পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তারা তোমাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলো, আমি তোমাদের কাছে তার বিষয় বর্ণনা করব।’ (আল্লাহতায়ালা বলেন,) ‘আমি তো তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৮৩-৮৫)
অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম বলেছেন, জুলকারনাইন একজন সৎ ব্যক্তি এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। ইমাম রাজি (রহ.)-এর মতে, জুলকারনাইনের প্রকৃত নাম সিকান্দার, যিনি আলেকজান্ডার নামে পরিচিত। তিনি দারা ইবনে দারাকে একাধিকবার পরাজিত করেছেন। অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, জুলকারনাইন হলেন বাদশাহ সিকান্দার ইবনে ফিলিবুস ইউনানি।’ (আত-তাফসিরুল কাবির, খণ্ড: ২১, পৃষ্ঠা: ৪৯৩)
ইমাম কুরতুবি (রহ.) ইবনে ইসহাকের বরাতে উল্লেখ করেছেন, ‘জুলকারনাইন ছিলেন মিসরের অধিবাসী। তিনি ইউনান বিন ইয়াফেস বিন নুহ (আ.)-এর সন্তান। ইবনে হিশাম বলেছেন, তার নাম সিকান্দার।’ (তাফসিরুল কুরতুবি, খণ্ড: ১১, পৃষ্ঠা: ৪৫)
জুলকারনাইন কি নবী ছিলেন?
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘জুলকারনাইন একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। আল্লাহতায়ালা তার কার্যাবলি পছন্দ করেছেন এবং তাঁর কিতাব কোরআনে তার প্রশংসা করেছেন।’ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১১৩)
তবে তার ব্যাপারে আলী (রা.) বলেন, ‘জুলকারনাইন নবীও ছিলেন না, বাদশাহও ছিলেন না; তিনি একজন সৎ বান্দা ছিলেন।’ (ফাতহুল বারি, খণ্ড:৬, পৃষ্ঠা: ২৯৫)
আবু হুরায়রাহ (রা.)-ও জুলকারনাইনকে সৎকর্মপরায়ণ বান্দা মনে করতেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১০৩)
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং জুলকারনাইন
জুলকারনাইন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত গুণাবলি ও ঐতিহাসিক তথ্যাবলির আলোকে এটা সুনিশ্চিত যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে কিছুতেই কোরআন-বিবৃত জুলকারনাইন বলা যেতে পারে না। যদিও কোনো কোনো আলেম আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে জুলকারনাইন বলেছেন। কিন্তু সৎ ও সত্যনিষ্ঠ অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম কঠোরভাবে তাদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন এবং উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ দিয়েছেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যে জুলকারনাইন নয়; এ ব্যাপারে কয়েকটি প্রমাণ তুলে ধরা হলো—
১. সর্বজন স্বীকৃত ব্যাপার হলো, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট প্রাচীন গ্রিক ধর্মের অনুসারী ও মূর্তিপূজক ছিলেন। তিনি কখনোই মুসলমান ছিলেন না।
২. ইতিহাসবিদদের ঐকমত্যে আলেকজান্ডার অত্যাচারী ও জালিম শাসক ছিলেন। সচ্চরিত্র ও পুণ্যাত্মা ছিলেন না।
৩. এটাও একটি সর্বজনস্বীকৃত বিষয় যে, আলেকজান্ডারের বিজয় ও অভিযানের ধারা পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়নি। (জুলকারনাইন ও আলেকজান্ডারের প্রাচীর, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৬-১৭)
আলেকজান্ডার শুধু দেবতার পূজাই করতেন না; বরং এই পর্যায়ের আত্মম্ভরী ও উদ্ধত ছিলেন যে, গ্রিস ও স্পেনের লোকদের তার সামনে সিজদাবনত হওয়ার নির্দেশ দিতেন এবং নিজেকে উপাস্য বলে পরিচিত করতেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আলেকজান্ডার যখন বাখতারে ফিরে এলেন এবং অক্সারটেসের কন্যা রোকসানাকে বিয়ে করলেন, তখন বিয়ের নিমন্ত্রণে তার গ্রিক ও ম্যাসেডোনিয়ান অনুসারীদের থেকে নিজের প্রভুত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে চেয়েছিলেন।’ (আজরার কিতাব, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪৮৪)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাদুদ্দিন বিন কাসির তার ইতিহাসগ্রন্থ ‘আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়ায় সিকান্দার জুলকারনাইন ও আলেকজান্ডার বিন ফিলিপের মধ্যে পার্থক্য করে ম্যাসেডোনিয়ান আলেকজান্ডারকে (আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে) মুশরিক বলেছেন। (প্রাগুক্ত, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১০৬)
ইবনে হাজার আসকালানি ম্যাসেডোনিয়ান আলেকজান্ডার ও তার মন্ত্রী এরিস্টটল উভয়কে কাফের বলেছেন। (ফাতহুল বারি, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ২৯৪)
উল্লিখিত দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং জুলকারনাইন এক ব্যক্তি নন। জুলকারনাইন ছিলেন আল্লাহবিশ্বাসী মুসলমান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ও সৎ বান্দা। আর আলেকজান্ডার ছিলেন কাফের ও অত্যাচারী শাসক।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক