আরবের রুক্ষ প্রান্তরে, প্রখর সূর্য যখন তার দহনলীলা চালাচ্ছিল, ঠিক তখনই মক্কা নগরীর বুকে এক নিষ্পাপ ফুলের কলি দশম বর্ষে পদার্পণ করে। এই ছোট্ট বালক আর কেউ নন, মক্কার নয়নমণি মুহাম্মদ (সা.)। কৈশোরের এই সোনালি অধ্যায়ে, তাঁর জীবন এমন কিছু স্পর্শকাতর ঘটনার সাক্ষী ছিল, যা ভবিষ্যতের বিশাল দিগন্তের ইঙ্গিত বহন করে।
তখনো তিনি মমতাময়ী মায়ের উষ্ণ আলিঙ্গন থেকে বঞ্চিত। শৈশবের শুরুতেই মা আমিনার চিরবিদায় এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল তাঁর ছোট্ট হৃদয়ে। তবে করুণাময় আল্লাহতায়ালার অসীম কৃপায়, তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন পিতৃব্য আবু তালিবের স্নেহময় আশ্রয়। কুরাইশ বংশের এই সম্মানিত ব্যক্তি আর্থিক কষ্টের মাঝেও তাঁর ভাতিজার প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব পরম মমতায় বহন করতেন। চাচার প্রজ্ঞা ও ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ নিঃসন্দেহে তরুণ মুহাম্মদের (সা.) কোমল মনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম)
কৈশোরের দশম বছরে এক বিশেষ ঘটনা ঘটে। চাচা আবু তালিব ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদূর সিরিয়ার পথে যাত্রা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিশোর মুহাম্মদ (সা.) চাচার সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আবদার করলেন। স্নেহপরায়ণ চাচা তাঁর ছোট্ট ভাতিজার ব্যাকুলতা উপেক্ষা করতে পারলেন না এবং তাঁকে সঙ্গী করে নিলেন। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁরা যখন বুসরা নামক স্থানে পৌঁছালেন, তখন বাহিরা নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রি বিশ্বনবিকে দেখেই বিশেষভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। আপ্যায়ন শেষে তিনি নবির সাথে কথা বললেন এবং নিশ্চিত হলেন এই শিশুই হবেন শেষ নবি।
তিনি চাচা আবু তালিবকে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র থেকে মুহাম্মদ (সা.)-কে রক্ষা করার জন্য সতর্ক করলেন এবং দ্রুত মক্কায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বিচক্ষণ চাচা আবু তালিব পাদ্রির কথা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করলেন এবং যাত্রা সংক্ষিপ্ত করে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। এর পর থেকে তিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতেন না। যদিও এই ঘটনার সঠিক সন-তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে।
ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, এই বছর মক্কার ধূসর প্রান্তরে আরও এক নতুন প্রাণের স্পন্দন অনুভূত হয় বেলাল ইবনে রাবাহ (রা.)-এর জন্ম। যিনি পরবর্তী সময়ে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজানের ধ্বনিতে বিশ্বকে মোহিত করেছিলেন। যদিও সেই সময়ে শিশু মুহাম্মদ (সা.) এবং নবজাত বেলালের (রা.) মধ্যে কোনো সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, তবে একই বছরে তাঁদের আগমন যেন একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করে, যেখানে শান্তি ও মুক্তির সুর অনুরণিত হবে।
কৈশোরের সেই দশম বছরে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সমবয়সীদের সাথে সরল আনন্দে দিন কাটাতেন, মক্কার নির্মল প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে নিতেন। তবে অন্যান্য সাধারণ বালকের চেয়ে তাঁর চরিত্রে ছিল এক স্নিগ্ধ ব্যতিক্রম। তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল সত্য-মিথ্যা। সম্ভবত সেই সময়েই তিনি সমাজের নানা অন্যায় ও কুসংস্কারের নীরব দর্শক ছিলেন, যা তাঁর সংবেদনশীল মনে এক চাপা কষ্টের জন্ম দিত।
আমরা এই সময়ের খুব বেশি তথ্য না জানলেও, এতটুকু অনুভব করতে পারি যে ৫৮০ সাল ছিল তাঁর জীবনের শুরুতে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষণ। এত অল্প বয়সে তিনবার মৃত্যুশোক অনুভব করেছিলেন। কিন্তু এই ধারাবাহিক শোক তাঁকে দুর্বল করেনি, বরং গড়ে তুলেছিল এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ হিসেবে যাঁর অন্তর পূর্ণ ছিল দয়া, মমতা, ধৈর্য আর ভালোবাসায়।
এ কারণেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তিনি কি তোমাকে এতিম পাননি, অতঃপর আশ্রয় দেননি?’ (সুরা আদ-দুহা, আয়াত ৬)। এই আয়াত তাঁর সেই এতিম জীবনের করুণ ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সেই সাথে আল্লাহর অসীম রহমতের বার্তাও বহন করে। এই কৈশোরের দশম বর্ষ ছিল সেই শান্ত সকালের মতো, যা ধীরে ধীরে বিশ্বকে আলোকিত করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, এক মহান রাসুলের আগমনী বার্তা নিয়ে।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক