আল্লাহতায়লা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ আদম, নুহ ও ইবরাহিমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের ওপর মনোনীত করেছেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৩)
কিছু মুফাসসির এ আয়াতে আলোচ্য ‘ইমরান’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে, সেটা নিয়ে মতপার্থক্য করেছেন। নবি-রাসুলদের বংশে ‘ইমরান’ নামে মোট দুজন ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। একজন হলেন হজরত মুসা ও হারুন (আ.)-এর পিতা এবং দ্বিতীয়জন হলেন হজরত মারইয়াম (আ.)-এর পিতা। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস দেখে জানা যায়, ‘হজরত মুসা (আ.)-এর পিতার নামও ইমরান ছিল।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৬৫)
অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, এ আয়াতে দ্বিতীয় ‘ইমরান’ অর্থাৎ হজরত মারইয়াম (আ.)-এর পিতাকে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে আহসানুল বয়ান, সুরা আলে ইমরানের ৩৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
ইমরান ছিলেন বনি ইসরায়েলের মধ্যে সুপরিচিত একজন পরহেজগার মানুষ এবং স্ত্রী হান্নাহও ছিলেন পরহেজগার ও আবেদা নারী। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই তাদের সৎকাজ ও ভালো আচরণের জন্য বনি ইসরায়েলের সব মানুষের কাছে প্রিয় ছিলেন। কয়েকজন ইতিহাসবিদের মতে, ইমরান ছিলেন হজরত সুলাইমান (আ.)-এর বংশধর আর হান্নাহ বিনতে ফাখুজ ছিলেন হজরত দাউদ (আ.)-এর বংশধর। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড: ১, সুরা আলে ইমরানের তাফসির দ্রষ্টব্য)
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর ছিল তাদের সংসার। আনন্দে কাটত তাদের দিন-রাত। দাম্পত্য-কলহের লেশ মাত্র ছিল না। কিন্তু একটি অপূর্ণতা ছিল ইমরান-হান্নাহর সংসারে। দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন তারা। প্রচণ্ডভাবে সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষিনী ছিলেন হান্নাহ। পিতা হওয়ার প্রচণ্ডরকম আগ্রহ ছিল ইমরানের। কিন্তু পূর্ণ হচ্ছিল না তাদের এ আশা। বাবা হতে পারছিলেন না ইমরান এবং মা হতে পারছিলেন না হান্নাহ। নানান সুখবোধের মধ্যেও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাদের এ অপূর্ণতা। (কসাসুল কুরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান সেওহারবি, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আল-আইনি, মাকতাবাতুল ইসলাম, খণ্ড: ১১, পৃষ্ঠা: ১০-১১)
হান্নাহ একদিন ঘরে পায়চারী করছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন একটি পাখি তার ছানাকে খাবার খাওয়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল হান্নাহর মন। কেঁদে উঠল তার অন্তর। সন্তানহীনতার শূন্যতার কথা চিন্তা করে মন খারাপ হলো তার। এমন অস্থির অবস্থায় প্রভুর দরবারে হাত তুললেন হান্নাহ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শুরু করলেন প্রার্থনা। বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক। হে আমার রব! আমাকেও এভাবে সন্তান দান করুন। এমন সন্তান দান করুন; যে হবে আমাদের চোখের আলো এবং অন্তরের প্রশান্তি।’ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, হাফিজ ইবনে কাসির আদ- দামেশকি, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১১৫)
পবিত্র কোরআন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, হে আমার রব! আমার গর্ভে যা আছে; নিশ্চয় আমি তা একান্তভাবে আপনার জন্য মান্নত করলাম। অতএব, আপনি আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৫)
অবশেষ হান্নাহর হৃদয়ের ব্যাকুলতার অবসান ঘটল। সন্তান লাভের প্রার্থনা কবুল হলো প্রভুর দরবারে। পাখির ছানার খাবার খাওয়ানোর দৃশ্য দেখে প্রার্থনা করার কয়েকদিনের মাথায় হান্নাহ অনূভব করলেন, তিনি গর্ভবতী। শোকরানার জায়নামাজের কৃতজ্ঞতা সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন তিনি। আলহামদুলিল্লাহ বলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন প্রভুর দরবারে। পূর্ণ হচ্ছে তার সন্তান লাভের দীর্ঘদিনে আশা। খুশি মনে আনন্দি চিত্তে মান্নত করলেন হান্নাহ, ‘আমার গর্ভ থেকে যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে; আমি তাকে পবিত্র উপাসনাগৃহে (মসজিদুল আকসা) ওয়াকফ করব।’ (তাফসিরে আনওয়ারুল কোরআন, মাওলানা আবুল কালাম মাসুম, ইসলামিয়া কুতুবখানা, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪৫১)
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বিশর ইবনে ইসহাক বলেন, ‘হান্নাহ গর্ভবতী থাকাবস্থায় তার স্বামী ইমরানের ইনতিকাল ঘটে।’ (ফাতহুল বারি, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ৩৬৪)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আরও এরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর সে যখন তা (সন্তান) প্রসব করল; বলল, হে আমার রব! নিশ্চয় আমি কন্যাসন্তান প্রসব করেছি। আর সে যা প্রসব করেছে, তা সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। আর পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের মতো নয় এবং নিশ্চয় আমি তার নাম রেখেছি মারইয়াম। আর নিশ্চয় আমি তাকে ও তার সন্তানদের বিতাড়িত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয় দিচ্ছি।’(সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৬)
সন্তান প্রসবের পর হান্নাহ দেখলেন, তিনি একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন! চিন্তায় পড়ে গেলেন হান্নাহ বিনতে ফাখুজ। কন্যাসন্তানকে দিয়ে কীভাবে মান্নত পূরণ হবে? কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ভাবলেন, তাহলে কি তার মান্নত পূর্ণ করা সম্ভব হবে না? কিন্তু আল্লাহ জানতেন, এই কন্যাই তার জন্য সর্বোত্তম। এটাই ছিল আল্লাহর পরিকল্পনা। হান্নাহর কন্যা সন্তানকেই বাইতুল মাকদিসের প্রথম নারী তত্ত্বাবধানকারী বানানোই ছিল আল্লাহতায়লার পরিকল্পনা। (ঈসা ইবনে মারইয়া, শাইখ আহমদ মুসা জিবরিল, অনুবাদ: সিফাত-ঈ-মুহাম্মাদ, সমর্পণ, পৃষ্ঠা: ১২)
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক