মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন কাজকে সহজ করে দিচ্ছে, অপরদিকে এর অপব্যবহার জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। এ জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারে নৈতিকতা ও শুদ্ধাচারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্টারনেট ব্যবহারে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। বিভিন্ন বয়সী শিশু, কিশোর, তরুণ ও বয়স্ক লোকেরা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীদের জীবনে বেশি বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাদের অনেকে পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে ও বাড়ির অন্যান্য কাজে অনীহা দেখিয়ে দিন-রাত শুধুই ইন্টারনেটে ডুবে থাকে। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক-শারীরিক সমস্যাসহ নানাবিধ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রভাব: সতর্ক হওয়া জরুরি’ শীর্ষক সমীক্ষায় তথ্য উঠে এসেছে, দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই অপ্রয়োজনীয় কাজে ইন্টারনেটে বেশি সময় ব্যয় করে। দিনে ১১ ঘণ্টার ওপরে অনলাইনে থাকে ৬ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৮-১০ ঘণ্টার মতো ইন্টারনেট ব্যবহার করে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৫-৭ ঘণ্টা ইন্টারনেটে থাকে ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ২-৪ ঘণ্টার মতো ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপমতে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কথা বলতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে ও সংবাদ পড়তে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু এর ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি অনুসরণ করা হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনেকে অন্যের ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে গুজব রটায়। ভিত্তিহীন ও ভুল তথ্য ছড়ায়। মানহানিকর কাজ করে। অন্যকে আঘাত দিয়ে, হেয়প্রতিপন্ন করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, অসম্মান করে কমেন্ট করে। অশোভন ভাষায় কথা বলে। ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কথা বলে। দেশ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত হয়। ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয় এমন প্রচারণা চালায়। বিশেষ করে একশ্রেণির ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছেন, তারা ফেসবুকে বিভিন্ন ফেক আইডি খুলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। সেখানে নানা ধরনের অপরাধ ছড়ায়। কোনো সংবাদ পেলেই তা যাচাই ছাড়া গ্রহণ করা সমীচীন নয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বসো। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম, হাদিস: ৫)
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তম ভাষা ব্যবহার করা প্রয়োজন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ ও শেষদিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি, হাদিস: ৬০১৮)
একজন মুসলিম কখনো অশ্লীল কাজ করতে পারেন না। অশ্লীলতা ছড়াতেও পারেন না। অশ্লীলতা মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, যা তোমরা জানো না।’ (সুরা নুর, আয়াত: ১৯)
বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়া, অশ্লীল কনটেন্ট দেখা এবং শেয়ার করা অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে। এসব দেখা, ডাউনলোড করা, শেয়ার করা, পৃষ্ঠপোষকতা করা পাপের কাজ। অনেক সময় না বুঝেই এগুলোতে লাইক, শেয়ার করে এসবের নির্মাতাদের উৎসাহ দেওয়া হয়। এসব থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের মানবকল্যাণের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজে আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)। এ নীতি অনুসরণে শুধু ইন্টারনেট নয়, সব ক্ষেত্রে কল্যাণকর কাজে নিজেদের ব্যাপৃত রাখতে হবে। অন্যকেও ভালোর দিকে আহ্বান জানাতে হবে। ভালো কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে।
ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহার সুফল বয়ে আনতে পারে। ইন্টারনেট ব্যবহারেও ভালো কাজে সহযোগিতা করা যায়। দরিদ্র, অসুস্থ, অনগ্রসর, নিপীড়িত মানুষকে সাহায্য করা যায়। কল্যাণধর্মী কাজে উৎসাহ দেওয়া যায়। শেখানো যায়। শেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আচরণের মাধ্যমে ভদ্রজনোচিত কঠোর ভাষায় জনমত গঠন করা যায়। অপরদিকে এর অপব্যবহার নিঃসন্দেহে মানবজীবনের জন্য ক্ষতিসাধন করে। সুতরাং আমাদের সবার ইন্টারনেট ব্যবহারের আদবকেতা মেনে চলা উচিত।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক