সে এক পূর্ণিমা রাতের কথা। আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্র মিটিমিটি হেসে আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ধুলির ধরার এক মানুষ চাঁদের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করলেন। আর দেখতে-না দেখতে চাঁদটি তখন মাঝ বরাবর ফেটে গেল। পুরোপুরি দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুই টুকরো হেরা পাহাড়ের দুই দিকে পড়ে গেল! সামান্য সময় পরেই আবার মিলে গেল। ঠিক আগের মতো হয়ে গেল। যারা এই মুহূর্তটির সাক্ষী ছিলেন, ইতিহাসের অনন্য মানুষ তারা। পৃথিবীর ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ক্ষণের সাক্ষী হলেন তারা। এ এমন এক দৃশ্য—যা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। পরেও কখনও ঘটবে না।
এই ঘটনা ঘটেছিল সপ্তম শতাব্দীর এক ঐতিহাসিক রাতে। বাস্তব ঘটনা ছিল। কোনো রূপক গল্প কিংবা প্রবাদ ছিল না। ঘুমের ঘোরের স্বপ্ন ছিল না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে এটা সংঘটিত হয়েছিল। তাঁর সাহাবিরা মিনার ময়দানে উপস্থিত থেকে নিজ নিজ চোখে এটা দেখেছিলেন। মক্কার অন্যান্য মানুষও দেখেছিল। আল্লাহতায়ালা এ ঘটনাকে চিরন্তন করে আয়াত অবতীর্ণ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কিয়ামত অত্যাসন্ন। চাঁদ বিদীর্ণ হয়ে গেছে।’ (সুরা কামার, আয়াত: ১)
আলি ইবনে আবি তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, জুবাইর ইবনে মুতইম, আনাস ইবনে মালেক, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হুজাইফা ইবনুল ইয়ামানসহ একাধিক সাহাবি থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বুখারি ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে সে রাতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নিজে সে ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘নবিজির যুগে চন্দ্র দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘তোমরা দেখো!’ ইবনে মাসউদের অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমরা নবিজির সঙ্গে মিনাতে ছিলাম। এমন সময় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এক টুকরো পাহাড়ের সামনে আরেক টুকরো পেছনে গিয়ে পড়ে (অন্য বর্ণনায় এক টুকরো পাহাড়ের সামনে অন্য টুকরা পাহাড়ের ওপর গিয়ে পড়ার কথা আছে। এটা বাস্তবে পতন নয়; বরং আকাশের দ্বিখণ্ডিত বস্তুর সামনে পাহাড় বিদ্যমান থাকলে চোখে সাধারণত যেভাবে দৃশ্যমান হয়) রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা দেখো!’ (বুখারি, হাদিস: ৩৬৩৬)
জুবাইর ইবনে মুতইমও এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘নবিজির যুগে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ দুই টুকরো হয়ে দুই পাহাড়ের ওপর গিয়ে পড়ে। তখন তারা (কাফেররা) বলে, ‘মুহাম্মাদ আমাদের জাদু করেছে!’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩২৮৯)
এভাবে তারা ঈমান আনার পরিবর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জাদুকর হিসেবে আখ্যা দেয়। তারা এটাকে জাদু হিসেবে নিলেও তাতে পরোক্ষভাবে মূল ঘটনার স্বীকৃতি প্রমাণিত হয়। তাদের জাদুকর অপবাদও কোরআনে আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করে বলেন, ‘যখনই তারা কোনো নিদর্শন দেখে, তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে চিরাচরিত জাদু।’ (সুরা কামার, আয়াত: ২)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘মক্কাবাসী নবিজির কাছে (ঈমান আনার শর্তস্বরূপ) একটি মুজিজা দাবি করে। তিনি তাদের চাঁদ বিদীর্ণ করে দেখান।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৬৩৭)
আনাস ইবনে মালেকের অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘নবিজির যুগে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৮০২)
তাছাড়া উক্ত ঘটনার পর থেকে এসব আয়াত ও হাদিস রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ও তাঁর ওফাতের পরে সকল সাহাবি, তাবিয়িন ও তাবে-তাবিয়িন পড়েছেন। এ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো ইমামগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে চন্দ্র বিদীর্ণের ঘটনা ‘মুতাওয়াতির’ তথা প্রসিদ্ধ ও সন্দেহাতীভাবে প্রমাণিত। এই কারণে মুসলিম ইতিহাসে এমন একটি ঘটনাও নেই, যেখানে কেউ উক্ত আয়াত ও হাদিসগুলোর বিরোধিতা করেছে। কারণ খোদ মক্কার কাফের ও মুশরিকরাই ইসলামের জঘন্য বিরোধিতা সত্ত্বেও এই ঘটনার সত্যতার বিরোধিতা করেনি। বোঝা গেল, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা সর্বজন স্বীকৃত ছিল। সবার জানা ছিল। সকল মানুষ এটাতে বিশ্বাস রাখত।
লেখক: আলেম ও গবেষক