ঢাকা ১০ আষাঢ় ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
English

নাবালেগ সন্তানের কোরবানি দিতে হবে?

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪, ০৭:০০ পিএম
আপডেট: ০৯ জুন ২০২৪, ০৭:২৬ পিএম
নাবালেগ সন্তানের কোরবানি দিতে হবে?
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত কোরবানির পশুর সঙ্গে এক কিশোরের ছবি।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তারা কতক নির্দিষ্ট দিনে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুর মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ২৮)

আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে (কোরবানির পশুর)) গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না; বরং তোমাদের অন্তরের তাকওয়া পৌঁছায়।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)

কোরবানি অর্থ নৈকট্য অর্জন করা, ত্যাগ স্বীকার করা। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুসারে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা হলো কোরবানি। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট দিয়ে কোরবানি দেওয়া যায়। একটি গরু, মহিষ বা উট সাত শরিকে বা সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা শুধু একজনের পক্ষ থেকে দেওয়া যাবে। 

স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম ‘নিসাব’ পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার জন্য একটি কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক। নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা ও ব্যবসার পণ্য বা সম্পদ। 

অনেকেই শুধু পরিবারপ্রধানের পক্ষ থেকে কোরবানি করেন। এটা ভুল পদ্ধতি। ইসলাম ব্যক্তিস্বাধীনতায় ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করে। তাই প্রত্যেক ব্যক্তি আলাদাভাবে সম্পদশালী হলে প্রত্যেকের জন্য কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। 

নাবালেগ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান ও শিশু-কিশোর নেসাবের মালিক হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তাদের অভিভাবক নিজ সম্পদ দিয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করলে তা সহিহ হবে। (বাদায়েউস সানায়ে, ৪/১৯৬; রদ্দুল মুহতার, ৬/৩১৬)। তবে নিজের সম্পদ থেকে অপ্রাপ্তবয়স্কের নামে কোরবানি দেওয়া অভিভাবকের ওপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব। (রদ্দুল মুহতার, ৬/৩১৫)

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

 

নামাজে মাহরামের সম্মুখে মহিলাদের পূর্ণ শরীর ঢেকে রাখা জরুরি কী?

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৩:০০ পিএম
নামাজে মাহরামের সম্মুখে মহিলাদের পূর্ণ শরীর ঢেকে রাখা জরুরি কী?
প্রতীকী ছবি । সংগৃহীত

প্রশ্ন: মাহরামের সম্মুখে মহিলাদের পূর্ণ শরীর ঢেকে রাখা জরুরি নয়। কিন্তু ঘরে মাহরাম থাকাকালীন নামায পড়লে পূর্ণ শরীর ঢাকে রাখা জরুরি কী? 

উত্তর: নামাজে শরীর ঢেকে রাখার মাসয়ালা ভিন্ন। সে সময় অন্য কেউ সামনে থাকা বা না থাক এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এক্ষেত্রে মাসয়ালা হল, মহিলাদের জন্য নামাজেরর সময় চেহারা, কব্জি পর্যন্ত উভয় হাত ও উভয় পা টাখনু গিরা পর্যন্ত খুলে রাখা জায়েয। এছাড়া অবশিষ্ট পুরো শরীর ঢেকে রাখা জরুরি। আর পায়ের পাতা ঢেকে রাখা উত্তম।

নামাজ অবস্থায় উপরোক্ত নিয়মে শরীর ঢেকে রাখা মহিলাদের জন্য সর্বদা পালনীয় বিষয়। চাই নামাজ একাকি নির্জনে পড়া হোক বা মাহরামের সামনে পড়া হোক।

আলমুহীতুল বুরহানী ২/১৪; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১/৪১৪; আদ্দুররুল মুখতার ১/৪০৪-৪০৫

 

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক

যেভাবে শুরু করবেন আপনার দিন

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১০:২৬ এএম
যেভাবে শুরু করবেন আপনার দিন
দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতির ছবি । সংগৃহীত

প্রতিটি নতুন দিন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অপার নেয়ামত। এই নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করা । দিনের শুরুটা আল্লাহর স্মরণে করা মুমিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা  সারা দিনের কর্ম ও চেতনায় এক অপার্থিব বরকত বয়ে আনে। প্রভাতের পবিত্র মুহূর্তে আল্লাহর জিকির ও নবিজির (সা.) সুন্নাহ অনুসরণ করে যে যাত্রা শুরু হয়, তা আত্মিক প্রশান্তি ও সাফল্যের পথ খুলে দেয়।

প্রভাতের সূচনায় কৃতজ্ঞতা ও তাসবিহ
ঘুম ভাঙার পর মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করাই একজন মুমিনের প্রথম কাজ। প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন, দিনের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করা এবং তাঁর মহিমা স্মরণ করা। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,  রাসুলুল্লাহ (সা.) ভোরে উপনীত হলে বলতেন, ‘আসবাহনা ওয়া আসবাহাল হামদু কুল্লুহু লিল্লাহ, লা শারিকা লাহু, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া ইলাইহিন নুশুর।’

অর্থ: আমরা ভোরে উপনীত হয়েছি এবং আল্লাহর রাজত্ব (সৃষ্টিকুল) ভোরে উপনীত হয়েছে। সব প্রশংসা মহান আল্লাহর। তাঁর কোনো শরিক নেই। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং পুনরুত্থান তাঁর কাছেই।

এছাড়াও, প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে ১০০ বার এবং সন্ধ্যায় ১০০ বার 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি' পড়বে, কিয়ামতের দিন তার চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু কেউ নিয়ে আসতে পারবে না; তবে সে ব্যক্তি ছাড়া যে তার মতো বলবে বা তার চেয়ে বেশি আমল করবে। এই তাসবিহের অর্থ হলো : ‘আমি আল্লাহর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি।’ এই আমলগুলো আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং সারা দিন আল্লাহর রহমতের ছায়ায় থাকার সুযোগ করে দেয়।

ফজরের নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াতের মাহাত্ম্য
দিনের শুরুটা ফজরের জামাতে নামাজ আদায় করে শুরু করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়ে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে আল্লাহর জিকির করে, তারপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে, সেই ব্যক্তি একটি হজ ও একটি উমরার সওয়াব লাভ করে।’ (তিরমিজি, ৫৮৬) এটি শুধু একটি সওয়াবের মাধ্যম নয়, বরং দিনটিকে একটি শান্তিপূর্ণ ও বরকতময় করার বড় উপায়।

কুরআন তেলাওয়াত সর্বোত্তম জিকির। পবিত্র কুরআনের হৃদয় বলা হয় সুরা ইয়াসিনকে। দিনের শুরুতে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করা অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। বিশিষ্ট তাবেয়ী ইয়াহইয়া ইবন কাসির (রহ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুখে-স্বস্তিতে থাকবে। যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে সে সকাল পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে।’ এটি অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত।

 

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক 

 

জিনদের হাদিস বর্ণনা ও ইসলামের বিধান

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ০৩:০০ পিএম
জিনদের হাদিস বর্ণনা ও ইসলামের বিধান
প্রতীকী ছবি । সংগৃহীত

জিনদের অস্তিত্ব যেমন কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত, তেমনি তাদের মধ্যে মুসলিম, কাফির, ভালো ও মন্দ সব শ্রেণির জিনও রয়েছে। কোরআনে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিনদের একটি প্রতিনিধি দল এসেছিল এবং তিনি তাদের ইসলাম শিক্ষা দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে কিছু মুসলিম জিন রাসুলের হাদিস বর্ণনা করেছে তবে তা নিয়ে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

ইসলামের ইতিহাসে জিনদের হাদিস বর্ণনার কিছু ঘটনা পাওয়া যায়। আবু নুআইম আসবাহানি (রহ.) উবাই ইবনু কাব (রা.) থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। একদল লোক মক্কার পথে যাত্রা করে। দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর তারা পথ হারিয়ে ফেলে এবং পানির অভাবে প্রায় মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। এমতাবস্থায়, তাদের কাছে এক জিন এসে জানায় যে সে নবিজি (সা.)-এর কাছে আগমনকারী জিন দলের শেষ সদস্য। জিনটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছে, ‘প্রকাশ্যে হোক বা অপ্রকাশ্যে, এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। পানি ও পথ প্রদর্শনে সে তার ভাইকে ধোঁকা দেয় না।’ এরপর জিনটি তাদের পানির সন্ধান এবং সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়।

এ ধরনের আরও কিছু হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে কোনো মুসলিম জিন হাদিস রিওয়ায়াত করেছেন। তবে, ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি অনুযায়ী, জিনদের বর্ণিত হাদিস মানুষের জন্য শরিয়তের দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে সব মুসলিম ইমাম একমত পোষণ করেছেন। এর কারণ হলো, হাদিস গ্রহণের ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা, স্মৃতিশক্তি ও সততা বিশেষভাবে যাচাই করা হয়। জিনদের জগৎ মানুষের থেকে ভিন্ন এবং তাদের স্বভাব ও জ্ঞান সম্পর্কে মানুষের পূর্ণাঙ্গ ধারণা নেই। তাই, তাদের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে শরিয়তের কোনো বিধান নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত নয়।

তবে, জিনরা নিজেদের মধ্যে হাদিস বর্ণনা করতে পারবে। এতে কোনো বাধা নেই। কারণ তাদের নিজস্ব জীবন ও শরয়ী বিধিবিধান থাকতে পারে, যা তারা একে অপরের কাছে বর্ণনা করতে পারে। কিন্তু সেই বর্ণনা মানুষের জন্য অনুসরণীয় বা দলিল হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হবে না। জিনদের হাদিস বর্ণনা ইসলামি ইতিহাসে একটি গ্রহণযোগ্য বিষয় হলেও, মানুষের জন্য শরিয়তের দলিল হিসেবে তা গ্রাহ্য নয়। মানুষের জন্য অনুসরণীয় দলিল হলো সাহাবা, তাবেইন ও অন্য নির্ভরযোগ্য মানব বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে পরম্পরায় বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী ও কর্ম।

 

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক

জিন ও মানুষের সহবাস প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে?

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১০:৪৪ এএম
জিন ও মানুষের সহবাস প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে?
প্রতীকী ছবি । সংগৃহীত

ইসলামি শরিয়তে জিনদের অস্তিত্ব বাস্তব এবং কোরআন-হাদিসে তা বারবার এসেছে। বহু মানুষের অভিযোগ থাকে যে, তাদের ওপর কোনো জিন বা অদৃশ্য সত্তা প্রভাব বিস্তার করছে বা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। শরিয়তের দৃষ্টিতে এসব বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে, যা জানা একজন মুসলিমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কোরআনুল কারিমের সুরা আর-রাহমানের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা জান্নাতের হুরদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সেখানে (জান্নাতে) রয়েছে আয়তলোচনা রমণীরা, যাদের আগে কোনো মানুষ কিংবা কোনো জিন স্পর্শ করেনি।’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল জাওজি (রহ.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালার এই বাণী প্রমাণ করে যে, জিনদের নারী ও পুরুষ উভয়ই মানব নারী-পুরুষের সঙ্গে সহবাস করতে সক্ষম।’


এই প্রেক্ষাপটে, ইসলামি শরিয়তে জিন ও মানুষের সহবাসের বিষয়টিকে প্রধানত তিনটি অবস্থায় বিবেচনা করা হয়-

১. স্বপ্নে সহবাসের অনুভূতি: ঘুমের মধ্যে যদি কোনো নারী বা পুরুষ এমন কিছু অনুভব করে যা স্বামী বা স্ত্রীর সহবাসের সময় হয়ে থাকে এবং ঘুম ভাঙার পর বীর্য (শুক্রাণু) দেখতে পায়, তাহলে তার ওপর গোসল ফরজ হবে। আর যদি বীর্য দেখতে না পায়, তবে তা সাধারণ স্বপ্নদোষ হিসেবে গণ্য হবে এবং এক্ষেত্রে গোসল ফরজ হবে না।

২. জিনের মানুষের আকৃতিতে সহবাস: যদি কোনো জিন বা পরি মানুষের আকৃতি ধারণ করে কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে সহবাস করে, তাহলে বীর্যপাত হোক বা না হোক, এমতাবস্থায় গোসল ফরজ হবে। কারণ এমনটা বাস্তবে বিরল হলেও ইসলামি ফিকহে তা সম্ভব হিসেবে গণ্য করা হয়।

৩. অদৃশ্য জিনের সহবাস: যদি কোনো জিন অদৃশ্য থেকে কোনো জাগ্রত মানুষের সঙ্গে সহবাস করে এবং সেই অনুভূতিও সহবাসের মতোই হয়, তাহলে চার মাজহাবের অধিকাংশ ফকিহের মতানুসারে, যদি বীর্যপাত ঘটে তবেই গোসল ফরজ হবে, অন্যথায় নয়।

এ বিষয়ে শরিয়তের নির্দেশনা স্পষ্ট। যেকোনো অবস্থায় শুক্রাণু নির্গত হলে গোসল ফরজ হয়। তবে এমন ঘটনায় মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। তাই এসব বিষয়ে বিশ্বস্ত আলেমদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ইসলামি শরিয়ত আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়, যা আমাদের আধ্যাত্মিক ও শারীরিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে।

 

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক 

৫৮০ সাল: জীবনের শুরুতেই নির্মম বাস্তবতার দিনগুলো

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ০৭:৩০ পিএম
৫৮০ সাল: জীবনের শুরুতেই নির্মম বাস্তবতার দিনগুলো
আরবিতে মুহাম্মদ লেখা ছবি । সংগৃহীত

আরবের রুক্ষ প্রান্তরে, প্রখর সূর্য যখন তার দহনলীলা চালাচ্ছিল, ঠিক তখনই মক্কা নগরীর বুকে এক নিষ্পাপ ফুলের কলি দশম বর্ষে পদার্পণ করে। এই ছোট্ট বালক আর কেউ নন, মক্কার নয়নমণি মুহাম্মদ (সা.)। কৈশোরের এই সোনালি অধ্যায়ে, তাঁর জীবন এমন কিছু স্পর্শকাতর ঘটনার সাক্ষী ছিল, যা ভবিষ্যতের বিশাল দিগন্তের ইঙ্গিত বহন করে।
 
তখনো তিনি মমতাময়ী মায়ের উষ্ণ আলিঙ্গন থেকে বঞ্চিত। শৈশবের শুরুতেই মা আমিনার চিরবিদায় এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল তাঁর ছোট্ট হৃদয়ে। তবে করুণাময় আল্লাহতায়ালার অসীম কৃপায়, তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন পিতৃব্য আবু তালিবের স্নেহময় আশ্রয়। কুরাইশ বংশের এই সম্মানিত ব্যক্তি আর্থিক কষ্টের মাঝেও তাঁর ভাতিজার প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব পরম মমতায় বহন করতেন। চাচার প্রজ্ঞা ও ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ নিঃসন্দেহে তরুণ মুহাম্মদের (সা.) কোমল মনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম)

কৈশোরের দশম বছরে এক বিশেষ ঘটনা ঘটে। চাচা আবু তালিব ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদূর সিরিয়ার পথে যাত্রা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিশোর মুহাম্মদ (সা.) চাচার সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আবদার করলেন। স্নেহপরায়ণ চাচা তাঁর ছোট্ট ভাতিজার ব্যাকুলতা উপেক্ষা করতে পারলেন না এবং তাঁকে সঙ্গী করে নিলেন। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁরা যখন বুসরা নামক স্থানে পৌঁছালেন, তখন বাহিরা নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রি বিশ্বনবিকে দেখেই বিশেষভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। আপ্যায়ন শেষে তিনি নবির সাথে কথা বললেন এবং নিশ্চিত হলেন এই শিশুই হবেন শেষ নবি।

তিনি চাচা আবু তালিবকে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র থেকে মুহাম্মদ (সা.)-কে রক্ষা করার জন্য সতর্ক করলেন এবং দ্রুত মক্কায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বিচক্ষণ চাচা আবু তালিব পাদ্রির কথা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করলেন এবং যাত্রা সংক্ষিপ্ত করে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। এর পর থেকে তিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতেন না। যদিও এই ঘটনার সঠিক সন-তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে।

ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, এই বছর মক্কার ধূসর প্রান্তরে আরও এক নতুন প্রাণের স্পন্দন অনুভূত হয় বেলাল ইবনে রাবাহ (রা.)-এর জন্ম। যিনি পরবর্তী সময়ে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজানের ধ্বনিতে বিশ্বকে মোহিত করেছিলেন। যদিও সেই সময়ে শিশু মুহাম্মদ (সা.) এবং নবজাত বেলালের (রা.) মধ্যে কোনো সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, তবে একই বছরে তাঁদের আগমন যেন একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করে, যেখানে শান্তি ও মুক্তির সুর অনুরণিত হবে।

কৈশোরের সেই দশম বছরে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সমবয়সীদের সাথে সরল আনন্দে দিন কাটাতেন, মক্কার নির্মল প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে নিতেন। তবে অন্যান্য সাধারণ বালকের চেয়ে তাঁর চরিত্রে ছিল এক স্নিগ্ধ ব্যতিক্রম। তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল সত্য-মিথ্যা। সম্ভবত সেই সময়েই তিনি সমাজের নানা অন্যায় ও কুসংস্কারের নীরব দর্শক ছিলেন, যা তাঁর সংবেদনশীল মনে এক চাপা কষ্টের জন্ম দিত।

আমরা এই সময়ের খুব বেশি তথ্য না জানলেও, এতটুকু অনুভব করতে পারি যে ৫৮০ সাল ছিল তাঁর জীবনের শুরুতে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষণ। এত অল্প বয়সে তিনবার মৃত্যুশোক অনুভব করেছিলেন। কিন্তু এই ধারাবাহিক শোক তাঁকে দুর্বল করেনি, বরং গড়ে তুলেছিল এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ হিসেবে যাঁর অন্তর পূর্ণ ছিল দয়া, মমতা, ধৈর্য আর ভালোবাসায়।

এ কারণেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তিনি কি তোমাকে এতিম পাননি, অতঃপর আশ্রয় দেননি?’ (সুরা আদ-দুহা, আয়াত ৬)। এই আয়াত তাঁর সেই এতিম জীবনের করুণ ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সেই সাথে আল্লাহর অসীম রহমতের বার্তাও বহন করে। এই কৈশোরের দশম বর্ষ ছিল সেই শান্ত সকালের মতো, যা ধীরে ধীরে বিশ্বকে আলোকিত করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, এক মহান রাসুলের আগমনী বার্তা নিয়ে।

 

লেখক: আলেম ও সাংবাদিক