রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ঈমানের সত্তর অথবা ষাটের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর স্বীকৃতি প্রদান করা। সর্বনিম্ন শাখা হলো, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা ঈমানের অন্যতম একটি শাখা।” (বুখারি, হাদিস : ৯)
উল্লিখিত হাদিস থেকে বোঝা যায়, ঈমানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা রয়েছে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান (রহ.)-এর মতে, ঈমানের মোট ৭৯টি শাখা রয়েছে। (আল-ইহসান ফি তাকরিরি ইবনে হিব্বান, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা-৩৮৭)
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আবদুল জলীল আল-কসরি (রহ.) তার রচিত শুআবুল ঈমান নামক গ্রন্থে ৭৪টির কথা উল্লেখ করেছেন। হাফেজ আবু আবদিল্লাহ আল-হালিমি (রহ.) তার রচিত আল-মিনহাজ ফি শুআবিল ঈমানে ৭৭টি এবং ইমাম আবু বকর বাইহাকি (রহ.) তার রচিত জামিউল মুছান্নাফ ফি শুআবিল ঈমানে ঈমানের ৭৭টি শাখা-প্রশাখার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও আলোচনা তুলে ধরেছেন। (উসুলুল ঈমান, ড. আহমদ আলী, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা-৪২-৪৩)
মর্যাদার বিবেচনায় ঈমানের শাখা-প্রশাখাগুলো সমান নয়। পূর্ণাঙ্গ মুমিন-মুসলমানের মাঝে সবগুলো শাখা-প্রশাখা পাওয়া যাবে। যাদের মধ্যে কম পাওয়া যাবে, তারা দুর্বল বা ত্রুটিযুক্ত মুমিন।
ঈমানের কিছু শাখা-প্রশাখা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতে হয়—যা গোপন। কিছু আছে প্রকাশ্য। কিছু আছে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং ইবাদতকেন্দ্রিক আবার কিছু শাখা সামাজিকতানির্ভর। লজ্জা ও আদবের মতো নৈতিকতায় মোড়ানোও কিছু শাখা রয়েছে। (দ্য ব্রাঞ্চেস অব ঈমান, ড. ইয়াসির কাদি, (ঈমানবৃক্ষ) অনুবাদ: মুহাম্মাদ খালিদ সাইফুল্লাহ, গার্ডিয়ান, পৃষ্ঠা-৮-৯)
ঈমানের সংজ্ঞা অনুযায়ী এর শাখা-প্রশাখাগুলো মোট তিন ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব। যথা—
ক. ঈমানের কিছু শাখা-প্রশাখা অন্তর বা বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, এর সংখ্যা ৩০টি।
খ. কিছু জবান বা মৌখিক স্বীকৃতির সঙ্গে জাড়িত, এর সংখ্যা ৭টি।
গ. কিছু শাখা-প্রশাখা শরীর বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা আমলের সঙ্গে জড়িত, এর সংখ্যা ৪০টি।
ফলাফল দাঁড়াল—(ক.) ৩০ + (খ.) ৭ + (গ.) ৪০ = ঈমানের ৭৭টি শাখা-প্রশাখা। (উসুলুল ঈমান, ড. আহমদ আলী, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা-৪৩)
(ক.) অন্তর বা বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত শাখা-প্রশাখাগুলো হলো—
১. আল্লাহতায়ালার প্রতি ঈমান। (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩৬; মুসলিম, হাদিস নং-২৬)
২. আল্লাহ ছাড়া বাকি সবকিছুই তাঁর সৃষ্টি। (সুরা জুমার, আয়াত : ৬২)
৩. ফেরেশতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৫)
৪. পবিত্র কোরআন ও আসমানি সব কিতাবের প্রতি বিশ্বাস। (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩৬)
৫. রাসুল (সা.)-সহ সব নবী-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস। (মুসলিম, হাদিস : ৮)
৬. তাকদির। (সুরা নিসা, আয়াত : ৭৮; মুসলিম, হাদিস : ৬৫০১)
৭. আখেরাত ও পুনরুদ্ধার। (সুরা তাওবা, আয়াত : ২৯)
৮. হাশর, মিজান, কিয়ামত ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস। (সুরা জাসিয়া, আয়াত : বুখারি, হাদিস : ৬৫৩১)
৯. জান্নাত ও জাহান্নাম। (সুরা বাকারা, আয়াত: ৮১; বুখারি, হাদিস : ১৩৭৯)
১০. আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৬৫; বুখারি, হাদিস : ১৫)
১১. আল্লাহর প্রতি ভয়। (সুরা তাওবা, আয়াত : ১৭৫; সুরা মায়েদা, আয়াত : ৪৪)
১২. আল্লাহর প্রতি সুধারণা। (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৬; সুরা জুমার, আয়াত : ৫৩)
১৩. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১২২, ১৬০; বুখারি, হাদিস : ৫৭০৫)
১৪. রাসুলুল্লাহকে (সা.) ভালোবাসা। (বুখারি, হাদিস : ১৫)
১৫. আল্লাহর জন্য কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা করা। (বুখারি, হাদিস : ৬৬০)
১৬. ইখলাসের সঙ্গে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা। (সুরা বাইয়িনা, আয়াত : ৫; তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯০)
১৭. গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করা। (সুরা তাহরিম, আয়াত : ৮; মুসলিম, হাদিস : ৭০৩৬)
১৮. লজ্জা করা। (তিরমিজি, হাদিস : ২০০৯; মুসলিম, হাদিস : ১৬২)
১৯. নিয়ামতের শোকর আদায়। (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৭; মুসলিম, হাদিস : ৭২২৯)
২০. বৈধ প্রতিশ্রুতি পালন। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৪; বুখারি, হাদিস : ১/৩৩)
২১. ধৈর্য ধারণ করা। (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৬; বুখারি, হাদিস : ৫৬৫৩-১২৫২)
২২. বিনয়ী হওয়া। (সুরা শুআরা, আয়াত : ২১৫; বুখারি, হাদিস : ৬২৫৬)
২৩. সৃষ্টিজীবনের প্রতি দয়া। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯; বুখারি, হাদিস : ৬০১৩)
২৪. আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্টি থাকা। (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৬)
২৫. অহংকার ত্যাগ করা। (সুরা বাকারা, আয়াত : ৩৪; মুসলিম, হাদিস : ৯১)
২৬. বড়দের সম্মান এবং ছোটদের স্নেহ করা। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯২০; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪৩)
২৭. হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ করা। (সুরা ফালাক, আয়াত : ৫; বুখারি, হাদিস : ৬০৬৫)
২৮. রাগ-ক্রোধ ও মনোমালিন্য ত্যাগ। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪; বুখারি, হাদিস : ১৩৭)
২৯. সবার কল্যাণ কামনা করা। (সুরা আরাফ, আয়াত : ৬২; মুসলিম, হাদিস : ৫৫)
৩০. পার্থিব ধন-সম্পদ ও নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব-ক্ষমতার প্রতি মোহ না থাকা। (সুরা ফাতির, আয়াত : ৫; মুসলিম, হাদিস : ৭১২৪)
(খ.) জবান বা স্বীকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত শাখা-প্রশাখাগুলো হলো—
১. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা তাওহিদের স্বীকৃতি প্রদান করা। (সুরা ফাতির, আয়াত : ৩; বুখারি, হাদিস : ৯)
২. পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত। (সুরা আনফাল, আয়াত : ২)
৩. দ্বীনি জ্ঞানার্জন করা। (সুরা জুমার, আয়াত : ৯; বুখারি, হাদিস : ৭১)
৪. দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেওয়া ও দ্বীনের প্রচার করা। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১১০; বুখারি, হাদিস : ৫০২৭-২৮)
৫. দোয়া করা। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৬; তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৭১)
৬. আল্লাহর জিকির করা। (সুরা রাদ, আয়াত : ২৮; বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)
৭. অনর্থক কথা বলা ও শোনা থেকে বিরত থাকা। (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৩)
(গ.) শরীর, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা আমলের সঙ্গে জড়িত শাখা-প্রশাখাগুলো হলো—
১. পবিত্রতা অর্জন। (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৬; মুসলিম, হাদিস : ৪৪১)
২. নিয়মিত নামাজ আদায়। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৪৩; সুরা নিসা, আয়াত : ৭৭)
৩. জাকাত আদায় ও দান-সদকা করা। (সুরা বাইয়িনা, আয়াত : ৫; বুখারি, হাদিস : ২৯)
৪. রমজানের রোজা রাখা। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩; বুখারি, হাদিস : ২১)
৫. হজ পালন। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭; সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৬)
৬. রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৫; বুখারি, হাদিস : ২০২৬)
৭. হিজরত করা। (সুরা নাহাল, আয়াত : ৪১)
৮. আল্লাহর নামে মান্নত করলে, তা পূর্ণ করা। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭০)
৯. আল্লাহর নামে বৈধ কসম করলে, তা আদায় করা। (বুখারি, হাদিস : ৬১০৮)
১০. কসম ভঙ্গ করলে, তার কাফফারা আদায় করা। (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৮৯)
১১. সতর আবৃত রাখা। (সুরা আরাফ, আয়াত : ২৬; মুসলিম, হাদিস : ৩৩৮)
১২. কোরবানি দেওয়া। (সুরা কাউসার, আয়াত : ২; তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭)
১৩. মৃত ব্যক্তির জানাজা আদায় ও দাফন-কাফন করা। (বুখারি, হাদিস : ১২৪০)
১৪. ঋণ পরিশোধ করার দৃঢ় ইচ্ছা। (বুখারি, হাদিস : ২৩৮৯)
১৫. ধোঁকা না দেওয়া। (মুসলিম, হাদিস : ১০২)
১৬. সত্য সাক্ষ্য গোপন না করা। (সুরা ফুরকারন, আয়াত : ৭২; বুখারি, হাদিস : ২৬৫৪)
১৭. সামর্থ্য থাকলে বিয়ে করা। (বুখারি, হাদিস : ৫০৬৬)
১৮. হক আদায়। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮১)
১৯. মা-বাবার সঙ্গে সদ্বব্যবহার। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)
২০. সন্তান-সন্তুতির সুলালন ও পালন করা। (সুরা তাহরিম, আয়াত : ৬)
২১. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ২২; বুখারি, হাদিস : ২০৬৭)
২২. মনিবের আনুগত্য করা। (মুসলিম, হাদিস : ১৩৩)
২৩. ন্যায়বিচার। (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮; সুরা হুজুরাত, আয়াত : ৯)
২৪. মুসলিম জামাতে শামিল থাকা এবং উম্মতের মাঝে ফাটল সৃষ্টি না করা। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩; মুসলিম, হাদিস : ১৮৪৮)
২৫. মুসলিম খলিফা বা নেতার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৯)
২৬. ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা করা। (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ৯; তিরমিজি, হাদিস : ২৫০৯)
২৭. ভালো কাজে সহায়তা করা। (সুরা মায়েদা, আয়াত : ২; বুখারি, হাদিস : ২৪৪৪)
২৮. সৎকাজে আদেশ করা ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৮-১১০)
২৯. শরিয়ত প্রবর্তিত শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন করা। (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৩৩-৩৪; সুরা নুর, আয়াত : ২)
৩০. প্রয়োজন অনুযায়ী জিহাদ করা। (সুরা হজ, আয়াত : ৭৮)
৩১. আমানত রক্ষা এবং তা সঠিকভাবে আদায় করা। (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮)
৩২. অভাবী ও ঋণগ্রস্তদের ঋণ দেওয়া। (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩২৮৫)
৩৩. প্রতিবেশীর হক আদায়। (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৬; তিরমিজি, হাদিস : ১৯৪৩)
৩৪. হালালভাবে উপার্জন এবং ভক্ষণ করা। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৭২; সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৫১; বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৯২০৩)
৩৫. শরিয়তের বিধান মেনে আয়-ব্যয় সমন্বয় করা। (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৬৭)
৩৬. সালাম দেওয়া এবং সালামের উত্তর দেওয়া। (সুরা নিসা, আয়াত : ৮৬)
৩৭. হাঁচিদাতা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা। (বুখারি, হাদিস : ১২৪০; মুসলিম, হাদিস : ২৯৯২)
৩৮. কাউকে কষ্ট না দেওয়া এবং কারও কোনও ক্ষতি না করা। (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৮; সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১১)
৩৯. অবৈধ খেলাধুলা ও রং-তামাশা থেকে বেঁচে থাকা। (সুরা জুমআ, আয়াত : ১১)
৪০. রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৫৭)
লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক