ইত্যাদি। কাজেই প্রকল্পের নাম যাই দেন ডিএনসিসি, এসটিপি, সিগন্যালিং পদ্ধতি উন্নয়ন, আরএসটিপি কিংবা অন্য যাই হোক, এ দিয়ে বা নগর পরিকল্পনাবিদ এবং সড়ক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ট্রাফিক সিগন্যালিং ব্যবস্থার কোনোরকম উন্নয়ন করা অলীক কল্পনা। মূল সমস্যা হলো গাড়ি চলার জন্য শহরে ২৫ ভাগ রাস্তা প্রয়োজন, তা কমে বর্তমানে ৬ ভাগে এসেছে। কোনো ধরনের গণপরিবহনব্যবস্থা এ ট্রাফিক জটকে নিরসন করতে পারবে না। তার প্রমাণ এমআরটি প্রকল্পের পিপি-তে যে উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছিল, প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সেই উদ্দেশ্য এতটুকু অর্জিত হয়নি। সে কারণে নানাবিধ উদ্যোগ ও পরামর্শ গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে।
বিজ্ঞানে যেকোনো কিছুর একটি সর্বোচ্চ বহনক্ষমতা আছে। তেমনি একটি ট্রফিক সিগন্যালিং পয়েন্টেও সর্বোচ্চ ব্যবহার অর্থাৎ পিক আওয়ারে কতগুলো যানবাহন কোন দিকে আসা-যাওয়া করবে তা অঙ্ক ও জ্যামিতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। আমাদের ঢাকা শহরে এ সংখ্যাটি কয়েক গুণ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিদ্যুচ্চালিত লাল-সবুজ সিগন্যালব্যবস্থা উন্নয়ন করলেও তা হাত ও বৈদ্যুতিক লাঠি নিয়ন্তিত ট্রাফিক পুলিশের বর্তমান ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার চাইতে এতটুকু উন্নতি আনতে পারবে না। যে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ৪০ সেকেন্ড বা ১ মিনিট ৫০-৬০টি যানবাহনকে সামনে চলার অনুমতি দিচ্ছে, হাতে চালিত সিস্টেমও ঠিক সেই কাজটি করছে। এ সময়ে গাড়ির অপেক্ষমানের তালিকা হয়ে যাচ্ছে আরও ৬০-৮০টি এবং এটি প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রতিদিন নতুন ২৭০টির মতো যানবাহনের একটি অংশ প্রতিটি ট্রাফিক পয়েন্টে নতুন করে যোগ দিচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ২০-৩০ বছর আগের মতো এক লেনে গাড়ির সংখ্যা এখন এক সারি নয়, তা তিন-চার সারি। ফলে সিগন্যাল পেলেও সামনে যাওয়ার গতি ধীর, কারণ সামন-পেছনে, ডানে-বামের গাড়িগুলোর সঙ্গে যেকোনো গাড়ির ধাক্কা লাগার আশঙ্কা রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ বা যন্ত্রের কোনোটিই এ নির্গমন সংখ্যাকে বৃদ্ধি করতে পারবে না। কাজেই একান্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিতে অন্তত ট্রাফিক সিগন্যালব্যবস্থা উন্নয়নের নামে কোনো অর্থব্যয় করা সমীচীন হবে না।
একটি কনসালট্যান্সি রিপোর্ট পাওয়ার আগেই দু-তিনজন করে কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা হচ্ছে কী করে যানজট নিরসন করা যায় সে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য। ১০ মাসে তারা কোনো সমাধান দিতে পারেনি, তা পারা সম্ভবও নয়। যারা গণপরিবহনে চড়ছেন, তারা চড়বেন। যারা উঁচু শ্রেণির, তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা থেকে নিবৃত করার পরামর্শ দিয়ে গণপরিবহনে চড়ার পরামর্শ দেওয়ায় কোনো সুফল হবে না।
মানুষ সারা জীবনে যে টাকা সঞ্চয় করে তা ধস্তাধস্তি ও গায়ে ধাক্কাধাক্কি করে গণপরিবহনে চড়ার লক্ষ্যে নয়, বরং একটি ব্যক্তিগত সুশীতল মোটরগাড়িতে চড়ার লক্ষ্যে। দেশের সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এ শহরে গাড়ি বেচাকেনার দোকান ৬০০টির মতো। ভাগ্য ভালো দারিদ্র্যর কারণে এর ৫০ শতাংশ দোকানেই প্রতিদিন গড়ে একটি গাড়িও বেচা হয় না। তবে সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে তা হবে। তাহলে তখন কী হবে? গাড়ি আমদানি খাতে সরকার বিপুল পরিমাণ কর পাচ্ছে, যা ছাড়া বাজেট হবে বেশি ঘাটতির। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ টেনেছেন। এ উদাহরণও একান্ত অঙ্ক ও বিজ্ঞানবিরোধী। কারণ, সেসব দেশ বিশাল, জনসংখ্যাও বাংলাদেশের তুলনায় অল্প। পরিবারপ্রতি ৩.৫টি করে ব্যক্তিগত যানবাহন থাকার পর তারা লম্বা দূরত্বের স্থানগুলোতে গণপরিবহন ব্যবহার করেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সারোয়ার খবরের কাগজকে বলেন, সিগন্যাল সিস্টেম আধুনিকায়ন করে যানজট রাতারাতি কমে যাবে তা মনে হয় না।’ সরকারি পেশায় থেকে এমন সৎ মন্তব্য প্রশংসাযোগ্য। এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে দেশের জন্যসংখ্যাকে এবং ঢাকা শহরের ২ কোটি ৬৫ লাখ জনসংখ্যাকে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা। তখন হ্রাসকৃত জনসংখ্যার ব্যবহার্য যানবাহন এবং অন্যান্য সবকিছু আনুপাতিক হারে কমে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালের সর্বোচ্চ বহনক্ষমতার কাছাকাছি চলে এলে ট্রাফিকব্যবস্থা সুস্থতায় ফিরে আসবে। তাছাড়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সুষ্ঠু সংজ্ঞা কী তা নির্ধারণ না করে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়াও অর্থহীন। অন্য কোনো সংজ্ঞা না দিয়ে শুধু অনুভূতির ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা উন্নয়নে হাত দেওয়া অর্থহীন হবে।
যানবাহন ব্যবহারকারী এ অপেক্ষার সময়কে ২ মিনিট বা ৩ মিনিট করলে সন্তুষ্ট কি না তা জরিপের মাধ্যেমে নির্ণয় করে এ কাজটি করা সম্ভব। কিন্তু তাতেও ২ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ অধ্যুষিত মাত্র ৪০০ বর্গমাইলের একটি শহরে যানবাহনে যাত্রীদের আরাম দেওয়া যাবে না। কারণ, এখন ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে দিন ও রাতে ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড বা দেড় মিনিট তো দূরের কথা, গড়ে ১৭ মিনিট করে যানবাহনগুলোকে সামনে যাওয়ার ক্লিয়ারেন্স পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, যা নিত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এবার জট বৃদ্ধির সিগন্যালবহির্ভূত একটি কারণের কথা মনে করি। বিজয়নগর, মগবাজার, বারিধারাসহ কিছু এলাকার মূল রাস্তার চওড়ার ৮ ফুটের ওপর দাঁড় করিয়ে সকাল থেকে রাত ১০টা গাড়ির নানাবিধ ডেকোরেশনের যে কাজ করা হয় তা ওখানে যানবাহনের গতিকে কমিয়ে দিচ্ছে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত। এ গতিকে শ্লথ করছে বিপরীত দিক থেকে চালানো রিকশার স্রোত। বছরে ২২ লাখ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় যেকোনো জটসহ যানজট নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। সড়ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তথা যানবাহনের সংখ্যা কমাতে হবে। ঈদের সময় এ মহানগরীতে বিপুল সংখ্যায় জনসংখ্যা কমে যায় বলেই যানজট শূন্য হয়। পরে তা ফেরার ফলেই যানজটও ফেরে উপচে পড়া ঘনত্বে। যানজটের প্রধান কারণ এটিই। এক সন্তানবিশিষ্ট পরিবার গঠন, সমস্যার মূল সমাধানের পথের সূচনা করবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল