মানুষের চাহিদার সীমা-পরিসীমা নেই। আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। মানুষ যত ইচ্ছা কামনা করতে পারে। প্রত্যাশার ঘোড়াকে দ্রুতবেগে দৌড়াতে পারে। কিন্তু যারা আশা-আকাঙ্ক্ষা ও পাওয়ার কাতরতায় বুঁদ থাকে, অধিক পাওয়ার ইচ্ছায় সর্বদা ব্যস্ত থাকে, তারা প্রতি মুহূর্তে না পাওয়ার বেদনায় যন্ত্রণায় ভোগে। অভাব-অনটন তাদের লেগেই থাকে। বঞ্চনার বেদনা থেকে তারা সহজে রক্ষা পায় না। তাই জীবন চলার পথে আত্মিকভাবে বিত্তশালী ও অভাবমুক্ত হওয়ার জন্য অল্পে তুষ্টির বিকল্প নেই। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ধনের আধিক্য হলে ধনী হয় না, অন্তরের ধনীই প্রকৃত ধনী।’ (বুখারি, হাদিস: ৬৪৪৬)
পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষই আছেন, যাদের অর্থবিত্ত আছে, কিন্তু সুখ নেই। আবার কারও বিত্তবৈভব তেমন না থাকলেও সুখ-শান্তির অভাব নেই। তবে কেউ যদি অন্যের ধনৈশ্বর্য বা সুখ-শান্তি দেখে মন খারাপ করে, না পাওয়ার বেদনায় ভোগে, তাহলে তার জীবনে সুখ আসবে না। তার দুর্ভোগ ও দুর্দশা বেড়ে যাবে। অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পত্তির প্রতি লোভ না করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৩২)
নিজের চেয়ে অধিক সম্পদশালী ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি দিলে নিজেকে অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মনে হয়। এতে ব্যক্তির আফসোস ও পরিতাপ বেড়ে যায়। বঞ্চনার হাহাকার নিজের মধ্যে বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে কেউ যদি তার চেয়ে কম সম্পদের অধিকারী লোকের প্রতি তাকায়, তাহলে তার মধ্যে সুখী হওয়ার বোধ জাগ্রত হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পার্থিব ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে কম সম্পদশালী মানুষদের প্রতি দৃষ্টি দিও; তোমাদের চেয়ে ধনী লোকদের দিকে নয়। এতে করে তোমাদের কাছে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ নগণ্য মনে হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৩)
প্রচলিত বচন আছে, ‘অর্থই সব অনর্থের মূল’। অর্থ অনেক সময় অন্যায়, অনাচার ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়। জাগতিক উন্নতি ও অগ্রগতির অতিশয় আসক্তি মানুষকে পরকাল ভুলিয়ে দেয়। জাগতিক লোভ-লালসা ও দুনিয়ার মোহ বর্জনকারীকে আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন। অনুরূপভাবে জাগতিক বিষয়াশয়ের প্রতি অনাসক্ত লোককে মানুষও ভালোবাসে। মানুষকে উপকারকারী ব্যক্তিও মানুষের ভালোবাসা পায়। সাহল ইবনে সাদ আস-সাইদি (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালোবাসবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি অবলম্বন করো। এতে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের কাছে যা আছে, তুমি তার প্রতি অনাসক্ত হয়ে যাও, তাহলে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪১০২)
জীবন ধারণের জন্য সহায়-সম্পদ ও অর্থবিত্তের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সেই প্রয়োজনের পরিমাণ ও পরিধি কতটুকু? খুব বেশি নয়। হালাল রিজিকের ওপর নির্ভর করে যদি পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনযাপন করা যায়, তাহলেই যথেষ্ট। কিন্তু বহু মানুষ দিনরাত দুনিয়ার পেছনে ছুটে চলে। অঢেল সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিরাম নেই। বিশ্রাম নেই। হালাল-হারামের ধার ধারে না।
নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না। এমন মানসিকতার লোককে সফল বলা যায় না। সফল ওই ব্যক্তি, যে নিজের সম্পত্তির ওপর সন্তুষ্ট থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির ইসলাম কবুল করার সৌভাগ্য হয়েছে, যাকে প্রয়োজন পরিমাণ রিজিক দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহতায়ালা তাকে যে সম্পদ দিয়েছেন এর ওপর তুষ্ট থাকার শক্তি দিয়েছেন, সেই সফলতা লাভ করেছে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৩১৬)
পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষই পথচারীর মতো। বুদ্ধিমান পথচারী শুধু ততটুকুই বহন করে, পথ চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। মানুষের জীবন যেহেতু অনিশ্চিত ভ্রমণের মতো তাই হাদিসে লোকদের পথিকের মতো জীবনযাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার আমার দুই কাঁধ ধরে বললেন, তুমি দুনিয়ায় থাকো যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১৬)
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার